আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

গল্প: লাল পাহাড়ের রাজা

বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, পুন্য হউক, পুন্য হউক, পুন্য হউক, হে ভগবান। বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ, পুর্ন হউক, পূর্ন হউক, পূর্ন হ্‌উক, হে ভগবান। রবীন্দ্রনাথ

পুন্ড্রনগরের সুদর্শন যুবক ব্রাত্য। দিন কতক হইল সে সমতট রাজ্যের রাজধানী দেবপর্বত নগরে ঘুরিয়া বেড়াইতেছে। পুন্ড্রনগর সমতল বলিয়াই দেবপর্বত নগরের মনোরম পার্বত্য পরিবেশ তাহার মনে ব্যাপক বিস্ময় সৃষ্টি করিতেছে।

লাল মাটির আঁকাবাঁকা পাহাড়িয়া পথ, সেই সর্পিল পথের দুই পার্শ্বে শালের গভীর বন; বৌদ্ধ সঙ্ঘারাম, দলছুট কিংবা দলবদ্ধ ভিক্ষু কিংবা ভিক্ষুণি, নির্জন সড়কপথে মন্থর লয়ে চলিয়া যাওয়া একটি কি দুইটি গম্ভীর হাতি-এই সমস্তই তাহার বিস্ময়ের উদ্রেক করিয়াছে। দেবপর্বত নগরের উপান্তে লালম্বি বন অবস্থিত। সেই বনে স্বামী দেবখড়গ কর্তৃক নির্মিত একটি মার্গ-পদস্তম্ভ খুবই চিত্তাকর্ষক। ইহা ছাড়া শালবনবিহার, বড় ধর্মপুর, চান্দিমুরা প্রভৃতি নির্জন স্থান সমূহ ঘুরিয়া দেখিতে তাহার ভালো লাগিয়াছে। সময়টি শীতের প্রারম্ভ বলিয়াই নম্র রৌদ্রে ঘুরিয়া বেড়াইতে আমোদ বোধ করিতেছে ব্রাত্য।

দেবপবর্ত নগরটি চন্ডীমুড়া নামক একটি শৃঙ্গের উপরে অবস্থিত। চন্ডীমুড়া শৃঙ্গের নীচে বহমান ক্ষীরোদা নদী। তাহার পাটলরঙা জল কার্তিক দিবসের রৌদ্রে ঝিকমিক করে। নদীর তীরে নৌকার বহর এবং হাতির জলক্রীড়ার দৃশ্য দেখিয়া মুগ্ধ হইয়া যায় ব্রাত্য। পুন্ড্রনগরের বিশিষ্ট বংশের সন্তান ব্রাত্য।

শঙ্খ শিল্প তাহাদের পারিবারিক ব্যবসা । পারিবারিক ভাবেই তাহার বিবাহের উপক্রম হওয়ায় গোপনে নৌকাযোগে পূর্বদিকের মেঘনাপাড়ে পালাইয়া আসিয়াছে। ব্রাত্য পুন্ড্রনগর হইতে নিরুদ্দেশ হইয়া গেলেও পুন্ড্রনগরের প্রবীণ জ্যোতিষ চন্দ্রনাথ অবশ্য ব্রাত্যর উৎকন্ঠিত পিতা গৌড়কে এই বলিয়া আশ্বস্ত করিয়াছে যে- ব্রাত্যর কোষ্ঠীতে বিবাহযোগ সুনিশ্চিত । যাই হোক। আবাল্য পার্বত্য সমতট রাজ্যের কথা শুনিয়া আসিয়াছে ব্রাত্য।

স্বচক্ষে দেখিবে বলিয়া পণ করিয়াছিল। তাহার স্বপ্ন পূরণ হইয়াছে। এক্ষণে সমুদ্র দেখিবে বলিয়া সমতট হইতে হরিকেল রাজ্যে যাওয়ার ইচ্ছা ব্রাত্যর। তাহার সেই বাসনা অবশ্য এই যাত্রায় পূরণ হয় নাই। কিছুকাল হইল সমতট রাজ্যের রাজা ভবদেব বড় দুশ্চিন্তার মধ্যে কালাতিপাত করিতেছেন।

তাহার কারণ আছে। রাজার জ্যেষ্ঠ ভাই রামদেব উত্তরাধিকারসূত্রে সমতট রাজ্যের সিংহাসনে আরোহন করিয়াছিলেন বটে কিন্তু তাহার অকাল মৃত্যু হইলে ভবদেব সিংহাসনে বসেন। প্রয়াত রাজা রামদেব-এর বন্ধ্যা স্ত্রী রানী বসুমতীর একটি পালক পুত্র ছিল; তাহার নাম কৈলাণ। রাজা ভবদেব সৎ বলিয়াই রানী বসুমতীর কাছে শপথ করিয়াছিলেন- কৈলাণ প্রাপ্তবয়স্ক হইলেই রাজা ভবদেব কৈলাণের নিকট রাজক্ষমতা ফিরাইয়া দিবেন। কৈলাণ প্রাপ্তবয়স্ক হইয়াছে।

রাজা কৈলাণের নিকট সিংহাসন হস্তান্তরের কথা ভাবিতেছেন-গোল বাঁধিল অন্যত্র। মণিমালা নামে রাজা ভবদেব একটি কন্যা রহিয়াছে। সে কন্যা পরমা সুন্দরী। কৈলাণ তাহাকে বিবাহ করিতে ইচ্ছুক, মণিমালা বিবাহে সম্মত নয়। এই লইয়া রাজপরিবারে চাপা অষোন্তষ চলিতেছে।

প্রাসাদে চাপা গুঞ্জন ... দিন কয়েক হইল মণিমালা রাজপ্রাসাদ হইতে নিরুদিষ্ট হইয়া গিয়াছে। তাহাকে কোথাও খুঁজিয়া পাওয়া যাইতেছে না। রাজার নির্দেশে গুপ্তচরগন সর্বত্র অর্ন্তজাল বিস্তার করিয়াছে। তবে তাহাদের উপর রাজার কড়া নির্দেশ: রাজকন্যা মণিমালাকে যেন অতর্কিতে বন্দি করা না হয়। রাজা কন্যাকে আপন প্রাণের অধিক ভালোবাসেন।

রাজা তাহাকে দুঃখ দিতে পারেন না। মণিমালা অত্যন্ত অভিমানী। গোপনে মণিমালাকে অনুসরণ করিয়া রাজা কন্যার অভিপ্রায় বুঝিতে লইতে চান। বস্তুত, দেবপর্বত নগরটি শালের নিবিড় বনে আচ্ছাদিত। মানুষের পদচারণায় শালবন হইতে হিঃস্র শ্বাপদ অপসারিত হইলেও সারাক্ষণ পাখির কূজনে শালবন মূখরিত হইয়া থাকে।

কাকসহ অন্যান্য পাখি থাকিলেও শালবনে টিয়া ও ময়নার আধিক্যই যেন বেশি। সে যাই হোক। ছায়াঘন নিবিড় শালবনের অভ্যন্তর ভাগে একটি পরিচ্ছন্ন কুটির লক্ষ করা যায়। কুটিরটি ব্যাধ শৌনিক-এর; রাজপ্রাসাদ হইতে দাসীর ছদ্মবেশে পলাইয়া আসিয়া রাজকন্যা মনিমালা ব্যাধ শৌনিক-এর কুটিরে আশ্রয় নিয়াছে । শৌনিক রাজকন্যার অপরিচিত নয়।

বালিকাবেলায় ক্ষিরোদ নদীর তীরে পার্বণীর মেলায় পাখি কিনিবার সময় প্রথম ব্যাধের সঙ্গে দেখা। তাহার পর হইতে মাঝেমাঝেই শৌনিক পাখি বিক্রয় করিতে রাজপ্রাসাদে যাইত। বালিকারা বড্ড কৌতূহলী হয়; রাজকন্যাও ‘ব্যাধ, তুমি কোথায় থাকো গো’-প্রভৃতি প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিয়া করিয়া ব্যাধের হাঁড়ির খবর লইয়াছিল। শৌনিক ঠিক প্রথাগত ব্যাধ নয়। বস্তুত সে পাখি শিকারী।

শালবনে টিয়া ও ময়না ধরিয়া দেবপর্বত নগরের বিবিধ হাটে বিক্রয় করিয়া থাকে। ময়না ও মতি নামে তাহার দুইটি সন্তান আছে। ময়না দ্বাদশ বর্ষীয়া বালিকা। শ্যামবর্ণের মিষ্টি নম্র দেখিতে। মতি এইবার নয় বৎসরে পড়িল।

রাজকন্যা মণিমালা ময়নামতীর সহিত বসিয়া গল্প করে, শালবনে ঘুরিয়া বেড়ায়; সুতরাং ময়নামতীর সহিত রাজকন্যার গভীর সখ্য গড়িয়া উঠিল। শৌনিক এর স্ত্রী জয়া পরম গুণবতী এক নারী । রন্ধনকার্যে অতিশয় পারদর্শী জয়া। ছদ্মবেশী রাজকন্যাকে নানা পদ রান্না করিয়া খাওয়াইয়া তৃপ্ত বোধ করিতেছে সে। রাজকন্যাও জয়ার নিকট হইতে বিবিধ রান্না শিখিয়া লইতেছে।

পর্ণকুটিরের মাটির আসনে বসিয়া শাকান্ন খাইতে ভালো লাগিতেছে রাজকন্যার, রাজপ্রাসাদের ন্যায় ব্যাধের পর্ণকুটিরে সপ্তব্যঞ্জনের অত্যাচার নাই। রাজকন্যার পরনে ব্যাধকন্যার ছিন্ন পোশাক। কে তাহাকে চিনিবে। চিরকাল এই নিবিড় শালবনে থাকিয়া যাইবে। পাষানে নির্মিত কক্ষে কে বন্দি থাকিতে চায়।

এই নিবিড় অরণ্যজীবন কি সুন্দর। কি নির্জন। রাজপ্রাসাদের কোলাহল নাই, বৌদ্ধমঠের প্রগাঢ় নির্জনতা রহিয়াছে। শৌনিক পরিবারের একটি পোষা হাতি আছে। ময়নামতী সে হাতির নাম আদর করিয়া রাখিয়াছে ‘লালমাই’।

সপ্তাহে একবার ক্ষিরোদা নদীতে লইয়া গিয়া দলাইমলাই করে। মণিমালা ময়নমতীকে লইয়া হাতির পিঠে চড়িয়া বসিয়া দিনমানে নিবিড় শাল অরণ্যে বেড়াইয়া বেড়ায়। স¤প্রতি তাহার পাতার গন্ধ, শিশিরের গন্ধ ভালো লাগিতেছে। রাত্রে ময়নামতী ঘুমাইয়া পড়িলে একা একা শালবনে হাঁটিয়া বেড়ায় মণিমালা। শরীরে অন্ধকার কিংবা জোছনার কিরণ মাখে।

রাত্রিকালীন নিস্তব্দ নিবিড় অরণ্যের সংস্পর্শে আসিয়া তাহার তনুমন সুস্থির হইয়া উছে। শৌণিক অবশ্য আড়ালেই থাকিয়া রাজকন্যাকে লক্ষ করে। রাজ্যকন্যা টের পায় না। দেবপর্বত নগরের অতিথিশালাসমূহ অবস্থিত বড় ধর্মপুরে । সাদা রং করা দ্বিতল ভবন।

অতিথিশালার পিছনে শালবনের ব্যাপক বিস্তার। একটি প্রাচীন বৌদ্ধ সঙ্ঘারাম পরিলক্ষিত হয়। দেবপর্বত স্বভাবতই নির্জন নগর। শীতের প্রারম্ভ হওয়ায় নির্জনতা আরও প্রকান্ড হইয়া উঠিয়াছে। এক আসন্ন সন্ধ্যায় অতিথিশালায় কৈলাণ নামে এক যুবকের সঙ্গে ব্রাত্যর পরিচয় হইয়া গেল।

যুবকের নিবাস দেবপর্বতেই বলিল। স্বাস্থ্যবান কৈলাণের গাত্রবর্ণ কৃষ্ণকায়; মাথা কামানো, তবে সে বৌদ্ধ কি না তাহা প্রথম দর্শনে বুঝা গেল না। তবে কৈলাণ নাকি রাজবংশের সন্তান, সমতটের রাজার নিকট আত্মীয় বলিয়া পরিচয় দিল। ব্রাত্য অবশ্য সন্দেহ প্রকাশ করিল না। কথায় কথায় জানা গেল- কৈলাণের ঈষৎ পানাহারের অভ্যাস আছে বলিয়া প্রায়শ অতিথিশালায় আসে।

অতিথিশালায় নানা জাতের বণিক-পর্যটকের ভিড়। আমোদ-প্রমোদের বিবিধ ব্যবস্থা রহিয়াছে বলিয়া পানাহারের সুবিধা। রাজপ্রাসাদে লাল পাহাড়ের রাজার তীক্ষ্ম পর্যবেক্ষনে নাকি পানাহারের সমস্যা। লাল পাহাড়ের রাজা? ব্রাত্য জিজ্ঞাসা করিল। কৈলাণ বলিল, সমতট রাজ্যের রাজার নাম ভবদেব; এতদ্বঞ্চলে তিনি লাল পাহাড়ের রাজা নামে খ্যাত ।

কেন? তাহার কারণ- যে চূড়ার উপর দেবপর্বত নগরটি অবস্থিত, সে চূড়ার নাম চন্ডীমুড়া । চন্ডীমুড়া চূড়াট লাল মাটি দ্বারা গঠিত বলিয়া মনে হয়। রাজার নামকরণের হেতু এই। ওহ্ । স্বীকার করিব, কৈলাণ বলিল, লাল পাহাড়ের রাজা অত্যন্ত প্রজাবৎসল ।

রাজা যেমন প্রজাকে ভালোবাসেন, প্রজারাও তেমনি রাজাকে ভালোবাসে। হুমম। বুঝিলাম। ব্রাত্য বলিল। কৈলাণই সহাস্যে প্রস্তাব করিল, চল হে নব্য সহৃদ, যৎসামান্য পান করা যাক।

ব্রাত্য সম্মত হইল। সে ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির নয়। ব্রাত্য তাহাকে দ্বিতলে আপন কক্ষে লইয়া গেল। সদ্য সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হইয়া গিয়াছে। কক্ষে একখানা প্রদীপ জ্বলিতেছিল।

শীতসন্ধ্যার নিথর বাতাসে ধূপের সুগন্ধ ভাসিতেছিল। দেবপর্বত নগরে মশকের ভারি উপদ্রক। যথা সময়ে ধূপ প্রজ্জ্বলিত করিতে হয়। ব্রাত্যের তুলনায় কৈলাণ যথেষ্ট বলিষ্ট গড়নের হইলেও স্বল্প পানের পরই সে মাদকাক্রান্ত হইয়া গেল। অস্পস্ট জড়ানো কন্ঠস্বরে কৈলাণ বলিতে লাগিল, দুই দিন পর আমি হইব সমতট রাজ্যের অধিশ্বর ।

আর মণিমালা কিনা আমাকে অবজ্ঞা করে। নটির আস্পর্ধা দেখ! কে মণিমালা? কে আর ...কথা সমাপ্ত হইল না-কৈলাণ ‘সামন্ত’ ‘সামন্ত’ বলিয়া চিৎকার করিয়া উঠিল। খর্বাকৃতি একজন ব্যাক্তি কক্ষে প্রবেশ করিল । স্থূলকায় মাঝবয়েসী ব্যাক্তিটির মুখে বসন্তের দাগ। ইহারও মস্তক মুন্ডিত।

কৈলাণ তাহাকে জিজ্ঞাসা করিল, আজ কোন নটি আসিয়াছে ? ক্ষীরোদার ঘাট হইতে মাধুরী আসিয়াছে। সামন্ত বলিল। ‘ওহো মাধুরী, মাধুরী’ বলিয়া কৈলাণ উঠিয়া দাঁড়াইল। টাল সামলাইতে না পারিয়া পড়িয়া যাইবে- বসন্ত আগাইয়া আসিয়া তাহাকে ধরিল। মদ্যপ কন্ঠে ‘ছাড়ো আমাকে’ বলিয়া টলিতে টলিতে কক্ষ ত্যাগ করিল কৈলাণ।

ব্রাত্য মৃদু হাসিল। গৃহত্যাগ করিবার পর হইতে কত যে বিচিত্র অভিজ্ঞতা হইতেছে। হরিকেল রাজ্যে পৌঁছিবার পর নিশ্চয়ই আরও বিবিত্র অভিজ্ঞতা হইবে। সে ঢেঁকুর তুলিল। অনেক দিন পরে পান করিল।

অবশ্য সমতটী তরলে তেমন ঝাঁঝ নাই। তরল হয় বটে পুন্ড্রনগরে। নীচতলায় আহারের ব্যবস্থা। নীচে নামিয়া আহার সারিল ব্রাত্য। তাহার পর উপরে উঠিয়া আসিল।

প্রদীপ নিভাইয়া শুইয়া পড়িল বটে-তবে ব্রাত্যর ঘুম আসিতেছিল না। সে উঠিয়া বসিল। অতিথিশালার বিপরীতের সেই প্রাচীন সংঘারামে নির্জনতা প্রচন্ড হইয়া রহিয়াছে । নির্জন শীতরাত্র বলিয়াই পাশের কক্ষ হইতে উত্তেজিত রমনীর শীৎকারের শব্দ শোনা যায়। মাধুরী? এই মুহূর্তে মহামতি গৌতম বুদ্ধকে সম্পূর্ন ব্যর্থ মনে হইল ব্রাত্যর ।

তাহার মনে হইল- জগৎ বদলায় না, জগৎ-এর মতোই রহিয়া যায়, সিদ্ধপুরুষগন জগৎ সম্পর্কে চমৎকার বাণী রাখেন মাত্র। চাদরখানি তুলিয়া নিয়া দ্বিতল হইতে নামিয়া আসিল ব্রাত্য। তাহার পর পায়ে পায়ে অতিথিশালার পিছনে আসিয়া দাঁড়াইল । চারিদিকে শালবন। ফুটফুটে কার্তিক জোছনা ফুটিলেও ঘন কুয়াশার বিস্তার চতুর্দিক ছাইয়া আছে।

শীত করিতেছিল। চাদরখানি ভালো করিয়া জড়াইয়া নিল। তাহার পর হাঁটিতে হাঁটিতে অনেক দূর চলিয়া আসিল। মাঝে মাঝে রাত্রিতে ঘুম না আসিলে করতোয়া নদীর পাড়ে গিয়া বসিয়া থাকে ব্রাত্য। সহসা শালবনে একটি রূপসী মেয়েকে দেখিয়া থমকাইয়া গেল সে।

মেয়েটি যেই হোক প্রথম দর্শনেই তাহাকে অসম্ভব ভালো লাগিয়া গেল ব্রাত্যর । মনিমালারও প্রথম দর্শনেই ব্রাত্যকে ভালো লাগিয়া গেল। মণিমালা জিজ্ঞাসা করিল, আপনি? ব্রাত্য বলিল, আমি পর্যটক। সমতট নগরে ভ্রমনের উদ্দেশ্যে আসিয়াছি । ওহ্ ।

আপনার নাম জানিতে পারি কি? আমার নাম ব্রাত্য, ব্রাত্য বণিক। আপনি? আমার নাম মেঘা। আমি ব্যাধকন্যা । ওহ্ । তা এতরাত্রে নির্জন শালবনে কি করিতেছ? আমার ঘুম আসিতেছিল না।

তাই শালবনে ঘুরিয়া বেড়াইতেছি। ঘুম আমারও আসিতেছিল না। বলিয়া চারিদিকে তাকাইল। চরাচর নিঃশব্দ হইয়া আছে। চাঁদের কিরণ ও কুয়াশার এক অলীক লড়াই চলিতেছে।

মণিমালা বলিল, কোথায় আপনার নিবাস, তা জানিতে পারি কি? সমৃদ্ধশালী পুন্ড্রনগরে আমার বাস। ওহ্ । রাজকন্যাহেতু মণিমালা বিলক্ষণ পুন্ড্রনগরের নাম শুনিয়াছে। কিন্তু, পুন্ড্রনগর না-চিনিবার ভান করিল। ব্যাধকন্যাকে এতকিছু জানিতে নাই।

বরং বলিল, আমাদের রাজা খুব ভালো মানুষ। লোকে তাকে বলে লাল পাহাড়ের রাজা। জানি। জানেন। কী ভাবে? অতিথিশালায় আজ আমার একজনের সঙ্গে পরিচয় হইয়াছে।

তাহার নাম কৈলাণ। কৈলাণই আমায় বলিয়াছে। কৈলাণ! রাজকন্যা চমকাইয়া উঠিল। সামলাইয়া নিয়া বলিল, তা আমাদের রাজ্যটি আপনার নিকট কেমন লাগিতেছে? যা দেখিতেছি, মুগ্ধ হইয়া যাইতেছি। সত্যি বলিতেছেন তো? কেনই-বা মিছিমিছি মিথ্যা বলিতে যাইব? মণিমালা বলিল, ব্যাধকন্যা সমাজের চোখে অচ্ছুৎ বলিয়া তাহার নিকট সবাই সত্য লুকাইয়া থাকে।

অভিমানের স্বর ফুটিয়া উঠিল মণিমালার কন্ঠে। যেন সে সত্য সত্যই ব্যাধকন্যা। ব্রাত্য রঙ্গ করিয়া বলিল, হে ব্যাধকন্যা, তুমি যে আমার নিকট সত্য লুকাইতেছ না তাহা আমি কী করিয়া বুঝিব? সচকিত হইয়া উঠিয়া মণিমালা বলিল, আপনার এইরূপ মনে হইবার কারণ? তুমি অত্যধিক রূপসী মেঘা। ব্যাধকন্যারা তো এত অধিক রূপসী হয় না। রাজকন্যা লজ্জ্বিত হইল।

নম্রকন্ঠে বলিল, সংসারে নারীমাত্রেই অঙ্গাভরনের কারণে কিছু না কিছু মাত্র রূপসী হইয়া থাকে। এইই মা-প্রকৃতির বিধান। মানিলাম। ব্রাত্য বলিল। শ্বাস টানিল।

নরম কন্ঠে বলিল, তবে তাহারও তো সীমারেখা আছে। তোমার রূপরাশি সমস্ত সীমারেখা অতিক্রম করিয়াছে মেঘা। মণিমালা চুপ করিয়া থাকে। ভিতরে ভিতরে কম্পন টের পাইতেছে। দূরদেশি এই শ্যামল সুদর্শন যুবকটি অতিশয় সংযমী ।

কৈলাণের মতো নয়। কৈলাণ চরিত্রহীন, লম্পট-যা পিতা বুঝিতে চায় না । রাজপ্রাসাদের কুমারী কন্যারা তো বটেই দাসীরা অবধি কৈলাণের পাশবিক অত্যাচারে অস্থির হইয়া আছে। অনেক দাসী সম্ভ্রম বাঁচাইতে আত্মহননের পথও বাঁছিয়া লইয়াছে। এইরূপ দূরাচারীকে কিভাবে স্বামীরূপে গ্রহন করে মণিমালা?।

অথচ, এই দূর রাজ্যের যুবকটি এতক্ষণেও বিন্দুমাত্র অশালীন ইঙ্গিত করে নাই, বরং মণিমালা সম্পর্কে শোভণ কৌতূহল দেখাইয়াছে মাত্র। মণিমালা ব্রাত্য বণিককে ভালোবাসিয়া ফেলিল। জানিতে পারি কি আপনি কি কিরূপে জীবিকা নির্বাহ করেন? মণিমালা জিজ্ঞাসা করিল। আমাদের পারিবারিক ব্যবসা শঙ্খ শিল্প। আপনার অবর্তমানে আপনার প্রিয়তমা স্ত্রী নিশ্চয়ই আপনার পিতামাতার সেবাযতœ করিতেছে? ব্রাত্য হাসিয়া কহিল, আমি বিবাহ করি নাই মেঘা।

পারিবারিক ভাবেই আমার বিবাহের উপক্রম হওয়ায় গোপনে নৌকাযোগে পূর্বদিকের মেঘনাপাড়ে পালাইয়া আসিয়াছি। পালাইয়া আসিয়াছেন? কেন? নিয়তি! ওহ্ । মণিমালা তাহার বুকের ভিতরে আনন্দস্রোত টের পাইল। দ্রুত জিজ্ঞাসা করিল, পুন্ড্রনগর যে নদীর পাড়ে, সে নদীর নাম কি? সে নদীর নাম করতোয়া। নদীটি নিশ্চয়ই ভারি সুন্দর? ব্রাত্য বলিল, করতোয়া মতন স্বচ্ছ সলিলা নদী জগতে আর একটিও নাই।

তাহার কন্ঠে অহংকারের ছোঁওয়া। মণিমালা মনে মনে বলিল, আমাদিগের ক্ষীরোদা নদীটিও সুন্দর। তবে মুখে বলিল, করতোয়া মতন স্বচ্ছ সলিলা নদী জগতে আর একটিও নাই? আপনি সত্য বলিতেছেন কি? মিথ্যা বলিব কেন? রাজকুমারীর কাছে মিথ্যা বলিলে শূলে চড়িতে হইবে না? বলিয়া ব্রাত্য হাসিল। মণিমালা আপাদমস্তক চমকাইয়া উঠিল। আপনি ... আপনি কি করিয়া জানিলেন যে আমি ...আমি রাজকুমারী? ব্রাত্য ব্যাঙ্গের সুরে বলিল, ব্যাধকন্যার হাতে রাজকীয় হীরার অঙ্গুরীয়।

আমি সমতট রাজ্যের পরিবর্তে দেবরাজ্যে আসিয়া পড়ি নাই তো? আপনি তো দেখিতেছি ভারি চতুর। রাজকন্যা হাসিল। এবং নিবিড় কটাক্ষ করিল। এই কার্তিকের রাত্রে শীত অসহ্য হইয়া না উঠিলে বুকের কাছ হইতে চাদরখানি খানিকটা সরাইয়া স্তনসম্পদখানি দূরদেশির দৃষ্টিগোচর করাইয়া দিত। ব্রাত্য হাসিয়া বলিল, পুন্ড্রের মানুষ কর্মঠ বলিয়াই চতুরই হইয়া থাকে।

ইহার পর মণিমালা ব্রাত্যর নিকট উষ্ণ ও আবেগঘন কন্ঠে সকল ঘটনা খুলিয়া বলিল। যেন কতকাল পর রাজকন্যা তাহার নিকটের মানুষটিকে সন্নিকটে পাইয়াছে। ব্রাত্য বলিল, কৈলাণকে আমারও ভালো লাগে নাই। বলিয়া মণিমালার নিকট ব্রাত্য অতিথিশালার আদ্যপান্ত ঘটনা খুলিয়া বলিল। তাহার পর বলিল, কৈলাণ যতক্ষণ জীবিত আছে এ রাজ্যে তোমার ভয়ানক বিপদ মনিমালা।

সুতরাং – সুতরাং? কাল বিলম্ব না করিয়া আমার সঙ্গে পুন্ডনগর যাত্রা কর। মণিমালা মাথা নাড়িল। তাহারও করতোয়া নদীটি দেখিতে ভীষণই ইচ্ছা করিতেছে। অবশ্য মায়ের কথা ভাবিয়া বিষন্নবোধ করিল। ইস্ , একবার যদি পিতার সহিত সাক্ষাৎ হইত! অর্ন্তযামী রাজকন্যার প্রার্থনা শুনিলেন।

একটি শাল গাছের আড়াল হইতে সব শুনিতেছিল শৌনিক। এইবার সে তাহাদের সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইল। মণিমালা শৌণিককে সমস্ত খুলিয়া বলিল। হাতির পিঠে চড়িয়া মণিমালা ও ব্রাত্য ক্ষীরোদা নদীর পাড়ে যাইবে। (তৎকালে ক্ষীরোদা নদীর সহিত মেঘনা নদীর সংযোগ ছিল।

) শৌনিক লালমাইকে আনিতে গেল। জয়া ও ময়নামতির সঙ্গে বিদায় লইতে রাজকন্যা কুটিরের কাছে আসিল। ময়নামতি ঘুম ঘুম চোখে আসিয়া দাঁড়াইল। তাহাদের রাজকন্যা মণিমালা বলিল, আমি তোমাদের আর্শীবাদ করিতেছি। সমতটবাসী আমায় ভুলিয়া গেলেও যুগ যুগ ধরিয়া তাহারা তোমাদিগকে স্মরণ করিবে।

রাজকন্যা মণিমালার ভবিষ্যৎবাণী উত্তকালে সার্থক হইয়াছিল। ময়নামতি নিঃশব্দে মাথা নীচু করিয়া দাঁড়াইয়া থাকিল। মণিমালা জয়াকে জড়াইয়া ধরিল। শৌনিক এর কুটিরের পিছনে একটি শাল গাছের সঙ্গে বাঁধা ছিল লালমাই। শাল গাছের আড়ালে লুকাইয়াছিল এক গুপ্তচর।

তার কানে কানে শৌনিক কি সব যেন বলিল। চরটি তৎক্ষণাৎ রাজপ্রাসাদের দিকে উর্ধ্বশ্বাসে ছুটিল। শৌনিক হাসিল। লাল পাহাড়ের রাজা সন্তুষ্ট হইয়া নিশ্চয়ই প্রচুর ধনরত্ন দিবেন। দীর্ঘদিন গুপ্তচরবৃত্তির সহিত জড়িত শৌনিক- মাঝেমধ্যে রাজকীয় দয়াদাক্ষিণ্য জুটিলেও কপালে তেমন ধনরত্ন জুটে নাই।

রাজকন্যা মণিমালা যেদিন প্রথম ব্যাধের কুটিরে আসিয়াছিল সেই দিনই লাল পাহাড়ের রাজা কে সংবাদ দিয়াছিল শৌনিক। লাল পাহাড়ের রাজা সস্নেহে বলিয়া ছিলেন, শৌনিক, মা আমার যতদিন ইচ্ছা তোমার কাছেই থাক। নিয়মিত আমায় খবর দিও। জয়া ও ময়নামতীর নিকট হইতে বিদায় লইয়া মণিমালা ও ব্রাত্য লালমাইয়ের পিঠে চড়িয়া বসিল। যাত্রাপথে গভীর শীতার্ত নিশুতির কুয়াশাময় সৌন্দর্য অবলোকন করিয়া মুগ্ধ হইয়া গেল।

ক্ষীরোদার কূলে পৌঁছাইতে পৌঁছাইতে ভোর হইয়া গেল। নির্জন ঘাটে লাল পাহাড়ের রাজা ভবদেব উপস্থিত । লাল পাহাড়ের রাজা পাত্রমিত্র লইয়া শিবিকায় চাপিয়া দ্রুত ক্ষীরোদার কূলে পৌঁছাইয়াছেন। মণিমালা পিতাকে দেখিয়া বিস্মিত হইয়া যায়। লালমাইয়ের পিঠ হইতে নামিয়া পিতার বুকে ঝাঁপাইয়া পড়িয়া অনেক ক্ষণ ধরিয়া কাঁদিল, তাহার পর পিতাকে সমস্তই খুলিয়া বলিল।

লাল পাহাড়ের রাজার মুখ গম্ভীর হইয়া উঠিল। কৈলাণকে আমি উচিত শিক্ষাই দিব! বলিয়া লাল পাহাড়ের রাজা ব্রাত্যকে বুকে জড়াইয়া ধরিয়া আর্শীবাদ করিলেন। ততক্ষণে কার্তিক প্রভাতের কুয়াশা ভেদ করিয়া সোনালি রোদ্দুর ফুটিয়া উঠিতেছিল। ঘাটে একখানা বিশালাকার নীলবর্ণের ময়ূরপঙ্খী নাও দৃশ্যমান হইয়া উঠিল। লাল পাহাড়ের রাজা বলিলেন, মাঝিকে বলিও মা, নাওখানা যেন ধীরে বায়।

আমি ধনরত্নপূর্ণ আরও সাতটি নাও পাঠাইয়া দিব। ব্রাত্য কী বলিবে বুঝিতে পারিল না। সে ডান হাত দ্বারা মণিমালাকে বেষ্টন করিয়া সর্ন্তপণে ময়ূরপঙ্খি নায়ে উঠিল। ভব নদীর কান্ডারী ঈশ্বরের নাম ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত করিয়া মাঝিমাল্লাগন ময়ূরপঙ্খী নাও ছাড়িয়া দিল।



এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.