আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ঝর্ণার টানে ছুটে চলা (খাগড়াছড়ি)-ছবি ও ভ্রমণ কাহিনী

আপাতত ঘুরপাক খাচ্ছি!

পোষ্টের শিরোনাম ঠিক হলো কিনা জানিনা! তবে এই পোষ্টের উদ্দেশ্য খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার দীঘিনালা উপজেলার মোটামুটি দুর্গম এলাকায় নান্দনিক দুইটি ঝর্ণা দর্শন। ঝর্ণা দুটি এখনও তেমন পরিচিত হতে পারেনি। যোগাযোগ সমস্যাটাই মূল কারণ। কিছুদিন আগে কয়েকটি পেপার পত্রিকায় এই ঝর্ণার কথা উঠে এসেছে। বাংলাদেশে ঝর্ণা বলতে আমরা মৌলভাবাজারের মাধবকুন্ড আর রাঙামাটির শুভলং কে বুঝি।

যে দুটো ঝর্ণা অতি সহজেই গাড়িতে চড়ে বা নৌবিহারে দেখা যায়। একই কারণে বোধয় আমারও দেখা হয়েছে ঝর্ণা দুটি। এ্যাডভেঞ্চার প্রিয় বন্ধু বললো বাংলাদেশে সর্বোচ্চ ঝর্ণা বলতে বাকলই ফলস(বান্দরবান)। যেখানে কিনা ৩০০ ফুটের মত উপর থেকে পানি পড়ে। তারা কয়েক জন মিলে দেখে এসেছে।

ছবি দেখলাম। কিন্তু ঝর্ণার অর্ধেক পানিপতন দৃশ্য দেখা যায় না। পাহাড়ী গাছপালা আর ঝোপঝাড়ের কারণে ঢাকা পড়ে গেছে। আর পানি পতনের পরিমাণ একটু কম মনে হলো। বান্দরবানের জাদিভাই পাড়ার কাছে আর একটি নান্দনিক ঝর্ণা রয়েছে।

এখানে আবার পানি পতনের পরিমাণ অনেক বেশী। ঝর্ণার উপরের অংশ অনেক শাখা-প্রশাখায় বিস্তৃত হয়ে পানি পড়ছে। এটার অবশ্য ভিডিও ফুটেজ দেখেছি। তাছাড়া কয়েক দিন আগে টিভিতেও দেখেছি। পুরা পার্বত্য এলাকায় এখনও হয়ত অনেক অদেখা ঝর্ণা রয়েছে।

তো যাই হোক ম্যলা প্যাঁচাল পারলাম। এইটাকে রথ দেখা আর কলা বেচা টাইপের অভিযাত্রা বলা চলে। যাত্রা শুরু হোক ১ অক্টোবর ২০১০, শুক্রবার; সকাল নয় টায়; দীঘিনালা উপজেলা প্রাঙ্গন থেকে। কারণ দীঘিনালা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ছিলেন উদ্যোক্তা। সাথে স্থানীয় প্রাইমারী ও হাই স্কুলের হেড মাষ্টার, কিছু পত্রিকার সাংবাদিক; বিটিভির সাংবাদিক; এলাকার কিছু ছেলে এবং আমার কলিগ আর আমি।

উপজেলা প্রাঙ্গন থেকে জীপে করে প্রায় দুই কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে পোমাংপাড়া পৌঁছলাম। সবাই জড়ো হতে হতে সকাল দশটা বেজে গেল। পোমাংপাড়ার এখান থেকেই পায়ে হাঁটার পথ শুরু। কিছুক্ষণ পর আমরা হাঁটা শুরু করলাম। সূর্য্যিমামা ততক্ষনে তেতে উঠেছে।

হাঁটতে হাঁটতে প্রথম পাহাড়ের কাছে এসে পৌঁছেছি। পাহাড়ের পাদদেশে বাঁক নিয়ে সামনে এগিয়ে যাচ্ছি। এবার নামতে হবে প্রথম ছড়ায়। অনেকে পাড় হয়েছে। বাকীরা পাড় হচ্ছে।

প্রথম ছড়াটি পার হয়ে। পাহাড়ের উঁচু পথ ধরে হাঁটছে সবাই। দুই ধারে ঝোপঝাড় দেখা যাচ্ছে। সামনে উঁচু নিচু পথ চোখে পড়ছে। দুইধারে এরকম অনেক গাছপালা দেখা যায়।

পথের ডানপাশের দৃশ্য। পাহাড়ের উপর কিছু জুম ঘর চোখে পড়ে। এইসব জুম ঘরে থেকে পাহাড়ী লোকজন পাহাড়ের ঢালে ফসল ফলায়। এখনও পাহাড়ের উঁচু পথ বেয়ে সামনে এগিয়ে যাচ্ছি। উপরে নীল আকাশে সাদা মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে।

পাহাড়ী এলাকায় আকাশটাকে অনেক বেশী নীল মনে হয়। প্রথম উঁচু পথ প্রায় শেষ। সামনে নিচের দিকে নামতে হবে। সামনে যেন একটি ছোট্ট সুরঙ্গ পথ। ঝোপঝাপ হেলে পড়ে এই পথটি এরকম আকার ধারণ করেছে।

সুরঙ্গের মত পথটুকু পেরিয়ে সামনে বেশ ফাঁকা জায়গা দেখা যাচ্ছে। পাহাড়ের ঢালে কিছু বাড়িঘর চোখে পড়ছে। বামপাশে আমাদের পরিচিত জবা ফুল। এখানে বেশ সদম্ভে দাঁড়িয়ে রয়েছে। যেন আমাদের চিনেই না মনে করেছিলাম বাড়িগুলো নিকটে।

কিন্তু মাঝখানে ছড়াটি দূরত্বটা যেন বাড়িয়ে দিল। বেশ প্রশস্ত বোয়ালখালী ছড়া। ছড়া পাড় হয়ে সবাই একটু রেস্টে আছে। প্লানও করা হচ্ছে কি করা যায়। কারণ এতক্ষণে প্রায় তিন কিলোমিটার পথ পেরিয়ে এসেছি।

সূর্যের ক্ষরতাপে আলুসিদ্ধ হয়ে পড়েছি যেন। পাহাড়ি এলাকায় রোদের তাপটা যেন একটু বেশীই লাগে। বোয়ালখালী ছড়ার আপ স্ট্রিমের চিত্র। অনেক ভেবে চিন্তে সিদ্ধান্ত হলো পাহাড়ের উপরের বাড়িতে গিয়ে জিরোনো যাক। আমাদের সাথে থাকা প্রাইমারী স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা কামনা' র আত্মীয়ের বাড়ি এই গ্রামেই।

কামনা আমাদের সাথে থাকা একমাত্র মহিলা অভিযাত্রী। তার স্ট্যামিনা আমাদের চাইতে অনেক বেশী। মনে হচ্ছে আমরা দৌঁড়িয়েও তার নাগাল পাচ্ছি না। আপাতত গন্তব্য ধারেকাছেই কামনা'র আত্মীয়ের বাড়ি। সামনে সুন্দর একটা পথ চোখে পড়ে।

পাহাড়ের ফাঁটল বেয়ে নেমে আসা পানি। এটাকে আসল মিনারেল ওয়াটার বলা চলে। কয়েকজন আবার এই পানি দিয়েই তৃষ্ণা মেটালাম। পাড়াটির নাম বুদ্ধমা পাড়া। একটি নেমপ্লেট দেখা যাচ্ছে।

কামনা'র আত্মীয়ের বাড়িতে এসে জাম্বুরা খেলাম। তারপর ডাবের পানি খেলাম। কামনা সবার মাঝে চকলেট বন্ঠন করলো। বেশ কিছুক্ষণ রেষ্ট নিলাম এখানেই। পাহাড়ী জনগোষ্ঠীর লোকজন।

একজনকে বাঁশের হুক্কায় তামাক টানতে দেখা গেল। এবার তৈদু ছড়া ধরে হাঁটা শুরু করলাম। কখনও হাঁটু পানি দিয়ে হাঁটতে হচ্ছে। কখনও বা পানি বেশী থাকায় ডানে বায়ে উপরে দিয়ে যেতে হচ্ছে। সামনে একটি গুহার মত জায়গা চোখে পড়ে।

সামনে দেখা যায় কোমর সমান পানি। পাহাড়ী কলার ছড়া দেখা যাচ্ছে একজনের কাঁধে। বেশ রিস্কি জায়গা মনে হচ্ছে। ডান দিকে পাহাড়ের খাড়া ঢাল বেয়ে বেয়ে সামনে এগিয়ে যাচ্ছি। একটু পিছলে গেলেই ধপাস করে পানির মধ্যে পড়তে হবে।

বাংলাদেশী নায়াগ্রা জলপ্রপাত। ছড়ার এই অংশটা একটু উঁচু। এখান থেকে অতিদ্রুত পানি নেমে যাচ্ছে। ডানে কিছু বড়বড় পাথর দেখা যায়। শুধু হাঁটছি তো হাঁটছি।

একটা পাথর তুলে কারো মাথায় ভাঙতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু শরীরে তো এনার্জি প্লাস নাই সবাই একটু হাঁফিয়ে উঠেছে। তাইতো পাথরের উপর বসে একটু রেষ্ট। সবাই কামনা'র নিয়ে আসা কমলা গোগ্রাসে গিলছে। বামে একটা হস্তি আকারের পাথর চোখে পড়লো।

মনে হচ্ছে আস্ত হস্তি জিরোচ্ছে। ডান পাশেও দেখি কাছিমের মত পাথর। কাছিমটাকে একটু ভালভাবে দেখি। সামনে অগ্রসর হচ্ছি। কিন্তু ঝর্ণা -------আর কতদূর! এরমধ্যে ছড়ার এক কোণে আটকে থাকা স্বচ্ছ পানি পান করলাম।

যে যাই বলুক এতো দেখি টারজানের ল্যাঞ্জা। মনে লয় এই দিক দিয়েই তো জেন রে নিয়া পালাইছে বোধয় ঝর্ণার খুব কাছাকাছি এসেছি। কারণ এইদিকে পাথরের পরিমাণ খুব বেশী। মাথার উপর খাদ্য জাতীয় কোন ফলফ্রুটস দেখা যায়। ঝর্ণার সন্নিকটে এসে গেছি।

পথটা বেশ এলেবেলে। এবার মনে একদম কাছে। ঐতো কিছু একটা দেখা যাচ্ছে। যাক শেষ পর্যন্ত ৩ ঘন্টায় ৫ কিমি পথ অতিক্রম করে প্রথম ঝর্ণায় এসে পৌঁছেছি। এটার নাম তৈদু ছড়া ঝর্ণা।

আনুমানিক ৬০ ফুট উঁচু। এবার ফটোসেশনের পালা। অন্যদের ফটো তুলতে গিয়ে পাথর থেকে ধপাস করে পিছলে পড়লাম। ডান পায়ের গোড়ালীর কাছে ছিলে গেল। প্রথম ঝর্ণা দেখা শেষ।

এবার দ্বিতীয় ঝর্ণা দেখার পালা। ফিরে সবাই হাঁটা শুরু করলাম ছড়া পথে। কিছু পাহাড়ী শ্রমজীবি মানুষ বললো প্রথম ঝর্ণার ডানপাশ দিয়ে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে উঠলে খুব কাছাকাছি হবে। ততক্ষণে দুপুর ১ টা বেজে গেছে। ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা পাড় হয়ে যাবে।

বয়স্ক এবং আরও কিছু যাত্রী পিছপা হলো। আমরা ৮০-৮৫ ডিগ্রী এঙ্গেলের ঢাল বেয়ে বানরের মত প্রায় ৮০-৯০ ফুট উপরে উঠা শুরু করলাম। সবাই প্রায় উপরে উঠে গেছে। শ্রমিকদের করে দেয়া খাঁজগুলোও পিচ্ছিল হয়ে গেছে। আমি পিছনে ছিলাম।

এমন সময় উপর থেকে সাপসাপ করে চিল্লানো শুরু করলো। ভয়ে পা পিছলে পড়ে গেলাম। ভাগ্যিস পাঁচ ফিটের মত নিচে এসে একটা গাছের সঙ্গে আটকা পড়লাম। শক্ত করে মাটি আঁকড়ে ধরতে গিয়ে ডান হাতের তর্জনী আর মধ্যমা আঙ্গুলের নখে মাটি ঢুকে রক্ত বের হওয়া শুরু করলো। পরে অনেক কষ্টে ডান পাশ দিয়ে উপরে উঠে গেলাম।

উঠার পর শুনলাম, একটা সবুজ সাপ গাছের সঙ্গে পেঁচিয়ে রয়েছে ঝর্ণাটির মুখ। এখান থেকেই পানি পড়ছে। এরপর আবার চলা শুরু করলাম। কিছুদূর গিয়ে অজগর সাপের মত কি জানি দেখলাম। দ্রুত পার হয়ে পেছন ফিরে দেখি একটা সাইকাস না পাইনাস জাতীয় গাছ।

সামনে অগ্রসর হলাম। উপর থেকে প্রচন্ড বেগে পানি নেমে আসতেছে। এই বেগ ঠেলে পানি বরাবরই হাঁটতে হয়। ডানে বায়ে যেখানে পানির স্রোত কম সেখানে শ্যাওলা জমেছে। একটুতেই পা পিছলে যায়।

বেশ সুন্দর একটা জায়গা চোখে পড়লো। পানির স্রোত এত বেশী যে ধাক্কা দিয়ে নিচে নিয়ে যেতে চায়। ছড়াটি এখানে ৯০ ডিগ্রী বামে টার্ন নিছে। এখানে পা টিপে টিপে অনেক সাবধানে হাঁটতে হয়েছে। একবার পিছলে গেলে মনে হয় কয়েকশ হাত দূরে নিক্ষেপিত হতে হবে।

এরপর উপরে উঠার পালা। উপরে উঠেই গুহার মত অংশ চোখে পড়লো। নিচে এক কোমড় পানি। দুই সাইডে পা ছড়িয়ে উপরে উঠতে হলো। গুহার মুখে আবার কয়েকটা পাথর দেখা গেল।

পাথরগুলার মধ্যে একটা একদম ফুটবলের মত গোলাকার। ফুটবলের মত পাথর। এর ব্যাস একটা মানুষের সমান প্রায়। এরপর তেমন আর বাঁধা বিপত্তি চোখে পড়েনা। এক হাঁটু পানির মধ্য দিয়ে হাঁটা।

ঐ তো! এবার দ্বিতীয় তৈদু ঝর্ণা দেখা যায়। কারো আর তড় সয় নাই। ঝর্ণার নিচে সবাই ঝাপিয়ে পড়ছে। ঝর্ণাটার উচ্চটা ৭৫-৮০ ফুট হবে। অনেক গুলো ছোটছোট স্টেপ আছে।

দাঁড়িয়ে ইচ্ছেমতো গোসল করা যায়। আমিও আর থাকতে পারি নাই। গিয়ে গোসল করা শুরু করলাম। আহা কি মজা! একটু হাঁটতে হাঁটতে বাম সাইডে গিয়েছি। অমনি ধপাস করে চিৎপটাং (পানির ফ্লো কম যেখানে শ্যাওলা সেখানে)।

জীবনে এত্ত বড় আছাড় খাই নাই। এবার ঝর্ণা একাই পোজ দিয়েছে। ফেরার পালা। শেষবার ঝর্ণার সাথে দেখা ঝর্ণাকে একটু পিছনে ফেলে। এবার আর সেই ঢাল বেয়ে নামার এনার্জি কারও নাই।

দ্বিতীয় ঝর্ণা থেকে একটু দূরে গিয়ে বামপাশে পাহাড়ে উঠে গেলাম। এবার পাহাড়ী মেঠোপথে পথে চলেছি-------- কাঁশবন আর ঘাসবন পেরিয়ে---------- পাতার ফাঁকে পাহাড় আর অভিযাত্রী দল। সূর্য্যিমামার তেজ অনেক কমে এসেছে যেন----------- আবার ছড়ার বুকে---- হস্তিপাল যেন শুয়ে ছড়ার সঙ্গে খেলছে আর ঝর্ণা বিজয়ের জন্য আমাদেরকে অভিনন্দন জানাচ্ছে আমাদের দলও যেন বেশ হাঁফিয়ে উঠেছে। আবারও পথচলা শুরু আর ফেলে যাওয়া সেই নায়াগ্রা আপস্ট্রিম থেকে সেই প্রথম খাঁদটি। পাহাড়ের কোলে সোনালী দিনের হাতছানি-- ক্লান্ত ও বিধ্বস্ত অনেকেই।

পা টেনে টেনে চলছে তারা। দিনের আলো নিভে এল, সেই সঙ্গে বৃক্ষরাজির সালোকসংশ্লেষণ ও কমে গেল। আমাদের যাত্রার আয়ুও শেষের দিকে। পাহাড় চূড়া থেকে দীঘিনালা। আমাদের বর্তমান ঠিকানার হাতছানি।

পাহাড়িয়া মন আর ডালা ভর্ত্তি স্বপ্ন নিয়ে ফিরে আসা। ক্যাম্পে ফিরে আসতে আসতে সন্ধ্যা সাতটা বেজে যায়। এতক্ষণ সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ!

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.