আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

‘প্রেমে ব্যর্থতা, হতাশা থেকে জঙ্গিবাদে’

“আমি বিরাট ভুল করেছি, দয়া করে আমাকে ক্ষমা করে দিন। আমার বাবা আমার কারণে চাকরি হারিয়েছেন। একমাত্র বোনের বিয়ে হয়ে গেছে, আমি ছাড়া আমার বাবা-মাকে দেখার এখন আর কেউ নেই। আমি তাদের পাশে থাকতে চাই। ”
“আমি আপনার মাধ্যমে সবার কাছে ক্ষমা চাইছি।

দয়া করে সাজা দেয়ার আগে আমাকে একটু করুনা করুন। আমার বেঁচে থাকার আশাটি জাগিয়ে রাখুন। আমাকে ক্ষমা করে দিন, প্লিজ। ”   
কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের বিচারকের মন যে গলেনি, তা স্পষ্ট হল এই বাংলাদেশি যুবকের বিরুদ্ধে ৩০ বছর কারাদণ্ডাদেশের রায় ঘোষণার মাধ্যমে।
উচ্চ শিক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়া ২২ বছরের নাফিসকে সন্ত্রাসী হামলা চালিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ উড়িয়ে দেয়ার চেষ্টার দায়ে এখন ৩০ বছর ওই দেশেরই কারাগারে থাকতে হবে।


শুক্রবার দেয়া এই রায়ের একদিন আগে নিউ ইয়র্কের ডেইলি নিউজ বিচারক ক্যারল আমনকে গত ৩১ জুলাই পাঠানো নাফিসের একটি চিঠির অনুলিপি প্রকাশ করে, যাতে এই যুবক সব দায় মাথায় নিয়ে অনুকম্পা চেয়েছেন।
নাফিসকে গ্রেপ্তার করা হয় গত বছরের ১৭ অক্টোবর। নিউ ইয়র্ক পুলিশ ও এফবিআই তখন জানায়,  কথিত ‘স্টিং অপারেশনের’ মাধ্যমে নাফিসকে গ্রেপ্তার করেছে তারা।
নাফিসের বাবা ঢাকার যাত্রাবাড়ীর বাসিন্দা কাজী মো. আহসান উল্লাহ তখন বলেছিলেন, তার ছেলেকে ফাঁদে ফেলা হয়েছে।
‘স্টিং অপারেশন’ নিয়ে সমালোচনা রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রেও, যে প্রক্রিয়ায় গোয়েন্দা কর্মকর্তারা সন্দেহভাজনদের টোপ দিয়ে অপরাধে ‘প্ররোচিত’ করেন এবং তারপর আটক করেন।


নাফিসের বিরুদ্ধে অভিযোগে বলা হয়, এই বাংলাদেশি যুবক এক হাজার পাউন্ড বিস্ফোরক দিয়ে ফেডারেল রিজার্ভ ভবন উড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু তার ভ্যানে ‘সত্যিকারের বিস্ফোরক’ না থাকায় সেটি আর ফাটেনি।
বিচারককে লেখা চিঠিতে নাফিস বলেন, তিনি একটি ‘বিরাট ভুল’ করেছিলেন এবং ওই সময় মানসিকভাবে বিপর্যন্ত ছিলেন ।
নাফিস দাবি করেন, ছোটবেলার তোতলামির সমস্যা, লেখাপড়ায় ভাল করতে না পারা, ভাগ্যান্বেষণে যুক্তরাষ্ট্রে গিয়েও সফল হতে না পারা এবং প্রেমিকার বিশ্বাসভঙ্গের হতাশাই তাকে জঙ্গিবাদের পথে ঠেলে দিয়েছিল।
নিজে কখনো ইসলামী জঙ্গিবাদে বিশ্বাস করেননি বলেও দাবি করেন নাফিস।

 
নাফিসের পরিবারের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, তিনি আইডিয়াল স্কুল ও কলেজ এবং ঢাকা কলেজে পড়াশোনার পর নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন।
২০১২ সালের জানুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান বা-মার একমাত্র ছেলে নাফিস। মিসৌরি স্টেট ইউনিভার্সিটিতে সাইবার নিরাপত্তা নিয়ে পড়াশোনা করতে যান তিনি।
কিন্তু ওই কোর্স শেষ না করেই জুনের শেষ সপ্তাহে নিউ ইয়র্কে একটি টেকনিক্যাল কলেজে ভর্তি হন নাফিস।  এই কলেজে পড়াশোনা করা অবস্থায়ই গ্রেপ্তার হন তিনি।


নাফিস বিচারককে লেখা চিঠিতে নিজের বিশ্বাস, তার যুক্তরাষ্ট্রে আসা, এখানে থাকা নিয়ে সমস্যা, একাকীত্ব, স্বদেশে প্রেমিকার বিশ্বাসভঙ্গ- সব বিষয়ে খোলামেলাভাবে তুলে ধরেন।
“জঙ্গিবাদে আমি কখনোই অনুরক্ত ছিলাম না। আমি একে ঘৃণা করি হৃদয়ের অন্তস্থল থেকে। এটা ইসলামই নয়। ”
কখনোই বন্ধু তৈরি করতে না পারার হতাশাও ফুটে ওঠে নাফিসের চিঠিতে।


“আমার কোনো বন্ধু ছিল না। বাবা-মার সঙ্গে সম্পর্কও সহজ ছিল না। আমি ছিলাম নিঃসঙ্গ। এই পর্যন্ত জীবনে আমি কিছু একটা হওয়ার চেষ্টা করেছি, কিন্তু ডুবেছি হতাশায়। ”
নিজের প্রতি আস্থা ফেরাতেই যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়া বলে জানান এই যুবক।

ভাবছিলেন, অর্থ উপার্জন করে পরিবারকে যেমন সহায়তা করবেন, তেমনি নিজের পড়াশোনাও চালিয়ে যাবেন।
“কিন্তু এই চেষ্টাও সফল হয়নি। উপরন্তু বাড়ি থেকেই আমাকে অর্থ নিয়ে চলতে হত। ”
মিসৌরির বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে নিউ ইয়র্কে চলে আসেন নাফিস একটি কাজের আশায়, উঠতে চেয়েছিলেন আলবেনিতে এক চাচার বাড়িতে। কিন্তু চাচির অসম্মতিতে তা হয়নি বলে জানান এই যুবক।


এরপর তিনি আশ্রয় নেন জ্যামাইকার কুইন্সে দূর সম্পর্কের আত্মীয় সোনিয়ার বাড়িতে। কিন্তু একদিন ‘ছোট’ একটি ঘটনার জন্য সোনিয়ার বাবার ‘তীব্র’ তিরস্কার শুনতে হয় তাকে।
“তারপর সোনিয়ার বাড়িতে থাকা আমার জন্য অসম্ভব হয়ে দাঁড়াল,” বলেন নাফিস।
এই সময় নাফিস খবর পান, স্বদেশে থাকা যে তরুণীকে নিয়ে ভবিষ্যতের ছক আঁকছিলেন তিনি, সেও প্রতারণা করছে।
“আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল।

মনে হল, এই পৃথিবীতে আমার আর কোনো প্রয়োজন নেই। আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলাম, কিন্তু ধর্ম এতে সমর্থন দেয় না বলে তা-ও করতে পারিনি। ”
এরপর ‘হতাশ-বিপর্যস্ত’ নাফিস ভাবেন, ‘জিহাদে’ নিজেকে উৎসর্গ করবেন তিনি।
“খেপাটে পরিকল্পনা নিয়ে আমি তখন ছদ্মবেশী ওই এজেন্টদের সঙ্গে যোগাযোগ করি, বলি আমার পরিকল্পনার কথা। ”
নাফিস গত ৭ ফেব্রুয়ারি আদালতে দোষ স্বীকার করলে তখনি বিচারক তার ৩০ বছর শাস্তির আভাস দিয়েছিলেন।

সব শুনেও এই যুবক বলেছিলেন, তিনি বুঝেই দোষ স্বীকার করছেন।
বন্দি হওয়ার পর আত্মপীড়নের জর্জরিত হওয়ার কথাও বিচারকের কাছে তুলে ধরেন নাফিস।
“এখানে আমি সম্পূর্ণ কুরআন পড়েছি, যা আগে পড়া হয়নি কখনো। নিজের কাজের ন্যূনতম সমর্থনও এতে পেলাম না। ”
বন্দিশিবিরে এসে যুক্তরাষ্ট্র এবং এর বাসিন্দাদের সম্পর্কে অনেক ধারণাই পাল্টে গেছে বলে জানান নাফিস।

নিজের আগের সুখকর ঘটনাগুলোও যে সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয়েছেন, তাও বুঝতে পারেন এখানে।
যুক্তরাষ্ট্র সরকার নাফিসের আইনজীবী হিসেবে যাকে দিয়েছিল, সেই হেইডি সেজারেরও উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করা হয় চিঠিতে।
নাফিস আরো বলেন, “বন্দিশালায় আমি নিজের ধর্মীয় আচার পালন করতে পেরেছি। এখানে এসে আমি ধর্মকে আরো ভালোভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছি। ”
নিজের সব দোষ স্বীকার করে নাফিস সান্ত্বনা খুঁজছেন এই বলে যে, তার পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়েছিল; ফলে কোনো জীবননাশের কারণ তিনি হননি।


“আমি খুব ভাগ্যবান যে পরিকল্পনা বাস্তবায়নের আগেই এজেন্টরা আমাকে ধরে ফেলে। আর এর মধ্য দিয়ে জীবনের নতুন অর্থ খুঁজে নেয়ার সুযোগ পেয়েছি আমি। ”

সোর্স: http://bangla.bdnews24.com     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.