আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

চালকের একগুঁয়েমিতে তুরাগে হারাল বাস



বৈশাখী পরিবহনের একটি বাস গতকাল রবিবার সকাল ১০টার দিকে ঢাকার বাড্ডা থেকে সাভারের উদ্দেশে ছেড়ে যায়। বাসটি ছিল ৫২ আসনের। চালক ও হেলপারসহ আরোহী ছিলেন ৫৪ জনের মতো। শুরু থেকেই চালক দ্রুতগতিতে বাস চালাচ্ছিলেন। যাত্রীরা তাঁকে বারবার সাবধান করছিলেন।

কিন্তু চালক কারো কথার তোয়াক্কা করছিলেন না। সকাল আনুমানিক সোয়া ১১টার দিকে গাবতলী-আমিনবাজার পার হয়ে সালেহপুর সেতুর কাছে পেঁৗছার আগেই বাসের সামনের দিকের একটি চাকা পাংচার হয়ে যায়। এর পরও চালক ওই অবস্থাতেই দ্রুতগতির আরেকটি বাস অতিক্রমের চেষ্টা করেন। আর এ সময় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বাসটি সেতুর ওপর থেকে তুরাগ নদে পড়ে তলিয়ে যায়। এ দুর্ঘটনার পর বাসের কয়েকজন যাত্রীর সঙ্গে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্রীকে উদ্ধার করা হলেও পরে তিনি মারা যান।

তাঁর নাম মনোয়ারা হোসেন তারা। তিনি ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী। বাসের আরোহীদের মধ্যে আট থেকে ১০ জন সাঁতরে তীরে উঠতে সক্ষম হন বলে প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছ থেকে জানা যায়। বাকিদের কী পরিণতি হয়েছে, গত রাতে এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত জানা যায়নি। এমনকি নদে তলিয়ে যাওয়া বাসটির অবস্থানও শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি।

আশঙ্কা করা হচ্ছে, বাকি অন্তত ৪৫ জন আরোহীর সলিলসমাধি ঘটেছে। সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, ফায়ার ব্রিগেড, র‌্যাব ও পুলিশ যৌথভাবে আরোহীদের উদ্ধারের চেষ্টা চালাচ্ছিল। দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে আসা লোকজন কালের কণ্ঠকে জানান, বাসটি পানিতে পড়ে যাওয়ার পর তাঁরা নিজেরা যে কিভাবে বাসের ভেতর থেকে বাইরে চলে আসেন, তা বুঝে উঠতে পারছেন না। তবে অধিকাংশ যাত্রীই বের হয়ে আসতে পারেননি এবং বাসের মধ্যেই আটকে আছেন বলে তাঁরা জানান। উদ্ধারকাজে নিয়োজিত সেনা, নৌ ও ফায়ার ব্রিগেড সূত্র জানায়, তুরাগ নদের পানির গভীরতা ৩০ ফুটের কিছু বেশি।

দুর্ঘটনার সময় স্রোতও ছিল প্রবল। আর তাই ধারণা করা হচ্ছে, বাসটি নদে পড়ামাত্রই স্রোত অনেক দূরে ঠেলে নিয়ে গেছে। তাই বাসটির অবস্থান বের করা সম্ভব হচ্ছে না। দুর্ঘটনার পর থেকেই ডুবুরিরা কাজ করছেন। সন্ধ্যার পর থেকে বিশেষভাবে আলোর ব্যবস্থা করে ডুবুরির সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে।

টানা উদ্ধার অভিযান চালানো সম্ভব হলে রাতের মধ্যেই উদ্ধারকাজ শেষ হতে পারে বলে উদ্ধারকর্মীরা জানান। দুর্ঘটনার পর ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, এলাকাবাসীকে সঙ্গে নিয়ে উদ্ধারকাজ চালাচ্ছেন সেনা, নৌ, পুলিশ ও র‌্যাবের সদস্যরা। অনেকে নৌকায় করেও উদ্ধারকাজে অংশ নিচ্ছেন। তবে বাসের অবস্থান নিশ্চিত না হওয়ার কারণে তাঁরা শুধু এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করছিলেন। এরই মধ্যে বাস থেকে বের হয়ে আসা কয়েকজন যাত্রীকে তাঁরা উদ্ধার করেন।

উদ্ধার হওয়া বাসযাত্রী জসিম উদ্দিন কালের কণ্ঠকে জানান, দুর্ঘটনার সময় তিনি ঘুমিয়ে ছিলেন। চিৎকার শুনে চোখ মেলেই দেখতে পান বাসটি যেন শূন্যপথ ধরে এলোমেলো পানির দিকে ছুটে চলেছে। মুহূর্তের মধ্যে তিনি বুঝে ফেলেন কী ঘটতে যাচ্ছে। আর বোঝামাত্রই তিনি অনেক চেষ্টা করে জানালা দিয়ে বের হয়ে আসেন। তবে ততক্ষণে বাসটি পানিতে তলিয়ে প্রবল স্রোতের কারণে ঘূর্ণির মতো ঘুরপাক খাচ্ছিল।

এরপর তিনি আর কিছু বলতে পারেন না। হয়তো জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। তার শুধু এটুকুই মনে পড়ে, একদল লোক এসে তাঁকে পানি থেকে টেনে নৌকায় তুলছে। উদ্ধার হওয়া আরেক যাত্রী তপন জানান, বাসটি বেপরোয়া গতিতে চলছিল। মূলত চাকা পাংচার হয়ে যাওয়ার পর চালক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে দুর্ঘটনার কবলে পড়েন।

এ দুর্ঘটনার জন্য চালকের বেপরোয়া গাড়ি চালানোই মূল কারণ বলে তিনি জানান। এদিকে উদ্ধার তৎপরতার গতি নিয়ে এলাকাবাসীর ক্ষোভ আর তোপের মুখে পড়ে স্থানীয় প্রশাসন এবং উদ্ধারে অংশ নেওয়া বিভিন্ন সংস্থার সদস্যরা। এ ক্ষোভ একসময়ে বিক্ষোভে পরিণত হয়। এলাকাবাসী স্লোগান দিতে শুরু করে এবং অনেকটা মারমুখী হয়ে ওঠে। এ পর্যায়ে র‌্যাব ও পুলিশ বিক্ষোভকারীদের লাঠিপেটা করলে পরিস্থিতি আরো উত্তপ্ত হয়ে ওঠে।

পরে স্থানীয় নেতারা এবং ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে। বিক্ষোভে অংশ নেওয়া যুবক আলী হোসেন, আসাদুজ্জামান তপনসহ আরো কয়েকজন জানান, দুর্ঘটনার অনেক পরে এসে পেঁৗছেন উদ্ধারকারী দলের সদস্যরা। এরপর তাঁরা প্রক্রিয়া শুরু করতেই অনেক সময় নেন। বেশ কয়েকজন ডুবুরি থাকলেও সবাইকে মাঠে নামায়নি তাঁরা। তাঁদের এ ঢিলেমির কারণেই বাসটি স্রোতে অনেক দূর চলে গেছে বলে তাঁরা অভিযোগ করেন।

তাঁদের দাবি, দ্রুত তৎপরতা শুরু করলে হয়তো অনেক যাত্রীকেই উদ্ধার করা সম্ভব হতো। এ ব্যাপারে উদ্ধারকাজে অংশ নেওয়া সেনাবাহিনীর প্রকৌশল বিভাগের একজন মেজর নাম প্রকাশ না করার শর্তে কালের কণ্ঠকে বলেন, আসলে উদ্ধার প্রক্রিয়া সম্পর্কে অজ্ঞতার কারণেই এ ধরনের অভিযোগ আসে। এটি খুবই স্বাভাবিক। দুর্ঘটনার পর সেতুর নিচ দিয়ে নৌকা চলাচল করেছে। এতে তাঁদের কাজে বিঘ্ন ঘটেছে।

এ ছাড়া ডুবুরির সংখ্যা বেশি হলেও তাঁদের সবাইকে একসঙ্গে নামানো সম্ভব নয়। এতে পানির তলায় এ ডুবুরিরাই বিপদে পড়তে পারেন। যাঁরা এ ব্যাপারে প্রশিক্ষিত, তাঁরা বিষয়টা বুঝবেন। ফায়ার ব্রিগেডের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার আবু নাঈম মোহাম্মদ শহিদুল্লাহ কালের কণ্ঠকে জানান, তাঁরা তাঁদের সঙ্গে থাকা বিভিন্ন যন্ত্রপাতি নিয়েই উদ্ধার তৎপরতা চালাচ্ছেন। ঢাকার বাইরে চট্টগ্রাম থেকেও সোনারসহ কিছু আধুনিক উদ্ধার সরঞ্জাম আনা হয়েছে।

এই সোনার যন্ত্র দিয়ে পানিতে শব্দ ছড়িয়ে দিয়ে এর প্রতিধ্বনির ভিত্তিতে পানিতে কোনো ধাতব বস্তুর অবস্থান খুঁজে বের করা হয়। তবে তাঁদের মূল লক্ষ্য আগে বাসটির অবস্থান নির্ণয় করে ভেতরে কেউ আটকে থাকলে তাঁকে আগে উদ্ধার করা। নৌবাহিনীর ডুবুরি নোমান জানান, নদের তলদেশ অসমতল এবং নদে প্রচণ্ড স্রোত থাকায় তাঁদের কাজ করতে সমস্যা হচ্ছে। এ নদের পানির গভীরতা প্রায় ৯৫ ফুট বলে তিনি জানান। ঘটনাস্থলে উপস্থিত ঢাকার জেলা প্রশাসক মো. মোহিবুল হক জানান, নদে প্রচণ্ড স্রোত থাকায় বাসটি তাৎক্ষণিকভাবে উদ্ধার করা সম্ভব হচ্ছে না।

তবে চেষ্টার কোনো ত্রুটি নেই। উদ্ধারে সেনাবাহিনী ও নৌবাহিনীর উদ্ধারকর্মীদের সঙ্গে স্থানীয় লোকজনও যোগ দিয়েছেন। ফায়ার ব্রিগেডের ডুবুরিরা বাস উদ্ধার করতে সার্চলাইট নিয়ে নদে নেমেছেন। ধারণা করা হচ্ছে, স্রোতের টানে ঘটনাস্থল থেকে বাসটি দক্ষিণ দিকে অনেক দূর চলে গেছে। স্থানীয় প্রশাসন জানায়, ঘটনার পর আটজন নারী ও পুরুষ সাঁতরে তীরে উঠেছেন।

তাঁদের কয়েকজনকে সাভারের এনাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। তাঁদের মধ্যে অচেতন অবস্থায় ছিলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী মনোয়ারা হোসেন তারা। কর্তব্যরত চিকিৎসক তারাকে মৃত ঘোষণা করেন। গতকাল বিকেলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন, যোগাযোগমন্ত্রী আবুল হোসেন, পুলিশের মহাপরিদর্শক হাসান মাহমুদ খন্দকার, র‌্যাবের মহাপরিচালক মোখলেসুর রহমান ঘটনাস্থলে ছুটে গিয়ে উদ্ধার তৎপরতা পর্যবেক্ষণ করেন। তাঁরা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের প্রয়োজনীয় সব ধরনের সহযোগিতার আশ্বাস দিয়ে দ্রুততার সঙ্গে উদ্ধারকাজ চালানোর নির্দেশ দেন।

পুলিশের আইজি হাসান মাহমুদ খন্দকার কালের কণ্ঠকে জানান, উদ্ধারের জন্য প্রয়োজনীয় সব প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে। এখন পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা একজনই। সূত্র : কালের কন্ঠ

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.