আফগানিস্তান, ইরাকের পর নজর এবার ইরানে
আফগানিস্তান, ইরাকের পর নজর এবার ইরানে। অজুহাত সেই প্রায় একইরকম পারমাণবিক অস্ত্রোৎপাদন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কাল থেকে যে ঠাণ্ডা লড়াইয়ের তীব্রতা বাড়তে থাকে তার প্রেক্ষিতে ইরান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমী জোটের কাছে ক্রমশ গুরুত্ব পেতে শুরু করে প্রধানত দুটো কারণে। প্রথমত, মধ্যপ্রাচ্যে সোভিয়েতকে ঢুকতে দেওয়ার পথ বন্ধ করা, আর দ্বিতীয়ত, মধ্যপ্রাচ্যের তেলের খনিগুলোকে নিজেদের কবজায় আনা।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইরানের সম্পর্কের সূচনা ঘটে ঊনবিংশ শতকের মধ্যভাগ থেকে, কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে পর্যন্ত তা ছিল নামমাত্র।
ইরানকে নিয়ে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে উত্তেজনার সৃষ্টি হয় ব্রিটেনকে কেন্দ্র করে। মার্কিন গুপ্তচর সংস্থা সি আই এ একটি অভ্যুত্থান ঘটিয়ে ১৯৫৩ সালে ইরানীয় প্রধানমন্ত্রী মোহম্মদ মোজাদেককে ক্ষমতা থেকে অপসারিত করে। আসল ঘটনা হলো ইরানীয় শহর আবাদানে অবস্থিত পৃথিবীতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যর সর্ববৃহৎ তৈল সংস্থা অ্যাংলো-ইরানিয়ান অয়েল কোম্পানিকে প্রধানমন্ত্রী মোজাদেক জাতীয়করণের উদ্যোগ নেন। ইরানীয় সাংসদরা এপ্রশ্নে এককাট্টা ছিল। এর প্রতিশোধ হিসাবে ব্রিটেন ইরানীয় তেলের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করলে পৃথিবীর বড় বড় তেল কোম্পানিগুলি তার সমর্থনে দাঁড়ায়।
উভয় দেশের মধ্যে কয়েক মাস সমস্ত আলাপ-আলোচনা বন্ধ হয়ে গেলে স্বভাবতই তার নেতিবাচক প্রভাব পড়ে ইরানীয় অর্থনীতির ওপর। মার্কিন রাষ্ট্রপতি ট্রুম্যান ব্রিটেনকে ইরানের সঙ্গে আলোচনায় নরম মনোভাব নিতে এবং কোনভাবেই ইরানকে আক্রমণ না করার পরামর্শ দেন। এতে মোজাদেক ভেবেছিলেন মার্কিন সমর্থন তাঁর পক্ষে ছিল। ট্রুম্যান সরকারও মোজাদেককে অর্থনৈতিক সাহায্য করে। মোজাদেক কয়েকবার মার্কিন সফরেও যান।
কিন্তু মার্কিন গুপ্তচর সংস্থা সি আই এ ইরানে গোপন কাজকর্ম চালিয়ে যায় ১৯৫২-এর গ্রীষ্মকাল থেকে। উদ্দেশ্য, ব্রিটিশ তেল কোম্পানিকে জাতীয়করণকারী ইরানীয় সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করা। পরবর্তী মার্কিন রাষ্ট্রপতি আইজেনহাওয়ার কঠোর অবস্থান নিয়ে ইরানে রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টির পদক্ষেপ নেন। ব্রিটেন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গোপনে ১৯৫৩ সালে ‘অপারেশন অ্যাজাক্স’ নামে এক ষড়যন্ত্রমূলক কর্মসূচী পরিচালনা করে তেহেরানে মার্কিন দূতাবাস থেকে। যার লক্ষ্য ছিল অভ্যুত্থানের মাধ্যমে মোহম্মদ মোজাদেক সরকারকে উৎখাত করা।
তেলের লোভ
ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল ইরানের তেলের ওপর ব্রিটিশ প্রাধান্য বজায় রাখার বিষয়ে একা ব্রিটেন যথেষ্ট নয় বুঝে মার্কিন সাহায্যের দ্বারস্থ হলেও ওয়াশিংটন আইজেনহাওয়ারের আগে পর্যন্ত ব্রিটেনকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়নি। ব্রিটেন ওয়াশিংটনকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছিল যে, মোহম্মদ মোজাদেক সোভিয়েতপন্থী তুদেহ পার্টিকে ভর করে ইরানকে সোভিয়েত রাজনীতির পরিমণ্ডলের মধ্যে এনে ফেলবেন। যদিও এটা ঘটনা যে মোজাদেক কোনও অর্থে কমিউনিস্ট মনোভাবাপন্ন ছিলেন না এবং সে কথা তিনি প্রকাশ্যে ঘোষণাও করেছেন একাধিকবার। তাই যে কোনও উপায়ে মোজাদেক সরকারের পতন ঘটানোর জন্য সি আই এ-র সহ অধিকর্তা ডালাস দশ লক্ষ মার্কিন ডলার মঞ্জুর করেন। সঙ্গে সঙ্গে তেহেরানে ষড়যন্ত্রের কাজকর্ম শুরু হয়ে যায়।
তবে নিউ ইয়র্ক টাইমস এর বক্তব্য অনুসারে জুন মাসে বেইরুটে ব্রিটিশ ও মার্কিন ইন্টেলিজেন্স বসে ষড়যন্ত্রের চূড়ান্ত রূপ দিলে একদা মার্কিন রাষ্ট্রপতি রুজভেল্টের নাতি কেরমিট রুজভেল্ট তাকে কার্যকর করার জন্য তেহেরানে রওনা দেন।
ইরান সম্রাটকে দিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে খারিজ করার নির্দেশ জারি করানোর জন্য চলে নানা কৌশল। তাঁকে রাজি করাতে না পেরে শেষ পর্যন্ত তাঁর বোন আশরাফকে ঘুষ দিতে হয় দামী পোশাক ও নগদ টাকা। আশরাফকে দিয়ে যাতে সম্রাটকে রাজি করাতে পারেন। শেষ পর্যন্ত শাহ ইঙ্গ-মার্কিন চাপের কাছে নতি স্বীকার করেন এবং দুটি ফরমান জারি করেন।
একটিতে প্রধানমন্ত্রীকে খারিজ এবং অপরটিতে তিনি সি আই এ-র পছন্দের ফাজলোল্লাহ জাহেদীকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ। এই দুটি ফরমান জারি করে তিনি প্রথমে বাগদাদ এবং পরে রোমে চলে যান আত্মগোপনের উদ্দেশ্যে। ১৯শে আগস্ট ১৯৫৩-এর সি আই এ পরিচালিত অভ্যুত্থানের পর শাহ দেশে ফিরলে মোজাদেককে সামরিক আদালতে বিচার করে তিন বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয় এবং বাকি সময়টা তাঁকে যাবজ্জীবন গৃহবন্দী করে রাখা হয়। জাহেদী সরকার বিদেশী তেল সংস্থাগুলির সঙ্গে চুক্তি করে একটি কনসর্টিয়াম গঠন করে। যার উদ্দেশ্য ছিল বিশ্ববাজারে যথেষ্ট পরিমাণে ইরানীয় তেল আসার প্রবাহকে ফিরিয়ে আনা।
যাতে করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ব্রিটেন ইরানীয় তেলের সিংহভাগ পায়। এর বিনিময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিপুল পরিমাণে আর্থিক সাহায্য দেয় ইরানকে, সেনাবাহিনীকে, গোপন পুলিসবাহিনী ‘সাভাক’-কে। গোটা ঘটনার পেছনে যে মার্কিন হাত ছিল তা আইজেনহাওয়ার অস্বীকার করেন। মার্কিন সরকার প্রায় দু’দশক সেই ষড়যন্ত্র চেপে রাখতে সক্ষম হলেও সাতের দশকে তা প্রকাশ্যে এসে পড়ে। ২০০০ সালের মার্চ মাসে খোদ মার্কিন বিদেশ সচিব অ্যালব্রাইট মোজাদেক-এর ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার ঘটনাকে দুঃখজনক বলেন।
এই ঘটনা থেকে ইরানীরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিম ইউরোপের বিরোধী হয়ে পড়ে। আইজেনহাওয়ার-এর সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা এখানে। এই বিদ্বেষ বাড়তে বাড়তে ১৯৭৯ সালের ইরান বিপ্লবের রূপ নেয় যার নেতৃত্বে ছিলেন আয়াতোল্লা খোমেইনি।
ইরান বিপ্লব, ১৯৭৯
মার্কিন রাষ্ট্রপতি জিমি কার্টার ১৯৭৭ সালে প্রাক-নববর্ষের শুভেচ্ছা বার্তায় রাষ্ট্রনেতা হিসাবে শাহকে সর্বাধিক স্বীকৃতি দেন, যদিও ততক্ষণে ইরান বিপ্লবের পথে অনেক দূর এগিয়ে গেছে। ইরানের মাটিতে যে তখন বিপ্লবের বীজ পোঁতার কাজ সম্পূর্ণ তা কুখ্যাত মার্কিন গুপ্তচর সংস্থা সি আই এ-ও টের পায়নি।
ইরান বিপ্লবের সূচনা ঘটে ১৯৭৮ সালের জানুয়ারি মাসে বিশাল শাহ-বিরোধী প্রতিবাদী মিছিলের মধ্য দিয়ে এবং শেষ হয় ১৯৭৯-এর ডিসেম্বর মাসে। নতুন ধর্মাশ্রয়ী সংবিধান প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আয়াতোল্লাহ খোমেইনি দেশের সর্বোচ্চ নেতার পদে বসেন। তার আগে ১১ই ফেব্রুয়ারি ১৯৭৮-এ ইরানে শাহ-অনুগামী সেনাবাহিনী গেরিলা ও প্রতিবাদী সেনাদের কাছে পরাজিত হয়ে নিজেদের নিরপেক্ষ ঘোষণা করে। তার কয়েকদিনের মধ্যেই ইরানে আনুষ্ঠানিকভাবে শাহ মোহম্মদ রেজা পহলবী রাজত্বের অবসান ঘটে। ইরান ১৯৭৯-র ১লা এপ্রিল সরকারীভাবে একটি ইসলামীয় প্রজাতন্ত্রে পরিণত হয়।
এই সংবিধান গণতান্ত্রিক ও জাতীয়বাদী সংবিধান হিসাবে স্বীকৃত হয়।
ইরান বিপ্লবে ক্ষমতাচ্যুত শাহকে ক্যান্সার চিকিৎসার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার জন্য তেহরানে মার্কিন দূতাবাসের কাছে আবেদন করলে তারা তা ফিরিয়ে দেয়। কারণ নতুন সরকারের সঙ্গে তাদের বোঝাপড়ার সম্ভাবনাকে নষ্ট করতে চায়নি। বস্তুত মার্কিনীদের কাছে যা আর কাজে লাগে না তার আর কোনও মূল্য থাকে না, কার্টারের ক্ষেত্রেও তা সত্য। কিন্তু শেষ পর্যন্ত চাপে পড় শাহকে সেই অনুমতি দেওয়া হয়।
বিপ্লবে প্রত্যাখ্যাত এই শাহকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চিকিৎসার সুযোগ দেওয়ায় ক্ষিপ্ত মুসলিম ছাত্ররা ৪নভেম্বর, ১৯৭৯ তেহেরানে অবস্থিত মার্কিন দূতাবাস দখল করে নেয় এবং ঐ দূতবাসের ৬৬জন কর্মীকে পণবন্দী করে, যাদের মধ্যে ৩জন ইরান বিদেশ দপ্তরের কর্মচারী ছিল। ধরা পড়ার আগেই ৬ জন আমেরিকান পালিয়ে যায়। ৬৬ জনের মধ্যে ১৩জনকে ১৯ ও ২০ নভেম্বর, ১৯৭৯-তে ছেড়ে দেওয়া হয় আর একজনকে ১১ই জুলাই ,১৯৮০-তে মুক্তি দেয় ইরান সরকার। বাকি ৫২জনকে ৪৪৪ দিন আটকে রাখে। যারা এই ৫২জন মার্কিন দূতাবাস কর্মীকে পণবন্দী করে তারা আসলে ১৯৫৩ সালে যে মার্কিন চক্রান্ত গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত মোজাদেক সরকারকে অন্যায়ভাবে অপসারিত করে তার প্রতিশোধ নেয়।
পণবন্দীকারীদের একজন তেহেরানে মার্কিন দূতাবাসের প্রধান ব্রুশ লেইনজেনকে বলে : ‘তোমাদের অভিযোগ করার কোনও অধিকার নেই কারণ তোমরা আমাদের গোটা দেশটাকেই ১৯৫৬-তে পণবন্দীতে পরিণত করেছো। ’ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিজের ইজ্জত বাঁচাতে ১৯৮০ সালের ২৪শে এপ্রিল অপারেশন ঈগলক্স নামে এক সামরিক অভিযান চালায় পণবন্দীদের উদ্ধার করার জন্য। কিন্তু তা শুধু ব্যর্থই হয়নি সঙ্গে ৮ জন মার্কিন সেনাকে প্রাণ দিতে হয়। শেষ পর্যন্ত ১৯৮১ সালের ১৯শে জানুয়ারি অ্যালজেরিয়া চুক্তি স্বাক্ষরিত হলে ২০শে জানুয়ারি বন্দীদের মুক্তি দেওয়া হয়।
খোমেইনি ক্ষমতায় আসার পর পুঁজিবাদী ব্যবস্থার পরিবর্তন করার লক্ষ্যে বেশ কিছু কলকারখানার জাতীয়করণ করা হয়।
পাশ্চাত্য সংস্কৃতির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। শরিয়তী আইন প্রবর্তন করা হয় এবং বিদ্যালয়গুলিতে মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করা হয়। যারা মার্কিন বিরোধী আন্দোলনে সঙ্গী ছিল, কিন্তু পরে ধর্ম-ভিত্তিক রাষ্ট্রের বিরোধিতা করে সেইসব কমিউনিস্ট ও ধর্মনিরপেক্ষদের অত্যন্ত কঠোরভাবে দমন করা হয় খোমেইনি শাসিত ইরানে। সাম্রাজ্যবাদ ও পুঁজিবাদ উভয়কে বাদ দিয়ে ইসলামি প্রজাতন্ত্রের পথে খোমেইনি ইরানকে চালিত করেন। একই সঙ্গে অতি রক্ষণশীল ইসলামপন্থীদেরও ক্ষমতার বাইরে রাখেন।
ইরান বিপ্লবের কারণ
ইরানের শাহ-র অতিরিক্ত মার্কিন ঘেঁষা নীতি যা ইরানের মুসলিম সংস্কৃতিকে তুচ্ছ করে পশ্চিমী জীবনধারাকে প্রবর্তন করছিল। এর বিরুদ্ধে শিয়া সম্প্রদায়ের প্রতিবাদকে গ্রাহ্য করা হয়নি শাহ-র জামানায়।
১৯৭৬ সালে ইসলামি ক্যালেন্ডারকে বাতিল করে সাইরাস-এর জন্মদিনের ভিত্তিতে নতুন ক্যালেন্ডার প্রবর্তন করা হয় যা মক্কা-মদিনা থেকে অনুমোদন পাওয়ার আগেই নতুন দিনপঞ্জী চালু হওয়ার বছরের হিসাব পালটে রাতারাতি ১৩৫৫ থেকে ২৫৩৫ হয়ে যায়। অমিতব্যয়িতা, চূড়ান্ত দুর্নীতি ক্রমশই জনমনে শাহ-বিরোধিতা বাড়িয়ে তোলে। শাহ ইরানে কমিউনিস্ট ও অন্যান্য বামশক্তিকে মোকাবিলায় যখন ব্যস্ত তখন অন্যান্য জনপ্রিয় ধর্মীয় দলগুলি শাহ বিরোধী প্রচার ও সংগঠন চালিয়ে গেছে।
১৯০৬ সালের সংবিধানকে উপেক্ষা করে স্বৈরতান্ত্রিক পথে দেশ শাসন, সাভাক নামে গুপ্ত পুলিস বাহিনীর মাধ্যমে গণতন্ত্রকে স্তব্ধ করার প্রচেষ্টা মানুষের মধ্যে শাহ বিরোধিতা গড়ে তোলে।
দেশে একদলীয় ব্যবস্থা (রাস্তাকীজ দল) কায়েম তার সদস্যপদ ও চাঁদা সকলের জন্য বাধ্যতামূলক করা এবং মানুষের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় বিষয়ে হস্তক্ষেপ করা মানুষকে শাহ বিরোধী করে তোলে।
সরকার পরিচালনায় উদাসীনতা ও সেই সঙ্গে ক্যান্সারে আক্রান্ত শাহ আত্মবিশ্বাসহীন রাষ্ট্রনেতায় পরিণত হলে বিপ্লবের গতি আরও ত্বরান্তিত হয়। খোমেইনি-র ‘ইরান বিপ্লবের সামগ্রিক প্রাধান্য’ তত্ত্ব বুঝতে শাহ ব্যর্থ হন।
ইরান বিপ্লবের নেতৃত্ব এক আধুনিক, উদার ও সর্বগ্রহণযোগ্য ইসলাম ধর্ম প্রচার করেন যা শিক্ষিত মধ্যবিত্ত মানুষের কাছে সবিশেষ গ্রহণযোগ্য হয়।
এমনকি ইসলাম বহির্ভূত মানুষের কাছেও তার একটা আবেদন ছিল। আধুনিক মুসলিম, উদারপন্থী, বামপন্থী ও ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীরা শাহ বিরোধী আন্দোলন ও পরে বিপ্লবে শামিল হন। এই সময়ে খোমেইনি তাঁর ধর্মীয় অভিভাবকত্বের তত্ত্ব লুকিয়ে রেখে নিজেকে একজন আধুনিক মুসলমান হিসাবে তুলে ধরেন।
এইসব বিভিন্ন কারণের ভিত্তিতে ইরানে যে বিপ্লব হয় তা ভিয়েতনাম যুদ্ধের পর মার্কিনীদের কাছে সবচেয়ে বড় পরাজয়। ইরান বিপ্লব শাহকে ক্ষমতাচ্যুত করায় মধ্য-প্রাচ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার এক বিশ্বস্ত মিত্রকে হারায়।
ইরান-মার্কিন ঠাণ্ডা লড়াই ?
সি আই এ এবং পূর্বতন জাতীয় নিরাপত্তা পর্ষদের পদাধিকারী ব্রুশ রিডেল খুব দামী কথা বলেন : ‘পূর্ব বা পশ্চিম কোনও বাফার না থাকায় স্বাভাবিকভাবেই তেহরানের প্রভাব বৃদ্ধি পায়; এর কারণ যতটা না ইরানের কোনও বুদ্ধিদীপ্ত কৌশলের জন্য তার থেকে বেশি আমেরিকানদের ভুলের জন্য। ’ আমেরিকা যে বিষয়ে চিন্তিত তা হলো ইরান-মধ্যপ্রাচ্য ক্রমশই তার প্রভাব বাড়িয়ে চলেছে। এই মুহূর্তে তা খুব উল্লেখযোগ্য না হলেও ভবিষ্যতে তা বড় রূপ নিয়ে মধ্যপ্রাচ্য মার্কিন স্বার্থের পক্ষে ক্ষতিকর হতে পারে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইরানের সমুদ্র উপকূলের বাইরে যুদ্ধ জাহাজ নিয়োগ করে। রাষ্ট্রসঙ্ঘ ইরানীয় অর্থনৈতিক সংগঠনগুলির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে।
ইরানে গণতন্ত্র গড়ে তোলার লক্ষ্যে ২০০৭ সালে ৭৫ মিলিয়ন ও ২০০৮ সালে ১০৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বরাদ্দ করে। এছাড়া মার্কিনীরা গোপন কার্যকলাপ শুরু করে দেয়, যা তাদের কূটনীতির চিরন্তন বৈশিষ্ট্য।
পারমাণবিক শক্তির পথে ইরান?
পারমাণবিক বিষয় নিয়ে ইরান সম্পর্কে পশ্চিমী প্রচার এমনভাবে করা হচ্ছে যেন এর আগে ইরান পরমাণু বিষয়টি কি তা জানতই না। ঘটনা হলো এই যে গত শতকের ৫-এর দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ‘শান্তির জন্য পরমাণু’ কর্মসূচীর মাধ্যমে ইরানকে পারমাণবিক কার্যকলাপের সঙ্গে যুক্ত করে। ১৯৭৯ সালের ইরান বিপ্লবের পর ইরানের পারমাণবিক পরীক্ষার ক্ষেত্রে মার্কিন সাহায্য বন্ধ হয়।
তাছাড়া ১৯৭৯-এর বিপ্লবের পরে ইরান প্রথমদিকে নিজেই পারমাণবিক গবেষণার কাজ বন্ধ করে দিলেও অল্পদিনের মধ্যেই তা আবার শুরু করে তবে পশ্চিমী জোটের থেকে কম সাহায্য নিয়ে। ইরান তার পারমাণবিক কর্মসূচীর মধ্যে বেশ কতগুলি গবেষণা কেন্দ্র, দুটি ইউরেনিয়াম খনি, ইউরেনিয়াম প্রক্রিয়াকরণের জন্য ৩টি ইউরেনিয়াম এনক্রোচমেন্ট প্ল্যান্ট অন্তর্ভুক্ত করে।
তবে বর্তমানে ইরানে পারমাণবিক কাজকর্মের দায়িত্বে আছেন দেশের সর্বোচ্চ পদাধিকারীরা যেমন, দেশের রাষ্ট্রপতি, সেনাধ্যক্ষ, প্রতিরক্ষা শিল্পের প্রধান এবং ইরানের পারমাণবিক শক্তি সংগঠনের প্রধান! সমস্ত রকমের মার্কিন চাপ থাকা সত্ত্বেও রাসায়নিক, জৈবিক ও আনবিক গণ-বিধ্বংসী অস্ত্র নির্মাণের কাজ চালিয়ে যায়। আইনানুগতভাবে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র গড়ে তোলার পাশাপাশি ইরান যে গোপনে পরমাণু অস্ত্র বানাচ্ছে এমন কথাও বিশ্বাস হিসাবে পশ্চিমী জগৎ থেকে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। এই মার্কিন গুপ্তচর সংস্থা সি আই এ আফগানিস্তান সম্পর্কে প্রতিবেদনে বলে যে তারা গোপনে গণ-বিধ্বংসী অস্ত্র গড়ে তুলছে।
সাদ্দামকে মেরে ফেলার পর বুশ বলেন যে ইরাকে মার্কিন গোয়েন্দাদের ভুল হয়েছিল কারণ সেরকম কোনও অস্ত্রই পাওয়া যায়নি। মৃত সাদ্দামের জীবন কি ফিরিয়ে দিতে পারবে আমেরিকা তার ভুল শোধরাতে? শুনতে খারাপ লাগলেও বলি যে রাষ্ট্রপতি মেয়াদের শেষ পর্যায়ে জর্জ বুশ যে পুষ্পবৃষ্টির আশায় ইরাকে গিয়েছিলেন এবং সেখানে সেই সাংবাদিক তাঁর দিকে যে জুতো ছুঁড়েছিলেন তা শুধু বুশ নয় পেন্টাগন ও হোয়াইট হাউসের অধিকাংশ বাসিন্দাদের প্রাপ্য। তবুও ঈশ্বর এতটুকু লজ্জা দেননি মার্কিন রাষ্ট্রনেতাদের। তাই নির্লজ্জ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ঐ একই অজুহাতে আফগানিস্তানের পর এবার ইরানের দিকে হাত বাড়াচ্ছে। আগেই বলা হয়েছে মার্কিন সামরিক বাজেটের মাত্র ১ শতাংশ ইরান তার সামরিক ক্ষেত্রে বরাদ্দ করে।
যদিও ইরান সবসময়েই বলেছে যে গঠনমূলক কাজে তারা পারমাণবিক শক্তিকে ব্যবহার করতে চায়, তবুও মার্কিনীদের ভয় যে তারা শান্তির কর্মসূচীর আড়ালে আসলে পারমাণবিক যুদ্ধাস্ত্র তৈরি করছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার দোসর দেশগুলি একই সুরে বলে চলেছে যে ইরান গোপনে পারমাণবিক বোমা বানাতে চলেছে শীঘ্রই, যদিও ইরান বারবার বলছে যে তারা অসামরিক এবং বিশেষত চিকিৎসার উদ্দেশ্যে পরমাণু শক্তি অর্জন করার চেষ্টা চালাচ্ছে। ক্যান্সার রোগীদের ক্ষেত্রে কি ভাবে এই শক্তিকে ব্যবহার করা যায় ইরান তার চেষ্টা করছে বলে সরকারীভাবে বলা হয়েছে। ইউরোপীয়ান ইউনিয়নের পক্ষে ক্যাথারিন অ্যাশটন মনে করেন যে পারমাণবিক শক্তিকে ক্যান্সার চিকিৎসায় ব্যবহার করার মতো দক্ষতা নেই ইরানের। যদি আমরা ধরেও নিই যে ইরানের সরকারী ঘোষণার মধ্যে কূটনৈতিক লুকোচুপি রয়েছে তাহলেও মার্কিনীদের ইরানী পারমাণবিক শক্তিকে ভয় পাওয়ার কোনও যুক্তিসঙ্গত কারণ আছে কি, যাদের পরমাণু অস্ত্রের সম্ভার এমনকি উত্তর-ঠাণ্ডা লড়াইয়ের যুগেও সর্বাধিক? এই অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা মার্কিনীদের সেই অশুভ কূটনৈতিক ইঙ্গিতবাহী যার উদ্দেশ্য হলো ইরান আক্রমণের প্রেক্ষাপট তৈরি করা।
মনে রাখা দরকার যে ইরানকে কবজা করতে পারলে ইরাক, ইরান, আফগানিস্তান মার্কিন প্রভাবাধীন হলে ভবিষ্যতে চীন এবং রাশিয়ার পক্ষে মধ্যপ্রাচীয় রাজনীতিতে পশ্চিমী জোটের সঙ্গে অসম অবস্থান মেনে নিতে হবে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।