ইমিগ্রেশনের দেশ কানাডা। প্রতিদিনই কিছু না কিছু লোক এখানে এসে নামে নতুন জীবনের সন্ধানে। পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গার বিভিন্ন ধর্ম, বিভিন্ন জাতির লোক আসে এখানে। আমার কাছে মনে হয়- বিভিন্ন জাতির বিভিন্ন দেশের মানুষের সমন্বয়ে কানাডা একটি ছোটখাট পৃথিবী। এতো দেশের এতোরকম মানুষ একমাত্র কানাডাতেই মনে হয় সমবেত হয়েছে।
এদিক থেকে আমার কানাডায় থাকার অভিজ্ঞতা অনেক সমৃদ্ধ। সারা পৃথিবী ঘুরে এত জাতির সাথে পরিচয় করা কোনোভাবেই সম্ভব ছিল না। মানবতা এবং মাল্টিকালচারের দেশ কানাডা। আমাদের দেশের অনেকের নাক সিঁটকানো ভাব আছে আমেরিকান নিয়ম-নীতির ব্যাপারে। বুশের কার্যক্রমে তাদের ধারণা আরো মজবুত।
তবে বড় একটা ভুল অনেকেই করেন আমেরিকা আর কানাডাকে একই রকম মনে করে। এটা সম্পূর্ণ ভুল ধারণা।
আমেরিকায় যাদের অভিবাসন নেn, তারা প্রথমে আমেরিকান তারপর নিজের দেশের লোক হন। নিজের দেশকে ভুলে গিয়ে শুধুই আমেরিকান হলেও কোনো ক্ষতি নেই। এটাই আমেরিকা চায়।
অর্থাৎ আমেরিকান হয়ে যাওয়া। কানাডা এর সম্পূর্ণ বিপরীত। কানাডা সবাইকে বলে তুমি প্রথম তোমার নিজের দেশী, তারপর কানাডিয়ান। নিজের অস্তিত্বকে ভুলে নিজের জাতিসত্তা বিলিয়ে দিয়ে হঠাৎ এসে আরেকটি দেশের সবকিছু গলধঃকরণ সম্ভব নয়। এটা কানাডিয়ানরা জানে ভালো মতো।
তাই প্রতিটি নতুন আগন্তুক যেন নিজেকে নতুন সমাজ ব্যবস্থার সাথে মানিয়ে নিতে পারে এর জন্য বিনামূল্যে বা নামমাত্র মূল্যে ভাষাশিক্ষা, আপগ্রেডিং করার জন্য নানারকম প্রতিষ্ঠান আছে। পাঁচ বছর পর্যন্ত এখানে বসবাসকারীকে নতুনের মধ্যে ধরা হয়। যারা প্রথমে এসে কিছুদিন নিজেদের পড়ালেখায় নিয়োজিত রাখেন তারা ধীরে ধীরে ভালো পর্যায়ে কাজ পেয়ে যান। তবে জীবিকানির্বাহের জন্য অনেককেই নিজের যোগ্যতার চেয়ে যথেচ্ছভাবেই অযোগ্য কাজে নেমে পড়তে হয়। দিনমান খাটনির পরে নিজেকে আপডেট করার মতো ধৈর্য অনেকেরই থাকে না।
এখানে কাজ মানে কাজ, কোনো ফাঁকিঝুকি নেই। অলস বা অযোগ্য লোক রাখার কথা কোম্পানি ভাবতেও পারে না। ফাঁকিবাজি দেখলে ফায়ার করে দিতে একটুও ইমোশনে বুক কাঁপে না কর্তাব্যক্তিদের। অফিসিয়াল কাজ ছাড়া কাজের জায়গায় বসে কাজ করার সুযোগ খুব কম। আট ঘন্টা দু’পায়ের উপর দাঁড়িয়ে কাজ ।
বসার সুযোগ খুব কম। ব্যাংকের টেইলরদেরও দাঁড়িয়ে সেবা দান করতে হয়। ম্যানেজার বা ডিরেক্টরের একটি সাজানো কক্ষ থাকলেও ঘুরে বেড়ান সারাক্ষণ অফিস জুড়ে, তদারকি করেন সকলের কাজের। প্রয়োজনে সাহায্য করেন কাস্টমার বা অধীনস্ত কর্মচারীর কাজে। এখানে যে যেখানে কাজ করে, সেই কাজের জায়গার অন্যান্য অন্যান্য কাজ সম্পর্কে সম্পূর্ণ না হলেও মোটামুটি ধারণা তার আয়ত্বের মধ্যে থাকে।
কারণ কোনো অসুবিধায় যেন কাজ আটকে না থাকে। কাজের বাইরে নানারকম সেফটি ট্রেনিং রাখতে হয়।
কানাডা পারিবারিক বন্ধনকে ভীষণ গুরুত্ব দেয়। পরিবার যেন সুরক্ষিত থাকে তার জন্য সরকার চেষ্টা করে। নিম্নআয়ের পরিবারে সরকারি সাহায্য থাকে।
বাচ্চা হওয়ার সময়ে স্ত্রী এবং সংসারের দেখা শোনা করতে পারেন এজন্য বেতনসহ স্বামীকে বেশ কিছুদিনের জন্য প্যারেন্টাল ছুটি দেয়া হয়। বাচ্চা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় কানাডায়। বাচ্চারা বাবা-মায়ের সাথে থাকে। কিন্তু তাদের অনেক গুরুদায়িত্ব পালন করে সরকার। প্রত্যেকটি বাচ্চার জন্য দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত পড়ালেখা ফ্রি।
বাচ্চাদের স্কুলে না পাঠানো দ-নীয় অপরাধ। আগে বাবা-মাবিহীন বাচ্চারা থাকতো অরফেনেজে, বর্তমানে বাচ্চারা যাতে পরিবারের সাথে থাকতে পারে এজন্য ‘ফস্টার-প্যারেন্ট’ সিস্টেম চালু হয়েছে। এদেশের বাচ্চারা ছাড়াও কত দেশ বিদেশের বাচ্চাদের কানাডিয়ান ফস্টার-পেরেন্টরা এডপ্ট করে নিয়ে আসছে নিজেদের কাছে। নিজের বাচ্চার সাথে একই আদর মমতায় বড় করছে সেই শিশুদের। বাংলাদেশের বহু যুদ্ধশিশু বড় হয়েছে কানাডায়।
যারা আজ তাদের জীবনে সুস্থ স্বাভাবিক ভাবে প্রতিষ্ঠিত। কানাডার মতন দেশ না পেলে তাদের জীবন হয়ত এমন সুন্দর হতো না।
আঠারো বছর পর্যন্ত প্রতিটি বাচ্চা চাইল্ড ট্যাক্স বেনিফিট পায়; বাবা মায়ের আয় অনুযায়ী তা কম বেশি হয়। হাই স্কুল শেষ করে কলেজ বা ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার সুযোগ যারা পায় কম আয়ের জন্য বাবা-মা পড়াতে না পারলে কোন অসুবিধা নেই। সরকার তাদের পড়ার খরচ দেয়।
পড়ালেখা শেষ করে চাকুরি পাবার পরে অল্প অল্প করে ঋণ শোধ করে দিতে হয়। এজন্য বেশ কিছু সময় দেয়া হয়।
বিভিন্ন দেশ থেকে আগত নানা বয়স, নানা দেশের শিশুরা কানাডায় এসে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র হাতে পাওয়ার পরে বাবা-মার হাত ধরে স্কুলে হাজির হয়। বয়স অনুযায়ী তাদের বিভিন্ন গ্রেডে ভর্তি করে নেয়া হয়। স্কুলে তাদের পড়ালেখা করতে হবে এটাই বড় কথা।
মূলকথা, ওরা এখানে শিখতে আসবে, শিখবে। ওরা কি জানে, শিক্ষকদের সামেন সেটার ইন্টারভিউ দিতে হয় না। অজানা-অচেনা ভাষায় কিছু দিনের মধ্যে পারদর্শী হয়ে উঠে বিভিন্ন ভাষা-ভাষী ছেলেমেয়েরা। মাতৃভূমির বুলি ছেড়ে ইংরেজিতে কথা বলতে স্বাচ্ছন্দবোধ করে তারা। ইংরেজি হয়ে যায় তাদের নিজস্ব ভাষা।
বাচ্চাদের কাছ থেকে শেখা হয় মা-বাবাদেরও অনেক নতুন শব্দ, নিয়ম, উচ্চারণ।
এসময়ে মনে বড় দুঃখ লাগে, আমাদের দেশের অসহায় বাচ্চাদের কথা ভাবলে। মা-বাবাকে ছাড়া যারা পৃথিবীর আর কিছুই চেনেনা, চেনার বয়সও নয় তাদের, সেই ছোট ছোট শিশুদের ভর্তি পরীক্ষার মতোন কঠিন পদ্ধতি পার হতে হয় একটি মনমতো ভাল স্কুলে ভর্তি হওয়ার জন্য। ছোট সে বুকের কষ্টগুলো কবে বুঝবে বাংলাদেশের শিক্ষা পদ্ধতি নির্ধারকরা। কেন যারা কিছুই শেখেনি তাদের একটির পর একটি স্কুলে গুরুগম্ভীর সব পরীক্ষা দিতে হবে শিখতে ভর্তি হওয়ার জন্য?
অথচ অপরিচিত অন্য দেশের একজন শিক্ষক অল্প কয়েক দিনেই আপন হয়ে যায় এদেশের মাল্টিকালচার বাচ্চাদের কাছে।
তখন আমাদের এক ভাষাভাষি, এক জাতির শিক্ষকরা থাকেন গাম্ভীর্যের বুহ্যের ভেতর, বাচ্চাদের মন থেকে অনেক দূরে। স্কুল হয় এক ভীতি-সন্ত্রস্ত জায়গা, প্রথম দিন থেকে আতংক বুকে নিয়ে স্কুলে যায় আমাদের দেশের শিশুরা আর এদেশের শিশুরা স্কুলে যায় আগ্রহ ভরে, আনন্দিত মনে। অসুখ হলেও একদিনও স্কুল কামাই করতে চায়না এখানে শিশুরা। দেরী করে স্কুলে গেলে বা বাচ্চা যদি স্কুলে না যায় তাহলে অভিবাবকের দায়িত্ব স্কুলকে টেলিফোন করে জানিয়ে দেয়া স্কুলে অনুপস্থিতির কারণ বা দেরী করে যাওয়ার কারণ। নয়তো স্কুল থেকে ফোন করে নিশ্চিন্ত হবে জেনে, যে বাচ্চা বাসায় আছে।
পথে কোন দুর্ঘটনা ঘটে নাই। আমাদের দেশের স্কুলগুলোর নিয়মের মতো অল্প সময়ের দেরীর জন্য বাচ্চাকে স্কুলে ঢুকতে না দিয়ে ফিরিয়ে দিয়ে, সারাদিনের শিক্ষা ও বাচ্চার স্কুলে থাকার আনন্দ থেকে বঞ্চিত করা হয় না এবং সারা জীবনের জন্য বাচ্চার মনে একটি ভয় ঢুকিয়ে দেয়া হয় না।
চিকিৎসা ব্যবস্থাও একটি সুন্দর পদ্ধতিতে চলছে এখানে। বিশেষ কিছু শর্ত ও ক্ষেত্র ব্যতীত প্রতিটি মানুষের চিকিৎসা খরচ সরকার দেয়। হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীর দেখাশোনা করবে নার্স, ডাক্তার।
খাওয়া-দাওয়া, পরীক্ষা-নিরীক্ষা কোনো কিছুর জন্য আত্মীয়স্বজন কাউকে পাশে রাখার দরকার হয় না। হাসপাতালের দায়িত্বে থাকে রোগীর যাবতীয় প্রয়োজনীয় জিনিস। একজন মানুষ রাস্তায় অসুস্থ হলে বা এক্সিডেন্ট হলে বা কোথাও আগুন লাগলে এম্বুলেন্স, ফায়ার সার্ভিস, পুলিশ এক সাথে হাজির হয় সাইরেন বাজিয়ে। রাস্তার সব গাড়ী একপাশে সরে দাঁড়িয়ে ওদের তাড়াতাড়ি যাওয়ার সুযোগ দেয়। মানুষটি সাদা কি কালো, বাঙালি কি চীনা তা না দেখে মানুষটির সুশ্রষায় ব্যস্ত হয় কর্মরত ব্যক্তি।
মানুষটিকে বাঁচানোর প্রচেষ্টা আগে, মিছেমিছি তার আইডেনটিটি খুঁজতে গিয়ে সময় ব্যয় করা হয় না চিকিৎসার। মানবতার এই অভুতপূর্ব দিকটি প্রতিটি রাষ্ট্রের গ্রহণ করা উচিত।
সাদা, কালো, বাদামি নানা বর্ণ নানা আকৃতির মানুষের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে এই মানবতাবাদী মাল্টিকালচার সোসাইটি। কানাডায় প্রথম আসার পরে সাবওয়ে বা বাসে চড়ে কোথাও যাওয়ার সময়ে আশেপাশের মানুষের কথা শুনে ভাবতাম এদের ইংরেজি কেমন? বুঝতে পারি না কেন? পরে কান পেতে থেকে বুঝলাম, সবাই নিজের ভাষায় কথা বলে। সব দেশের নতুন প্রজন্ম ইংরেজি বলে, আর বলে যাদের ভাষা ইংরেজি, তারা।
তবে আমরা বাংলাদেশে যে ইংরেজি বলি বা শুনি, এখানকার উচ্চারণ তার থেকে অনেক অনেক পার্থক্য। প্রথমদিকে তো কিছুই বুঝতে পারতাম না। এখন দেখা যায় ফ্রান্স, পর্তুগিজ, জ্যামাইকা, বারবেডো, স্পেনিশ, ইতালি, গ্রিক, রাশিয়া, চীন, ইন্ডিয়া, শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ, ইংল্যান্ড, ফিলিপিনসহ সবার কথার আলাদা ধরণ বুঝতে পারি। এ যেন সিলেট, ঢাকা, রংপুর, পাবনার আঞ্চলিক ভাষার মতো নানান আঞ্চলিকতার টানে কথা বলা।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।