সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী বাতিল সংক্রান্ত বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগের দেয়া বিস্তারিত রায়ের খবর ২৯ জুলাইয়ের বিভিন্ন দৈনিকে প্রধান শিরোনাম হিসেবে প্রকাশিত হয়েছে। রায়কে বিভিন্ন পর্যবেক্ষক যুগান্তকারী বলে উল্লেখ করেছেন। কেননা এর মাধ্যমে সেনাবাহিনীর ক্ষমতা দখলের অভিলাষ চিরতরে লোপ পাবে বলে তাদের ধারণা। ওই রায়ের প্রেক্ষিতে সংবিধানে কী থাকবে কী থাকবে না তার বিবরণও পত্রিকাগুলোয় প্রকাশিত হয়েছে। দৈনিক প্রথম আলোতে এ বিষয়ক বিবরণীর এক জায়গায় উল্লেখ করা হয় ‘পঞ্চম সংশোধনীতে ধর্মনিরপেক্ষতা বাদ হয়।
সমাজতন্ত্র শব্দটি রেখে একটি ব্যাখ্যা দেয়া হয়। বলা হয়, সমাজতন্ত্র মানে হবে— অর্থনৈতিক ও সামাজিক সুবিচার। আর নতুন করে এখানে যোগ করা হয়, সর্বশক্তিমান আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস, এখন তা থাকবে না। ’ যেহেতু সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে ‘সর্বশক্তিমান আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস হবে যাবতীয় কার্যাবলীর ভিত্তি’ কথাটি সংযোজিত হয়েছিল; সংশোধনীটি বাতিল হওয়ায় একথাগুলো আর সংবিধানে বহাল থাকবে না। কিন্তু আপিল বিভাগ পঞ্চম সংশোধনীর কিছু বিষয় বহাল রেখেছেন যেমন—চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে রহিত হওয়া বাহাত্তরের সংবিধানের ৪৪ অনুচ্ছেদে মৌলিক অধিকার বলবত্ করার বিধান পুনর্বহাল—একে বলা হয়েছে আইনের শাসন ও জনকল্যাণমুখী।
চতুর্থ সংশোধনীতে রাষ্ট্রপতিকে বিচারকের অপসারণের যে ক্ষমতা দেয়া হয়, তার অবসান ঘটিয়ে পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে আনা জুডিশিয়াল কাউন্সিলের বিধানকে ‘অধিকতর স্বচ্ছ’ বলে প্রশংসাসূচক মন্তব্য করা হয়। পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে হাইকোর্টের সংবিধানের ১০২(১) অনুচ্ছেদে থাকা মৌলিক অধিকারকে ফিরে পাওয়াকেও উপকারী বলে অভিমত ব্যক্ত করা হয় এবং বাকশাল ব্যবস্থা বাতিল সংক্রান্ত সংশোধনীকে প্রয়োজনীয় বলে উল্লেখ করা হয়। কেননা এছাড়া বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের অস্তিত্ব, সংসদীয় নির্বাচন, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ইত্যাদি কার্যকর থাকে না।
অতএব দেখা যাচ্ছে, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, জনগণের মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ সংক্রান্ত পঞ্চম সংশোধনীর ধারাগুলো আপিল বিভাগ বহাল রেখেছেন। এখন প্রশ্ন আসছে, সর্বশক্তিমান আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস সংক্রান্ত সংযোজনীটি রাষ্ট্রের জন্য জনগণের কল্যাণকর, না ক্ষতিকর।
বাহাত্তরের সংবিধান রচনার সময় থেকেই বলা হচ্ছে, ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। ধর্মনিরপেক্ষতা বলতে বোঝানো হয়েছে, প্রত্যেক নাগরিক নিজ নিজ ধর্ম নির্বিঘ্নে পালন করবেন। কেউ এতে হস্তক্ষেপ করবে না এবং ধর্মীয় কারণে কেউ বৈষম্যের শিকার হবে না। মহান আল্লাহ সবার সৃষ্টিকর্তা এবং পালন কর্তা। তিনি মুসলিম-অমুসলিম, ধার্মিক-অধার্মিক—সবারই রিজিকদাতা, রক্ষাকর্তা।
একথা মোটামুটি সব ধর্মের লোকরাই বিশ্বাস করেন বা মেনে চলেন। মুসলমানরা যে মহান সত্তাকে আল্লাহ বলে সম্বোধন করেন, অন্য ধর্মের লোকরা সে একই সত্তাকে ভগবান, ঈশ্বর, গড ইত্যাদি বলে সম্বোধন করেন।
এখন যদি ধর্মনিরপেক্ষতা রক্ষা করার যুক্তি হিসেবে আল্লাহর ওপর আস্থা ও বিশ্বাসের কথা সংবিধান থেকে উঠিয়ে দেয়া হয়, তা হবে সুস্পষ্ট ধর্মহীনতা। কেননা, আল্লাহতে আস্থা ও বিশ্বাস না থাকলে ধর্ম থাকে না। আল্লাহ সব মানুষকে সৃষ্টি করেছেন তাঁর খলিফা বা প্রতিনিধি হিসেবে।
তিনি মানুষের মধ্যে রেখেছেন তার মহান আমানত। মানুষের আত্মা হলো আল্লাহর ‘আমর’ বা ‘আদেশ’।
অতএব আল্লাহর খলিফা হিসেবে, আল্লাহর আমানতদার হিসেবে, আল্লাহর রুহ থেকে সঞ্চারিত বিশেষ সৃষ্টি হিসেবে, মানুষের দায়িত্ব হলো সার্বক্ষণিক আল্লাহর স্মরণে থাকা, আল্লাহর প্রতি আনুগত্য, বিশ্বাস ও আস্থা রাখা। মানুষের সব কাজকর্ম, চিন্তাভাবনা আল্লাহকেন্দ্রিক হওয়া।
এখানে বিষয়টি সুস্পষ্ট করা প্রয়োজন, আল্লাহর প্রতি সত্যিকার আনুগত্য ও বিশ্বাস কখনও মানুষে মানুষে ভেদাভেদ বা হিংসা সৃষ্টি করে না।
কেননা, আল্লাহ হলেন, ‘রব’-স্রষ্টা ও পালনকর্তা। তিনি সবকিছু সৃষ্টি করেছেন এবং এদের লালন-পালনও করছেন। মানুষ তাঁর প্রতিনিধি হিসেবে খোদায়ী গুণাবলী অর্জনের মাধ্যমে অন্য মানুষের প্রতি সহনশীল ও দয়াশীল হবে, মানুষের কল্যাণকামী হবে, সর্বক্ষেত্রে সহযোগিতার হাত সমপ্রসারিত করবে। ধর্মের মূল উদ্দেশ্য মানুষের মধ্যে আল্লাহর প্রতিনিধিত্বের মর্যাদা সংরক্ষণ এবং একে সমুন্নত রেখে আবার তাঁর কাছে প্রত্যাবর্তন। পবিত্র কোরআন ও অন্যান্য ধর্মগ্রন্থে উল্লেখ আছে, শয়তান বা অশুভ শক্তি মানুষকে প্রতিনিয়ত আল্লাহ থেকে দূরে সরানোর চেষ্টা করছে।
সে জন্যই যুগে যুগে নবী-রাসুলগণ প্রেরিত হয়েছেন মানুষকে শয়তানের বেড়াজাল থেকে মুক্ত করার জন্য। ধর্মীয় বিশ্বাস অনুযায়ী শয়তান নানা কৌশলে মানুষকে পথভ্রষ্ট করার অপচেষ্টা চালায়। পবিত্র কোরআনে অনেক জায়গায় মানুষের প্রতি নির্দেশ আছে— ‘তারা যেন আল্লাহর আনুগত্য স্বীকার এবং শয়তানের আনুগত্য থেকে দূরে থাকে। কেননা, শয়তান মানুষের চিরশত্রু। ’
আমার যতদূর মনে পড়ে, আমাদের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বেশ ক’বছর আগে ‘আমার আব্বা’ শীর্ষক একটি প্রবন্ধে লিখেছিলেন- তাঁর পূর্ব পুরুষরা ইরাক থেকে ইসলাম প্রচারের জন্য এদেশে এসেছিলেন।
আমার জানা মতে, সংবিধান সংশোধন কমিটির চেয়ারপার্সন সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী মহান অলী হজরত শাহ আলী বাগদাদীর (র.) বংশধর, যার মাজার ঢাকার মিরপুরে অবস্থিত। তিনিও পবিত্র ইসলাম প্রচার ও সুফী সাধনায় দীক্ষার মাধ্যমে মানুষকে আল্লাহর সঙ্গে সম্পৃক্ত করতেই এদেশে এসেছিলেন।
আমাদের প্রধানমন্ত্রী সংসদে দাঁড়িয়ে বলেছেন, আল্লাহর রহমতেই তাঁর দল তথা জোট তিন-চতুর্থাংশের বেশি আসন পেয়ে সংসদীয় নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছে। অতএব তাঁকে এবং সংবিধান সংশোধন কমিটির চেয়ারপার্সনকে সচেতন থাকতে হবে, যাতে তাঁদের হাত দিয়ে মহান আল্লাহর নাম, আল্লাহর প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস একথাগুলো সংবিধান থেকে বিলুপ্ত হয়ে না যায়। তাহলে তাদের প্রতি পূর্ব পুরুষদের আত্মা অসন্তুষ্ট হবে।
কেননা তারা এদেশে এসেছিলেন মানুষের আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস ও আস্থা স্থাপন করাতে। আল্লাহর নাম মুছে ফেলা মানে আল্লাহর রহমত থেকে বঞ্চিত করা। অতএব দেশের স্বার্থে, জাতির স্বার্থেই সর্বশক্তিমান আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস ও আস্থাসহ বিসমিল্লাাহির রাহমানির রাহিম সংবিধানে সংরক্ষণ করা অত্যাবশ্যকীয়।
সূত্র: সম্পাদকীয়, দৈনিক আমার দেশ, ২৮ নভে
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।