ইউনিভার্সিটিতে এসেও ছকেবাধা জীবন যাপন করছে আনুশা। আজকাল চাইলেও আর রুটিন ভাঙতে পারে না। সেই ছোট্টবেলা বেলা থেকে আগেই নির্ধারণ করা হয় তার জীবনের কোন পর্যায়ে কি ঘটবে। এই গুরুভার বহন করছে তার মা বাবা। এতদিনের অভ্যাসের কারণে বান্ধবী রিনার দেওয়া প্রস্তাবটা বারবার ভাবছে সে।
কক্সবাজার যাবে কি যাবে না? মাকে বলা দরকার কিন্তু এই রিনার যেন তর সইছে না। কক্সবাজারে এই আছে,সেই আছে। কত্ত মজা হবে,হেনতেন। মাকে ফোন করতেও ভয় পাচ্ছে সে,যদি মা রাগ করে? অবশেষে মোবাইলে মায়ের নাম্বারটা বের করে সবুজ বাটনে টিপ দিলো সে।
-হ্যালো মা, কেমন আছো?-এইতো ভাল,সারাদিনের যা কাজ।
তুই এই ভরদুপুরে ফোন করলি যে? কিছু বলবি?মা যে কিভাবে বুঝে যায় তা এখনও তার কাছে রহস্য! আমতা আমতা করে বলল,-ইউনিভার্সিটি থেকে কক্সবাজার নিয়ে যাবে। সবাই যাবে। বলছিলাম কি আমি যদি কয়টাদিনের জন্য......
-খবরদার! এইসব আজেবাজে চিন্তা মাথায় আনবি না। তোর বাবা শুনলে কি হবে জানিস? কত আজেবাজে ছেলে যাবে, অভিভাবক থাকবে না, কি খাবি না খাবি তার ঠিক নাই। কোনও দরকার নাই।
- কিন্তু মা। এইবারই তো শেষ। গত বছর রাঙ্গামাটিতেও তো যাই নি। সবাই যাচ্ছে...প্লিজ...
-একদম না। আর কয়টা মাস আছে পড়াশুনা কর তারপর ফাইলান পরীক্ষা হয়ে গেলে বিয়ে করে একেবারে জামাই নিয়ে কক্সবাজার যাবি।
হঠাৎ আজ আনুশার মাথা গরম হয়ে গেল। আগেও মায়ের মুখে এসব কথা শুনেছে কিন্তু রাগ হয় নি, বরং মন খারাপ হয়েছে। খুব কষ্টে রাগ সংযত করে মাকে বলল- আচ্ছা মা,এখন তাহলে রাখি। -এইতো আমার লক্ষ্মী মেয়ে। মা যা বলে ভালোর জন্যই বলে বুঝলি? আচ্ছা, ভাল থাকিস।
ফোন কেটে বিছানায় বসে পড়লো আনুশা। আজ এত রাগ হচ্ছে কেন? এটাই তো স্বাভাবিক। এমনি তো হওয়ার কথা। চোখের সামনে সমুদ্রের ঢেউ ভেসে আসছে, কানে শুনতে পারছে সমুদ্রের গর্জন। হঠাৎ রিনার কথার শব্দ শুনতে পেল।
রুমে আসছে রিনা। দৌড়িয়ে বাথরুমে ঢুকে দরজা লাগিয়ে শব্দহীন কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো সে। এই একটা কাজ করেই সে একটু শান্তি পায়। বাথরুমের দরজার ওপাশ থেকে ভেসে আসছে রিনার কণ্ঠ- “কি রে, কই গেলি? আনুশা? আরে তাড়াতাড়ি আয়, কক্সবাজার থেকে কি কি কিনবো তার একটা লিস্ট বানাইছি...”
আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে আনুশা। সন্ধ্যার ঠিক আগের সময়টা খুব ভাল লাগে তার।
গোধূলি আলোকে খুব বেশি পবিত্র মনে হয়। যেন আনন্দ আর বিষাদের খেলা। যেদিন মন ভাল থাকে সেদিন মনটা আরও ভাল হয়ে যায় আর যেদিন মন খারাপ থাকে সেদিন যেন বিষণ্ণতার অন্ধকার আরও বেশি গ্রাস করে,যেমনটি আজ আনুশার মনের অবস্থা। রিনাকে জানানোর পর থেকে খুব ক্ষেপে গেছে সে। এতদিনের একটা পিকনিকেও আনুশা যায় নি, ভেবেছিল এইবার বান্ধবীকে নিয়ে খুব ঘুরবে আর মজা করবে।
কিচ্ছু হলো না, রাগে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছে সে। কিন্তু আনুশা জানে রিনার এ রাগ ক্ষণস্থায়ী।
রাতের খাবার খেয়ে রুমে আসার পর এই প্রথম রিনা কথা বলল -আর একবার কি আন্টির সাথে কথা বলা যায় না? আমি কি একবার অনুরোধ করে দেখব?
অন্যমনস্কভাবে আনুশা বলল-একটা কাজ করতে পারবি?
-কি?
-ক্লাসের সবাইকে বলে দিস আমার শরীরটা খারাপ, কেউ যেন আমাকে জোর না করে।
কথাটা বলে ফিজিক্স বইটা হাতে নিলো সে। বইয়ে মনযোগ দিলো।
কিছুক্ষণের জন্য চুপ হয়ে গেল রিনা তারপর আস্তে করে বলল, পরশও যাবে রে... একটু ভেবে দেখ প্লিজ।
বই থেকে মুখ না তুলে খুব শান্ত ভাবে বলল- আবার ওই কথা? তোকে না মানা করছি এইসব বলতে... আমার ভাল লাগে না। আর পরশের ব্যাপারটা নিয়ে আমার কিছুই করার নাই। ওকে আমি বুঝিয়েছি, না বুঝলে তো আমার কিছু করার নাই,তাই না? এখন আমাকে পড়তে দে তো।
পরশের ব্যাপারে এত কঠোর কথা প্রায়ই শুনতে হয় রিনার।
এত চেষ্টা করলো তাও ছেলেটার কথা বলে আনুশার মন গলাতে পারে নি। কিছু মানুষ হয়ত আসলেই এমন হয়, ভালবাসাবিরোধী।
রিনাকে জবাব দেওয়ার পর ফিজিক্স বইয়ের সমীকরণগুলো হঠাৎ ঝাপসা হয়ে আসে আনুশার চোখে। বইয়ের দিকে তাকিয়ে দেখতে পাচ্ছে এক বছর আগের বিকালবেলা। ক্যাম্পাসের গাছগুলো খুব ভাল লাগে আনুশার, প্রতিদিন দেখত আর ধার দিয়ে হেঁটে যেত।
সেদিন বিকালবেলা হঠাৎ পরশ চলে আসে হাতে গোলাপ ফুল নিয়ে। আনুশা তো একেবারে অবাক। পরশ মনে হয় একটু একটু ভয় পাচ্ছিল। পরশের চোখটা খুব নিষ্পাপ মনে হয়েছিল ওইদিন। ক্লাসে সবাই যাকে ভীতুর ডিম বলে তার হাতে গোলাপ ফুল!! কাঁপা কণ্ঠে এক নিঃশ্বাসে আনুশার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, -“আমি তোমাকে অনেক ভালবাসি আনুশা।
অনেক চেষ্টা করার পর আজ বলতে এসেছি। আমি জানি তুমিও আমাকে ভালবাসো। ’’
-মানে কি? কি বলতে চাও তুমি?
-তোমার চোখে স্পষ্ট দেখতে পাই আমি। আর এটাও বুঝি যে তোমার কোনও ব্যাপারে অনেক কষ্ট। আমাকে কি তোমার কষ্টগুলো ভাগ করে নেওয়ার সুযোগ দিবে?
পরশের কাছে এসব কথা শুনে আরও অবাক হয় আনুশা।
কিভাবে বুঝলও পরশ?মাথাটা এলোমেলো লাগতে থাকে আনুশার। ক্লাসের সবচেয়ে চুপচাপ ছেলের মুখে এমন কথা!
এর বেশি কোনও অনুভূতি হওয়ার আগেই আনুশা পরশকে সোজা মানা করে দেয়। কত বার পরশ বলল, ‘আমার দোষটা কি? একবার কি সুযোগ দিবে না আমাকে?’
নির্লিপ্তভাবে আনুশা বলেছিল-‘আমার পরিবারকে তুমি জানো না পরশ। তারা এসব পছন্দ করেন না। আর আমারও এইসব প্রেম-ভালবাসা পছন্দ না।
’
আর কোন কথা না বলেই আনুশা সোজা হেঁটে যায়। এরপরও কত চেষ্টাই না করে পরশ। চিঠি দেয়,ফোন করে,রিনার সাহায্য নেয় তবে কিছুতেই কিছু হয় না। অবশেষে আনুশা পরশকে বলে দেয় যে সে যদি সত্যিই তাকে ভালবাসে তাহলে যেন কখনও ভালবাসার দাবী নিয়ে তার সামনে না আসে। ওই দিনের পর থেকে পরশ আর স্বেচ্ছায় দেখা দেয় নি।
..................................................................................................
ছয়মাস পর ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হল। এই কয় মাস খুব পরিশ্রম গেছে সবার। আজ যেন সবাই হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। পরীক্ষা শেষের খুশীতে অনেকেই আজ ক্যাম্পাসের ভেতরই পার্টি দিবে। সবাই থাকবে কিন্তু আনুশা থাকতে পারবে না কারণ বাবার নির্দেশ রাতের ট্রেনেই বাড়ি ফিরতে হবে।
নিজে বিরোধিতা করার সুযোগটাও পায় নি কারণ সন্ধ্যা হতেই মামা চলে আসে। চটজলদি ব্যাগ গুছিয়ে নিয়ে মামার সাথে বেরিয়ে পরে স্টেশনের পথে। যাওয়ার আগে সবার সাথে ঠিকমত বিদায় নিতে পারে না সে,শুধু রিনাকে বলে আসে। রিনা জড়িয়ে ধরে অস্ফুট কান্নার শব্দে বলেছিল- ‘জানি না তোর সাথে আর দেখা হবে কিনা। পারলে যোগাযোগ রাখিস।
’ হালকা হেসে আনুশা বাইরের পথে পা বাড়াল। রিনা বলল- ‘পরশকে বলে যাবি না?’
রিনার কথা না শুনার ভান করে চলে গেল সে।
চট্টগ্রামের ট্রেনে উঠে জানালের বাইরে তাকায় আনুশা। রাতের জার্নি তার সবসময়ই পছন্দের। কালো আকাশের বুকে মিটিমিটি উজ্জ্বল তারা যেন কষ্টের সাগরে বিন্দু বিন্দু সুখের ঠিকানা।
মামা ট্রেনে উঠার পরপরই ঘুমিয়ে যান। কথা বলার মতও কেউ নেই। বাইরের পরিবেশ উপভোগ করতে করতে নিজের জীবনের কথা ভাবতে থাকে সে। আজ সত্যিকার অর্থেই বড় হয়ে গেছে। রেজাল্ট হলেই ইউনিভার্সিটি লাইফের অবসান।
ছোট্টবেলা থেকে ভাল রেজাল্ট করার তাগিদে পড়াশুনা ছাড়া আশেপাশের জগতটা দেখার সময় হয়নি তার। কারণ তার মায়ের নির্দেশ। মা যেন পরিবারের সবার সামনে মাথা উঁচু করে বলতে পারে আমার মেয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। এছাড়া ক্লাসের ভাল রেজাল্ট করতেই হবে। তাই সারাদিন পড়া না হয় প্রাইভেট।
সবার চোখে ‘আদর্শ ছাত্রী’হতে যেয়ে আর কোনও দিকে তাকানোর সময় পাই নি। ফলস্বরূপ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিজিক্স ডিপার্টমেন্ট হয় আনুশার ঠিকানা। একা মেয়ে কিভাবে হলে থাকবে তা নিয়েও অনেক ঝামেলা হয়েছিল। প্রথম একটা বছর মামার বাড়িতেই ছিল। পরে নানা সমস্যার কারণে মা রাজি হয় হলে থাকার ব্যাপারে।
বাবাও সে বার খুব কষ্টে রাজি হয়েছিলেন শুধুমাত্র মেয়ের পড়াশুনার কথা ভেবে। ছোটবেলার একদিনের কথা খুব মনে পড়ে আনুশার। রাস্তা পার হওয়ার সময় এত যানবাহনের ভিড়ে বুঝতে পারছিল না কিভাবে পার হতে হবে। মা তখন বলেছিল, ‘একি! তুই আমাকে না ডেকে রাস্তা পার হচ্ছিস কেন? আমি থাকতে তোর কি দরকার একা একা পার হওয়ার। একটা গাড়ি ধাক্কা দিলে কি হবে বুঝিস?’ এরপর হাত ধরে মা আনুশাকে পার করান।
এরপর থেকে খুব ভয় লাগত আনুশার। একা রাস্তা পার হওয়ার সাহস আর কখনোই হয় নি। এসব ভাবতে ভাবতে কখন আনুশা ঘুমিয়ে পরে তা নিজেও বুঝতে পারে না।
বাড়িতে এসে খুব ভাল লাগে আনুশার। মা বাবাকে দেখে এক মুহূর্তেই সব কষ্ট ভুলে যায়।
মা অনেক কিছু রান্না করেছেন। প্রথমদিন ভালই কাটলো তবে দ্বিতীয় দিন বুঝলো তাকে এত তাড়াতাড়ি বাড়িতে ডাকার কারণ। সকালে মা একটা শাড়ি আর কিছু গহনা দিয়ে বলল সন্ধ্যায় ভালভাবে সেজেগুজে থাকতে। উচ্ছ্বাসিত কণ্ঠে মা আরও বলল,‘তোর বাবার বন্ধুর ছেলে। অনেক ভাল চাকরি আর টাকা পয়সা ভালই।
এমন ভাল জুটি আর হতেই পারে না!’ কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল আনুশা। কেন বলবে? ঠিকই তো আছে। আর মা-বাবার পছন্দ ভালোই হবে হয়ত।
যান্ত্রিক মানুষের মত সেজেগুজে বসে আছে সে। যতক্ষণনা তারা আসবে ততক্ষণ সাজগোজ একটুও নষ্ট হওয়া যাবে না।
মা একটু পর পর এসে চুল আঁচড়িয়ে দিয়ে যাচ্ছে। দীর্ঘ এক ঘণ্টা পর ছেলেপক্ষ আসল। আনুশার রুপে গুনে তারা মুগ্ধ। এমন ভাল ছাত্রী আর সভ্য মেয়ে যেন দ্বিতীয়টি নেই। আনুশা শুধু জানতে পারলো ছেলের নাম ফাহাদ।
ভাল চাকরি করে। ওই রাতেই তাদের আংটি বদল হয়ে যায়।
সবকিছু এত তাড়াতাড়ি হয়ে যাচ্ছে যে কিছু ভাবার সময়ই পাচ্ছে না সে। রাতভর জেগে ভাবতে থাকে আনুশা। আজ রিনার কথা খুব মনে পরছে।
ইশ, যদি রিনা থাকত কিন্তু মা-বাবা বন্ধুবান্ধব পছন্দ করেন না। রিনা কি জানতে পারবে তার বিয়ে হয়ে যাচ্ছে? খুব কথা বলতে ইচ্ছা করছিল রিনার সাথে কিন্তু বিয়ের কথা হওয়ার পর থেকেই মা আনুশার মোবাইলটা নিয়ে নেয়। রিনা অবশ্য জানলে এভাবে বিয়ে হতেই দিত না, নিশ্চয়ই একটা ঝামেলা বাঁধাত! মনের অচেনা কোনও এক কোণা থেকে হঠাৎ পরশকে দেখতে পায় সে। নাহ! পরশকে কখনোই ভালবাসে নি সে। কাউকে ভালবাসে না।
মা বাবার উপর কোনও কথা বলার সাহস নাই তার তাইতো নিজের কোনও সিদ্ধান্ত আজ পর্যন্ত নিতে পারেনি। মনকে বেঁধে রেখেছিল সে। ছোটবেলা থেকেই মা বাবার নির্দেশে কাজ করতে করতে আত্মসিদ্ধান্ত নিতে কবে ভুলে গেছে তা নিজেও জানে না। আজকাল বড় ভয় হয় আনুশার। জীবনকে খুব ভয় লাগে এক অচেনা কারণে।
আর কিছু ভাবতে পারে না সে,মাথা প্রচণ্ড ব্যথা করতে থাকে। সবকিছু ভুলে আনুশা সিদ্ধান্ত নেয় এই নতুন সম্পর্কটাকে মেনে নেওয়ার।
একমাসের মধ্যে বিয়ে হয়ে যায় আনুশার। সে কি আয়োজন! তবে অনুষ্ঠানটা কাছের মানুষদের মাঝেই সীমাবদ্ধ ছিল। বিয়ের পর মায়ের কথা মত কক্সবাজারে যায় তারা।
এত সৌন্দর্য সে কখনও দেখে নি। এখানে এসে ইউনিভার্সিটির কথা খুব মনে পরে যায়। তবে ফাহাদের সাথে খুব ভালো সময় কাটে। ফাহাদের সাথেই জীবনের নতুন স্বপ্ন দেখা শুরু করে সে। একমাস ঘুরে বেরিয়ে ফিরে আসে তারা।
দিনের পর দিন পার হয়ে যায়। ফাহাদের সাথে কয়েকটা ব্যাপারে মাঝে মাঝে মনোমালিন্য হয় তবে তখনই মায়ের কথা মনে হয়। মা বলেছিল যেকোনও অবস্থাতেই মানিয়ে নিতে। খুব বেশি অধিকার খাটানোর চেষ্টা করার দরকার নাই। এটাই নাকি মেয়েদের কর্তব্য।
বিয়ের পর কয়েকমাস আনুশা একটা স্কুলে শিক্ষকতা করে তবে বুঝতে পারে যে ফাহাদ এটা ততটা ভাল চোখে দেখে না। আর শ্বশুর-শাশুড়ি সারাদিন বলে, “এত টাকা থাকতে বাড়ির বউ বাইরে কাজ করবে?? এই দিন দেখার জন্যই কি বেঁচে আছি?” প্রথমে একটু বিরোধিতা করেছিল আনুশা তবে এক পর্যায়ে চাকরিটা ছেড়ে দেয়। খুব কষ্ট হয়েছিল সেদিন। তবে বুকে কষ্ট চেপে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল তার এই নতুন জীবনকে রাঙ্গিয়ে তোলার।
এক বছরের মাথায় আনুশা তার জীবনের সবচেয়ে খুশির সংবাদটা শুনে।
তার মাঝে এখন এক নতুন প্রাণের বাস। এই প্রথম নিজেকে স্বাধীন মনে হলো তার। ফাহাদের উচ্ছ্বাসটাও ছিল অনেক তবে কেমন জানি ভয় লাগলো আনুশার। শ্বশুরবাড়িতে তারভালই যত্ন শুরু হয় তবে কয়েকদিন পর আনুশা বুঝতে পারে কোনও একটা বিষয় তার শ্বশুরবাড়ির মানুষদের চিন্তার কারণ। কিছুতেই বুঝতে পারে না আনুশা।
অবশেষে একমাস পর এক রাতে ফাহাদ বলে, তোমার কি মনে হয় বাচ্চাটা ছেলে নাকি মেয়ে?
-মানে? আমি কিভাবে জানবো?
-না মানে... মা বাবার ইচ্ছা প্রথম সন্তানটা যেন ছেলে হয়।
আনুশা নিজের কানে কথাটা বিশ্বাস করতে পারে না। অবাক হয়ে বলে- এই যুগে এইসব কেউ মানে?
-না...আসলে বড় বড় কথা বললেই তো হয় না। বড় ছেলে থাকলে পরিবারের মুখ উজ্জ্বল করতে পারবে। আর আমাদের এত সম্পত্তি রক্ষণাবেক্ষণের দরকার আছে না?
আনুশা কি বলবে তা বুঝতে পারে না।
আজ সে এক নতুন ফাহাদকে দেখতে পাচ্ছে। অনেক্ষন চুপ করে থেকে বলে- তুমিও কি তাই চাও?
-আমি মা বাবার কথার অমান্য কখনোই করি না।
-ও... তাহলে এখন আমাকে কি করতে হবে?
- দেখো... আমার মা বাবা এসব দিক দিয়ে একটু পুরনো মানসিকতা বহন করে। আল্ট্রাসনোগ্রাফি করে না জানা পর্যন্ত তাদের সংসয় দূর হবে না। তুমি না হয় ততদিনের জন্য চট্টগ্রামে চলে যাও।
আনুশা আর কিছু বলতে পারে না। চোখের নদীটিও আজ শুকিয়ে গেল। নির্ঘুম রাত কাটিয়ে পরেরদিন চলে গেল চট্টগ্রামে। আনুশার কথা শুনে সবাই হতভম্ভ হয়ে গেল। প্রথম প্রথম আত্মীয়স্বজন খুব গালাগাল করলো ফাহাদের পরিবারকে।
তারপর সবাই চুপ। সবার ভাষায়, ‘সবই কপালের লিখন। একে মেনে নিতেই হবে। ’
দিন দিন আনুশার শরীর খারাপ হতে থাকে। দুশ্চিন্তা আর শারীরিক কষ্ট তার সহ্যসীমা অতিক্রম করে।
তবুও একবারও সে ছেলে হওয়ার জন্য প্রার্থনা করে নি। তার সন্তান ছেলে বা মেয়ে যাই হোক না কেন সে তা নিয়ে চিন্তিত না। শুধু ফাহাদের কথাগুলো বারবার তার কানে বাজে।
ছয় মাস পর আলট্রাসনো করে বোঝা যায় যে তার গর্ভের সন্তানটি মেয়ে। মেয়ের কথা শুনে আনুশার মুখে এক চিলতে হাসি ফুটে ওঠে।
আগের চেয়ে আরও বেশি মমতা অনুভব করে। তবে এ খবরে আনুশার পরিবার হতাশায় ডুবে যায়। ফাহাদের ফোনটাও অফ। কেউ আর খোঁজ নিচ্ছে না আনুশার। ফাহাদ আনুশাকে বাসায় আসার কথাও আর বলে নি।
মা বাবা খুব চেষ্টা করছে কিন্তু কিছুতেই তাদের মানাতে পারছে না। আনুশার তাতে কোনও আক্ষেপ নেই। সারাদিন মেয়ের চিন্তা করতেই তার সময় কেটে যায়... এভাবেই এক সময় জন্ম হয় একটা ফুটফুটে মেয়ের। মায়ের বাড়ি আনুশা তার মেয়েকে নিয়ে আনন্দেই ছিল। কিন্তু একটা পর্যায়ে নানা ভাবে কটুকথার সম্মুখীন হতে হয় আনুশার পরিবারকে।
কয়েকদিন পর এক বিকালে আনুশার মা বলে-আর কত দিন এখানে পরে থাকবি? তুই বরং জামাইয়ের বাড়ি যা। বাচ্চার মুখ দেখলে মন গলতেও পারে।
-কেন মা? আমার এখানে থাকায় কি খুব সমস্যা হচ্ছে?
- না তা না... বিবাহিত মেয়ের এত দিন বাপের বাড়ি থাকা ঠিক না। আর তোর জীবনের কঠিন সময়টার সম্মুখীন তো তোর নিজেকেই হতে হবে।
তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে আনুশা বলল, “আমাকে তো জীবনের সাথে কখনও সংগ্রাম করতে শেখাওনি মা।
জীবনকে চিনতে দাও নি। আমাকে তো একটা ভীতু মানুষ বানিয়েছ। তাইতো এত অন্যায়েরও প্রতিবাদ করার সামান্য সাহসটা আমার নাই। ”
মেয়ের মুখে এমন কথা শুনে চুপসে যায় মা। এই প্রথম আনুশার কথার কোনও জবাব নাই তার কাছে।
ধীর পায়ে রুম থেকে বেরিয়ে যায় মা।
প্রতিদিনের মত আজও সূর্য ডুবছে। গোধূলি বেলায় আনুশা আকাশ দেখছে। নিজের চোখের সামনে তার মেয়ের জীবন ধ্বংস হতে দিবে না। তাকে সংগ্রাম করতেই হবে।
আকাশের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ আজ পরশের কথা মনে পরে যায়। “আচ্ছা, পরশ কেমন আছে? ও কি বিয়ে করেছে? নাকি এখনও...” নাহ! নিজেকে খুব স্বার্থপর ও অপরাধী মনে হচ্ছে আনুশার। আজ প্রয়োজনের সময় পরশকে মনে পরছে তার। যাই হোক না কেন আনুশা তার মেয়ের জীবনটা এভাবে শেষ হতে দিবে না। এই সমাজে বাঁচার মত বাঁচতে হবে তাদের।
নানা চিন্তার ভিড়ে মায়ের ডাকে আনুশার ঘোর কাটে। ফাহাদ নাকি ফোন করেছে,তার সাথে কথা বলতে চায়। অচেনা এক আশা নিয়ে ফোন ধরে আনুশা।
-হ্যালো আনুশা... ভালো আছো?
-কেন ফোন করলে সেটা বলো।
-দেখ, এভাবে তো হয় না তাই না? তোমার মা বাবা তো প্রতিদিন ফোন করে তোমাকে নিয়ে যাওয়ার অনুরোধ করে।
কিন্তু তুমি তো জানোই আমার মা বাবা এসব ব্যাপারে কতটা সিরিয়াস।
-শুধু মা বাবার কথা বলছো কেন? তুমিও কি সিরিয়াস নও?
-আহা, এসব বললে এখন হবে? মা বাবাকে অনেক বুঝিয়ে একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তুমি যদি রাজি থাক...
-এখন আবার কি করতে হবে আমাকে?
-না মানে...আমাদের পরের সন্তানটা যদি ছেলে হয়...
-লজ্জা করে না তোমার??! ছিঃ!
রাগে ফোনটা না কেটেই চলে যায় নিজের ঘরে। মা বারবার জিজ্ঞাসা করার পরও কোনও কথা বলে না আনুশা।
পরদিন সকালে নিজের আদরের সন্তানকে বুকে নিয়ে অজানা পথের উদ্দেশে চলা শুরু করে আনুশা।
পরাধীন স্বাধীনতার বেড়াজাল ভেঙ্গে চলতে থাকে সত্যিকারের আত্মিক স্বাধীনতার সন্ধানে..
বন্ধুরা সময় পেলে আমার সাইট থেকে ঘুরে আসার নিমন্ত্রণ রইল। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।