. আমার নাইবা হলো পারে যাওয়া...
২৬শে জুলাই সকালে রবীন্দ্রনাথকে খোসমেজাজেই দেখা গেল। অনেকেই দেখা করতে এসেছেন। গতরাতে অবনীন্দ্রনাথ তাঁর প্রিয় রবিকাকার করুন দশা দেখে সামনে আসেন নি। সকালে ইশারায় রানী চন্দের কাছে কবির অবস্থা ভালো জেনে ঘরে ঢুকলেন। আশি বছরের কাকা আর সত্তর বছরের ভাইপো মুহুর্তেই আড্ডায় জমে গেলেন।
চেহারায় খুশী ছড়িয়ে কবি অকুন্ঠে অবনীন্দ্রনাথের প্রশংসা করলেন। “ অবন, তোমার স্মৃতিচারনাতেই আমার সঠিক রুপ ফুটে উঠেছে। সবাই আমাকে ছিন্নভিন্ন করেছে। অনেকে আবার স্তুতি করতে গিয়ে প্রকৃত আমাকে প্রকাশ করতে পারেনি। এবার সবাই জানতে পারবে তোমাদের রবি-কাকাকে।
অবনীন্দ্রনাথ তাঁর জন্মোৎসব পালনে আপত্তি জানিয়েছিলেন। সেকথা স্মরন করে কবি বললেন, “তুমি নাকি জন্মোৎসব পালনে আপত্তি করছ? দেশের লোক যদি চায়, তোমার তাতে আপত্তি কেন? তোমার তো তাতে কোন হাত নেই”। একেতো কাকার মুখে প্রশংসা, তার উপর বকুনি খেয়ে অবনীন্দ্রনাথ ছোট ছেলের মত মাথা চুলকে, ভয় পাওয়া গলায় বললেন, “তা আদেশ যখন করছ, মালা-চন্দন পরব, ফোঁটানাটা কাটব, তবে কোথাও যেতে পারবনা কিন্তু”। কথা শেষ করেই কবিকে প্রনাম করেই ছুটে বেরিয়ে গেলেন তিনি। হেসে উঠে স্বদক্তি করলেন কবি, শোন, “অবন কিছু চায়না, জীবনেও কিছু চায়নি।
কিন্তু এই একটি লোক যে শিল্প-জগতে যুগ-প্রবর্তন করে দেশের সব রুচি বদলে দিয়েছে। ওঁকে সমাদর করতেই হবে।
অবনকে নিয়ে ভাবতে ভাবতে কবি যেন পুরনো সময়ে হারিয়ে গেলেন। আন্দলনের সময়ে। গোপন সভা, দলবেধে চাঁদা তুলে বেড়ানো, পুলিশি ঝামেলা- উত্তেজনা-পুর্ন সেই সময়।
যৌবনের দীপ্তিতে নতুন কিছু করার আনন্দ ঝলমল করে উঠত তখন।
বিকেলে ডাক্তার সত্তেন্দ্রনাথ রায় কবিকে গ্লুকোজ় ইনজেকশন দিলেন। তাঁর নির্দেশ মতই কবির হাতে নুনের পুটুলির সেঁক দিচ্ছিলেন রানী মহলানবিশ। হঠাৎ কবির হাতটা ঝাকুনি দিয়ে উঠল। অস্ফুট আর্তনাত করে ডাক্তারকে ডেকে আনলেন রানী।
ততক্ষনে প্রবল বেগে সারা শরীরে কাঁপুনি শুরু হয়েছে। ডাক্তার দেখে বললেন, কখনও কখনও গ্লুকোজ ইনজেকশনের রিয়াকশনে এমনটি হয়। ১০০.৪ জ্বরে বেহুশ হয়ে থাকলেন সারা রাত। সকালে কবি উৎফুল্ল গলায় রানীকে বললেন, “প্রতিবার ভাবি এই বুঝি শেষ, কিন্তু আবারও একটা বেরোয়। প্রতিবার ভাবি এই বুঝি ঝুলি খালি হয়ে গেল।
সকাল বেলার অরুন আলোর মত মনে পড়ে কয়েক লাইন... না লিখে রাখলে ওরা যে হারিয়ে যাবে......”
" প্রথম দিনের সূর্য
প্রশ্ন করেছিল
সত্তার নতুন আবির্ভাবে-
কে তুমি?
মেলেনি উত্তর।
বতসর বতসর চলে গেল,
দিবসের শেষ সূর্য
শেষ প্রশ্ন উচ্চারিল
পশ্চিম সাগরতীরে,
নিস্তব্ধ সন্ধ্যায়-
কে তুমি?
পেল না উত্তর"।
দীর্ঘদিন রোগের সঙ্গে লড়াই করে এবার অপারেশনের আগ-মুহুর্তে কবি যেন মানস-চক্ষে পড়ে ফেলেছেন নিজেরই পরমায়ু, জন্ম থেকে মৃত্যু অবধি সময়। কবিতাটিতে দর্শন আছে, তা ছাপিয়ে প্রধান হয়ে উঠেছে মৃত্যু চেতনা। রোমান্টিকতাকে দূরে সরিয়ে রাখা এক নগ্ন মৃত্যু চেতনা।
মুখে অবশ্য তিনি কৌ্তুক করতে ছাড়তেন না। “ডাক্তারদের ভারী বিপদ! আমাকে নিয়ে কত কিছু করছে। কিন্তু কোন দোষই পাচ্ছেনা তাতে! এ তো অদ্ভুত! রোগী আছে রোগ নেই! ডাক্তারদের মন খারাপ না হয়ে কি পারে”! অ্যালোপ্যেথি চিকিৎসা ও অপারেশনের প্রতি তীব্র অনিচ্ছার কারনে মজা করে বল্লেও কথার মাঝে খোঁচা ছিল। অসুস্থতার কারনে অনেকদিন যাবত বিছানায় কবি সোজা হয়ে শুতে পারতেন না। অনেকগুলো বালিশ দিয়ে আধ-শোয়া হয়ে থাকতেন।
পায়ের নিচেও বালিশ দিতে হত। অপারেশনের পর যেহেতু কবিকে কিছুদিন সোজা হয়ে শুতে হবে তাই ডাক্তারের নির্দেশে তাঁর বালিশ কমিয়ে দেয়া হচ্ছিল। যাতে তিনি অভ্যস্ত হতে পারেন। এটা নিয়েও মজা করলেন। “আর কেন রে? পা তুলে থাকা আমার আর চলবে না গো, ডাক্তারদের বিধান।
উঁচু ঘাড়ও চলবে না। যে ঘাড় কোনদিনও নামাইনি, আজ তোদের ডাক্তাররা বলছে ঘাড় নামাও, পা সোজা কর, একি অধঃপতন হল আমার বল দেখি”!
৩০শে জুলাই অপারেশনের দিন ঠীক হলেও কবিকে আগে থেকে জানানো হয়নি। উদ্বিগ্ন কবি জ্যোতিবাবুকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, “আমাকে বুঝিয়ে বলো তো, কতটুকু ব্যাথা পাবো? আগে থেকে সব বুঝে নেয়াই ভাল”। জ্যোতিবাবু বললেন, “কী আর এমন লাগবে, এই যে রোজ এতো ইনজেকশন নিচ্ছেন, সে রকমই সামান্য লাগবে। এমনও হতে পারে, একদিকে ডাক্তাররা অপারেশন করবে আর আপনি শুয়ে শুয়ে কবিতা বলবেন”।
তবুও কবির চিন্তা দূর হলনা। পরদিন সকালেও কবি জানেন না যে আজ তাঁর অপারেশন।
পাথরের ঘরের পুর্বদিকের লম্বা বারান্দা ঘেষে টেবিল সাজানো হয়েছে। নিঃশব্দে ঘর ধোয়া-মোছা চলছে। সাদা পর্দা টাঙ্গিয়ে অপারেশন টেবিল আড়াল করা হয়েছে।
সকালে রানী চন্দকে ডেকে ক্লান্ত গলায় বললেন কবিতা লিখে নিতে। তখনও কেউ জানে না, এটাই বিশ্বকবির শেষ কবিতা।
“তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছ আকীর্ন করি
বিচিত্র ছলনা-জালে,
হে ছলনাময়ী।
মিথ্যা বিশ্বাষের ফাঁদ পেতেছ নিপুন হাতে
সরল জীবনে"।
কবিতা বলা শেষ করে চরম ক্লান্তিতে চোখ বুজে ঘন ঘন শ্বাষ ফেলতে লাগলেন।
আচ্ছন্ন হয়ে থাকলেন অনেকক্ষন। অস্পস্ট স্বরে কয়েকবার ডাকলেন, ‘মামনি’। কবির মুখে প্রতিমা দেবীর নাম শুনে সাহস করে রানী বললেন, “বৌঠান আপনার জন্য অনেক ভাবনায় আছেন। একটা চিঠি লিখবেন বৌঠানকে”? কবি বলে গেলেন, লিখে নিলেন রানী।
“ শুনেছি বড়োর আক্রমন তেমন দুঃসহ নয়।
এইসব ছোট ছোটএর উপদ্রব যেমন! – যা হোক এর ও তো অবসান আছে এবং তারও খুব বেশী দেরী নেই। চুকে গেলে নিশ্চিন্তে থাকব”। চিঠির নিচে কাঁপা হাতে লিখলেন, ‘বাবামশাই’। বিধাতা জানতেন এটাই কবির শেষ সাক্ষর।
বেলা দশটায় প্রশান্ত চন্দ কবির ঘরে এলে কবি যুদ্ধের খবর জানতে চাইলেন।
রাশিয়ান সৈন্যদের কাছে জার্মানরা একটু প্রতিহত হচ্ছে জেনে খুশী হয়ে বললেন, “পারবে, পারবে, ওরাই পারবে। ভারী অহংকার হয়েছে হিটলারের”। সাড়ে দশটার সময় ডাক্তার ললিতকুমার বন্দোপাধ্যায় কবির ঘরে এলেন। উপস্থিত সবাই কবির প্রতিক্রিয়ার কথা ভেবে সস্ত্রস্ত হলেন। ললিতবাবু বললেন, “আজ দিনটা ভাল আছে।
তাহলে আজই সেরে ফেলি”? কবিগুরু হকচকিয়ে উঠে বসতে চাইলেন। দুর্বলতায় পারলেন না। একবার শুধু বললেন, “আজই?” তারপর সবার দিকে চেয়ে বললেন, “তা ভাল, এরকম হঠাৎ হয়ে যাওয়া মন্দ নয়”। তাঁকে খুব শান্ত দেখাল। যেন তৈরী হয়ে নিলেন মনে মনে।
রানীকে বললেন সকালের কবিতাটি পড়ে শোনাতে। শুনে বললেন, “কিছু গোলমাল আছে। তা থাক! ডাক্তরাররা তো বলেছেন অপারেশনের পর মাথাটা আরও পরিস্কার হয়ে যাবে। তখনই ঠিক করে নেবোখন”।
সকাল ১১টায় কবিকে অপারেশন টেবিলে শোয়ানো হল।
উদ্বিগ্ন রথীন্দ্রনাথ ও অন্যরা আশে-পাশে হাটাহাটি করছেন। পর্দার আড়ালে ১০/১২জন ডাক্তার অপারেশনে মগ্ন হলেন। ঠাকুর বাড়িতে পাথরের নিস্তব্ধতা নেমে এল। ১২টা নাগাদ অপারেশন শেষ হলে কবিকে তাঁর বিছানায় আনা হল। যন্ত্রনা কাতর গলায় কবি বললেন, “জ্যোতি মিথ্যে বলেছে।
আমার খুব লেগেছে”। ডাক্তাররা এ কথা শুনে রথীন্দ্রনাথকে বললেন, “বিষয়টা অনেকখানি সাইকোলজিক্যাল”। সারাটা দিন ওষুধের প্রভাবে কবি আচ্ছন্ন থাকলেন। একদিন পরই কবির হিক্কা আরম্ভ হল। খুব কষ্ট পেতে থাকলেন।
টোটকা, কবিরাজি, কিছুতেই উপসম হলনা। শরীরের তাপমাত্রাও বেড়ে গেল। নিঃসাড় পড়ে রইলেন। পরদিন কষ্ট আরও বাড়ল। ডাক্তাররা কেবলি অবস্থা পর্যবেক্ষন ও আলোচনা করছেন।
হিম-শীতল আবহাওয়া চারিদিকে।
২রা আগষ্ট আচ্ছন্নতা ভেঙ্গে দু’একটা কথা বললেন, তাতেই সবার মুখে হাসি ফুটে উঠল। ডাক্তাররা জানতে চাইলেন, “কি রকম কষ্ট হচ্ছে আপনার”? ক্ষীন হাসবার চেষ্টা করে বললেন, “এর কি কোন বর্ননা আছে”? দুপুর থেকে আবার আচ্ছন্ন হয়ে পড়লেন। ডাক্তার বিধানচন্দ্র ছুটে এলেন। “কিডনি ঠিকমত কাজ করছে না”।
এ খবর ছড়িয়ে পড়তেই শান্তিনিকেতন থেকে গুরুতর অসুস্থ প্রতিমা দেবীকে নিয়ে কৃষ্ণ কৃপালিনি ছুটে এলেন। রথীন্দ্রনাথ, মীরা দেবী- সবাই মুষড়ে পড়লেও একমনে কর্তব্য করে যাচ্ছেন। ৪ঠা আগষ্ট ভোরে কবি একটু সাড়া দিলে প্রতিমা দেবী কানের কাছে মুখ নিয়ে বললেন, “বাবামশায়, আমি এসেছি, আপনার মা-মনি”। কয়েকবার বলার পর চোখ দুটো অতি কষ্টে একটু খুলে মাথা নাড়লেন। আবার হারিয়ে গেলেন অবচেতনের গহীন অন্ধকারে।
সকলের চোখে অশ্রু। ৫ই আগষ্টও আচ্ছন্ন, অচেতন অবস্থায় কাটল। বিকেলে ডাক্তার বিধানচন্দ্র রায় ও নীলরতন সরকার এলেন। কবির ইচ্ছার বিরুদ্ধে অপারেশনের উপর বিধানবাবুর মতই ছিল প্রবল। তাঁর মত- “দেশবাসীর স্বার্থে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নিরাময় প্রয়োজন।
এ ক্ষেত্রে কবির নিজের মত ততটা গুরুত্বপুর্ন নয়। প্রয়োজনীয় বাস্তবতার উপরই তিনি জোর দিয়েছিলেন। ডাক্তার নীলরতন সরকারের মত ছিল ভিন্ন। রবীন্দ্রনাথকে জোর করে অপারেশন করা তিনি মন থেকে মেনে নিতে পারেন নি। তিনি মনে করতেন আর দশটা সাধারন মানুষ বা সাধারন রোগীর কাতারে রবীন্দ্রনাথ নন।
নীলরতন সরকার ছিলেন কবির দীর্ঘদিনের সুহৃদ। যতক্ষন পাশে ছিলেন, অচেতন কবির ডান হাতের উপর পরম ভালবাসায় নিজের হাত বুলিয়ে গেলেন। বিদায় কালে তিনি এমন ভাবে ফিরে কবিকে দেখলেন যেন চির-বিদায় নিচ্ছেন। আশেপাশের অনেকেই কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন।
জোড়াসাঁকোর বাড়িটির আনাচে কানাচে দুঃখ বেদনা হতাশার পাশাপাশি ক্ষোভও পাক খাচ্ছিল।
কবির ঘনিষ্ঠ মানুষেরা অনেকেই ডাক্তার নীলরতন সরকারের মত ক্ষুদ্ধ। কবি স্পষ্টই বলেছিলেন, যেন তাঁর মৃত্যু শান্তিনিকেতনে হয়। নিজের শেষ হয়ে যাওয়া বুঝতে পেরেই তিনি অস্ত্রাঘাতহীন থাকতে চেয়েছিলেন। রাতের পর রাত-জাগা কাছের মানুষেরা আজ কবির এই পরিনতিতে ক্ষুদ্ধ হয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মৃত্যু সম্ভবনা প্রবল হয়েছে এ খবর চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল।
জোড়াসাঁকো লোকে লোকারন্য হয়ে গেল।
শ্রাবন পুর্নিমার রাত। চাঁদের আলোয় চারিদিক ভেসে যাচ্ছে। শ্রাবন আজ কান্না লুকিয়েছে। কিন্তু জোছনার ভেজা কান্না মিশে গেলো মানুষের চোখের জলের সাথে।
বারান্দায় দাঁড়িয়ে জোছনার সাথে কাঁদছিলেন প্রতিমা দেবী। সুধাকান্ত ও রানী চন্দের ডাকে ধীর পায়ে ‘বাবামশায়ের পাশে গিয়ে দাড়ালেন। কবির পুব-মুখী শিয়রের ওপাশে আকাশে শান্ত, স্নিগ্ধ পুর্নিমার চাঁদ। আর সে চাঁদের উপচে পড়া আলো ছড়িয়ে আছে কবির শরীরে। যেন জোছনা মাখা চন্দন ঝরে পড়ছে বিশ্বকবির অনন্তলোকগামী দুটি ডানায়।
কবি ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছেন জোছনায়। জোছনায় ভেসে আসে সুর- “ কে যায় অমৃতধাম যাত্রী......”।
রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় কবির শেষ-শয্যা পাশে উপাসনা করলেন। ৭ই আগষ্ট, রাত ১২-১০ মিনিটে কবি মিলিয়ে গেলেন অমৃতলোকে। শ্রাবনের শরীরে ছায়া ফেলে গেলো চির বিষাদ।
সুত্রঃ বাইশে শ্রাবন/ বিভাস রায়চৌধুরী।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।