আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

পরকীয়ায় ভাঙছে ঘর : ছন্নছাড়া জীবন সংসার



আট মাস আগে রাজধানীর বাড্ডার নীলা মেহরুনকে বিয়ে করেছিলেন হাসান আলী। নবদম্পতির সংসার-জীবন সুখেই কাটছিল। কিন্তু কিছুদিন আগে হাসান জানতে পারেন প্রিয়তমা স্ত্রী পরকীয়ায় আসক্ত। অন্য যুবকের সঙ্গে রয়েছে স্ত্রীর গোপন প্রণয়। স্বামীর অজান্তে সে মোবাইলে প্রেমিকের সঙ্গে খোশ গল্প করে।

প্রথমদিকে হাসান না বোঝার ভান করে এড়িয়ে যায়। কিন্তু বেশিদিন আর চাপা থাকেনি। হাসান সবকিছু বুঝতে পারেন। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সৃষ্টি হয় বিরোধ। সদ্যবিবাহিত হাসান ক্রমেই ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন।

তিনি স্ত্রীকে হত্যার পরিকল্পনা নেন। বেড়াতে যাওয়ার কথা বলে হোটেল কক্ষ ভাড়া করে ঠাণ্ডা মাথায় স্ত্রীকে খুন করেন। পরে তিনি নিজেই পুলিশের হাতে ধরা দিয়ে অকপটে সবকিছু স্বীকার করেছেন। এ ঘটনা ঘটেছে গত বুধবার রাজধানী ঢাকাতেই। পরকীয়ার কারণে এ ধরনের অসংখ্য ঘটনা প্রায়ই ঘটছে।

শুধু যে স্ত্রীর প্রাণ গেছে তা-ই নয়, স্বামীকেও প্রাণ দিতে হচ্ছে। স্ত্রী তার পরকীয়া প্রেমিক ও ভাড়াটে খুনি দিয়ে স্বামীকে খুন করাচ্ছেন। কখনও বা গর্ভধারিণী মায়ের সামনে সন্তানকেও খুন করার ঘটনা ঘটছে। পরকীয়ার টানে ভেঙে যাচ্ছে সাজানো সংসার। তছনছ হয়ে যায় সংসার-জীবন।

ঘটছে নৃশংস হত্যাকাণ্ড। কেউ বা ঘটনার পর নিজেই পুলিশের হাতে ধরা দেন। কেউ বা গ্রেফতারের পর অকপটেই স্বীকার করেন নিজের কৃতকর্ম। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে মামলা দায়েরের ঘটনাও ঘটছে। এসব ঘটনায় সন্তানের ভবিষ্যত্ হয়ে যায় অনিশ্চিত।

বাবা অথবা মায়ের মৃত্যুর পর অথবা জেলে গেলে সন্তাকে আত্মীয়-স্বজনের কাছে আশ্রয় নেয়া ছাড়া আর উপায় থাকে না। এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কামরুল আহসান চৌধুরী বলেন, দিন দিন সমাজের যে অবক্ষয় হচ্ছে তা থেকে আমাদের নিজেদের পরিবর্তন করে আনা উচিত। বিশেষ করে, আকাশ সংস্কৃতি থেকে যতটা দূরে থাকা যায় ততটাই মঙ্গল। হিন্দি সিরিয়ালগুলো যতটা কম দেখা যায় ততই ভালো। এসব সিরিয়াল থেকে ভালো কিছু শেখা যায় না; বরং অনৈতিক কাজে প্ররোচিত করে।

তিনি বলেন, এক্ষেত্রে রাষ্ট্রের কর্তাব্যক্তিদেরও দায়িত্ব রয়েছে। যারা রাষ্ট্র পরিচালনা করেন, তাদেরও নিজেদের নৈতিক চরিত্রের পরিবর্তন ঘটানো দরকার। ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগ থেকে জানা যায়, প্রতি বছর প্রায় শতাধিক নারীর মৃত্যু হয় পরকীয়ার কারণে। এর মধ্যে বেশিরভাগ মৃত্যু রহস্যজনক বলে রেজিস্ট্রি হয়ে থাকে। গৃহবধূ ছাড়াও স্বামী এবং স্বজনরাও হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়ে থাকেন।

গৃহবধূদের মধ্যে অনেকেই আত্মহত্যা করে থাকেন। আত্মহত্যার ঘটনায় থানায় অপমৃত্যু মামলা হয়। অপমৃত্যুর মামলাগুলোর তদন্তে খুব বেশি অগ্রগতি হয় না। একপর্যায়ে ধামাচাপা পড়ে যায়। ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গের ডোম সেকেন্দার আলী জানান, দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতায় তিনি বুঝতে পেরেছেন গলায় ফাঁস দিয়ে ও বিষপানে আত্মহত্যার বেশিরভাগ ঘটনাই পারিবারিক কলহের জের ধরে ঘটে থাকে।

আর বেশিরভাগ পারিবারিক কলহ সৃষ্টি হয় স্বামী-স্ত্রীর পরকীয়া অথবা সংসারে অভাব-অনটনের কারণে। তবে যৌতুকের কারণেও পারিবারিক কলহ সৃষ্টি হয় বলে মন্তব্য করেন তিনি। শাহবাগ থানার ওসি রেজাউল করিম জানান, বনানীর আবাসিক হোটেলে হাসান আলী তার স্ত্রীকে খুন করেন। হত্যার পর তিনি হোটেল থেকে পালিয়ে যান। পরে হাসান নিজে শাহবাগ থানায় গিয়ে আত্মসমর্পণ করে স্ত্রী হত্যার দায় স্বীকার করায় ঘটনা প্রকাশ পায়।

পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদের আগেই তিনি অকপটে হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা দেন। ওসি বলেন, যে কারণেই হোক স্ত্রীকে তিনি হত্যা করেছেন। পুলিশের হাতে তাকে ধরা দিতেই হতো। বিবেকের তাড়নায় হোক বা ভয়ে হোক, হাসান আইনের হাতে ধরা দিতে বাধ্য হয়েছেন। পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, পরকীয়ার কারণে বিভিন্নভাবে স্ত্রীকে খুন করার ঘটনা ঘটছে।

হোটেলে কক্ষ ভাড়া করে, বাড়ি ভাড়া নিয়ে, বিষপান করিয়ে ও নির্যাতন করে হত্যা করা হয় স্ত্রীকে। এসব হত্যারহস্য উদঘাটনে পুলিশকে বেগ পেতেও হয়। অনেক ঘটনার রহস্য উন্মোচন করাও সম্ভব হয় না। বিশিষ্ট মানবাধিকার নেত্রী বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী অ্যাডভোকেট এলিনা খান জানান, বাবা-মায়ের কারণে অনেক সময় সন্তানরা বিপথগামীও হতে পারে। কোনো কারণে যদি মা অথবা বাবার মৃত্যু হয় অথবা একজন জেলে থাকে, এ অবস্থায় সন্তান নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ে।

এ অবস্থায় বাবার কারণে ঘটনা ঘটলে সন্তানের ভরণ-পোষণের জন্য মা-ই অগ্রাধিকার পান। মা না থাকলে খালা অথবা নানি সন্তানের দায়িত্ব নেন। এলিনা খান বলেন, এ ধরনের পরিবেশে বড় হওয়া সন্তান একদিন তাদের বাবা-মায়ের ঘটনা জানতে পারবে। তাই আগে থেকেই সন্তানকে মানসিকভাবে প্রস্তুত রাখা এবং মনোবিজ্ঞানীর পরামর্শ নেয়া উচিত। কেস স্টাডি : নারায়ণগঞ্জে স্ত্রীর পরকীয়া সম্পর্ক জেনে ফেলায় স্বামীকে ১৩টি নেশাজাতীয় ইনজেকশন পুশ করে অচেতন করে রেখেছিলেন একটি এনজিওর সভানেত্রী রহিমা খাতুন লিজা।

স্বামী আবদুল জলিল ভূঁইয়াকে চারদিন ধরে ঘরের ভেতর শিকল দিয়ে বেঁধে রেখে অবর্ণনীয় নির্যাতন চালানো হয়। লিজার অনৈতিক কর্মকাণ্ড দেখে ফেলায় তিনি তার স্বামী আবদুল জলিল ভূঁইয়াকে প্রেমিক দিপুর সহায়তায় চারদিন ধরে বাড়ির একটি ঘরে ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে হাত-পা শিকল দিয়ে বেঁধে রেখেছিলেন। গত ১৩ অক্টোবর সকালে এলাকাবাসী বিষয়টি টের পেয়ে লিজা ও তার প্রেমিক দিপুকে আটক করে গণপিটুনি দিয়ে পুলিশে সোপর্দ করে। লিজার দেবর আলাল ভূঁইয়া জানান, শহরের পাইকপাড়ার ভূঁইয়াপাড়া এলাকার বাড়িতে তার বড় ভাই আবদুল জলিল ভূঁইয়া স্ত্রী রহিমা খাতুন লিজা ও ২ মেয়ে দোলা ও মৌকে নিয়ে বসবাস করতেন। তিনতলা বাড়িটির মালিক আবদুল জলিল।

এক ও দুইতলা ভাড়া দেয়া হয়েছে। তৃতীয় তলায় ভাই পরিবার নিয়ে বসবাস করতেন। তৃতীয় তলারই দুটি কক্ষে ভাবী লিজার নারী কল্যাণ সংস্থা নামে একটি এনজিও ছিল। লিজা ওই এনজিওর সভানেত্রী। সংস্থার ম্যানেজার ছিলেন দিপু নামের এক যুবক।

ওই যুবকের সঙ্গে লিজার পরকীয়া সম্পর্কের কথা জেনে ফেলায় তার ভাই জলিলকে ঘুমের ইনজেকশন পুশ করে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছিল। আবদুল জলিলকে শিকল দিয়ে ঘরে আটকে রাখার পাশাপাশি এ ঘটনা যাতে তিনি বাইরের কাউকে জানাতে না পারেন, সেজন্য চারদিন ধরে ১৩টি নেশাজাতীয় ইনজেকশন তার শরীরে পুশ করা হয়। খবর পেয়ে পুলিশ দুজনকে গ্রেফতার এবং জলিলকে উদ্ধার করে। গত ১১ জুন স্বামীর পরকীয়ার কারণে রাজধানীর জুরাইনে মা তার দুই অবুঝ সন্তান নিয়ে একসঙ্গে বিষ পান করে আত্মহত্যা করেন। পূর্ব জুরাইনের আলমবাগ এলাকায় সাংবাদিক শফিকুল কবিরের বাসার বেডরুম থেকে তাদের লাশ উদ্ধার করা হয়।

নিহতরা হচ্ছেন সাংবাদিক শফিকুল কবিরের ছেলে রাশেদুল কবিরের স্ত্রী ফারজানা কবির রীতা (৩৫) এবং তার দুই সন্তান কবির ইশরাত পবন (১৩) ও মেয়ে রাইসা রেশমি পায়েল (১১)। নিহতদের আত্মীয়-স্বজনরা অভিযোগ করেন, রীতার স্বামী রাশেদুল কবিরের সঙ্গে স্মৃতি নামে তার এক আত্মীয়ার পরকীয়া ছিল। দেড় বছর আগে তিনি ওই মেয়েকে বিয়ে করেন। এ নিয়ে তাদের দাম্পত্য জীবনে কলহের সৃষ্টি হয়। দ্বিতীয়বার বিয়ের ঘটনাটি ছয় মাস আগে পরিবারের অন্যান্য সদস্য এ সম্পর্কের কথা জানতে পারেন।

এ কারণে দুই সন্তানসহ আত্মহননের পথ বেছে নেন রীতা। এ ঘটনায় শফিকুল কবির, তার ছেলে রাশেদ ও স্মৃতিকে পুলিশ গ্রেফতার করে। এর আগে পরকীয়ার কারণে রাজধানীর আদাবর এলাকায় গত ২৪ জুন পাঁচ বছরের শিশু সামিউলকে মায়ের সামনেই হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় শিশুটির মা আয়শা হুমায়রা ও প্রেমিককে গ্রেফতার করে পুলিশ। এ ঘটনার কিছুদিন পরই গত ৪ আগস্ট খিলগাঁও এলাকায় মায়ের পরকীয়ার কারণে খুন হয় সাড়ে তিন বছরের শিশু তানহা।

শিশুটির লাশ গুম করার জন্য ফ্লাটের কার্নিশ থেকে নিচে ফেলে দেয়া হয়েছিল। এ ঘটনায় পরকীয়া প্রেমিক রেজাউল করিম রাজু ও ইয়াসমানি তমাকে পুলিশ গ্রেফতার করে। নিহত তানহার বাবা ফারুক গাজী সাংবাদিকদের বলেন, পরকীয়ার কারণেই তার জীবনে এ মর্মান্তিক অবস্থার সৃষ্টি হলো।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.