আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মাথার ভেতর সিলিকন চিপ



কম্পিউটারের মেমোরি কার্ড আপনি মাথার ভেতরে লাগিয়ে নিয়ে ঘুরছেন, প্রয়োজনের মুহূর্তে তাই-ই আপনাকে তথ্যের যোগান দিয়ে সাহায্য করছে! কী স্বপ্ন মনে হচ্ছে? আপনার স্বপ্ন মনে হতেই পারে; মনে হতে পারে আপনি কোন সায়েন্স ফিকশনের কেন্দ্রীয় চরিত্রের কথা পরছেন। না, আপনি কিন্তু সত্যি সত্যিই মাথায় অমন মেমোরি কার্ড বর্তমান যুগেও লাগাতে পারেন- তবে তা কোন সায়েন্স ফিকশনের মতো এখনোও ঠিক ভালোভাবে ব্যবহার করতে পারবেন না। সম্প্রতি একদল বিজ্ঞানী এ বিষয়ে বেশ অনেকখানি ধাপ এগিয়েছেন। ইউনিভার্সিটি অব সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়ার একদল গবেষক যন্ত্রের দ্বারা মনের বা মস্তিষ্কের কথা কাজে রূপান্তরের ক্ষেত্রে বেশ কিছুটা সক্ষম হয়েছেন। তারা একটি ইঁদুরের মস্তিষ্কের নষ্ট হয়ে যাওয়া স্নায়ুকোষকে প্রতিস্থাপনের সফল পরীক্ষার মাধ্যমে এই সিদ্ধান্তে উপনিত হন।

গত বেশ কয়েক বছর ধরে গবেষকরা একটি মাধ্যমের অন্য সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী আরেকটি মাধ্যমের চিন্তাধারাকে কাজে পরিণত করার সামর্থ্য বা ক্ষমতাকে বেশ গুরুত্বের সাথে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছিলেন। সরলভাবে, একটি সৃষ্টির অন্য আরেকটি সৃষ্টির চিন্তাধারাকে প্রথম সৃষ্টির কাজে পরিণত করার ক্ষমতাকে লক্ষ্য করছিলেন। ২০০০ সালে ডিউক ইউনিভার্সিটির স্নায়ুবিদ মিগুয়েল নিকোলেলিস একটি বানরের মস্তিষ্কে ইলেক্ট্রোড স্থাপন করেছিলেন যার দ্বারা বানরটি তার চিন্তা দিয়ে একটি যান্ত্রিক হাত নাড়াতে পারে। এর কিছু পরে জার্মানির টুবিঞ্জেন ইউনিভার্সিটির স্নায়ু বিজ্ঞানী নিলস্ বার্বোমার একটি ব্রেইন-মেশিন ইন্টারফেস বা ‘মস্তিষ্ক-যন্ত্র সমন্বায়ক’ উদ্ভাবন করেন যা ইতিমধ্যেই বেশ কয়েকজন পক্ষাঘাত আক্রান্ত ব্যাক্তিকে তাদের মস্তিষ্কের সাহায্যে কম্পিউটারের কার্সর নিয়ন্ত্রন করে বিভিন্ন বর্ণমালা নির্দেশের মাধ্যমে ক্ষুদে বার্তা লিখতে সক্ষম হোন। ইউনিভার্সিটি অব সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়ার একদল গবেষক থিওডোর ডব্লিউ বার্গারের নেতৃত্বে প্রথমবারের মতো এমন একটি ‘মস্তিষ্ক-যন্ত্র সমন্বায়ক’ উদ্ভাবন করেন যা কি না মস্তিষ্কের ভেতরের সংবেদনশীল জৈবিক তথ্যের বা স্নায়ুর সংকেত পাঠ করে সে আনুযায়ী যে কাজ সম্পন্ন করতে হবে তার জন্য নির্দিষ্ট সংকেত পুনরায় তৈরি করে স্নায়ুর সংকেত হিসেবে মস্তিষ্কে প্রেরণ করে কাজটি সম্পন্ন করতে সক্ষম।

তারা এ কাজের জন্য একটি সিলিকন চিপ নির্মিত কৃত্রিম স্নায়ু সার্জিকাল অপারেশনের মাধ্যমে ইঁদুরের মস্তিষ্কের হিপোক্যাম্পাসের কিছু স্নায়ু কেটে প্রতিস্থাপন করেন। হিপোক্যাম্পাস জীবের স্মৃতি সংগ্রহ, বাছাই এবং সংরক্ষণ করে থাকে। পরীক্ষায় দেখা গেছে যে, কৃত্রিম স্নায়ু তার দ্বারা প্রতিস্থাপিত স্নায়ুর মতোই পূর্বের ন্যায় জৈবিক স্নায়ুর সংকেত গ্রহন করে তা সংগ্রহ, বাছাই এবং সংরক্ষণ করার মাধ্যমে প্রায় শতকরা ৯০ ভাগ কাজ সঠিকভাবে করতে সক্ষম হয়েছে। হিপোক্যাম্পাস আসলে প্রাণীর জৈবিক বিশ্লেষক ‘হাব’। কম্পিউটার নেটওয়ার্কিংয়ে এক কম্পিউটার থেকে তথ্য অন্য আরেক কম্পিউটারে আদান-প্রদানের কাজটি করে থাকে ঠিক আনুরূপ কাজ প্রাণীর ক্ষেত্রে করে থাকে হিপোক্যাম্পাস ।

হিপোক্যাম্পাস বাহ্যিক পরিবেশ থেকে নানা ইন্দ্রীয়ের মাধ্যমে সংকেত ধারন করে সে অনুযায়ী প্রাণীকে সঠিক কাজটি করায়- স্নায়বিক সংকেতের মাধ্যমে। বিগত বছরগুলোতে জৈব-চিকিৎসা প্রকৌশলীরা অনেকবারই কোন চিপকে প্রায় হিপোক্যাম্পাসে প্রতিস্থাপনের কাছাকাছি নিয়ে আসলেও তা কোনো না কোনো বাধার সম্মুখীন হয়েছে। প্রচলিত ইলেক্ট্রোড অ্যারে প্রযুক্তি আর যেখানেই ভালোভাবে কাজ করুক না কেনো তা হিপোক্যাম্পাসে স্নায়ু তন্তুর বিকল্প হিসেবে তেমন কোন কাজেই তারা আসেনি। যার ফলে গবেষকদের নতুন জৈবিক পরিবেশে জৈব সংকেত নিয়ে কাজ করার জন্য সম্পূর্ণ নতুন ধরনের চিপ আবিষ্কারের দিকে ঝুঁকতে হয়েছে। তাছাড়া কেটে বাদ দেয়া অংশের স্নায়ু ছিদ্র বা পথকে ঠিক আগের মতো কার্যকর রাখাটাও বেশ দুরূহ কাজ।

যেহেতু এক বর্গ মিলিমিটার চিপ তৈরি করতে প্রায় মিলিয়ন ডলার খরচ হয় এবং তা বানাতে কয়েক মাস সময় লাগে, সে কারণে ইউনিভার্সিটি অব সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়ার গবেষক দলটি এই চিপের মডেলে তৈরি একটু বড় আকারের চিপ ব্যাবহার করেন। এই চিপটি এমন যে, একে পুনরায় প্রোগ্রাম করা যায় যা কম্পিউটারের সাথে যুক্ত। এর প্রযুক্তিগত প্রচলিত নাম ফিল্ড প্রোগ্রামেবল গেট অ্যারে বা এফপিজীএ (FPGA)। ব্রেইন চিপ আবিষ্কারের জন্য প্রথমেই থিওডোর ডব্লিউ বার্গারের যে কাজটি করতে হয়েছে তা হল স্নায়ু যোগাযোগের বিশাল নেটওয়ার্ক এর নাট-বল্টু খুঁজে বেড়ানো। দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে তিনি ইঁদুরের হিপোক্যাম্পাল স্নায়ু তন্তুর স্নায়ুকে বৈদ্যুতিক স্টিমুলেশনের বিভিন্ন প্যাটার্নের মাধ্যমে পরীক্ষা চালান।

ইঁদুরের এর প্রতি কি ধরনের প্রতিক্রিয়া হয় তা রেকর্ড করে স্নায়ুর সংবেদনশীলতার একটা বেশ গোছানো বড় তথ্য ভান্ডার সৃষ্টি করেছেন। তার দুই সহকর্মী ভাসিলিস মার্মাসিলিস এবং জন গ্রানাকি এই স্নায়ুর সংবেদনশীলতার তথ্যভান্ডারের স্নায়ুর বিভিন্ন সংবেদনের জন্য গাণিতিক সমীকরন তৈরি করেন এবং এই গাণিতিক সমীকরনকে যন্ত্রের ভাষায় রূপান্তর করতে সক্ষম হোন। FPGA গবেষকদের স্নায়ুর নতুন এই গাণিতিক সমীকরনের ব্যবহারিক পরীক্ষার সুযোগ করে দেয়। ইঁদুরের উপর FPGA এর এই পরীক্ষার দ্বারা গাণিতিক সমীকরনের পরিবর্তন ও পরিবর্ধনের মাধ্যমে গবেষকরা স্নায়ু যোগাযোগের জন্য নতুন চিপ উদ্ভাবনের পথে বেশ এগিয়েছেন। ওয়েক ফরেস্ট ইউনিভার্সিটির শরীরতত্ত্ববিদ্যা ও ওষুধতত্ত্ববিদ্যার অধ্যাপক স্যাম ডেডওয়েলার লক্ষ্য করেছেন যে, জীবন্ত ইঁদুরের হিপোক্যাম্পাসে নির্দিষ্ট কিছু বৈদ্যুতিক স্টিমুলেশনের মাধ্যমে স্মৃতির কাজ খুব লক্ষ্যনীয়ভাবে বাড়ানো যায়।

তিনি বেশ কিছু মাস ধরে FPGA এর নতুন ধরনের এই স্নায়ুর গাণিতিক সমীকরনের মডেলের সাহায্যে ইঁদুরের হিপোক্যাম্পাস কিভাবে কাজ সম্পাদনের জন্য বিভিন্ন জৈবিক তথ্য আদান প্রদান করে তা নির্ণয়ে পরীক্ষা চালিয়ে যাচ্ছেন। যদি স্নায়ুর গাণিতিক সমীকরনের মডেলের এই পরীক্ষা সফল হয় তবে, ইঁদুরের হারানো স্মৃতি এই কৃত্রিম চিপ ইঁদুরের হিপোক্যাম্পাসে প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে পুনরায় ফিরে পাওয়া সম্ভব হবে। আরো উন্নত প্রাণীর জন্য ইউনিভার্সিটি অব সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়ার পদার্থবিদ আর্মান্ড ট্যাঙ্গাই তথ্য আরো ভালভাবে আদান-প্রদানের জন্য মাল্টিচিপ মডিউল ব্যবহারের পরামর্শ দেন। তরঙ্গরশ্মি মাল্টিচিপ মডিউলের বিভিন্ন স্তরের সংকেত স্নায়ুতন্ত্রের একক স্নায়ু কোষ বা নিউরনে পাঠাবে। তারের ক্ষেত্রে সূক্ষ্ম নিউরনের সাথে যোগাযোগের জন্য নেটওয়ার্ক সৃষ্টি করা বা সঙ্কেত বাধাহীনভাবে পরিবহন করা দুঃসাধ্য একটি কাজ।

অন্যদিকে, তরঙ্গরশ্মি কোন মাধ্যম ছাড়াই তথ্য আদান-প্রদানে সক্ষম এবং সহজেই তা সিলিকন চিপের মধ্যে সূক্ষ্ম নিউরনের সাথে যোগাযোগের জন্য অতি সহজেই বিশাল নেটওয়ার্ক সৃষ্টি করতে পারে। ইউনিভার্সিটি অব সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়ার গবেষক দল প্রথমে ঠিক বুঝতে পারছিলো না জীবন্ত প্রাণী দেহে এই চিপ প্রতিস্থাপন করলে ঠিক কি ধরনের ফলাফল তারা আশা করবে। জীবন্ত প্রাণী দেহে বাহির হতে কোনো কিছু জীব এবং জড় কোনো বস্তু যদি প্রবেশ করে তা প্রাণী দেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার সম্মুখীন হয়। রোগ প্রতিরোধতন্ত্র থেকে ছাড় না পাওয়া পর্যন্ত প্রাণী দেহের ভেতর কোন কিছুই ঠিক ভাবে কাজ সম্পন্ন করতে পারে না। গবেষক দলের রসায়নবিদ মার্ক থমসনের ভাষ্যমতে, রোগ প্রতিরোধতন্ত্রের বাধা না পেয়ে কোন বস্তুর দেহের ভেতরে নির্বিঘ্নে কাজ চালিয়ে যাওয়ার অর্থ হচ্ছে রোগ প্রতিরোধতন্ত্র চিপকে তার দেহের তন্ত্রগুলোর কোন অংশ বলে মনে করছে।

মস্তিষ্কের সাথে অন্যান্য অংশের নিবিড় সংযোগ বা মস্তিষ্কের কোন বস্তুকে চিন্তে পারার ক্ষমতা বা নিউরাল প্লাস্টিসিটিও চিপের সাথে মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষের একটি স্থায়ী সংযোগ তৈরিতে বড় বাধা হয়ে দেখা দিতে পারে । “মস্তিষ্কের অন্যান্য অংশগুলো যেমন মোটর নিয়ন্ত্রক বা ইন্দ্রীয়ের কাজ নিয়ন্ত্রক অংশ, কোন কাজ সুচারুরূপে করতে পারার ক্ষমতা এবং পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে নেয়ার ক্ষমতা নিয়ন্ত্রক অংশগুলোর এই কৃত্রিম চিপের উপর কি ধরনের প্রভাব ফেলবে তাও দেখার বিষয়”-বেশ উৎসাহী কন্ঠে আশাবাদ ব্যক্ত করেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হেলথ ডিভিশন অব ডিসকভারি সায়েন্স এন্ড টেকনোলজির প্রোগ্রাম ডিরেক্টর গ্রেস পেং । এই ইঁদুরের উপর পরীক্ষা-নিরীক্ষা সফল হলে, গবেষক দলটি মানুষের জন্য নির্মিত চিপের মডেলটি বানরের মস্তিষ্কে স্থাপনের মাধ্যমে উন্নত প্রাণীদের উপর এর প্রতিক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করবে। মানুষের জন্য উন্নত মডেল নির্মাণের উদ্দেশ্যে মানুষের মস্তিষ্কের উপর পরীক্ষা-নিরীক্ষা কোখনই গ্রহণযোগ্য নয়। যদিও বানরের মস্তিষ্কে পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফলাফল একেবারে নিঁখুত না হলেও তা মানুষের মস্তিষ্কে প্রতিস্থাপনযোগ্য মডেল উদ্ভাবনে বিশেষ সাহায্যে আসবে।

এটা যদি মানুষের মস্তিষ্কে স্থাপন করা যায় তবে তা আবার নতুন প্রশ্নেরও জন্ম দেবে- মস্তিষ্কে হিপোক্যাম্পাসে স্থাপনের মাধ্যমে এর ক্ষতিগ্রস্থ স্নায়ুকোষ সারিয়ে তোলার সময় এটি কি মস্তিষ্কের অন্যান্য অংশেও প্রভাব ফেলবে? মস্তিষ্কের যে অংশ আমাদের চিন্তাধারাকে নিয়ন্ত্রণ করে আমাদের স্মৃতি থেকে তথ্য সরিয়ে দেয় তাকে কি নিয়ন্ত্রণ করা যাবে? অর্থাৎ আমরা কি আমাদের স্মৃতি স্থায়ীভাবে ধরে রাখতে পারবো? যদি এ কাজ করা সম্ভব হয় তবে যন্ত্রটি সত্যিকার অর্থেই একটি চিরস্থায়ী স্মৃতিধারক যন্ত্রে পরিণত হবে। (সমাপ্ত)

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.