কবে যাবো পাহাড়ে... কবে শাল মহুয়া কণকচাঁপার মালা দেব তাহারে.... আমাদের মূল শত্রু জামাত-শিবিরের নেতাকর্মীরা নয়। আমাদের মূল শত্র হলো জামাতী দর্শন। ইংরেজিতে একটা কথা আছে, “An idea never dies”- আমাদের এই প্রবাদটাকে ভুল প্রমাণ করতে হবে। রাজাকারদের ফাঁসীতে ঝোলানো অবশ্যই কর্তব্য। তবে এতে খুব একটা ইতরবিশেষ হবেনা।
জামাত থেকে যাবে। ওদের সংবিধান পরিবর্তন করে নিষিদ্ধ করেও হবে না, ওরা আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যাবে। মানুষ যুগে যুগে জামাতের সাথে ধর্মকে গুলিয়ে ফেলবে। যুগে যুগে ওরা ছেলেমেয়েদের ব্রেইনওয়াশ করে রাস্তায় নামিয়ে দেবে ধ্বংসযজ্ঞ চালাতে। এদের প্রতিহত করতে দরকার একটা সামাজিক আন্দোলন।
এদের পরাজিত করতে প্রয়োজন- জাতিগতভাবে এদেরকে বয়কট করা। সেটার জন্য গণজাগরণের বিকল্প নেই।
শাহবাগ আন্দোলনকে সমর্থন করি? অবশ্যই। এ আন্দোলন যেদিকেই ধাবিত হোক না কেন, এর সাথেই থাকবো। আন্দোলনটা এখন এত বেশি জনপ্রিয় এবং এত লক্ষ লোক এর সমর্থনে আছেন, যে এ আন্দোলনের নিকনির্দেশনা এখন জনতাই দেবে।
কেন্দ্রের নেতাদের কোনো দুরভিসন্ধি আছে কিনা, তাঁরা নিজেদের prejudice বাসায় রেখে এসেছেন কিনা, তাঁরা নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে পারছেন কিনা কিংবা তাঁরা রাজনৈতিক চাপের কাছে নতি স্বীকার করবেন কিনা- সব প্রশ্নই অবান্তর। আন্দোলনে যখন সতস্ফূর্ত জনতার উপস্থিতি থাকে (এবং তাও এরকম বিপুল সংখ্যায়) তখন কেন্দ্র ভুল সিদ্ধান্ত নিলে জনতাই সেটা শুধরে নেবে। কেন্দ্র যদি জনতার pulse ধরতে না পারে, জনতাই ওদের ছুঁড়ে ফেলে দেবে। নতুন নেতা জনতার মধ্য থেকেই বেরিয়ে আসবে। কাজেই, এ আন্দোলন যেদিকেই মোড় নিক, এমনকি- তা আমার ব্যক্তিগত আদর্শের সাথে সাংঘর্ষিক হলেও আমি সেটার সাথে থাকবো।
কারণ- আন্দোলন জনতাই চালাচ্ছে, জনতাই চালাবে।
আন্দোলন কি ধর্মনিরপেক্ষ না ধর্মবিদ্বেষী, জামাতবিরোধী না ইসলামবিরোধী- এমন বিতর্ক উঠেছে। অনেকে আঁতকে উঠেছেন ফেসবুকে বিরোধী স্ট্যাটাসের জোয়ারে। আমি আতংকিত নই। এটা বিপ্লব; বিপ্লব কখনও সরলরেখায় চলে না, বিপ্লব কখনো প্রশ্নাতীত থাকে না।
এসব বিতর্ক, সংশয়, দ্বন্দ্ব এবং বিরোধী চিন্তাই বিপ্লবকে দিকনির্দেশনা দেয়। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি- একটা গণতান্ত্রিক দেশে কেউ যদি ধর্মভিত্তিক রাজনীতি করতে চায়, সেটাতে তাকে বাধা দেওয়া অগণতান্ত্রিক- যতক্ষণ পর্যন্ত তাদের রাজনীতি অন্যের ব্যক্তি অধিকারে হস্তক্ষেপ না করছে। জামাত-শিবিরের রাজনীতি বন্ধ হওয়া জরুরী; কারণ বিগত প্রায় সাত দশক ধরে এরা পরগাছার মত আমাদের রক্ত চুষে ফুলে ফেঁপে উঠেছে, কিন্তু এরা কখনও বাঙালি জাতীয়তাবাদকে স্বীকৃতি দেয়নি, এরা জন্মলগ্নে নবজাতক বাংলাদেশকে গলা টিপে হত্যা করতে সচেষ্ট ছিলো এবং তারপর এই বাংলাদেশেরই রক্ত চুষে আজ তারা ধনাঢ্য এবং ক্ষমতাবান। এরা এমনকি এদের বিরোধী মতবাদকেও গলা টিপে হত্যা করতে উদ্বাহু। কাজেই, এরা অগণতান্ত্রিক, এদের নিশ্চিহ্ন করে দেয়াই একমাত্র পন্থা।
তবে কিছু অতি উৎসাহী ব্যক্তি যদি এই চোটে সকল ধর্মভিত্তিক দলকে নিষিদ্ধ করে ফেলতে চান- সেটা বুমেরাং হতে পারে। ইন ফ্যাক্ট, সেটা বুমেরাং হবেই।
অনেকে বলছেন- আন্দোলন কতদিন অহিংস পন্থায় চলবে? আর কতদিন বেলুন ওড়ানো, মোম জ্বালানো আর আলটিমেটাম দেয়া? একশনে নামবো কবে? আমি বলবো- আমরা একশনেই আছি। প্রতি দিন, প্রতি মিনিটে প্রজন্ম চত্বরের চেতনা ছড়িয়ে যাচ্ছে আরো বিস্তৃত হয়ে। প্রতি মুহুর্তে কিছু নতুন লোক এই আন্দোলনে যোগ দিচ্ছেন।
এই আন্দোলন যতদিন প্রতিটি স্বদেশি-প্রবাসী বাঙালির রন্ধ্রে রন্ধ্রে না পৌঁছুবে, যতদিন না প্লাবিত করবে বাংলাদেশের প্রতিটি ঘর, প্রতিটি মাঠ-ঘাট-জঙ্গল, প্রতিটি মানুষের হৃদয়- ততদিন আন্দোলন ধরে রাখতে হবে। তবেই আসবে সাফল্য। কারণ- এ আন্দোলনের মাধ্যমে জামাতী দর্শনকে হত্যা করা সম্ভব, কিংবা নিদেনপক্ষে নির্বাসিত করা। কিছু জামাতী সন্ত্রাসীর সাথে লাঠি নিয়ে যুদ্ধে নেমে আপনারা এত বড় সুযোগ হাতছাড়া করবেন না। চেয়ে দেখুন- শাহবাগে দিনরাত সময় কাটানো বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, শিশু, নারীদের দিকে।
আপনাদের আন্দোলন যদি লাঠিসোটা নিয়ে জামাত পেটানোর আন্দোলন হতো, স্বাধীন সার্বভৌম স্বদেশের আইন নিজের হাতে তুলে লোফালুফি খেলার আন্দোলন হতো- তাঁদের কি সাথে পেতেন? এখন এঁদের সাথে পেয়েছেন- আপনারা কি চান এদের হারাতে? আমরা কি চাই- টিভি চ্যানেলে জামাত-শিবিরের মত আপনার-আমার নৃশংস কার্যকলাপ দেখানো হোক?
অনেকে এটাকে নতুন মুক্তিযুদ্ধ নাম দিয়েছেন। আমি বলবো- মুক্তিযুদ্ধই বটে। তবে এ যুদ্ধ হাতাহাতি লড়াইয়ের থেকে অনেক বড়, অনেক মহান। এ যুদ্ধ আদর্শের যুদ্ধ, মতবাদের যুদ্ধ, স্বাধীনচেতা জনতার স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রাম। একে নিছক হাতাহাতির পর্যায়ে নামিয়ে আনবেন না।
সে কাজ আমাদের বেতনভূক পুলিশ-আনসার-বিডিআর এবং প্রয়োজনে সেনাবাহিনীকে করতে দিন। সরকার তার শক্তি যথার্থভাবে ব্যবহার না করলে তাদের বাধ্য করুন। কিন্তু সে দায়িত্ব নিজের হাতে তুলে নেবেন না। আমাদের দায়িত্ব এর থেকে অনেক বড়, অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। শাহবাগে যে মিটমিটে মোম জ্বলেছে, সে মোমের আলো সারা দেশে, সারা বিশ্ব জ্বেলে দিতে হবে।
যে আগুন ৫ তারিখে মুষ্টিমেয় কয়েকজনের হৃদয়ে জ্বলেছে, সে আগুন লক্ষ লক্ষ জনতার হৃদয়ে ছড়িয়ে গেছে কয়েক দিনেই। আর মাত্র কয়েকটা দিন, অচিরেই আপনি নিজের কানে শুনতে পাবেন ষোলো কোটি লোকের হৃদয়ের কম্পন। এই প্রাপ্তি, এই সম্ভাবনাকে এত সহজে হারিয়ে যেতে দেবেন না।
জামাতের আচরণে এটা স্পষ্ট- ওরা চায় শাহবাগে বসে বসে গান গাওয়া, আবৃত্তি করা, শ্লোগান দেয়া ধীরস্থির তরুণদের উত্তেজিত করতে, ওদেরকে সংঘর্ষে জড়াতে। কাজেই, উত্তেজিত হবার আগে আমাদের ভাবতে হবে- ওরা কী চায়? ওরা কি জানেনা- এই জনতা শাহবাগের নিরাপত্তা বেষ্টনী ভেঙে বেরিয়ে এলে ওরা সব গুঁড়িয়ে যাবে, নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে? পাগান ধর্মগুলোতে একটা কথা আছে- দেবতার শক্তি হচ্ছে তার অনুসারীদের বিশ্বাস।
একজন দেবতার সাথে সর্বশক্তিতে লড়াই করেও তাকে হারানো যায় না, কিন্তু তাকে ভুলে গেলে সে মরে যায়। ধারণাটা খুব সোজাসাপ্টা। জামাত নিশ্চিহ্ন হবার পথে, ওদের দর্শন মৃতপ্রায়। ওরা চাইছে নজর কাড়তে, ওরা চাইছে আমরা লড়াই করি। ওরা চাইছে- প্লাবন রুখতে, আমাদের বিশৃঙ্খল করতে।
আমাদের উচিত হবে- অবস্থান ধরে রাখা, বিশৃঙ্খল না হওয়া।
পরিশেষে আবারও বলতে চাই- যাঁরা বাংলাদেশে ইসলামের ভবিষ্যত নিয়ে শংকিত তাঁদের উদ্দেশে। বাংলাদেশে যতদিন আপনাদের মত ধার্মিক মুসলমান আছেন, ততদিন ইসলাম সমুন্নত থাকবে। ইসলামও একটা দর্শন। যতদিন আপনি ধর্ম পালন করবেন আন্তরিকতার সাথে, ততদিন আপনার ধর্মের গায়ে কেউ আঁচড়ও কাটতে পারবে না।
শাহবাগের আন্দোলন ধর্মবিরোধী নয়। যদি তাকে কেউ ধর্মবিরোধী করার চেষ্টা করে- তাদেরকে জনতাই ছুঁড়ে ফেলে দেবে। আপনি যদি শাহবাগ এখনও না গিয়ে থাকেন, আজই যান। মঞ্চে যে লোকটা মাইক হাতে শ্লোগান দিচ্ছে কিংবা লম্বা লম্বা ভাষণ ঝাড়ছে- সে আপনার থেকে কিছুমাত্র বেশি গুরুত্বপূর্ণ নয়। আপনার এবং আপনার মত আরো লাখো জনতার শক্তিতেই সে শক্তিমান, তাদের বলেই সে বলীয়ান।
শাহবাগে যান, লোকটাকে শক্তি দিন। শাহবাগের আন্দোলন যদি সঠিক পথে না চলে, তাহলেও যান- তাকে সঠিক পথে পরিচালিত করুন। মঞ্চের লোকটা যদি ভুল কথা বলে, ছুঁড়ে ফেলে দিন তাকে। তবুও যান শাহবাগে, জনতার কন্ঠে কন্ঠ মেলান। নাকি আপনার দেশের জনগণের ওপর আপনার আস্থা নেই?
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।