শ্রদ্ধা আর মমতাই তোমাকে জয়ী করতে পারে; তুমি তোমার জ্ঞান প্রয়োগ কর।
অদ্ভুত রহস্যময় জগত এক, ভৌতিক সব কাহিনী তাকে ঘিরে! সেখানে বাস করে প্রাণী, একই সাথে জীবিত ও মৃত। প্রতি মুহূর্তে ভেঙে পড়ে সে জগত, জন্ম নেয় কোটি কোটি নতুন জগত, একই মানুষকে তখন দেখা যায় ভিন্ন ভিন্ন জগতে। নিজেদের সাথে তারা যোগাযোগ করে আলোর চেয়েও দ্রুত গতিতে, একেবারে চিন্তার নিমেষে। বস্তুকণা সেখানে কখনো চলে যায় অতীতে, কখনো ভবিষ্যতে।
আমাদের চেনাজানা জগত থেকে একেবারেই ভিন্ন সে জগত, কোয়ান্টাম বলবিদ্যার জগত!
কিন্তু এসব গল্পে মোটেও ভয় পাবার মেয়ে নয় ফারিন। কোয়ান্টামের ক্ষ্যাপাটে জগতকে জানার আগ্রহ বরং দিন দিন বেড়েই চলে তার। চৌদ্দ চলছে ফারিনের বয়স, এবং সে জানে বড়রা তাকে সেখানে নিয়ে যাবে না, বরং দৈববাণীর মতো বলে উঠবে, "ইঁচড়েপাকা মেয়ে, বড়দের ব্যাপার এসব, তোমাকে নাক গলাতে হবে না। " তাই নিজেই একদিন চুপিচুপি হেঁটে হেঁটে তাদের এলাকা পেরিয়ে দূরে, বহু দূরে কোয়ান্টামের রহস্যময় নগরীর সদর দরজায় কড়া নাড়ল ফারিন।
"কে, কাকে চাই?" নীরব শুনশানভাবে খুলে যায় দরজা, বেরিয়ে আসে শুভ্র চুলের এক বৃদ্ধা।
চুলে তার খেলা করছে আলোর নানান কণার ঢেউ, হারিয়ে যাচ্ছে, আবার উঁকি দিচ্ছে।
"আমি ফারিন, আলোকিত ও অভিযানপ্রিয়। আমি এসেছি কোয়ান্টামের জগত দেখতে। "
মিষ্টি হাসে বুড়ি। "সবাই আমাকে বলে কোয়ান্টাম দিদিমা।
যেহেতু অনেক কষ্ট আর চেষ্টা করে এসেছিস তুই, কোয়ান্টাম জগতের কথা তোকে বলব। আসলে তোদের দেখা জগত আর অদেখা কোয়ান্টাম জগত একই, কেবল ভিন্ন ভিন্ন দুটি স্তর মাত্র, এ কথা বলা যায়। কিন্তু তার আগে তোকে পরীক্ষা করে দেখি, আমার কথা সত্যি সত্যি বুঝবি কি না; কাজেই তোদের দেখা জগত নিয়েই শুরু করা যাক। "
"আচ্ছা। " মাথা নেড়ে দুরুদুরু বুকে মেনে নেয় ফারিন।
"অনেক অনেক বছর আগে পৃথিবীর মানুষ ভাবত ভূমণ্ডল আর নভোমণ্ডলের জন্য রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন নিয়ম। আকাশের বস্তুসমূহ ঘুরতে থাকবে বৃত্তাকার পথে, আর পৃথিবীর বস্তুসমূহ ছেড়ে দিলে পড়তে থাকবে নীচে, এ-ই হচ্ছে নিয়ম। " একটু বলে থামেন কোয়ান্টাম দিদিমা, প্রশ্ন করেন, "নিউটনকে চিনিস?"
"চিনি, চিনি, মহামতি আইজাক নিউটন!" চিৎকার করে উঠে ফারিন। "জ্ঞান-সমুদ্রের তীরে দাঁড়িয়ে নূড়ি-পাথর কুড়িয়েছিলেন তিনি, অনন্ত সমুদ্রের দেখা পাননি বলে আক্ষেপ করেছেন খুব। মস্ত বড় বিজ্ঞানী!" দু'হাত ছড়িয়ে দিয়ে মস্ত ব্যাপারটি বোঝানোর চেষ্টা করে ফারিন।
বিষণ্ণতা ভর করে কোয়ান্টাম দিদিমার চেহারায়। "নিঃসঙ্গ, দুঃখী আর একরোখা মানুষ ছিলেন রে! তাঁর জন্মের পূর্বেই রাজা চার্লসের জন্য যুদ্ধ করতে গিয়ে মারা যান তাঁর বাবা আইজাক নিউটন। দুর্বল ক্লিষ্ট চেহারা আর অনেক ক্ষুদ্র আকৃতি নিয়ে জন্ম, দু'হাতের তালুতেই এঁটে যেত পুরো শরীর—মরে যাবার সব লক্ষণ নিয়েই পৃথিবীতে এসেছিলেন তিনি। এমনকি জন্মের পর নবজাতকের কিছু কাজের জন্য যে দুজন মহিলাকে পাঠানো হয়েছিল বাইরে, তারা হাঁটতে তাড়া অনুভব করছিল না, থেমে থেমে বিশ্রাম নিচ্ছিল বিভিন্ন জায়গায়, কারণ তাদের ফিরে আসার আগেই দুর্ভাগা শিশুটি মারা যাবে, এ ব্যাপারে নিশ্চিত ছিল তারা।
কিন্তু ভুল হয়েছিল তাদের।
যতই দিন যেতে লাগল, জীবনকে শিশুটি আঁকড়ে ধরতে লাগল ক্রমাগত জোরালোভাবে, অদ্ভুত এক একগুঁয়েমি দেখা গেল তার ভেতর, অনন্য এক ইচ্ছাশক্তি। গ্রামবাসীদের আগের এক বিশ্বাস ফিরে আসলো—মৃত পিতার পুত্র, বড়দিনে জন্ম, সাধারণ নয় সে।
জীবনের প্রথম কয়েক বছর নিউটন এত দুর্বল ছিল যে শক্ত গলাবন্ধ পড়ে থাকতে হয়েছিল তাকে, ঘাড়ের উপর মাথাটি যাতে সোজা থাকে। তা সত্ত্বেও জীবনের ঝুঁকিটি যখন রইল না তার, উলসথর্পের শান্ত গ্রামবাসীরা ভাবল, মা ও শিশুটি শান্ত, স্বস্তিদায়ক এক জীবনই কাটাতে যাচ্ছে। আবার ভুল হলো তাদের।
নিউটনের দু'বছর বয়সে বিয়ের প্রস্তাব পান তার মা হান্না আসকিউ নিউটন, ভাই রেভারেন্ড উইলিয়াম আসকিউ'র সাথে কথা বলে সে বিয়েতে মতও দিয়ে দেন তিনি। নানীর কাছে নিউটনকে রেখে নতুন স্বামীর বাড়িতে চলে যান মা।
দুর্বল একগুঁয়ে শিশুর জন্য স্বাভাবিক পরিস্থিতিতেই এটি হয়ে উঠত মর্মন্তুদ অভিজ্ঞতা। আর এটি ১৬৪৫ সালের কথা, ইংল্যান্ডের গৃহযুদ্ধ হানা দিয়েছে শান্ত গ্রামাঞ্চলেও। রাজার তত্ত্বাবধান থেকে উলসথর্প মুক্ত করে ফেলেছে সাংসদগণ, প্রতিদিনই রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে গোলাগুলির আওয়াজ ভেসে আসে।
ভয়ে কেঁপে কেঁপে কেঁদে উঠে সারাক্ষণই মাকে খুঁজত নিউটন, কিন্তু মা তো তার সেই অনেক দূরে!
বৃদ্ধা নানী চেষ্টা করতেন নিউটনকে যথাসাধ্য শান্ত করতে, কিন্তু চারপাশের ঘটনায় তিনি নিজেই প্রচণ্ড আতঙ্কিত। উলসথর্পের সমর্থ সব পুরুষ মারা গিয়েছে যুদ্ধে, অথবা এখনও যুদ্ধ করে যাচ্ছে; পেছনে রয়ে গেছে শুধু ধর্মীয় কাজে নিয়োজিত পুরুষগণ, যুদ্ধের পাশবিকতায় নারী ও শিশুদের রক্ষা করতে।
এ সময়, ১৬৪৯ খ্রিস্টাব্দে স্কুলে যেতে থাকে নিউটন। দুর্বল দেহে অন্যান্য বালকগণ দুরন্ত যেসব খেলা খেলত, সেগুলোতে অংশ নেয়ার সাহস কিংবা আমন্ত্রণ তার ছিল না। এতিম হওয়ার কারণে আর সব শিশুদের কাছে নিজেকে সবসময় ছোট আর অসহায় লাগত তার।
অসহায় ভাবটি তার আরো বেড়ে গেল যখন অলিভার ক্রমওয়েলের নেতৃত্বে পিউরিটান-প্রধান সংসদ রাজার বাহিনীকে পরাজিত করে ফেলে এবং রাজা চার্লসের শিরশ্ছেদ করে, কারণ নিউটন স্বপ্ন দেখত টগবগিয়ে ঘোড়ায় চড়ে কোনো একদিন রাজা নিজেই এসে তাকে উদ্ধার করে নিয়ে চলে যাবে।
মামার সঙ্গ এ সময় প্রেরণাদায়ক হয়ে উঠল নিউটনের কাছে। সৌম্য চেহারার রেভারেন্ড আত্মসমাহিত হয়ে পড়াশোনা করতেন তাঁর গ্রন্থাগারে, আর বিনম্রভাবে কথা বলতেন গ্রামবাসীদের সাথে। ধর্মীয় ও পাণ্ডিত্যপূর্ণ জীবনাচরণকে নিউটন দেখতে পেলেন নিরাপত্তা ও স্বস্তি হিসেবে, ফলে যুদ্ধের বিভীষিকা এড়িয়ে নির্জন শান্ত জায়গায় গভীর চিন্তামগ্ন হয়ে উঠার অভ্যেস গড়ে উঠল তঁর।
এভাবে তরুণ নিউটন প্রকৃতির সাথে একাত্ম হয়ে দেখলেন জীবনের করুণ অস্তিত্বকে সহজেই তিনি ভুলে যেতে পারছেন প্রকৃতির ব্যাপারে নানা প্রশ্নে করে, নানা অনুসন্ধানে।
রঙধনু কেন সবসময় একই রঙে আসে, জোয়ার-ভাঁটা কেন হয়, কেনই হয় চন্দ্রগ্রহণ আর সূর্যগ্রহণ? কিসের টানে চাঁদ ঘুরে পৃথিবীর চারদিকে, পৃথিবী ঘুরে সূর্যের চারদিকে?
সবকিছুই তিনি দেখতেন পরম কৌতূহলে, এমনকি উলসথর্পের ছোট্ট শিশুরা খেলার সময় যখন হাত ধরাধরি করে চক্রাকারে ঘুরত আর গাইত
Ring a-ring o' roses,
A pocketful of posies.
a-tishoo!, a-tishoo!.
We all fall down. ,
তিনি দেখতেন কীভাবে বেঁকে যাচ্ছে শিশুদের শরীর, যেন পেছন থেকে অদৃশ্য কেউ জামা ধরে টানছে তাদের!
এমনি একদিন এক সন্ধ্যায় বাগানে বসে নিউটন ভাবছিলেন নতুন এক গণিতের কথা, কীভাবে জট খোলা যায় তার, একদিন যার নাম হবে ক্যালকুলাস। কৃষ্ণমৃত্যু প্লেগের কারণে তখন বন্ধ হয়ে গিয়েছে ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়, বাড়িতে ফিরে এসেছেন তিনি। টুপ করে এক আপেল এসে পড়ে তার মাথায়, চমকে উঠে উপরে তাকান তিনি—থালার মতো বিশাল চাঁদ উঠেছে পূবের আকাশে।
আপেল সবসময় কেন খাড়া নীচে পড়ে? কেন তীর্যকভাবে পড়ে না? পাশে, উপরে এত জায়গা থাকতেও কেন যায় না সেদিকে?
নিশ্চয়ই কেউ সবসময় আপেলকে নীচের দিকে টেনে রাখে!
সেই জিনিসটি কী?
অনেক চিন্তাভাবনার পর নিজেকেই বললেন নিউটন, নিশ্চয়ই পৃথিবী, পৃথিবী ছাড়া আর কে আছে টানার? আরো ভেবে বের করলেন, পৃথিবী শুধু আপেলকেই টানে না, মহাশূন্যের আরো অনেক বস্তুকেও টানে। পৃথিবীর টানেই চাঁদ ঘুরে তার চারদিকে।
"হ্যাঁ, আমাদের বইয়ে পড়েছি। কিন্তু আমি সবসময় ভাবি, আপেল তো পৃথিবীর বুকে পড়ে যায়, চাঁদটা কেন পড়ে না?" চিন্তামগ্ন হয় ফারিন।
"দড়ির আগায় পাথরের টুকরো বেঁধে গোড়টা হাতে ধরে মাথার চারপাশে ঘুরিয়েছিস কখনো?" দিদিমা প্রশ্ন করেন তাকে।
"হ্যাঁ। "
"পাথরের টুকরা কেন ছিটকে চলে যায় না হাত থেকে, বল তো দেখি?"
"দড়ির সাহায্যে পাথরটা আমি শক্ত করে হাতের দিকে টেনে রাখি, তাই।
" হালকা ঠোঁট টিপে বলে ফারিন।
"হাতের মুঠি ছেড়ে দিলে কী হয়?" দিদিমার প্রশ্ন চলতে থাকে।
"পাথরটা সোজা ছিটকে দূরে চলে যায়। "
"নিউটন ভাবতেন, বিশাল এক অদৃশ্য দড়ি এভাবেই চাঁদকে টেনে ধরে রাখে তার ভ্রমণপথে, আর তাই পাথরের মতো এটি ঘুরতে থাকে। " দিদিমা বলেন।
"কিন্তু এভাবে অদৃশ্য দড়ি আসা কি সম্ভব?" ফারিনের চোখে অবিশ্বাস।
"চুম্বক নিয়ে কখনো খেলেছিস?"
"হ্যাঁ, অনেক। " মাথা নেড়ে নেড়ে বলে ফারিন। "চুম্বক দিয়ে লোহার টুকরো টেনেছি কতো!"
"তাহলে দেখেছিস, চুম্বকটা লোহার টুকরোর সাথে কোনোকিছু দিয়ে না লেগে থাকলেও লোহাটাকে সে ঠিকই টানে। এক হাতে চুম্বক আরেক হাতে লোহা রাখলে, অনুভব করবি চুম্বকটা লোহাসহ হাতকে টানছে।
"
"হ্যাঁ, দিদিমা, ঠিকই বলেছ। "
"এই যে চুম্বকের টান, একেই তুই দড়ির মতো মনে কর, বাস্তবে যদিও দড়িটা নেই। তাতে কী, টান তো আছে। তেমনিভাবে, পৃথিবী যে চাঁদকে টানে, সেই টানকেও তুই একটা দড়ি কল্পনা কর না? তাহলেই দেখবি কত্ত সোজা। "
"হ্যাঁ, এবার বুঝেছি।
কিন্তু চুম্বক তো লোহাকে টানে, কাঠকে টানে না। পৃথিবীও কি এরকম চাঁদের মতো বেছে বেছে কাউকে টানে? আমি বলতে চাচ্ছি, চুম্বকের টান আর পৃথিবীর টান কি এক রকমের?"
"না, একটু চিন্তা করলেই ধরতে পারবি তুই। যেমন, পৃথিবী আম জাম আপেল সব জিনিসকেই টানে, টানে বিমান, চাঁদ, উল্কা, গ্রহ-নক্ষত্র সবাইকে। চুম্বকের টানকে বলে চুম্বক টান বা চৌম্বক বল, পৃথিবীর টানকে বলে অভিকর্ষ। বুঝতেই পারছিস, পৃথিবীর টানের কোনো বাছবিছার নেই, সবাইকে টানে।
"
"পৃথিবী যদি অন্য গ্রহকে টানে, সেই গ্রহও কি একইভাবে পৃথিবীকে টানে?" ফারিনের প্রশ্ন।
"তোর অনেক বুদ্ধি রে! হ্যাঁ, তাই কি হওয়া উচিত না? পৃথিবী যদি মঙ্গল গ্রহকে নিজের দিকে টানে, মঙ্গল গ্রহও পৃথিবীকে নিজের দিকে টানবে, এ-ই স্বাভাবিক। আসলে পৃথিবীর সকল বস্তুই এভাবে একে অপরকে নিজের দিকে টানে। পৃথিবীর বুকের কোনো বস্তু, বাইরের কোনো বস্তু, মঙ্গলের বুকের কোনো বস্তু, মঙ্গলের বাইরের কোনো বস্তু, সবাই সবাইকে ক্রমাগত অদৃশ্য দড়ি দিয়ে টেনে যাচ্ছে। "
"তার মানে একজন মানুষও কি আরেকজন মানুষকে এভাবে টানে?" ফারিনের মনে দ্বিধা।
"হ্যাঁ। "
"কিন্তু তুমি যদি আমাকে তোমার দিকে টানোই, আমি সেই অদৃশ্য দড়িটার টান টের পাই না কেন?"
"তুই যদি দাঁড়িয়ে থাকিস, আর তোর বন্ধু যদি পেছন থেকে ধাক্কা দেয়, কী ঘটবে?"
"ধাক্কার ঠেলায় আমি সামনে চলে যাব, আছাড়ও খেতে পারি। "
"একটা পিঁপড়া যদি তোকে ধাক্কা দেয়?"
"হা হা হা। " একটি পিঁপড়া ধাক্কা দিচ্ছে, ছবিটি মনে ভাসতেই হাসিতে ফেটে পড়ল ফারিন। "আমি তো টেরই পাব না।
" বলে সে।
"একটি মানুষ আরেকটি মানুষকে তার চেয়েও অনেক কম জোরে টানে। "
"কিভাবে জানো?"
"নিউটন নামের মানুষটি শুধু টানের কথাই বলে যাননি, কে কাকে কত জোরে টানে তার অনেক অঙ্কও করে গেছেন। "
"বাব্বা!"
"নিউটনের এই সূত্রের সাহায্যে এভাবে গ্রহ-নক্ষত্রের গতিবিধি সঠিকভাবে হিসেব করা যায়। এমনকি একবার একটি গ্রহ কোথায় আছে, কেমন তার আকার আর গতিবেগ, জানতে পারলে তুই অঙ্ক করে বলে দিতে পারবি, কত দিন পর কোথায় এটি পাওয়া যাবে।
"
"অনেক মজা তো!" হাসিতে উজ্জ্বল হয় ফারিনের মুখ।
"নিউটন যে বছর তার অভিকর্ষ সূত্রটি পূর্ণাঙ্গ করলেন, সেই ১৬৮২ খ্রিস্টাব্দে লন্ডনের আকাশে উদয় হওয়া একটি ধূমকেতুর কথাই ধর। প্রাচীন পুঁথিপত্র ঘেঁটে নিউটনের বন্ধু, মহাকাশবিজ্ঞানী এডমন্ড হ্যালির মনে হলো, এটিই সেই ধূমকেতু শত শত বছর আগে ব্যাবিলন চীন আর গ্রিসের নক্ষত্র-অবলোকনকারীরা তাদের পুঁথিতে বলে গেছে যার কথা। এমনকি ১৬০৭ খ্রিস্টাব্দে একেই দেখেছিলেন বিজ্ঞানী ইয়োহান কেপলার। সবাইকে তাঁর ধারণার কথা বললেন হ্যালি, কিন্তু মানুষ কেবল হাসলো তাঁর কথায়।
কারণ তখন মানুষের বিশ্বাস ছিল, ধূমকেতুরা মহাকাশের কোনো জায়গা একবার অতিক্রম করে চলে যায়, আর ফিরে আসে না। কিন্তু নিউটনের সূত্র প্রয়োগ করে হ্যালি হিসেব করলেন, প্রতি ৭৬ বছর পর ধূমকেতুটি একবার করে আমাদের সৌরজগতে দেখা দিয়ে যায়। সে হিসেবে ১৭৫৮ খ্রিস্টাব্দে পৃথিবীর আকাশে আবার দেখা যাবে একে। " থামলেন দিদিমা।
"তারপর কী হলো?" তীব্র কৌতূহলে জানতে চায় ফারিন।
"হ্যালি জন্মেছিলেন ১৬৫৬ খ্রিস্টাব্দে, শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন ১৭৪২ খ্রিস্টাব্দে, ৮৬ বছর বয়সে। মৃত্যুর আগে বুঝতে পেরেছিলেন, সময় ঘনিয়ে এসেছে তাঁর, ধূমকেতুটিকে আরেক বার দেখে যেতে পারবেন না তিনি। কিন্তু নিখুঁত তাঁর হিসেব, এ বিশ্বাস নিয়ে উত্তরসূরীদের কাছে ধূমকেতুর দায়িত্ব তুলে দিয়ে হাসিমুখে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। "
"কিন্তু ধূমকেতুটির কী হলো?" তীব্র কৌতূহলে আবারও প্রশ্ন করে ফারিন।
"১৭৫৮ খ্রিস্টাব্দে বড় দিনের আগের রাতে লন্ডনের আকাশে ভেসে উঠে হ্যালির ধূমকেতু।
"
"বস্তুর গতি নিয়ে আরো তিনটি সূত্র আবিষ্কার করেন নিউটন। এ সূত্রগুলোর সাহায্যে ভূমণ্ডল ও নভোমণ্ডলের সকল বস্তুর চলাচল ব্যাখ্যা করা যায়, সবার জন্য একই নিয়ম, নীচে উপরে কোনো ভিন্নতা নেই। " কোয়ান্টাম দিদিমা বলতে থাকেন। "পরবর্তী বিজ্ঞানীরা এগিয়ে নিয়ে যান নিউটনের কাজ, পৃথিবীতে শুরু হয় বৈজ্ঞানিক নিশ্চয়তাবাদের (Scientific Determinism) যুগ। সমীকরণের সাহায্যে অঙ্ক করে সব বলে দেয়া সম্ভব, অনেক বিজ্ঞানী বিশ্বাস করা শুরু করলেন।
এবং নিউটনের প্রায় একশ বিশ বছর পর, ফ্রান্সের পিয়েরে সাইমন ল্যাপ্লাস ঘোষণা করেন, "মহাবিশ্বের বর্তমান অবস্থাকে আমরা বিবেচনা করতে পারি তার অতীত কোনো অবস্থার ফলাফল হিসেবে এবং ভবিষ্যতের কোনো অবস্থার কারণ হিসেবে। কোনো এক মহাসত্তা যদি কোনো এক মুহূর্তে পৃথিবীর সকল বলের মান এবং সকল বস্তুকণার পারস্পরিক অবস্থান জানতে পারে, এবং উক্ত মহাসত্তা যদি এতই বিশাল হয় যে সকল উপাত্ত বিশ্লেষণ করতে পারে, তাহলে সে এমন একটি মাত্র সূত্র তৈরি করতে পারবে যার দ্বারা সে বৃহত্তম বস্তুসমূহ থেকে শুরু করে ক্ষুদ্রতম কণাসমূহের গতিবিধি নিখুঁত হিসেব করতে পারবে; উক্ত মহাসত্তার কাছে কোনোকিছুই অনিশ্চিত থাকবে না এবং ভবিষ্যত তার কাছে অতীতের মতোই সুস্পষ্টভাবে প্রকাশিত হবে। "
"তার মানে কেউ একবার মহাবিশ্বের সব ঘটনা জেনে গেলে, পরে কী হবে সব হিসেব করে বের করে ফেলবে?" ফারিনের চোখ বড় হয়ে উঠে।
"হ্যাঁ, তিনি এবং অনেকে এ ধারণাই পোষণ করতেন। তাদের মতে, সবকিছুই চলে নিখুঁত অঙ্কের হিসেবে; একটি ঘটনা জন্ম দেয় আরেকটি ঘটনার, সেটি আবার জন্ম দেয় আরেকটি ঘটনার, এভাবে ঘটনার পর ঘটনা ঘটতে থাকে, কিন্তু সবই সুনির্দিষ্ট ছকে।
"
"বিজ্ঞানীদের কাছে নিশ্চয়তাবাদ বেশ আকর্ষণীয়;" বলেন দিদিমা, "সবই সমীকরণ, হতেও পারে, না-ও হতে পারে, এরকম কোনো ব্যাপার নেই এখানে। হবেই, এটিই হচ্ছে কথা; নেই কোনো অন্যথা, নেই কোনো অনিশ্চয়তা। "
"মজাই তো!"
"হ্যাঁ, তবে সমস্যাও আছে, কেউ যখন একে সবকিছুতে মিলিয়ে দিতে চায়, যখন বলে, মানুষের আচরণ ব্যবহার এসবও নিশ্চয়তাবাদের অংশ। তার মানে কেউ যদি কাউকে গালি দেয়, আঘাত করে, মেরে ফেলে, তা হচ্ছে অতীতের কোনো ঘটনার ফলাফল মাত্র, যার উপর আঘাতকারীর কোনো হাত বা প্রভাব নেই। "
"ইশশ, এ কেমন কথা!" অবাক হয় ফারিন।
"হ্যাঁ। যাক, সেটি আরেক প্রসঙ্গ। " দিদিমা বলেন।
"বিংশ শতাব্দির গোড়ার দিকে একদল বিজ্ঞানী যখন উন্মোচিত করতে থাকে বিশালকায় মহাশূন্যের রহস্য, আরেক দল তখন যেতে লাগল পদার্থের ভেতরে, গভীরতম প্রদেশে—ইলেকট্রন, প্রোটন ও নিউট্রনের বিস্ময়কর জগতে। বড় ধাক্কাটি আসলো সেখান থেকেই!
১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে জার্মানির ওয়ার্নার হাইজেনবার্গ প্রমাণ করলেন, ল্যাপ্লাসের বিশ্বাস ঠিক নয়!" থামলেন কোয়ান্টাম দিদিমা।
[ক্রমশ]
______________________
পোস্টের সূচনাভঙ্গিটি পরীক্ষামুলক, পরিবর্তিত হতে পারে। — লেখক
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।