. আমার নাইবা হলো পারে যাওয়া...
মীরা, প্রতিমা, ইন্দিরা, মৈত্রেয়ী, রানী চন্দ, রানী মহলানবিশ- এরা কেউ কন্যা, পুত্রবধু, ভ্রাতুস্পুত্রী, কেউবা স্নেহভাজন। এরা কাছে থাকলে রবীন্দ্রনাথ কৌতুকে মেতে উঠেন। অবশিষ্ঠ জীবনীশক্তিটুকু প্রকাশ পায়।
সারাদিন প্রানপনে নিজেকে ভুলিয়ে স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করলেও রাতে আর কোনো ভান টিকতো না। কষ্ট পেতেন কবি।
ডাক্তার বিধান চন্দ্র রায় স্বাস্থ্য পরিক্ষা করে গম্ভীর মুখে কলকাতায় ফিরে গেলেন। সংবাদপত্রে গভীর আশংকার কথা প্রচারিত হল। শেষ পর্যন্ত কবিকে বলতেই হল, “ ডাক্তারেরা মনে করছেন আপনার অপারেশনটা করিয়ে ফেলা উচিত। আর দেরী করা ঠিক হবে না। অপারেশন করলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।
মাথার কাজ আবার স্বচ্ছন্দে দশ বছর চালিয়ে নিতে পারবেন। তাই বিধান বাবুরা রথীবাবুকে বলেছেন অপারেশন এখনই হয়ে যাক!” কবি জানতেন, তার মঙ্গল আকাঙ্ক্ষায় শুভাকাংখীরা তার মত অগ্রাহ্য করবেন। তবুও যেন মনে ক্ষীন আশা ছিল, কবিরাজ মশাই তাঁকে অস্ত্রঘাত থেকে রক্ষা করতে পারবেন। ব্যাক্তও করলেন সে আশা। কবিকে আশ্বাষ দেয়া হল, এক মাসের মাঝে যদি কবিরাজ মশাই যদি রোগ সারিয়ে বা কমিয়ে দিতে পারেন তবে তো আর অপারেশনের প্রশ্নই উঠবেনা।
ছোট কবিরাজ কমলাকান্তকে ডেকে কবি বললেন, “ দ্যাখো হে, ডাক্তারদের সাথে লড়ে এক মাস সময় নিয়েছি। এইবার ছাড়ো তোমাদের ব্রহ্মাস্ত্র। এই এক মাসের মাঝে যেমন করে পারো আমাকে অস্ত্রাঘাত থেকে রক্ষা কর”। ছোট কবিরাজের আশ্বাষ পেয়ে কবির উৎসাহ বেড়ে গেল। একটু পর পর সেবিকাদের জানাচ্ছেন, ভালো ফল পাচ্ছেন।
পায়েস চেয়ে খাচ্ছেন। নাতনি নন্দিতার জন্মদিনের ভোরবেলায় আড়ষ্ঠ আঙ্গুলে অনেক পরিশ্রমে স্ব-হস্তে লিখিত কবিতা উপহার দিলেন। প্রচন্ড আবেগগ্রস্ত হয়ে বিষাদ-মাখা কন্ঠে আক্ষেপ করলেন, “ আমি আর পারি না। বিধাতা আমার সব শক্তি কেড়ে নিলেন...। আগে কত অজস্র লিখেছি, আর আজ অতি কষ্টে এইটুকু লিখতে পারলুম।
আংগুলের জন্য অক্ষরগুলো পর্যন্ত পরিস্কার হলনা। বিধাতাকে দত্তপহারক বলতে ইচ্ছে করে”।
শরীর মন ভেঙ্গে গেলেও কর্তব্য, দায়িত্বজ্ঞান অটুট ছিলো। ক’দিন পরেই অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সত্তর বছর বয়স হবে। সেটা পালন করার নির্দেশ দিয়েছেন কবি।
অবনীন্দ্রনাথকে নিয়ে তাঁর বক্তব্যও সুধাকান্ত বাবুকে দিয়ে লিখিয়ে রাখলেন। কবির নির্দেশে রানী চন্দ অবনীন্দ্রনাথের যে কথাগুলো লিখে রেখেছিলেন, তা দিয়ে ‘ ঘরোয়া’ গ্রন্থটি প্রকাশিত হবে। রানী চন্দকে ডেকে নির্দেশ দিলেন, তাড়াতাড়ি কলকাতায় গিয়ে অবনের কাছ থেকে ঘরোয়ার জন্য আরো কিছু গল্প আদায় করে আনতে। বললেন, “অবনকে গিয়ে বলিস আমি খুব খুশী হয়েছি। জীবনের যেসব ঘটনা ভুলে গিয়েছিলুম, তা অবনের মুখে এমন করে ফুটে উঠবে তা কখনো ভাবিনি”।
সমস্ত দেশ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্য উদ্বিগ্ন। তাঁকে অপারেশনের জন্য জোড়াসাঁকো নিয়ে যাওয়া হবে। অপারেশনে কবির তীব্র অনিচ্ছা দেখে ঘনিষ্ঠ চিকিৎসকরা পর্যন্ত বলছেন, কবির অসম্মতিতে এ ভাবে অপারেশন না করালেই ভালো হয়। তিনি যে ভালো হয়ে যাবেনই এ বয়সে তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। কিন্তু বিখ্যাত চিকিৎসক ডাক্তার বিধানচন্দ্র রায়ের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে যাবার সাহস কারোরই হলনা।
প্রতিমা দেবী খুব অসুস্থ হয়ে পড়লেন। ব্রহ্মাইটিস। ডাক্তারের নির্দেশে কবির ঘরে আসা বন্ধ হয়ে গেল তাঁর। অপারেশনের আগে কবি যাতে সর্দি-কাশির জিবানুতে সংক্রামিত না হন তাই এই ব্যাবস্থা। রথীন্দ্রনাথ ও অনিলচন্দ আগের দিন কলকাতা যাবার সময় কবিকে বললেন, “গুরুদেব, আপনার গাড়ীর ব্যাবস্থা করার জন্য আগে চলে যাচ্ছি”।
জানালার বাইরে মুখ ফিরিয়ে কবি বললেন, “গাড়ীর ব্যাবস্থা, না মারার ব্যাবস্থা করতে যাচ্ছ”? উপস্থিত সকলেই এ কথায় আতকে উঠল। অনিলচন্দ ধরা গলায় শুধু বললেন, “গুরুদেব”। সমবেত প্রতিবাদে কবি একটু হেসে বিষয়টা হালকা করার জন্য বললেন, “বাঙ্গাল ঠাট্টাও বোঝেনা”। যদিও অভিমানহত হৃদয় থেকে কথাটা উঠে এসেছিল।
পরদিন যাওয়া হবে।
বিপন্নতম এই পরিস্থিতিতে কবিগুরু তার সবচেয়ে ভরসার মামনিকে( প্রতিমা দেবী) দেখতে না পেয়ে আকুল হলেন। প্রতিমা দেবীর অনুপস্থিতির কারন তাঁকে বুঝিয়ে বলা হল।
সন্ধ্যার পর নন্দলাল বসু, ক্ষিতিমোহন সেন সহ কয়েকজন আশ্রম-সঙ্গিকে কাছে পেয়ে প্রানপনে পুরনো মেজাজে ফেরার চেষ্টা করলেন। ঠাট্টা তামাশা করছেন, কিন্তু সব কথাই ঘুরে ফিরে অপারেশন প্রসঙ্গে এসে কবিকে আনমনা করে তুলছিলো। ভোরে পোষাক পরে তৈরী হয়ে কবি পুবের জানালায় বসলেন।
শান্তিনিকেতনের ভোর হওয়া শেষ ইন্দিয় দিয়ে উপভোগ করলেন। আশ্রমের ছেলে-মেয়েরা গাইতে গাইতে এল।
“এ দিন আজি কোন ঘরে গো খুলে দিল দ্বার,
আজি প্রাতে সূর্য ওঠা সফল হল কার”।
উদয়নের ফটক পেরিয়ে তারা কবির জানালার নিচে এসে দাড়াল। এরা একদিনও অসুস্থ কবির কাছে আসতে পারেনি।
বিদায় বেলায় তাদের নিরব ভালবাসা-পুর্ন নিঃশব্দ প্রনাম অন্তর দিয়ে গ্রহন করলেন। তাদের নিরুচ্চার প্রার্থনায় কবি অশ্রুসিক্ত হলেন।
যাবার সময় হয়ে এল। বড় ইজি-চেয়ারে বসিয়ে কবিকে নামিয়ে এনে উদয়ন প্রাঙ্গনে ক্ষানিক রাখা হল। কবির দু’চোখ কালো চশমায় ঢাকা।
চারিদিকে মুখরিত হল।
“আমাদের শান্তিনিকেতন, সেযে সব হতে আপন।
তার আকাশ ভরা কোলে, মোদের দোলে হৃদয় দোলে।
মোরা বারে বারে দেখি তারে নিত্যই নতুন”
ছাতিমতলা, আম্রকুঞ্জ পার হতে হতে কবির শুখনো রুগ্ন গালে অশ্রু-ধারা গড়িয়ে পড়ল। জীবনে এতো প্রিয়জন বিচ্ছেদের শোক সহ্য করেছেন, কিন্তু শান্তিনিকেতন ছেড়ে যেতে কবি মনে মনে কাতর হয়ে পড়লেন।
দুরদর্শী মানুষটি কি তাঁর ভাগ্যলিপি পড়তে পেরেছিলেন? বুঝতে পেরেছিলেন যে আর এখানে ফেরা হবেনা তাঁর? কে দেবে উত্তর...।
আশ্রম পেরিয়ে গাড়ী রাস্তায় পৌছতেই দেখা গেল, পথের দু’পাশে গ্রামের মানুষ নীরব শ্রদ্ধা ও চোখের জল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কবির যাত্রা সংবাদ শুনতেই তারা নিজের শ্রমে রাস্তার খানা-খন্দ মাটি ফেলে ভরিয়েছে। যাতে যাত্রাপথে কবির কষ্ট না হয়। সাধারন মানুষের কাছে দেবতার সম্মান পেয়েছেন তিনি।
খ্যাতির বদলে এই প্রীতিকেই কবি বেশী মূল্য দিয়েছেন।
স্টেশনে পৌছে ব্যাবস্থা মোতাবেক বিশেষ সেলুনে তোলা হল কবিকে। যতক্ষন বোলপুর দেখা যায় ততক্ষনই কবি জানালার সামনে বসে ছিলেন। অজয় নদ পেরিয়ে যাবার পর চোখ বন্ধ করে শুয়ে পড়লেন। বর্ধমান স্টেশনে রেলের কর্মকর্তা এসে জিজ্ঞাসা করলেন, “গুরুদেব, কষ্ট হচ্ছে না তো”? সঙ্গে সঙ্গে ক্ষীন গলায় উত্তর দিলেন, “না, মুন্ডু খেতে খেতে বেশ চলেছি”।
কবিগুরুর কলকাতা আসার খবর গোপন রাখায় হাওড়া স্টেশনে ভীড় হয়নি। নির্বিঘ্নে কবি জোড়াসাঁকোর বাড়ীতে পুরনো পাথরের ঘরে এসে পৌছলেন।
চলবে...।
লেখা সুত্রঃ বাইশে শ্রাবন/ বিভাস রায়চৌধুরী।
ছবিঃ হুপফূলফরইভার
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।