খালেদাকে সেনানিবাসের বাড়ি দেওয়ার সিদ্ধান্ত বেআইনি
নিজস্ব প্রতিবেদক | তারিখ: ২২-১০-২০১০ প্রথম আলো
বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে সেনানিবাসের মইনুল সড়কের বাড়িটি দেওয়ার ক্ষেত্রে কোনো সরকারি সিদ্ধান্ত ছিল না। ওই সম্পত্তি হস্তান্তর প্রশ্নে সেনাপ্রধানের নেওয়া সিদ্ধান্ত ও ইজারা দেওয়ার পুরো প্রক্রিয়াটি ছিল একেবারেই বেআইনি। এই জমিটি এ-১ শ্রেণীর হওয়ায় সেনানিবাস ভূমি প্রশাসন (সিএলএ) বিধিমালা-১৯৩৭ অনুযায়ী হস্তান্তরযোগ্য নয়।
সম্পত্তিটি ইজারা দেওয়া বিধিমালার ২৬ বিধির পরিপন্থী। খালেদা জিয়ার বাড়ি ছাড়ার বৈধতা প্রশ্নে রিট খারিজসংক্রান্ত ১৩ অক্টোবর হাইকোর্টের দেওয়া রায়ে এ কথা বলা হয়েছে।
পূর্ণাঙ্গ রায় গতকাল বৃহস্পতিবার পাওয়া গেছে।
রায়ে আরও বলা হয়, সম্পত্তিটি উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তার সরকারি বাংলো হিসেবে চিহ্নিত থাকায় এবং সেনাপ্রধান ও রাষ্ট্রপতির সরকারি বাসভবন হিসেবে ব্যবহূত হওয়ায় এটি জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ সম্পত্তি। এ কারণে সম্পত্তিটি আবেদনকারীকে দেওয়া জনস্বার্থের পরিপন্থী।
রায়ে বলা হয়, তৎকালীন সেনাপ্রধানের আদেশে ও রাষ্ট্রপতির অনুমোদনে আবেদনকারীকে সেনানিবাসের বাড়ি ইজারা দেওয়া বেআইনি ও জনস্বার্থের পরিপন্থী। কারণ কোনো সরকারি সম্পত্তি বরাদ্দ দেওয়ার এখতিয়ার সেনাপ্রধানের নেই।
আর রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি যাকে খুশি, যেকোনো মূল্যে ও যেকোনো প্রক্রিয়ায় দেওয়ার নিরঙ্কুশ ক্ষমতা রাষ্ট্রপতিরও নেই। রাষ্ট্রপতি আইনের ঊর্ধ্বে ছিলেন না বা নন।
প্রতিক্রিয়া: অ্যাটর্নি জেনারেল মাহ্বুবে আলম গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, হাইকোর্ট রায়ে বাড়ি ছাড়তে ৩০ দিন সময় দিতে বলেছেন। ১৩ অক্টোবর আদালত রায় দেন। এই হিসাবে ১২ নভেম্বর সময়সীমা শেষ হবে।
খালেদা জিয়ার আইনজীবী রফিক-উল হক বলেন, রায়ের অনুলিপি পর্যালোচনা করে আপিলের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। স্থগিতাদেশ চেয়ে আবেদন করা হবে কি না—এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এ ধরনের আবেদন করা হতে পারে।
ঘটনাপ্রবাহ: সামরিক ভূমি ও সেনানিবাস অধিদপ্তরের সামরিক ভূ-সম্পত্তি প্রশাসকের কার্যালয় থেকে গত বছরের ২০ এপ্রিল খালেদা জিয়াকে ঢাকা সেনানিবাসের শহীদ মইনুল সড়কের বাড়িটি ছেড়ে দিতে নোটিশ দেওয়া হয়। গত বছরের ৭ ও ২৪ মে দুই দফায় আবার তাঁকে বাড়ি ছাড়তে নোটিশ দেওয়া হয়। এই নোটিশের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে খালেদা জিয়া হাইকোর্টে রিট করেন।
এর পরিপ্রেক্ষিতে গত বছরের ২৭ মে হাইকোর্ট নোটিশের কার্যকারিতা স্থগিত করেন ও রুল জারি করেন। রুলের ওপর চূড়ান্ত শুনানি শেষে আদালত তা খারিজ করে রায় দেন। একই সঙ্গে খালেদা জিয়াকে বাড়ি ছাড়তে ৩০ দিন সময় দিতে সরকারকে নির্দেশ দেওয়া হয়।
রায়ে যা বলা হয়েছে: ৪০ পৃষ্ঠার রায়ে বলা হয়, সরকারি কোনো সম্পত্তি কাউকে বরাদ্দ দেওয়া, এমনকি এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার সেনাবাহিনীর প্রধানের নেই। তাই সেনাপ্রধানের সিদ্ধান্তে ও আদেশে সম্পত্তিটি ইজারা দেওয়া বেআইনি।
রায়ে বলা হয়, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ও ডিএমএলসি কার্যালয়ের প্রাসঙ্গিক নথিপত্রে দেখা যায়, সেনাপ্রধানের আদেশে বার্ষিক এক টাকা ভাড়ায় দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয় এবং প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে সরকারের অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয়। তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি যিনি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন, তিনি শুধু ওই প্রস্তাবের ভিত্তিতে এ ইজারার অনুমোদন দেন। এটা স্পষ্ট যে, সরকারের পক্ষ থেকে আবেদনকারীকে ওই সম্পত্তি দেওয়ার কোনো সিদ্ধান্ত ছিল না। এ রকম একটি মূল্যবান সম্পত্তি যেকোনো বিবেচনায় কোনো বেসরকারি ব্যক্তিকে বরাদ্দ দেওয়ার এখতিয়ার সামরিক কর্তৃপক্ষের নেই। তাই যে বিবেচনায়ই হোক, সম্পত্তিটি সেনাপ্রধানের সিদ্ধান্তে ও আদেশে আবেদনকারীকে ইজারা দেওয়া বেআইনি ও বাতিল।
তৎকালীন রাষ্ট্রপতি সম্পর্কে রায়ে বলা হয়, এটি সত্য যে রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান হিসেবে (তৎকালীন সময়ে) রাষ্ট্রপতির সরকারের সার্বভৌম কর্তৃত্ব প্রয়োগ করার ক্ষমতা ছিল। কিন্তু অবশ্যই সেই ক্ষমতা আইনের অধীন। রাষ্ট্রপতিকেও দেশের আইন মেনে চলতে হয় ও তাঁর ক্ষমতা দেশের জনগণের স্বার্থে আইন অনুযায়ী প্রয়োগ করতে হয়।
রায়ে বলা হয়, ১৯৮১ সালের ১২ জুন সরকার মন্ত্রিসভার বৈঠকে খালেদা জিয়া ও তাঁর ছেলেদের বিপুল আর্থিক সুবিধাসহ গুলশানে বা ঢাকা মহানগরের অন্য কোনো অভিজাত এলাকায় একটি বাড়ি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় ও তা কার্যকর হয়েছে। কিন্তু মন্ত্রিসভার ওই বৈঠকে আবেদনকারীকে (খালেদা জিয়া) সেনানিবাসের সম্পত্তিটি দেওয়ার কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।
রায়ে বলা হয়, এই ইজারা অযৌক্তিক এই বিবেচনায় যে, রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর আবেদনকারী ও তাঁর দুই সন্তানকে আগেই বিপুল আর্থিক সুবিধা এবং গুলশান মডেল টাউনে দেড় বিঘার বেশি জমিতে নির্মিত একটি বাড়ি সরকারের পক্ষ থেকে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়।
রায়ে আদালত বলেন, ওই সরকারি বাংলোটিতে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান উপসেনাপ্রধান ও পরে সেনাপ্রধান হিসেবে পরিবার নিয়ে বাস করেছেন। তাই উচ্চ সামরিক কর্মকর্তার সরকারি বাংলো হিসেবে বাড়িটি ব্যবহূত হয়ে আসছিল। এ কারণে বাড়িটি অবশ্যই এ-১ শ্রেণীর সম্পত্তি। এ-১ শ্রেণীর সম্পত্তি সেনাবাহিনীর ব্যবহারের জন্য।
এটি কোনো বেসরকারি ব্যক্তিকে ইজারা দেয়া যায় না।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।