দাগ খতিয়ান নাইতো আমার/ঘুরি আতাইর পাতাইর...
হাওর এখন জলে থৈ থৈ। কুচিকুচি ঢেউ মন মাতায় আবার আফালে কেঁপে উঠি। গান ধরি তো পীর-মুর্শিদের নাম জপি। বন্ধু আমেনের সঙ্গে আসার কথা ছিল। কিন্তু কিসে যেন আটকে গেছে।
তাই জল আর জোছনায় ভিজতে একাই শাল্লার পথ ধরি। হাওর এই শরতে দারুণ সুন্দরী। সকাল ৮টায় সুনামগঞ্জ শহরের পুরনো বাসস্ট্যান্ড গিয়ে লেগুনায় চড়ে দিরাই যাই। দিরাই থেকে অটোরিকশায় মিলনবাজার হয়ে চাকুয়া। এখান থেকে শাল্লা ঘুঙ্গিয়াগামী গস্তি নৌকার ছাদে উঠে বসি।
হাওরমাঝের দাড়াই নদী দিয়ে নৌকা চলল। ছোট ছোট দ্বীপে হিজল করচ ডানা মেলে আছে। ডাঙা না থাকায় পুণ্যার্থীরা দুর্গা মায়ের অর্ঘ্য রেখেছে হিজলের ডালে। দৃষ্টির সীমা ছাড়িয়েও ছড়িয়ে আছে পানি। হাওরের সৌন্দর্য আমাকে এমন পেয়ে বসে যে ক্ষুধাও ভুলে যাই।
পাবলিক সার্ভিস নৌকা ঘাটে ঘাটে থামে। একটু বিরক্তি লাগলেও ভাটির বিচিত্র জীবনযাত্রা তো ফ্রি-মাগনা পাওয়া যায়। খড়ের গাদা, অলস আড্ডাবাজি, জাল সেলাই, টং দোকান আরো কত কিছু দেখি! নৌকা চললে দেখি নতুন গস্তি নাওয়ে নতুন বধূর নাইওর যাওয়া। কী যে ছটফটানি তার! বাল্যসখীরে কখন বরের কথা বলবে। শাশুড়ির ভয়ে কত দিন হাওরে ছোঁয়াছুঁয়ি খেলে না? বাবার বাড়ি গিয়েই ভাইটারে গুতুম গুতুম দিতে হবে, একবার চুপিও দিল না।
ভাবতে থাকি, শচীন দেব বর্মণ কোন মেয়েটার কথা বলেছিলেন? ওই যে 'সুজন মাঝিরে ভাইরে কইও গিয়া, না আসিলে স্বপনেতে দেখা দিত বইলা। '
মাঝিদের খোলা গলার ভাটিয়ালিতে হাওর দুলে ওঠে। ভাটির মানুষ শাহ আবদুল করিমকে মনে পড়ে। হিজল করচের ছবি তুলে দেখি বেশ হচ্ছে তো। ক্যামেরা ভরে ফেললাম ছবিতে।
বেলা ৩টায় কলেজ গেটে পৌঁছলাম। নৌকা থেকে নেমে গেলাম ডাকবাংলোয়। সাফসুতরো হয়ে বেরিয়ে পড়লাম আবার।
ছাড়িলাম হাসনের নাও
ঘুঙ্গিয়ার গাওয়ে আছে একটি শতবর্ষী হাট। হাটে নেই কোনো দালান, গাড়ির হর্ন, রিকশার টুংটাং।
কর্তার হোটেলে গিয়ে পেট ভরালাম। ঘুঙ্গিয়ার বন্ধু সাথীকে নিয়ে হাসনের নাও (পালতোলা ছোট নৌকা) ছাড়লাম কলারকান্দি গ্রামের উদ্দেশে। ঋষিপাড়ায় বরুণ ঋষির ঢোল করতালে মাতলাম আধঘণ্টা। পরে যাত্রাপুরে মাদার ফকিরের মাজারে গেলাম। মাদার ফকির এখানে খোয়াজ খিজিরের নাম জপতেন আর তাঁর পাশেই মহেশ যোগী কালিপূজা করতেন।
সেই থেকে দুই ধর্মের লোকজন তাদের এখানে সাধন-ভজন করে। মহেশ যোগীর নাতি বুবাই ঠাকুর জানালেন, প্রায় শত বছর ধরে আষাঢ়ি পূর্ণিমায় শিষ্যরা 'নিয়ম' (রোগ সারানোর পদ্ধতি) দেওয়ার জন্য ধ্যানের মেলা বসান। বিভিন্ন এলাকার নারী-পুরুষ ধ্যানের মাধ্যমে রোগ সারাতে আসেন। মাজার ঘুরে গেলাম সোমেশ্বরী মন্দির দেখতে। পথে 'সায়র'-এর দেখা পেলাম।
বাহারা গ্রামে দাড়াইন নদীর পারে দাঁড়িয়ে আছে। এই বৃক্ষের বয়স নাকি তিন শ বছর। নাওয়ের মাঝি সুখেন আরো জানাল গ্রামবাসী একে 'ব্যাটাঠাকুর' নাম দিয়ে যুগ যুগ ধরে পূজা দিচ্ছে। বিয়ের দিন-তারিখ ঠিক হলে বর-কনের মায়েরা সন্তানের মঙ্গল কামনায় এই বৃক্ষকে পূজা দেয়। আরো কিছুদূর গিয়ে পানিবন্দি সোমেশ্বরী মন্দির দেখি।
পড়ন্ত বেলার আলোয় মন্দির লাল হয়ে উঠেছে। মন্দিরের একটু আগে আছে একটি শতবর্ষী মঠ (স্থানীয়রা বলে মতিছিলা)। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসায় ডাকবাংলোয় ফেরার পথ ধরলাম।
হাওর ভাসে মরমি সুরে
সুনামগঞ্জের আকাশে-বাতাসে নাকি দিন-রাত মরমিয়া সুর ওড়ে। প্রমাণ পেলাম রাতের শাল্লায়।
বাজারঘরে, গাঁয়ের টং দোকানে, নৌকায়_সব জায়গায় গান হচ্ছে। ঘুঙ্গিয়ার আরতিরানী ধামাইল সম্রাট রাধারমণের গান ধরেন, 'জলে গিয়াছিলাম সই, কালার কাজলের পাখি দেইখ্যা আইলাম ওই। ' আরতিদি রাধারমণ ছাড়া চলতে পারেন না, তাঁর ভেতর রাধারমণ বাজে। বাজারের এক ঘরে কথক-পাঠকরা সুর করে রামায়ণ পড়ছেন। আরেক ঘরে দেখি প্রবীণ শিক্ষক রবীন্দ্রচন্দ্র দাস উদ্দীপনামূলক কবিতা পড়ছেন।
জোয়ান-বুড়ো সবাই হাজির এসব আসরে। রাত গভীর হলে পুঁথি পাঠ শোনা গেল। ছায়ার হাওর, ভরাম হাওর, ভাণ্ডাবিল হাওরের মাঝিদের গানও তখন চলছিল_মুর্শিদি, মালজোড়া, দেহতত্ত্ব, ধামাইল, জারিসারি ইত্যাদি। রাত দেড়টায় সাংবাদিক পীযূষ দাশ ও শিক্ষক কৃষ্ণকান্ত দাদাকে নিয়ে গেলাম শাহেদ আলী উচ্চ বিদ্যালয়ের মাঠে। সেখানে চলছে ঢপযাত্রা।
শ্রীকৃষ্ণের জীবনী নিয়ে এই পালা তৈরি হয়েছে। অভিনেতারা সবাই এই ভাটিরই মানুষ।
মোম জোছনায় উজালা সমুদ্রসৈকত
ঢপ দেখে রাতের হাওর দেখতে বের হলাম। আকাশ ভাইঙ্গা জোছনা পড়ছে হাওরের গায়ে। হাসপাতাল রোডের পেছনের জায়গাটা সমুদ্রসৈকতের মতোই।
লোকজন তাই নাম দিয়েছে 'উজালা সমুদ্রসৈকত'। চোখ ভরে যায় চকমকিতে, অঙ্গ যায় ভিজে। প্রিয়ার কথা মনে আসে, একটু কথা বলতে ইচ্ছে হয়। হেঁটে হেঁটে রাত পার করে ফেলি।
আসা-যাওয়া-থাকা
ঢাকার সায়েদাবাদ থেকে সুমি বা সৌদিয়া বাসে দিরাই যাওয়া যায়।
ভাড়া ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা। দিরাইয়ের মিলন বাজার থেকে ইঞ্জিনচালিত নৌকায় শাল্লা যেতে ২০ টাকা লাগে। কিশোরগঞ্জের ইটনা থেকেও নৌপথে শাল্লা যাওয়া যায়। জেলা পরিষদের (উপজেলা প্রশাসন থেকে অনুমতি নিয়ে) ডাকবাংলোয় ছয়জন থাকা যায়। ডাকবাংলো না পেলে আছে জননী রেস্ট হাউস।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।