সদ্য স্বাধীন দেশ বছর ঘুরে তৃতীয় বছরে পা দি দিতে না দিতেই ই জনগণের প্রত্যাশার আলো ধপ করে নিভেগেলো । আমদানী আর বিতরণ পক্রিয়ার প্রত্যেকটি স্তরে দুর্নীতি , কালোবাজারী , চোরাচালান ইত্যাদির বদৌলতে খাদ্য সরবরাহ অবনতির দিকে ধাবিত হতে লাগলো । মানুষ খেকো বাঘের মতো দুর্ভিক্ষ সারাদেশে সদর্পে ছেয়ে গেল ।
গ্রাম গুলোতে মশা-মাছির মতো মানুষ মরতে শুরু করলো । মুজিব নিজেই সরকারী ভাবে স্বীকার করেছে ২৭,০০০ লোক মারা গিয়েছে ।
এই হিসাবটা যথেস্ট কম ছিল । শুধু উপোস করাই নয় তার ফলশ্রুতিতে পুষ্টিহীনতা , টিকে থাকার ক্ষমতা হ্রাস ইত্যাদি কারনে ম্রেছে আরও অনেক বেশী । কিছু কুটনৈতিক অনুমান করছেন এই দুর্ভিক্ষে নিদেনপক্ষে ১০ লক্ষ মানুষ মারা যেতে পারে।
একজন গবেষকের মতে, চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষের কারণে কমপক্ষে পনেরো লক্ষ ।
বাংলাদেশী প্রাণ হারায়।
এদের সবাই মারা যায়নি দুর্ভিক্ষের সময়। প্রায় সাড়ে চার লাখ মারা যায় দুর্ভিক্ষের পরের মাসগুলোতে, অপুষ্টি ও বিভিন্ন রোগের কারণে। এদের বেশি মারা যায় কলেরা জাতীয় রোগে। এর কারণ, ঘরে খাবার না থাকায় মানুষ পঁচা, অখাদ্য খাবার খেয়ে বাঁচতে চেষ্টা করেছে। ওপরের এই তথ্য পাওয়া যায় Alagmir, M. (1980). Famine in South Asia: Political economy of mass starvation. Massachusetts: Oelgeschlager, Gunn & Hain বইটিতে।
[In terms of total mortality, though figures vary, one scholar estimates 1.5 million deaths as a reasonable estimate. This number includes the post-famine mortality. Starvation was not the only factor; a significant number of deaths are attributable to diseases, cholera, malaria and diarrheic diseases. As with most famines, weakened, disease-susceptible conditions resulted in high post-famine mortalities of over 450,000.]
অগাস্ট ১৪, ১৯৭৪ শেখ মুজিবর রহমান সকল দাতা দেশের কাছে ত্রানের আহ্বান জানান। তিনি বলেছেন, বন্যায় ফসলের যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে এবং এর ফলশ্রুতিতে উদ্ভুত দুর্ভিক্ষ এড়াতে দ্রুতই বৈদেশিক সাহায্য প্রয়োজন।
শেখ মুজিব জেনারেল অ্যাসেম্বলিতে ভাষণ দিতে নিউইয়ারক যাওয়ার প্রক্কালে ২৩শে সেপ্টেম্বর সারাদেশে ৪৩০০ লঙ্গরখানা খোলার কথা ঘোষণা করা হয় এবং শেষ পর্যন্ত ৫৭০০ লঙ্গর খানা খোলা হয়েছে । সে সমস্ত লঙ্গরখানার ইতিহাস আর এক করুণ কেলেঙ্কারীর ইতিহাস।
লাখে লাখে মানুষ গ্রাম ছেড়ে খাবারের সন্ধানে রাজধানীর দিকে পঙ্গ পালের মত ছুটে আসছে , তাদের প্রত্যাশা ছিল মুজিব তাদের জন্য দু’মুঠো খাবারের ব্যাবস্তা করবেন ।
কিন্তু বাস্তব ঘটনা তাদের জঠর জ্বালা নিভানোর কোন ব্যবস্তা করতে পারে নাই বঙ্গবন্ধু ।
তার ক’দিন পরেই ৬ই অক্টেবর ইত্তেফাক খবর দেয় যে, ২১ লাখ টাকার বিদেশী মদ ও সিগারেট আমদানি করা হয়েছে সরকারি টাকায়। ঐ দিনই খাদ্যমন্ত্রী বললেন, “তখন পর্যন্ত অনাহারে কতলোক মরেছে সরকারের তা জানা নেই। প্রকাশিত পত্রিকাগুলোর খবর অতিরঞ্জিত। ” তবে তিনি স্বীকার করেন চোরাচালান কিছুটা হয়েছে।
হাজার হাজার ছিন্নমুল জনতা ঢাকায় চলে এলে সরকার বিব্রত হয়ে পড়ে ।
১৯৭৪ সালে ১৮ অক্টোবর বোষ্টনের ক্রিশ্চিয়ান সায়েন্স মনিটরে ডানিয়েল সাদারল্যান্ড লিখেছিলেন, “গত দুই মাসে যে ক্ষুধার্ত জনতা স্রোতের মত ঢাকায় প্রবেশ করেছে,তাদের মধ্যে সরকারের সমর্থক একজনও নেই। বন্যা আর খাদ্যাভাবের জন্য গ্রামাঞ্চল ছেড়ে এরা ক্রমেই রাজধানী ঢাকার রাস্তায় ভিক্ষাবৃত্তির আশ্রয় নিচ্ছে। কিন্তু মনে হচ্ছে সরকার এদেরকে রাজপথের ত্রিসীমানার মধ্যে ঢুকতে না দিতে বদ্ধপরিকর। এরই মধ্যে বেশ কিছু সংখ্যককে বন্দুকের ভয় দেখিয়ে ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
সেখানে সারাদিন দুই এক টুকরা রুটি খেতে পাওয়া যায, মাঝে মাঝে দুই-একটা পিঁয়াজ ও একটু-আধটু দুধ মেলে। ক্যাম্পে ঢুকলে আর বের হওয়া যায় না। “যে দেশে মানুষকে এমন খাঁচাবদ্ধ করে রাখা হয় সেটা কি ধরনের স্বাধীন দেশ”- ক্রোধের সাথে বলল ক্যাম্পবাসীদেরই একজন। ক্যাম্পের ব্লাকবোর্ডে খড়িমাটি দিয়ে জনৈক কর্মকর্তা আমার সুবিধার্থে প্রত্যেকের রুটি খাওয়ার সময়সূচীর তালিকা লিখে রেখেছেন। “তালিকায় বিশ্বাস করবেন না”-ক্যাম্পের অনেকেই বলল।
তারা অভিযোগ করল যে, রোজ তারা এক বেলা খেতে পায়- এক কি দুই টুকরা রুটি। কোন এক ক্যাম্পের জনৈক স্বেচ্ছাসেবক রিলিফকর্মী জানাল যে, “সরকারী কর্মচারীরা জনসাধারণের কোন তোয়াক্কা করে না। তারা বাইরের জগতে সরকারের মান বজায় রাখতে ব্যস্ত। এ কারণেই তারা লোকদেরকে রাস্তা থেকে ধরে নিয়ে যাচেছ। বিদেশীরা ভূখা-জনতাকে রাস্তায় দেখুক এটা তারা চায় না।
”
১৯৭৫ সালে ৩রা জানুয়ারি “ ঢাকা শহর পরিচ্ছন্ন “ করার জন্যে এক ব্যাপক অভিযান চালিয়ে প্রায় দুই লক্ষ ছিন্নমূল আর আর বস্তিবাসী জনতাকে তাদের গ্রামের বাড়িতে অথবা সরকার সৃষ্ট “ক্যাম্পে” যেতে বাধ্য করেন ।
১৮ই ফেব্রুয়ারি ১৯৭৫ সালে গার্ডিয়ান পত্রিকায় ঐ ক্যাম্পটিকে “মুজিবের লোকদের সৃষ্ট দুর্যোগ এলাকা “ নামে আখ্যায়িত করেছিল । ঐ ক্যাম্পের অবস্তা এতই অমানবিক ছিল যে , সেখানে একজন সাংবাদিক দেখতে গেলে , এক হতভাগ্য ছিন্নমূল ক্যাম্পবাসী বুড়ো বলেছিল , “আমাদের খাইতে দেন, আর না হয় গুলি কইরা মারেন “ ,
“একটি তিন বছরের শিশু এতই শুকনো যে, মনে হল সে যেন মায়ের পেটে থাকাকালীন অবস্থায় ফিরে গেছে। আমি তার হাতটা ধরলাম। মনে হল তার চামড়া আমার আঙ্গুলে মোমের মত লেগে গেছে।
এই দুর্ভিক্ষের আর একটি ভয়ঙ্কর পরিসংখ্যান এই যে, বিশ্বস্বাস্থ্ সংস্থার মতে ৫০ লাখ মহিলা আজ নগ্ন দেহ। পরিধেয় বস্ত্র বিক্রি করে তারা চাল কিনে খেয়েছে। ”
“সন্ধা ঘনিয়ে আসছে এবং গাড়ী আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলাম-এর লরীর পিছনে পিছনে চলেছে। এই সমিতি ঢাকার রাস্তা থেকে দুর্ভিক্ষের শেষ শিকারটিকে কুড়িয়ে তুলে নেয়। সমিতির ডাইরেক্টর ডাঃ আব্দুল ওয়াহিদ জানালেন,“স্বাভাবিক সময়ে আমরা হয়ত কয়েক জন ভিখারীর মৃতদেহ কুড়িয়ে থাকি।
কিন্তু এখন মাসে অন্ততঃ ৬০০ লাশ কুড়াচ্ছি- সবই অনাহার জনিত মৃত্যু। ”
উপরের এই প্যারা দুটি প্রখ্যাত তথ্য-অনুসন্ধানী অষ্ট্রেলিয়ান সাংবাদিক জন পিলগার লিখা। লেখাটি ছাপা হয়েছিল ১৯৭৪ সালের ১৭ই ডিসেম্বর লন্ডনের ডেইলী মিরর পত্রিকায়।
তবে আশ্চর্যজনক সত্য হলো, অনুমাণ করা হচ্ছে ফসলের উৎপাদনে ঘাটতি ছিলো না বাংলাদেশে, বরং সেখান থেকে আনুমানিক ১ মিলিয়ন টন খাদ্যশস্য বিদেশে অবৈধভাবে পাচার করা হয়েছে। যা দিয়ে অন্তত দুর্ভিক্ষপীড়িত বাংলাদেশের মানুষদের ৬ সপ্তাহ খাওয়ানো যেতো।
'কিছু কিছু জায়গায় মানুষ ঘাস-পাতা খেয়ে আছে। এমন কেন হবে? 'এই প্রশ্নের উত্তরে মুজিব বলেন 'দেখুন কিছু কিছু জায়গায় এরকম হতে পারে। তবে সবজায়গায় আমাদের লঙ্গরখানা আছে।
মৃতের সংখ্যার ব্যাপারে জানায় 'আমার এসব তথ্য চেপে রাখার চেষ্টা করিনি। আমরা পার্লামেন্টে বলেছি প্রায় সাতাশ হাজারের মতো মানুষ না খেয়ে ও অসুখে মারা গেছে।
' পিলগার বলেন 'আমি কিন্তু দেখেছি সরকারী লঙ্গরখানাগুলোতে থেকে মানুষকে ফিরিয়ে দেয়া হচ্ছে এবং লাখ লাখ মানুষ খাদ্য পাচ্ছে না' 'এটা সত্যি নয়,' মুজিবের উত্তর। 'আপনি যেরকম বললেন সেটা সত্যি হলে কয়েক মিলিয়ন লোক মারা যেত। '
শেখ মুজিবকে প্রশ্ন করা হলো, খাদ্যশস্যের অভাবের ফলে দেশে মৃত্যুর হার ভয়াবহ হতে পারে কিনা, শেখ মুজিব জবাব দিলেন, ‘এমন কোনো আশঙ্কা নেই। ’ প্রশ্ন করা হলো, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, পার্লামেন্টে বিরোধী দল বলে যে, ইতিমধ্যেই ১৫ হাজার মানুষ মারা গেছে। ’ তিনি জবাব দিলেন, ‘তারা মিথ্যা বলেন।
’ তাঁকে বলা হলো, ‘ঢাকার বিদেশি মহলে মৃত্যুর সংখ্যা আরও বেশি বলে উল্লেখ করেন। ’ শেখ মুজিব জবাব দিলেন, ‘তারা মিথ্যা বলেন। ’ প্রশ্ন করা হলো, দুর্নীতির কথা কি সত্য নয়? ভুখাদের জন্য প্রেরিত খাদ্য কি কালোবাজারে বিক্রি হয় না...? শেখ মুজিব বললেন, ‘না। এর কোনোটাই সত্য নয়। ’ (এন্টারপ্রাইজ, রিভারসাইড, ক্যালিফোর্নিয়া, ২৯/০১/৭৫)।
অবশেষে পত্রিকাটি তাদের মন্তব্যে লিখে ‘যেসব সমস্যা তার দেশকে বিপর্যস্ত করছে সে সবের কোনো জবাব না থাকায় শেখের একমাত্র জবাব হচ্ছে তার নিজের একচ্ছত্র ক্ষমতা বৃদ্ধি। জনসাধারণের জন্য খাদ্য না হোক, তার অহমিকার খোরাক চাই। ’ (এন্টারপ্রাইজ, রিভারসাইড, ক্যালিফোর্নিয়া, ২৯/০১/৭৫)।
দেখুন John Pilger - An Unfashionable Tragedy [1975]
১৯৭৪ সালে ২রা অক্টোবর প্রকাশিত লন্ডনের গার্ডিয়ান পত্রিকায় জেকুইস লেসলীর কলাম অনুসারেঃ “একজন মা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে,আর অসহায় দুষ্টিতে তার মরণ-যন্ত্রণাকাতর চর্মসার শিশুটির দিকে তাকিয়ে আছে। বিশ্বাস হতে চায় না, তাই কথাটি বোঝাবার জন্য জোর দিয়ে মাথা নেড়ে একজন ইউরোপীয়ান বললেন, সকালে তিনি অফিসে যাচ্ছিলেন,এমন সময় এক ভিখারি এসে হাজির।
কোলে তার মৃত শিশু। বহু বিদেশী পর্যবেক্ষক মনে করেন বর্তমান দুর্ভিক্ষের জন্য বর্তমান সরকারই দায়ী। “দুর্ভিক্ষ বন্যার ফল ততটা নয়,যতটা মজুতদারী চোরাচালানের ফল”-বললেন স্থানীয় একজন অর্থনীতিবিদ। .. প্রতি বছর যে চাউল চোরাচালন হয়ে (ভারতে) যায় তার পরিমাণ ১০ লাখ টন। ”
এইসব চোরাচালানকৃত পণ্যের মধ্যে ছিল ধান, চাল, গম, পাট, যুদ্ধাস্ত্র, ঔষধ, মাছ, গরু, বনজ সম্পদ ইত্যাদি।
একটা নবগঠিত স্বাধীন দেশের সম্পদ ভারতে পাচার করা হতো কার স্বার্থে? কারা এসবের মদদদাতা ছিল? জনতার মুখপত্র, ১ নভেম্বর ১৯৭৫ সালে প্রকাশিত সংবাদ হিসেবে সেই সময়ে ভারতে পাচার হয়ে যায় প্রায় ৫০০০ কোটি টাকার পন্য।
মেজর অব: মো: রফিকুল ইসলাম বীরোত্তমের “শাসনের ১৩৩৮ রজনী” পৃ: ১১৯-১২৬ তে উনি লিখেছেন, “দীর্ঘ ৩ টি বছর আমরা এমনটি প্রত্যক্ষ করেছি। আমাদের চোখের সামনে চাল-পাট পাচার হয়ে গেছে সীমান্তের ওপারে, আর বাংলার অসহায় মানুষ ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে বিশ্বের দ্বারে দ্বারে। ”
আবুল মনসুর আহমদের লেখা আমার দেখা রাজনীতির ৫০ বছর, ৪৯৮ নং পৃষ্ঠায় উনি লিখেছেন, “সীমান্তের ১০ মাইল এলাকা ট্রেডের জন্য উম্মুক্ত করে দেয়া হলো। এর ফলে ভারতের সাথে চোরাচালানের মুক্ত এলাকা গড়ে উঠে।
পাচার হয়ে যায় দেশের সম্পদ। ”
বুলেটিন পত্রিকায় ২৯শে অক্টোবর প্রকাশিত হয় অদ্ভুত একটি সংবাদ- ত্রানের জন্য প্রতিদিন অন্তত ৫০০ পরিবার ভারতে অনুপ্রবেশের চেষ্টা করছে, পশ্চিম বঙ্গেও ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের প্রকোপ শুরু হয়েছে এবং ভারতের সীমান্ত রক্ষী বাহিনী তাদের প্রতিহত করছে।
যখন হাজার হাজার মানুষ না খেয়ে মরছে তখন শেখ কামাল এবং শেখ জামালের বিয়ে হলো সোনার মুকুট মাথায় দিয়ে।
১৯৭৫ সালের ১৪ জুলাই বিয়ে হয়েছিল নতুন গণভবনে। বিশাল আয়োজন।
অগুনিত অতিথির ভীড়। মনে হচ্ছিল পুরো ঢাকা শহরটাই এসে উপস্থিত হয়েছে বিয়েতে। বর্নাঢ্য জাকজমক পরিবেশে বিয়ের আয়োজন করা হয়েছে। বিয়ের মন্ডপে কামাল-জামাল দুই ভাই সোনার মুকুট মাথায় দিয়ে বর সেজে বসেছিল। বিয়ের পরদিন প্রায় সবগুলো দৈনিক পত্রিকায় বড় করে ছাপানো হল প্রধানমন্ত্রীর দুই ছেলের সোনার মুকুট মাথায় পড়ে বিয়ের খবর।
একই পাতায় ছাপানো হয়েছিল দুর্ভিক্ষপীড়িত, অনাহারক্লিষ্ট, হাড্ডিসার মুমুর্ষ মানুষ নামি কঙ্কালের ছবি এবং দুর্ভিক্ষের খবর ।
তাজউদ্দীন ছিলেন শেখ মুজিবের দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের ঘনিষ্ঠ সহযোগী এবং বিশ্বস্ত বন্ধু। দুর্ভিক্ষের ওইদিনগুলিতে ব্যাক্তিগতভাবে তিনি প্রধানমন্ত্রী কে বহুবার অব্যাবস্থাপনা সম্পর্কে সতর্ক করে সংকট উত্তরণের পথে ব্যাপক পরামর্শ দিয়েছেন। মন্ত্রীসভা বৈঠকেও তিনি কয়েকবার তার মতামত তুলে ধরেন।
এতে কাজ না হওয়ায় এই সৎ ও মানবতাবাদী রাজনীতিবিদ বিদেশ সফর শেষে ঢাকায় ফিরে '৭৪ -এর ১৩ অক্টোবর বিমানবন্দরে প্রেস ব্রিফিংয়ে দুর্ভিক্ষের সত্যতা স্বীকার করে বলেছিলেন,
" বিদেশে বাংলাদেশের যে ইমেজ দেখে এসেছু তাতে আমার মন ভেঙে গেছে।
বাইরে গেলে বাংলাদেশকে চেনা যায়। পত্রিকায় লেখা হয় মিঃ ফোর্ড বঙ্গবন্ধুর জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন। এতে দেশের ইমেজ নষ্ট হয়। ব্যক্তি বড় জিনিস নয়। জনগণ যদি মনে করে আমি যোগ্য নই, তাহলে গদীতে থাকার কোন অধিকারই আমার নেই।
মানুষকে বাঁচাতে হবে। ভিক্ষের চাল দিয়ে পেট ভরে না। প্রাকৃতিক দুর্যোগ সব দেশেই হয়। কিন্তু এমন অবস্থা হয় না। এ অবস্থার জন্য আমি আপনি দায়ী।
পয়সা আনাটা বড় জিনিস নয়। "
প্রধানমন্ত্রীর প্যাডে ১৯৭৪ সালের ২৬ শে অক্টোবর সকাল ১১ টায় শেখ মুজিব তার অর্থমন্ত্রীকে লিখলেন, --
" প্রিয় তাজউদ্দীন আহম্মদ,
বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থে আপনার মন্ত্রীপদে অধিষ্ঠিত থাকা সমচিন নয় বলে আমি মনে করি। তাই আপনাকে আমি মন্ত্রী পদে ইস্তফা দেয়ার আহ্বান জানাচ্ছি। এই সাথে আপনার স্বাক্ষরের জন্য পদত্যাগপত্র পাঠানো হল।
ইতি
শেখ মুজিবুর রহমান "
ওইদিন বেলা ১২ টা ২২ মিনিটে তাজউদ্দীন আহম্মদ প্রধানমন্ত্রীর পাঠানো পদত্যাগ পত্রে স্বাক্ষর করেন।
শেখ মুজিবের নির্দেশে অর্থমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগে বাধ্য হওয়া তাজউদ্দীন আহম্মদ বিকেল বেলা সাংবাদিকদের বলেছিলেন,
" আজকের দিনটি আমার কাছে খুবই পবিত্র। "
ক্ষমতায় থেকেও দুর্ভিক্ষ পীড়িত মানুষের মৃত্যু ঠেকাতে না পারার যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেয়েই হয়তো তার সেই দিনটিকে 'অত্যন্ত পবিত্র ' বলে মনে হয়েছে। কিংবা সংসদীয় গণতন্ত্রের ব্যবস্থার অবস্থানে তাকে আর শরিক হতে হবে না ভেবেই তার সেই উপলব্ধি তা বলা কঠিন।
শুধু বলা যায় মন্ত্রীত্ব হারানোর দিনটি তার কাছে ' অত্যন্ত পবিত্র '।
জনাব তাজুদ্দিন এক বিবৃতিতে বলেন, “জাতির বৃহত্তর স্বার্থে তিনি কোন বিতর্ক সৃষ্টি করতে চান না।
” ঢাকার এবং বিদেশী সাংবাদিকদের মতে স্বাধীনতা যুদ্ধে প্রত্যক্ষ ভূমিকা পালন করায় জনাব তাজুদ্দিন আহমদের যে ইমেজ গড়ে উঠে তা পাকিস্তানে আটক শেখ মুজিবর রহমান সহ্য করতে পারছিলেন না। তাছাড়া মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানে আটক শেখ মুজিবের চেয়ে স্বাধীনতার প্রশ্নকে বড় করে দেখার জন্য বেগম মুজিবও তাজুদ্দিনকে সহ্য করতে পারতেন না বলে জানা যায়। তাজুদ্দিন সম্পর্কে সরকার পক্ষ থেকে প্রচার চালানো হয় যে, তিনি অর্থমন্ত্রী থাকাকালে দেশের অর্থনীতি ধ্বংসের পথে চলে যায়। তাজুদ্দিন আহমদ বাকশালের কেন্দ্রিয় কমিটি থেকেও পরবর্তিতে বাদ পড়েন।
শেখ মুজিব সকল অপকর্মের দায়ভার পার্টির লোকদের এবং মন্ত্রীদের উপর চাপিয়ে দিতো ।
জনগণও তাই বিশ্বাস করতো , তাঁর ভাবতো মুজিব জনগণের সাথে বিশ্বাস ঘাতকটা করতে পারেনা । কিন্তু শেখ মুজিবের অত্যান্ত প্রিয়ভাজন এম আর আখতার মুকুল একদিন বোমা ফাটানো খবর দিলেন । জাসদ শেখ মুজিবকে একজন “স্বৈরাচার” হিসে্বে জানতো । সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের প্রতি ১৯৭২-১৯৭৪ সাল পর্যন্ত শেখ মুজিব স্বৈরাচারী মনোভাব পোষণ করেছিলেন বলে ইনু জানান, যার কারণে ইনুর দল জাসদ সেসময় কৃষক, কৃষিকর্মী, মজুর ও সাধারণ জনগণকে সরকারের বিরুদ্ধে “গণ-আন্দোলনে” উদ্বুদ্ধ করেছিল। শেখ মুজিবের আওয়ামী লীগের সরকার সেসময় সব বিরোধী রাজনীতি নিষিদ্ধ ও জনগণের অধিকার হরণ করেছিল বলেও ইনু স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেন।
১৯৭৪-৭৫ সালের দিকে শেখ মুজিবের বাহিনী জাসদ নেতা-কর্মীদের অমানবিকভাবে হত্যা করার নেশায় মেতে উঠলে ইনু ও তার দল গণবাহিনী নামে একটি প্রতিরোধ বাহিনী গঠন করে।
(সরকারের তথ্যমন্ত্রী জনাব হাসানুল হক ইনু তার বায়োডাটায় শেখ মুজিবকে “স্বৈরাচার” হিসেবে বর্ণনা করেছেন। বায়োডাটাটি পাওয়া যায় দুটি ভাষায়: বাংলা এবং ইংরেজিতে, এবং পাওয়া যায় :
বাংলাদেশ সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে
শেখ মুজিব জাসদের একটা গ্রুপের সাথে গোপন সম্পর্ক রেখে চলতো । জাসদ স্বিধান্ত নিল ১৭ই মার্চ তারা জনসভা করবেন পল্টনে । সেখান থেকে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে বঙ্গভবনে আক্রমণ চালাবে ।
শেখ মুজিব গোপন সম্পর্কের মাধ্যমে তাদেরকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মনসুর আলী র বাসভবনের দিকে লেলিয়ে দেন । মন্ত্রী ও তাঁর পরিবার বর্গ ঢাকার বাহিরে । বিশাল জনতা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাড়িতে আক্রমণ চালালো , আর রক্ষী বাহিনী গুলি চালালো জনতাকে লক্ষ্য করে , ১১ জন বিক্ষভ কারী নিহিত হল । অন্যদিকে সেইদিন ছিল শেখ মুজিবের ৫৩ তম জন্মদিন । তিনি গোপন সম্পর্কের মাধ্যমে নিজের উপর পরিকল্পিত আক্রমণ প্রতিহত করলো সাথে ৫৩ পাউন্ডের কেক কেটে জন্মদিন উজ্জাপন করলেন ।
শেখ মুজিবের দুমূখ নীতির আরেকটা উদারন । ১৯৭২ সালের ৮ ই জানুয়ারি সানডে টাইমসের উপ সম্পাদক নীকোলাস ক্যারোল সাংবাদিক অ্যান্থনি ম্যাসকার্ণহাস কে খবর দেয় শেখ মুজিব কারাচি থেকে মুক্তি পেয়ে লন্ডন আসছে । গভীর আগ্রহে অ্যান্থনি ম্যাসকার্ণহাস বন্ধু শেখ মুজিবের জন্য অপেক্ষা করছে । কিন্তু বন্ধুর সাথে দেখা হয়ে এক দুঃখ জনক পরিকল্পনার ইঙ্গিত পেয়ে মর্মাহত হন । কারন তা ছিল স্বাধীনচেতা বাংলাদেশীর মন মানসিকতার পরিপন্তী।
ঐ ইঙ্গিতটি শেখ মুজিবের ভাষায় “ তোমার জন্য একটা বিরাট খবর নিয়ে এসেছি । আমরা পাকিস্তানের সাথে একটা যোগ সুত্র রাখতে চাচ্ছি । তবে তোমাকে আর বেশী কিছুই এখন ব্লতে পারছিনা । অন্যাদের সঙ্গে এই ব্যাপারে আমাকে আলোচনা করে স্বিধান্ত নিতে হবে। আর খোদার দোহাই , এ বিশ্যে তোমাকে বিস্তারিত বলার আগে কিছু লিখনা কিন্তু “
স্পষ্টতই , রাওয়ালপিন্ডি শহরতলীতে অবস্তিত একটি রেস্ট হাউজে মুজিব- ভুট্টো দীর্ঘ গোপন আলোচনাটি তাঁকে লন্ডন পাঠানোর পূর্বক্ষনেই অনুষ্ঠিত হয় ।
ঐ আলোচনায় পাকিস্তানের সাথে “ লিংক” রক্ষার ব্যাপারে ঐক্যমত হয় মুজিব-ভুট্টো । প্রতিউত্তরে অ্যান্থনি ম্যাসকার্ণহাস তাঁর বন্ধু শেখ মুজিব কে জানান “ আপনি কি পাগল হয়েছেন ? আপনি কি জানেন না বাংলাদেশে কি ঘটে গেছে ? এত কিছু ঘটে যাওয়ার পর আপনি যদি পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের “লিংক “ আর ব্যাপারে একটি শব্দ উচ্চারণ করেন , আপনি বঙ্গবন্ধু হউন আর যাই হউন , জনগণ আপনাকে রাস্তায় ছুড়ে ফেলবে ।
১৯৭৪ সালে পাকিস্তানের লাহোরে অনুষ্ঠিত ইসলামি রাষ্ট্রগুলোর সম্মেলনে শেখ মুজিবুর রহমান, জুলফিকার আলী ভুট্টোর সাথে সেইরাম কুলাকুলি, মাখামাখির ছবিগুলো কি সেই " লিঙ্ক"
মানব দেবতা থেকে দানবে রূপান্তরিত এক স্বৈরশাসকের গল্প ( ১ম পর্ব ) পড়ুন
Click This Link
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।