জীবন, মনন যন্ত্রবদ্ধ, নেই তার স্বাধীনতা।
মননশীল মানুষ তার পৃথিবী সাজায় এক ভাবে, গতিশীল জীবনের প্রতিকূলতা অনেক সময় তাকে নিয়ে যায় অন্য পথে। অপূর্ণতা তাকে কূড়ে কূড়ে খায়। অস্থির মন বুঝে উঠতে পারে না, কি করবে। সে খুজে ফেরে অবলম্বন, যা তাকে খুজে দেবে আলোময় নতুন জীবন, যেখানে তার স্বপ্নের পৃথিবী।
কিন্তু সমাজের কিছু মনুষ্যত্ব বিকৃত মানুষ রূপী শয়তান, সাধারণ মানুষের এই দুর্বলতাকে পুঁজি করে নিজেদের হীনস্বার্থ উদ্ধারের চেষ্টা চালায়। কখনো সে আমাদের সমাজেরই কোন গন্যমান্য ব্যাক্তিবর্গ, কিংবা কোন ভিনদেশীয় অপশক্তি। সকল কিছুই সংঘটিত হয় মুখোশের আড়ালে, একান্ত অগোচরে। যদি কখনো এদের নিপাত করার জন্য প্রসাশন সচেষ্টও হয়। শয়তান মুখোশধারীরা বেঁচে রয় বহাল তবিয়তে।
মাঝখান থেকে প্রাণ হারায় সেই সব জীবন যুদ্ধে পরাজিত নিরীহ মানুষেরা।
অকল্পনীয় দক্ষতার সাথে পরিচালক তারেক মাসুদ তার “রাণওয়ে” সিনেমায় এই কথা গুলোকে পুংখানু পুংখানু ভাবে তুলে ধরেছেন। ৯০ মিনিটের সিনেমার গল্পটা এরকম...বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের রাণওয়ে কাছাকাছি কোন একটা এলাকায় একচালা ছোট্ট এক ঘরে রুহুল তার পরিবার নিয়ে বসবাস করে। তার বাবা কুয়েতে চাকরি করতে গিয়ে নিরুদ্দেশ এবং মা বিশ্বস্ত ব্যাংক নামক একটি ব্যাংকের ক্ষুদ্র ঋণ সমিতির মাধ্যমে একটা বিদেশি গাভী কিনে, দুধ বিক্রি করে কোন মতে সংসার চালায়। রুহুলের ছোট বোন ফাতেমা গার্মেন্টস শ্রমিক।
সেও সংসারে কিছু সাহায্য করে। হতাশাগ্রস্থ বেকার রুহুল রাণওয়ের আশেপাশে ঘোরাঘুরি করে সময় কাটায় এবং মাঝে মাঝে তার মামার সাইবার ক্যফেতে গিয়ে ইন্টারনেট সেখার চেষ্টা করে। কিন্তু সে বারবার ব্যর্থ হয়, তার মামা তাকে সেখায় ঠিকই, কিন্তু সেখানেও অপুর্ণতা থেকে যায়। কিছুদিন পর সেই সাইবার ক্যফেতে তার সাথে শান্ত মেজাজের কম্পিউটার দক্ষ আরিফের পরিচয় হয় এবং ক্রমশ বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। আরিফ উগ্র ধর্মীয় রাজনীতির মধ্যে জীবনের অর্থ খুজে পেতে রুহুলকে উদ্বুদ্ধ করে।
ভ্রান্ত আদর্শে উজ্জীবিত রুহুল বিভিন্ন ঘাত প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে অবশেষে জীবনের প্রকৃত বাস্তবকে উপলব্ধির করে......
সিনেমাটি আমি প্রথম থেকে শেষ অবধি সম্পুর্ণ ক্লান্তিহীন দৃষ্টিতে দেখেছি, কোথাও এতটুকু ছন্দ পতন হয়নি। আমি চিত্রগ্রাহক মিশুক মুনীরের চিত্রগ্রহন দেখে মুগ্ধ। বিশেষ করে উড়োজাহাজ গুলোর ওঠা নামার দৃশ্য। আমি বারবার অবাক হয়েছি এই ভেবে, আমাদের দেশেও এমন চিত্রগ্রাহক আছেন! প্রত্যেকটি দৃশ্যে অভিনয় শিল্পীদের অভিনয় প্রশংসনীয়। প্রধান অভিনয় শিল্পীরার প্রায় সবাই নতুন, কিন্তু কোথাও তা বোঝার এত টুকু অবকাশ নেই।
গল্পের উপস্থাপন অনবধ্য। নেপথ্য সঙ্গীত হিসেবে বারবার উড়োজাহাজের বজ্রধ্বনী সিনেমাটিকে আরো জীবন্ত করে তুলেছে। কখনো তা কারো কাছে শুধুই অসহনীয় বিকট শব্দ, কখনো আবার কারো কাছে আশার বার্তাবাহক। নিজেকে শুদ্ধ করার লোভে আরিফের স্বর্গতুল্য এই অপূর্ব পৃথিবীকে বিদায় জানানোর দৃশ্যটি অসাধারণ। শেষ দৃশ্যে রুহুলের ফিরে আসার অন্তর্নিহিত উপস্থাপন ছাপিয়ে গেছে সব কিছু।
পুজিবাদী এবং স্বার্থানেষী সমাজকে সঠিক ভাবেই তুলে ধরেছেন সিনেমার পরিচালক এবং চিত্রনাট্যকার তারেক মাসুদ। সিনেমার গল্পটা শুরু থেকে আমার কাছে অনেকটাই অনুমেয় লেগেছে। লাগাটাই স্বাভাবিক, কারণ এই সিনেমার পটভূমি হিসেবে এসেছে ২০০৫-২০০৬ সালের জাতীয় পর্যায়ে সংঘটিত কিছু ঘটনা। যা আমাদের কম বেশি সকলেরই জানা। এই সিনেমা আমাদের দেশের অনান্য পরিচালকের জন্য একটা বিশেষ নির্দেশিকা।
তাদের বোঝা উচিত শুধু ওকে/কাট বলে আর ইচ্ছেমতন ক্যামেরা ঘুরিয়ে চলচ্চিত্র পরিচালক কিংবা চিত্রগ্রাহক হওয়া যায় না। শেখার বাকী আছে এখনো অনেক কিছুই।
সিনেমাটি যখন শেষ হয়, তখন আমার কবি শেখ ফজলল করিমের বিখ্যাত সেই কবিতার কথা মনে পড়ে যায়ঃ
কোথায় স্বর্গ,কোথায় নরক
কে বলে তা বহু দূর?
মানুষেরই মাঝে স্বর্গ-নরক
মানুষেতে সুরাসুর।
রিপুর তাড়নে যখনি মোদের
বিবেক পায় গো লয়।
আত্মগ্লানির নরক অনলে
তখনি পুড়িতে হয়।
প্রীতি ও প্রেমের পুণ্য বাঁধনে
মিলি যবে পরস্পরে,
স্বর্গ আসিয়া দাঁড়ায় তখন
আমাদেরই কুঁড়েঘরে!
আমার মনে হয় এই কবিতাটিই এই "রাণওয়ে” সিনেমার সারাংশ।
সিনেমাটির প্রথম থেকে শেষ দৃশ্য পর্যন্ত যা কিছু দেখানো হয়েছে সব কিছু যথাযথ। কিন্তু শেষ দৃশ্যের পরে আরো কিছু কথা বাকী থেকে যায়। রুহুল যে পথে পা বাড়িয়েছিল, সে পথে যাওয়া যতটা সহজ, ফিরে আসা ততটাই কঠিন। মেনে নিলাম, রুহুল তার বিবেক দংশনে দংশিত হয়ে তার পূর্ব জীবনে সাচ্ছন্দে ফিরে এসেছে।
কিন্তু তার সহকর্মীরা তাকে কি এত সহজে ছেড়ে দেবে?? তাদের সংগঠনের সব খবর রুহুলের জানা। নিজেদের নিরাপত্তার জন্য হলেও তারা রুহুলের ক্ষতি করবে এবং এটাই বাস্তবতা, এমনটাই ঘটে চলেছে দিনের পর দিন। রুহুলদের নতুন জীবন কেমন হবে, তারা কি তাদের এই শুদ্ধ জীবন বহাল রাখতে পারবে, সেটা সত্যিই প্রশ্নবিদ্ধ!
আর একটা কথা না বললেই নয়, ২রা অক্টোবর ২০১০, রবিবার উদ্বোধনী প্রদর্শনীতে সিনেমাটি একবার দেখলেও আমি মনে মনে দেখেছি অসংখ্য বার। বারবার ভেবেছি সবাই এত পুজিবাদী স্বার্থপর কেন?? আমরা কি পারি না এই খোলশ থেকে বেরিয়ে এসে একটি সুখি সুন্দর সমাজ গড়তে। রাজনীতি, ধর্ম, শিল্প, সংষ্কৃতি -এ গুলোতো শান্তি সৃষ্টির লক্ষ্যে, কেন আমরা ঢালকে তলোয়ার হিসেবে ব্যবহার করছি? আমারা কেন আমারা আগামী প্রজন্মের কথা ভাবছি না!!
ধন্যবাদ পরিচালক তারেক মাসুদ, ধন্যবাদ প্রযোজিকা ক্যাথরিন মাসুদ...... অন্তর সত্বাকে আরো একবার উজ্জীবিত করার জন্য।
সম্ভবত পূর্ণদৈর্ঘ্য সিনেমাটি এই মাসেই প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পাবে। আশা করি সবাই দেখবেন। আমি মনে করি দেখা উচিত।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।