"বাঙ্গালী জাতির গৌরবময় ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব এবং জাতীয় সংস্কৃতির জন্য অপমানজনক কোনকিছু এই ব্লগে লেখা যাবে না। "শিহরণে সত্তায় তুমি, হে আমার জন্মভূমি"
যে দেশের মানুষ সব খায়, মানুষের মাংস ছাড়া এখন পর্যন্ত
Click This Link
মীরপুর থেকে আর যাই হোক যাতায়াত ব্যবস্থাটা যে কোন জায়গার চোস্ত ছিল। ভালো বলছি এ কারণে ডাইরেক্ট বাস ছিল সায়দাবাদ যাবার, গাবতলী, গুলিস্তান এসব জায়গায় যাওয়াও সহজ ছিল। রোকেয়া সরণী এরশাদের এক অবিস্মরণীয় দান। চীনের দুঃখ যেমন হোয়াংহো তেমনি মীরপুরবাসীর দুঃখ ছিল কল্যাণপুর ঘুরে যাওয়া।
কল্যাণপুরে বাঁশের এক আড়ৎ, বাঙলা কলেজের ঐখানকার জমাট বাঁধা অন্ধকার কতজনের যে সর্বস্ব কেড়ে নিতে সহায়তা করেছে!৯৭ তে ইউনিভার্সিটিতে উঠতে উঠতে চালু হলো গেটলক সার্ভিস। ভাড়া একটু বেশি। কিন্ত ডাইরেক্ট সার্ভিস।
৮৭ তে যখন প্রথম দোতলা বাস দেখলাম বিআরটিসির তখন ক্লাস ফোরে পড়ি, মনিপুর স্কুলে যাই লোকাল বাসে করে। মনে পড়ে আমরা যে কয়েকজন একসাথে যেতাম তারা দোতলা বাস আসার পর আর কিছুতেই নর্মাল মিনিবাসে উঠতে চাইতাম না।
একটু দেরী হলেও দোতলা বাসের জন্যে অপেক্ষা করতাম।
মীরপুরকে সবাই সে সময় ও সবচাইতে বড় ক্রাইম জোন হিসেবে দেখতো।
দিন যেতে যেতে ঘনবসতির মীরপুরে হরেকরকমের বাস নামলো। মার্কেট গড়ে উঠলো। আগে যে কোন কেনাকাটায় আমরা যেতাম নিউমার্কেট, পরে কম প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো মীরপুর থেকেই কেনা হতো।
জানি না মীরপুরবাসীর পল্লবীর হাবীব বুক হাউজের কথা মনে আছে কি না! প্রতি মাসে একবার ধর্না দিতাম, তিন গোযেন্দা, রহস্য পত্রিকা, কিশোর ক্লাসিক, ওয়েস্টার্ন,রোমান্টিক এসব বই এর জন্য। মীরপুর ছাড়ার আগেই বা তার অব্যবহিত পরেই জেনেছি চাঁদা না দেয়াতে সন্ত্রাসীরা হাবীব বুক হাউজের সেই আংকেলের চোখ তুলে নিয়েছে।
আমাদের মীরপুরের গর্ব ছিল জনি ড্যানি দু’ভাই। জাতীয় দলে ফুটবল খেলতো। ফীডব্যাকের মাকুসদ আমাদের পাশের লাইনের কোন মেয়েকে জানি বিয়ে করেছিলেন।
সব স্মৃতি একপাশে সরিয়ে এক সময় মীরপুর ছাড়লাম। ২০০৩ এ চলে এলাম ঢাকা শহরের আরেক প্রান্তে – এও আরেক উপশহর তার নাম মডেল টাউন উত্তরা।
প্রথম প্রথম গোপনে কাঁদতাম, অতটা বয়সেও; বাসার পাশেই রেললাইন, ট্রেনের আওয়াজে ঘুমানোই দায় ছিল প্রথম চার মাস। তবে উত্তরার সবুজ ছাওয়া নিরিবিলি পরিবেশ মন কেড়ে নিলো, পার্ক, সুন্দর সুন্দর দোতলা বাড়ি। খুব ঘুরতাম রিকশা দিয়ে।
অফিস শেষে প্রায় প্রতিদিন হয় কোন কলিগ বা একা কখনো দল বেঁধে একএকদিন এক এক সেক্টর ঘুরতাম।
অফিস শেষে কখনো কখনো শাহবাগ চলে যেতাম বাসে করে আধ ঘণ্টা এক ঘণ্টার মধ্যে, আবার আড্ডা দিয়ে রাত ৯-১০টার মাঝে বাসায় চলে আসতাম। কোন ব্যাপার ছিল না এসব।
ছিলাম ব্যাংকের লোন সেকশনে কাজের কারণেই এ জমি সে জমি দেখতে যেতে হতো, ফ্ল্যাটের মূল্য যাচাই করতে হতো। তখনো কমার্শিয়াল প্লটের কাঠা ৪০-৫০ লাখ ধরতাম আমরা, আবাসিক এলাকার ১৫-২৫লাখ; অবস্থানের উপর নির্ভর করে।
স্কয়ার ফিট ১৫০০টাকা করে সেদিনও ফ্ল্যাট বিক্রি হয়েছে।
এটা ২০১০ সাল। কত ডেভলপার! ৪৫০০-৬০০০ টাকা স্কয়ার ফিট। সুন্দর দোতলা বাড়ি থাকা মানে আপনি এখন গরীব। শুধু ফ্ল্যাট আর ফ্ল্যাট।
আমাদের উত্তরাতে মোটর ছাড়া পানি উঠতো ট্যাংকিতে । এখন পানির লাইনের সাথে টানা মোটর লাগিয়েও পানি পাওয়া যায় না। কারেন্ট তেমন যেতই না। এখন বিদ্যুৎ থাকলে আমরা আনন্দে আটখানা থাকি, বাসার সদস্ররা একে অন্যকে বলি আজ যে কারেন্ট গেল না!
আটাশির সেই ভয়াবহ বন্যা, ২০০৪ এর ভয়ংকর জলাবদ্ধতাতেও আমাদের উত্তরার বাসায় কোন সমস্যা হয়নি। এখন একঘণ্টা বৃষ্টি হলে বাসার সামনে কোমর পানি জমে যায়।
সব বড়লোকের বাস। কিন্তু মডেল টাউনে কোন সুয়ারেজ সিস্টেম নেই। সিটি কর্পোরেশনের অধীন এবং সেক্টরের মধ্যে যে এমন হতে পারে তা কোনদিন ও ভাবিনি।
আমাদের লোভ, আমাদের লোভ সব খেয়ে নিচ্ছে। প্রতিটা ড্রেন বন্ধ।
কেউ পরিষ্কার করে না। যে বাসায় সবোর্চ্চ ১০জন থাকতো সেখানে এখন ফ্ল্যাটের কল্যাণে ২০০জন থাকে। এ এক চেইন।
জন্ম, বিবাহ, জীবিকা, চিকিৎসা, শিক্ষা, মৃত্যু সবকিছুর চাবিকাঠি ঢাকায় কেন্দ্রীভূত। আমাদের মিডিয়ার খবর ঢাকা কেন্দ্রিক।
প্রশাসন তো ঢাকাকেই বাংলাদেশ জানে। হাজার হাজার বস্তি। মানুষ কাজের সন্ধানে আসছে।
জমির দাম প্লাটিনামের চাইতেও বেশি। মানুষ কিনছে।
কোথা থেকে টাকা পায় আমি জানি না। ৭০ লাখ যখন শুনি ফ্ল্যাটের দাম আমার বুক ধড়ফড় করে। ৩১লাখ যখন শুনি গাড়ির মুল্য আমার শরীরে ঘাম দেখা দেয়। কি কাজ করলে এসব কেনা যায়!
আমাদের শাহ আলম, বাবুলরা না কি জিডিপি নামক বস্তুতে বিরাট অবদান রেখেছেন তাই তারা সব হা করে গিলে ফেলার অধিকার রাখেন।
এলোমেলো স্মৃতিতে আশুলিয়ার কথা মনে পড়ে।
বর্ষায় দল বেধে নৌকায় ঘুরেছি। সেখানে এখন খুঁটি গাড়ানো – অমুক সিটির। বোটানিক্যাল গার্ডেন থেকে নৌকায় করে আলোকদি গ্রামে এসে আমরা কত মীরপুর ১২ নম্বরে উঠেছি। সেখানে এখন কোন পানির অস্তিত্ব নেই। এক সময় সদর ঘাট থেকে খুব ছোট নৌকায় করে ঘন্টা চুক্তিতে বুড়িগঙ্গায় ঘুরেছি।
বুড়িগঙ্গার যে কালোকুষ্টি থকথকে চেহারা আমি গতবছর দেখেছি, সেটা কোন নদীর চেহারা হতে পারে না।
কোথাও কেউ কিছু বলার নেই। আমরা বেঁচে আছি ঈশ্বর বা আল্লাহর দয়ায়। পুরো শহর একটা সিটি অব হররে রূপান্তরিত হয়েছে। কেউ বলে না আজ থেকে আর ফ্ল্যাট বানানো নিষেধ করা হলো।
কৃষি জমি অধিগ্রহণ করে কোন টাউন আর সরকার বা বেসরকারী কেউ বানাতে পারবে না। প্রতিদিন কৃষি জমি কমে যাচ্ছে। ২-৪বছরের মাথায় খাবার ও থাকবে না। এখনো প্রতি লোকমা ভাতে-খাদ্যে আমরা বিষ খাচ্ছি। খাদ্য ফলানোর জমি ই তো থাকবে না।
সিন্ধু সভ্যতার মতো, মায়া সভ্যতার মতো আমার ঢাক্বা, ঢাকা ও কালের গর্ভে আমাদের দেয়া ধাক্বায় পড়ে যাবার সামিল। আমি প্রতিক্ষণে ঢাকার কান্না শুনতে পাই। মনে হয় আমার খুব আপন কেউ কানের কাছে মুখ এনে বলছে “আমাকে মরতে দিও না”
যারা ডেভেলপার তারা বলবেন আমরা দায়ী না এককভাবে, পরিবহন ব্যবসায়ীরা বলবেন আমরা নই, প্রাইভেট কারের মালিকরা বলবে পাবলিক ট্রান্সপোর্ট না থাকলে আমরা কি করব, বিভিন্ন কার্যোপলক্ষে যাদের ঢাকায় বসবাস তারা বলবে বাইরে কাজ কই, এসবের সুযোগ কই – সরকার বলবে আমরা পরিকল্পনা হাতে নিয়েছি। এত কোটি টাকার, এক বিলিয়ন ডলারের। ব্রিটিশ আমলে একবার এক পাট গুদামে আগুন লাগলে দারোয়ান সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে চিঠি লিখে জানতে চায় এ মুহূর্তে তার করণীয় কি।
দেড়মাস পরে চিঠির উত্তর আসে “আগুন নিভাইয়া ফেলা হোক জল দিয়া”। "
আমাদের সরকারী পরিকল্পনাগুলো বাস্তব হতে হতে বিভীষিকার সব কটি স্তর পার হয়ে আমরা নৈব্যক্তিকতার সবোর্চ্চ ধাপে উপনীত হব এ বিষয়ে আমার কোন সন্দেহ নেই। যে দেশের মানুষ সব ইস্যুতে যানবাহন ভাংচুর ধ্বংস করা শিখেছে, যে দেশের মানুষ তার গণপ্রতিনিধিদের কাছ হতে পারস্পরিক দোষারোপ আর ক্ষমতার অপব্যবহার দেখেছে সে দেশের মানুষের কাছ হতে কোন শুভ-সুপ্রবৃত্তি আশা করতে আমার এখন কুণ্ঠা বোধ হয়।
আমি কি পলাতক হব? না কি ঢাকাকে বাঁচাতে আমার ক্ষুদ্র ক্ষমতা ব্যবহার করব?
নিজের সাথে চলা মানসিক দ্বন্দ্বে আমি খুব ক্লান্ত বোধ করি। আমার রক্তে বেড়ে ওঠা আজন্ম লালিত স্বপ্ন সাধ স্বাধীনতা, আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি, আমার বাংলায় লেখা প্রেমপত্র, আমার বছর বছর বাংলা বই, আমার বয়স্ক পিতামাতা, আমার পরিবারের নবীন সদস্যদের ভবিষ্যত, রাস্তায় বসে থেকে নষ্ট হওয়া আমার কর্মঘণ্টা, আমার নিরাপত্তাহীনতার শহর- সব মিলে মিশে আমাকে এক চরম আত্ম সংকটে ফেলে দিয়েছে।
এমন কি আরো অনেক মানুষের মনে হচ্ছে না? তারা কোথায়? তারা যদি একবার বলতেন আমি তাদের সাথে যে কোন কাজে নামতাম।
আমার কোন দল নেই, সংঘ নেই, আমি বড় একা – ওয়ান ম্যান আর্মি কিভাবে হয় আমি জানি না বিধায় একা একটা কাজই জানি সেটা হলো লিখা তাই করলাম।
সর্বগ্রাসী রাক্ষসদের পেট থেকে কিভাবে আমার ঢাকাকে বাঁচাবো তাই জানতেই এই লিখা।
(চলবে)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।