বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, পুন্য হউক, পুন্য হউক, পুন্য হউক, হে ভগবান। বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ, পুর্ন হউক, পূর্ন হউক, পূর্ন হ্উক, হে ভগবান। রবীন্দ্রনাথ
মিথ্রা। ইরানের প্রাচীন নাম পারস্য। সেই প্রাচীন পারস্যের সত্য, সংবিধান, চুক্তি, বিচার ও শপথের দেবতা ছিলেন মিথ্রা।
এ ছাড়া মিথ্রা গবাদি পশু, নবান্ন ও পানির অভিভাবক ছিলেন ; মিথ্রা কৃষি সংশ্লিষ্ট দেবতা বলেই সম্ভবত প্রাচীন পারস্যের আর্যরা মিথ্রার উদ্দেশ্যে ষাঁড় বলি দিত। প্রাচীন পারস্যের কোনও কোনও অঞ্চলে মিথ্রা কে সূর্যদেব মনে করা হত ।
পারস্যের মানচিত্র।
পরবর্তীকালে পারস্যের ভাষায় পরিবর্তন হয়। মিথ্রা নামটিও বদলে হয়ে যায়।
মিথ্রা হয়ে ওঠে মিহির। মিহির শব্দটি বাংলা ভাষার অর্ন্তগত একটি শব্দ, এর মানে আগুন। বাংলা ভাষার মিহির শব্দের উৎপত্তি ওই প্রাচীন পারসিক শব্দ মিথ্রা থেকে । মিহির শব্দটি কি সংস্কৃত থেকে বাংলায় এসেছে? নাকি ফারসি থেকে?
মিথ্রা-উপাসক প্রাচীন পারস্যের ইরানি আর্যরা ১৫০০ খ্রিস্টপূর্বে প্রাচীন ভারতে এসেছিল। যার ফলে ভারতীয় সংস্কৃত ভাষায় আমরা যে 'মিত্র' শব্দটি পাই তার মূলে মিহির শব্দটি ।
তার মানে মিত্র ও মিথ্রা শব্দগত ভাবে অভিন্ন । মিত্র শব্দের মানে মিত্রতা বা বন্ধুত্ব। যা আবার প্রাচীন পারস্যের আভেস্তার ভাষায় সংবিধান, চুক্তি এবং শপথ।
খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতকেই ভূমধ্যসাগরের পূর্ব তীরের রাজ্যসমূহ রোমান সাম্রাজ্যের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। ফলে এশিয়া মাইনর (বর্তমান তুরস্ক )
রোমান সাম্রাজ্যের অধীন হয়ে পড়ে।
এর আগে এশিয়া মাইনর ছিল পারস্য সাম্রাজ্যের দখলে। প্রাচীন পারস্যের অন্যতম ধর্ম ছিল জরথুশত্রবাদ। তবে পারস্যজুড়ে জরথুশত্র ধর্মের পাশাপাশি জরথুশত্রবাদ- পূর্ববর্তী সময়ের দেবতা মিথ্রার উপাসনাও হত।
রোমান সাম্রাজ্যের মানচিত্র।
এশিয়া মাইনরেই প্রথম রোমানদের সঙ্গে পারসিক দেবতা মিথ্রার উপাসনার পরিচিতি ঘটে ।
বিশেষত রোমান সৈন্যরা দেবতা মিথ্রা দ্বারা অনুপ্রাণিত হয় এবং দীক্ষিত হয়। এরাই মিথ্রার উপাসনা রোমে নিয়ে আসে। পরবর্তী সময়ে মিথ্রার উপাসনায় তিনটি প্রধান পরিবর্তন আসে। প্রথমত: ধর্মটির নাম হয় Mithraic mysteries বা মিথ্রীয় রহস্যবাদ (ইচ্ছে করেই মরমী শব্দটি ব্যবহার করলাম না। ) দ্বিতীয়ত: এতকাল পারস্যে যা ছিল প্রকাশ্য ধর্ম এখন তা হয়ে গেল গুপ্ত! এবং আমার মনে হয় পরবর্তীকালে খ্রিস্টানধর্মের গুপ্ত স¤প্রদায়গুলির শিকড় এখানেই প্রোথিত (যারা ড্যান ব্রাউনের দা ভিঞ্চি কোড পড়েছেন, তারা আমার এই কথাটির মানে বুঝতে পারবেন)।
মিথ্রাবাদ কেন গুপ্ত হল-প্রকাশ্য হল না-সে নিয়েও ভাবা যেতে পারে। তৃতীয়ত: আমি আগেই বলেছি, মিথ্রা কৃষি সংশ্লিষ্ট বলেই সম্ভবত প্রাচীন পারস্যের আর্যরা মিথ্রার উদ্দেশ্যে ষাঁড় বলি দিত। নব্য দীক্ষিত রোমানরাও ষাঁড় বলি দিত তবে তারা মিথ্রাকে নভমন্ডলের সঙ্গে প্রবলভাবে সম্পৃক্ত করেছিল ।
দেবতা মিথ্রা এবং নভমন্ডলের সম্পর্ক রহস্যময় ও গভীর
কিন্তু প্রশ্ন হল রোমান সৈন্যরা দেবতা হিসেবে মিথ্রাকে কেন গ্রহন করল?
সম্ভবত তারা তাদের ক্লিস্ট জীবন থেকে উদ্ধারের আশা করছিল এবং তৎকালে প্রচলিত রোমান ধর্ম-যা মূলত বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে প্যাগান, সেই সব সৈন্যদের জীবনের আশা-আকাঙ্খা পূরণ করতে পারছিল না। এ কারণেই সম্ভবত মিথ্রীয় রহস্যবাদে দীক্ষিত রোমানরা মিথ্রাকে মনে করেছিল উদ্ধারকর্তা।
একটি মিথ্রীয় রহস্যবাদী উপাসনালয়ের দেয়ালে এই কথাটি খোদিত ছিল ... আমাকে উদ্ধার করিতে রক্ত দিবে ...
মিথ্রা। অনেকটা যেন রোমান দেবতার মতো দেখতে। মিথ্রাকে প্রধান দেবতা হিসেবে গ্রহন করার আগে রোমানরা জুপিটার মার্স মারকারি মিনার্ভা নেপচুন ভেনাস প্রমূখ মানবীয় আবেগশূন্য দেবদেবীর উপাসনা করত। এসব দেবদেবীর অবস্থান স্বর্গলোকে- সাধারণ মানুষের নিত্যদিনের ব্যথা-বেদনা ও আনন্দ-খুশির বহুদূরে। মানুষের আকর্ষন তাই মানুষের হৃদয়ের স্পন্দন বুঝতে সক্ষম এমন দেবতার প্রতি।
ভারতবর্ষেও এমনটি দেখা গিয়েছে। নিরাসক্ত ইন্দ্র-বরুনের চেয়ে অনার্য শিব মানুষের প্রাণের অনেক কাছাকাছি। শিব এর এক নাম: আশুতোষ; এর মানে শিবকে বেলপাতা দিয়ে তুষ্ট করা যায়। বাংলায় আবার অন্নদাত্রী দূর্গার প্রবল জনপ্রিয়তা। দূর্গার সংসার মানুষ নিজের সংসারের মতোই সাজিয়েছে।
মিথ্রা । সাধারণ রোমান নাগরিকদের নিত্যদিনের সুখদুঃখের প্রতি নিরাসক্ত ছিলেন না? রোমান সৈন্য ছাড়াও সাধারণ মধ্যবিত্ত, সরকারি কর্মচারী এবং দাসরা ছিল মিথ্রীয় রহস্যের উপাসক। কেবল রোমেই মিথ্রার ৩৫টি উপাসনালয়ের কথা জানা গেছে। এ ছাড়া বর্তমান তুরস্ক এবং ব্রিটেন ছিল সেখানেও ...উপাসনা হত। প্রায় ৩০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে রোমান সাম্রাজ্যের শাসকগন মিথ্রীয় রহস্যের উপাসনা করেছে।
যে কারণে খ্রিস্টীয় ৩য় ও চতুর্থ শতকে রোমান সাম্রাজ্যে মিথ্রার উপাসনার চরম উৎকর্ষ সাধিত হয়। অবশ্য মিথ্রা খ্রিস্টর কাছে পরাজিত হন, যেহেতু রোমান সাম্রাজ্য খ্রিস্ট ধর্মকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে গ্রহন করে এবং ৩৯১ খ্রিস্টাব্দে থিওডোসিয়ান ড্রিক্রির মাধ্যমে রোমান সাম্রাজ্যে মিথ্রীয় রহস্যের উপাসনা নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়।
একটি মিথ্রীয় উপাসনালয়ের প্রবেশ পথ
দূর্ভাগ্যজনকভাবে মিথ্রীয় রহস্যবাদ সর্ম্পকে সমসাময়িক কোনও লিখিত নথি পাওয়া যায়নি। মিথ্রীয় রহস্যবাদের দীক্ষিতরা তাদের ধর্মবিশ্বাস, আচার-অনুষ্ঠান ও অন্যান্য বিষয়ে লিখে যায়নি। কাজেই মিথ্রীয় রহস্যবাদ সম্বন্ধে তেমন কিছু জানা যায় নি।
বস্তুত মিথ্রীয় রহস্যবাদ সম্বন্ধে জানা গেছে মূলত প্রত্নতাত্ত্বিক ও শিলালিপি বিচারবিশ্লেষন করে এবং ওই সময়কাল রোমান লেখকদের রচনা থেকে। কাজেই মিথ্রীয় রহস্যবাদ সম্বন্ধে তথ্য ভারি অপ্রতুল।
মিথ্রীয় রহস্যবাদী উপাসনালয়; একে বলে Mithraeum. মিথ্রীয় রহস্যবাদী উপাসনালয় নির্মাণ করা হত অন্ধকার জানালাশূন্য ভূগর্ভস্থ পাথুরে কক্ষে। এর এক কারণ, বিশ্বাস করা হত যে মিথ্রার উদ্ভব পাথর থেকে! প্রাচীন পারস্যে এরকম বিশ্বাস ছিল কি না বলতে পারব না। যা হোক।
মিথ্রীয় রহস্যবাদী উপাসনালয় একেবারেই রোমান স্থাপত্যের মতো নয় বরং এই উপাসনালয়ের বাইরের দিক থেকে দেখতে অনাড়ম্বর। এটা কি প্রাচ্যের অনাড়ম্বরহীনতার প্রভাব? পারস্য তো প্রাচ্যই। তবে উপাসনালয়ের অভ্যন্তরটি ছিল মহাকাশের দৃশ্যাবলীতে ভরপুর। কেননা, আমি আগেই বলেছি, মিথ্রা কৃষি সংশ্লিষ্ট বলেই সম্ভবত প্রাচীন পারস্যের আর্যরা মিথ্রার উদ্দেশ্যে ষাঁড় বলি দিত। নব্য দীক্ষিত রোমানরাও ষাঁড় বলি দিত, তবে তারা মিথ্রাকে নভমন্ডলের সঙ্গে সম্পৃক্ত করেছিল ।
সাধারনত: ৩০/৪০ জন দীক্ষিত একটি উপাসনালয়ের ভিতরে সমবেত হতে পারত। বেদির দু’পাশে থাকত হেলান দেওয়া বসবার আসন ... যেখানে চলত ধর্মীয় ভোজ। মিথ্রীয় রহস্যবাদীরা ষাঁড় হত্যা করত, যেহেতু প্রাচীন পারস্যে মিথ্রার উদ্দেশ্যে ষাঁড়বলি হত আর মিথ্রাও হত্যা করেছিলেন । ষাঁড়ের চামড়ার ওপর খাবারদাবার রাখা হত।
মিথ্রার উপাসনার উদ্ভব পারস্যে হলেও স্বাভাবিকভাবেই উপাসনার রীতিতে কিছু রোমান ধ্যানধারনার মিশ্রন ঘটেছিল।
বাংলার বাউল স¤প্রদায়ের মতোই মিথ্রীয় রহস্যবাদী ধর্মটি গুপ্তধর্ম। এদের নিজস্ব গূহ্য সাধনপদ্ধতি ছিল যা কেবল দীক্ষিতেরাই জানতে পারে। একজন দীক্ষিতের কাছ থেকে অন্য একজন জ্ঞানলাভ করে। দীক্ষিতদের সাতটি স্তর ছিল। প্রতিটি স্তরেই একটি অধিপতি গ্রহ দীক্ষিতদের পর্যবেক্ষন করত।
১ র্যাভেন (বুধ)
২ নিমফাস (শুক্র)
৩ সোলজার (মঙ্গল)
৪ লায়ন (বৃহস্পতি)
৫ পারসিয়ান (চন্দ্র)
৬ হেলিওড্রোমাস ( সূর্য)
৭ ফাদার (শনি)
আগেই একবার বলেছি যে, ওই সময়কার উপাসনালয়ের দেওয়ালেরর ছবি দেখে মনে হয় মিথ্রীয় রহস্যে দীক্ষিতরা জ্যোতিষশাস্ত্রে গভীর ভাবে বিশ্বাস করত। অবশ্য প্রাপ্ত ছবির মধ্যে বৃষবলির ছবিই বেশি। বৃষবলি মানে বসন্ত- এরকমই বিশ্বাস ছিল মিথ্রীয় রহস্যের দীক্ষিতদের । এ ছাড়া আরও যেসব ছবি পাওয়া গেছে সেসব হল: হাইড্রা (সাপ), কানিস মেজর (কুকুর), কোরভাস (দাড়কাক) এবং লায়ন (সিংহ)। মহাকাশে বৃষমন্ডলের ওপর যে পারসিসাস নক্ষত্রমন্ডল রয়েছে , তার সঙ্গেও মিথ্রার সম্পর্ক ছিল বলে মিথ্রীয় রহস্যের দীক্ষিতরা গভীরভাবে বিশ্বাস করত।
প্রতিটি প্রার্থনা কক্ষে রয়েছে মিথ্রা পবিত্র ষাঁড় হত্যা করছে।
একে বলে tauroctony. আসলে এটি নক্ষত্রের সমাবেশের প্রতীক ...
মিথ্রার উপসনায় নারীর অংশগ্রহন একেবারেই ছিল না। সম্ভবত প্রাচীন পারস্যে এরকম বিধিনিষেধ ছিল না। মনে হয় এটি পুরুষতান্ত্রিক রোমান সভ্যতারই কৃতিত্ব! রোমান সভ্যতায় আপন সন্তানের উপরই নারীর অধিকার ছিল না ...
একুশ শতকের মিডিয়ার মিথ্রা
মানচিত্র, ছবি ও তথ্য : ইন্টারনেট
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।