বিদ্যুৎ উৎপাদনে সমগ্র বিশ্ব এখনো মূলত কয়লা, তেল, গ্যাস, জলশক্তি ও পারমাণবিক জ্বালানির ওপর নির্ভরশীল। বর্তমান বিশ্বে মোট উৎপাদিত বিদ্যুতের মাত্র ৫ শতাংশ তৈরি হয় নবায়নযোগ্য সৌর, বায়ু ও জৈব জ্বালানি ব্যবহার করে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, ৫০ থেকে ৬০ বছর পর বিশ্বে নবায়নযোগ্য সৌর, বায়ু ইত্যাদি শক্তিনির্ভর বিদ্যুৎ সহজলভ্য হবে এবং তখন বাংলাদেশসহ বিশ্বের অনেক দেশেই বিদ্যুৎ সমস্যার বেশির ভাগই হ্রাস পাবে।
কিন্তু অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশের মতো জ্বালানি নিরাপত্তাহীন দেশের বিদ্যুৎ ব্যবস্থাপনা কতটা নাজুক হতে পারে কিংবা তা সামাল দেওয়া কতটা সম্ভব হবে, তা নিয়ে পর্যবেক্ষকেরা চিন্তিত বৈকি। বর্তমানে দেশে প্রায় ছয় হাজার মেগাওয়াট (দৈনিক সর্বোচ্চ) বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়।
ভবিষ্যৎ বিদ্যুতের চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে সরকারি ভাষ্যমতে, ২০২০ সালে দেশে মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনক্ষমতা অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা ২২ হাজার মেগাওয়াট, আর ২০৩০ সালে এ লক্ষ্যমাত্রা ৩৯ হাজার মেগাওয়াট। ২০২০ সালে ওই পরিমাণ বিদ্যুৎ পেতে হলে এখন থেকে গড়ে প্রতিবছর দুই হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়াতে হবে এবং তার পরের ১০ বছর গড়ে প্রতিবছর আড়াই হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়াতে হবে। বাস্তবে বিদ্যুৎ উৎপাদন কার্যক্রম পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, আমরা অন্য মাত্রার গতিতে চলতে অভ্যস্ত। বিগত সাড়ে চার বছরে তিন হাজার ৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধির কৃতিত্ব নিতে সরকারি প্রশাসন সর্বদাই প্রস্তুত থাকে, যদিও এর মধ্যে একটি বড় অংশ কেবলই অস্থায়ী রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল কেন্দ্র থেকে উচ্চমূল্যের তেলনির্ভর বিদ্যুৎ। তাই স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে, ঘোষিত ভবিষ্যৎ বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের পরিকল্পনা কি বাস্তব কার্যক্রম দ্বারা সমর্থিত, নাকি নেহাতই জনগণের তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে আশাবাদমাত্র? কোনো কোনো ক্ষেত্রে এহেন প্রশ্ন ওঠার যৌক্তিকতা রয়েছে বৈকি।
বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য বাংলাদেশে নিজস্ব জ্বালানি সম্পদ মূলত মধ্যম মাত্রার গ্যাস ও কয়লা মজুতের মধ্যে সীমিত। গ্যাসের বর্তমান সীমিত মজুত ক্রমবর্ধমান চাহিদার চাপে এক দশকের মধ্যেই নিঃশেষ হতে পারে বা তা গৌণ জ্বালানির পর্যায়ে নেমে যাবে। এ অবস্থায় গ্যাস অনুসন্ধানের ধীরগতি এ ব্যাপারে সরকারি উদাসীনতার প্রতিফলন। সমুদ্রবক্ষে গ্যাস অনুসন্ধানে বিদেশি কোম্পানিকে আকৃষ্ট করার ব্যর্থতা যদি গ্যাসের মূল্য নিয়ে দর-কষাকষির (ইউনিটপ্রতি সাড়ে পাঁচ মার্কিন ডলার পর্যন্ত) জন্য হয়ে থাকে, তবে একই সময়ে মধ্যপ্রাচ্য থেকে ইউনিটপ্রতি ১৪ ডলারের ব্যয়সাপেক্ষ এলএনজি (তরলীকৃত গ্যাস) চুক্তি করার উদ্যোগ নিঃসন্দেহে স্ববিরোধী। তদুপরি বিগত দুই বছর ধরে মধ্যপ্রাচ্য থেকে এলএনজি আমদানি করে ২০১২ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে (পরে সময় বাড়িয়ে ২০১৩) জ্বালানি জোগানের ব্যবস্থার ঘোষণা, চুক্তি ও কার্যক্রম চালিয়ে শেষ পর্যায়ে তা বাতিল করাটা দেশের প্রশাসনযন্ত্রে সুচিন্তিত ও দক্ষ ব্যবস্থাপনার অভাব বলেই প্রমাণ করে।
একইভাবে গ্যাস উৎপাদনের ক্ষেত্রেও দেশি কোম্পানির তুলনায় অনেক বেশি ব্যয়ে বিদেশি কোম্পানিকে (রাশিয়ার গ্যাজপ্রম) নিয়োগ দিয়ে তা থেকে যথাসময়ে ঈপ্সিত গ্যাস সরবরাহ না পাওয়ার দৃষ্টান্ত উপরিউক্ত কার্যক্রমকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। এ বিষয়গুলো জনগণকে বিভ্রান্ত করেছে।
গ্যাসের স্বল্পতার কারণে নীতিনির্ধারণী মহলে এটি স্বীকৃত হয়েছে যে বিদ্যুৎ উৎপাদনে কয়লার ব্যবহার উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি করার বিকল্প কিছু নেই। সরকারি প্রাক্কলন অনুযায়ী, ২০২০ সালে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জ্বালানি হিসেবে কয়লার ব্যবহার বর্তমানের ৩ থেকে বাড়িয়ে ২৫ শতাংশ করার পরিকল্পনা রয়েছে। এ জন্য সে সময় প্রতিবছর প্রায় ১৫ মিলিয়ন টন কয়লার প্রয়োজন হবে (বর্তমানে প্রতিবছর প্রায় এক মিলিয়ন টন কয়লা উৎপাদিত হয়)।
আর সে অনুযায়ী কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র গড়ে তুলতে হবে। বর্তমান বাস্তবতা হলো, দেশে কয়লা উৎপাদন বাড়ানোর কার্যক্রম কেবল বিতর্কের জালে আবদ্ধ, বিদেশ থেকে কয়লা আমদানি (তা তুলনামূলকভাবে ব্যয়সাপেক্ষ) করার প্রয়োজনীয় অবকাঠামো প্রশ্নবিদ্ধ এবং দেশে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পর্যাপ্ত কার্যক্রম দৃশ্যমান নয়। যা দৃশ্যমান তা হলো আরেক বিভ্রান্তি, যথা: বাংলাদেশে বৃহৎ কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা হয় ভারতের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে। এটির নির্মাণস্থান নির্ধারণ করা হয় বাগেরহাট জেলার রামপাল। কয়েক বছর ধরে এটি নিয়ে একক ও দ্বিপক্ষীয় আলোচনা, দ্বিপক্ষীয় চুক্তি স্বাক্ষর, কোম্পানি গঠন, জমি অধিগ্রহণ ইত্যাদি কার্যক্রম সম্পন্ন হয়।
এ পুরো সময়টিতেই দেশের পরিবেশবিদেরা সুন্দরবনের এত কাছে রামপালে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের বিরোধিতা করে দাবি জানান যে যেহেতু এটি সুন্দরবনের জন্য ভয়াবহ দূষণ বয়ে আনবে এবং বনকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে নিয়ে যাবে, তাই তাঁরা এটি হতে দেবেন না। পরিবেশবাদীদের এ দাবি যৌক্তিক হলেও সরকার প্রায় নির্বিকারভাবে রামপালে কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে থাকে। সর্বশেষ পর্যায়ে প্রধান বিরোধী দলের পক্ষ থেকে বলা হয়, তারা ক্ষমতায় গেলে রামপালে বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন কার্যক্রম বাতিল করবে। আগামী নির্বাচনে যদি ক্ষমতার হাতবদল হয় তাহলে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের কী হবে? পরিবেশবাদীদের দাবির পক্ষে-বিপক্ষে না গিয়েও যে প্রশ্নটি করা যায় তা হলো, সরকার কেন জাতির অতি জরুরি বিদ্যুৎ ব্যবস্থাপনার কার্যক্রমকে বিতর্কিত করে। রামপাল ছাড়া কি অন্য কোনো স্থান নেই, যেখানে এ বিদ্যুৎকেন্দ্রটি স্থাপন করা যায়? এটি কি সরকারি একগুঁয়েমি, নাকি জনগণের যৌক্তিক দাবির প্রতি সরকারের নির্লিপ্ততা?
যেহেতু বাংলাদেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য প্রাথমিক জ্বালানির অভাব রয়েছে ও তা প্রকট থেকে প্রকটতর হচ্ছে, তাই বিদেশ থেকে জ্বালানি আমদানির যেকোনো সুযোগ কাজে লাগানো আবশ্যক।
বাংলাদেশ ভারত থেকে কখনো গ্যাস আমদানি করতে পারবে না, বরং ভারতই বাংলাদেশ থেকে গ্যাস কিনতে চায়। কিন্তু পার্শ্ববর্তী মিয়ানমার থেকে গ্যাস আমদানির একটি সুযোগ বাংলাদেশ নষ্ট করেছে। বেশ কয়েক বছর আগে ভারত মিয়ানমারের সাগরবক্ষে আবিষৃ্কত গ্যাসক্ষেত্র থেকে গ্যাস আমদানির পরিকল্পনা করে। এ লক্ষ্যে ভারতের প্রয়োজন ছিল মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে পশ্চিমবঙ্গ (ভারত) পর্যন্ত একটি পাইপলাইন। ভারত প্রস্তাব করে বাংলাদেশ তার ভূখণ্ডের ভেতর দিয়ে পাইপ গ্যাস সরবরাহের অনুমতি দিলে বাংলাদেশ উইলিং চার্জ পাবে।
ভারতের জন্য মিয়ানমারের গ্যাস পেতে এই পাইপলাইনের কোনো বাণিজ্যিক বিকল্প ছিল না। কারণ, মিয়ানমার থেকে মিজোরাম, আসামের দুর্গম পথে পাইপলাইন নির্মাণ যৌক্তিক প্রমাণ হয়নি। আর এটিই ছিল বাংলাদেশের জন্য ট্রাম্পকার্ড। বাংলাদেশ সহজেই এ প্রস্তাব দিতে পারত যে, ভারত পাইপলাইনে মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশের ভূখণ্ডের ভেতর দিয়ে গ্যাস নিতে পারে, তবে গ্যাস যাওয়ার পথে ওই পাইপলাইন থেকে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ গ্যাস বাংলাদেশের কাছে বিক্রি করতে হবে। বাংলাদেশের বিদ্যুৎ অবকাঠামো মূলত গ্যাসভিত্তিক, তাই গ্যাসের এই দীর্ঘমেয়াদি বাড়তি সরবরাহব্যবস্থার সুযোগ ছিল উত্তম ও সহজ পন্থা।
কিন্তু কূটনীতিতে অপরিপক্ব বাংলাদেশ এই ত্রিদেশীয় গ্যাস পাইপলাইন স্থাপনের ব্যাপারে নেতিবাচক সিদ্ধান্ত নেয়।
এই সহজ পথের সুযোগ না নিয়ে বাংলাদেশ পরবর্তী সময়ে বরং অন্য এক জটিল পথে এগোনোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তা হলো রূপপুরে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের চুক্তি। পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে দুর্ঘটনা ঘটার ক্রমধারায় সর্বশেষ জাপানের ফুকুশিমা দুর্ঘটনার পর বিশ্বের অধিকাংশ দেশই পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ওপর আগ্রহ হারায় বা কমায়। আর বাংলাদেশের মতো ঘনবসতিপূর্ণ স্থানে চুক্তি মোতাবেক প্রস্তাবিত মডেলের (ভিভিআর ১০০০) পারমাণবিক চুল্লিনির্ভর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের সিদ্ধান্তকে অনেক বিশেষজ্ঞই প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন (প্রথম আলো, ৫ জুলাই ২০১৩)।
দুর্ঘটনার আশঙ্কা বাদ দিলেও রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র চালাতে, তত্ত্বাবধান করতে, বিপজ্জনক তেজস্ক্রিয় জ্বালানি আনা-নেওয়া করতে ও জ্বালানি ব্যবহার শেষে ব্যবহূত তেজস্ক্রিয় পদার্থ সরিয়ে নিতে যে দক্ষ কারিগরি কর্মী ও ব্যবস্থাপনা প্রয়োজন, তার কোনোটাই বাংলাদেশের নেই। এর জন্য দীর্ঘ সময়ব্যাপী বাংলাদেশকে রাশিয়ার ওপর নিঃশর্তভাবে শতভাগ নির্ভরশীল হয়ে থাকতে হবে। আর এসবই ২০২০ সাল নাগাদ (বা তারও পর) পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে এক হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাওয়ার জন্য, যখন সরকারি প্রাক্কলন অনুযায়ী দেশের মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনক্ষমতা অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা ২২ হাজার মেগাওয়াট।
দুই বছরের বেশি সময় ধরে পরিবেশবাদীদের দাবি অগ্রাহ্য করে রামপালে কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের কার্যক্রম চালিয়ে তাকে বিতর্কিত ও অনিশ্চিত করে তোলা, দেশীয় কয়লা উত্তোলন ও উন্নয়ন বৃদ্ধির কার্যকর ব্যবস্থা না নেওয়া, গ্যাস অনুসন্ধানে যথেষ্ট গতি আনতে ব্যর্থ হওয়া কিংবা দুই বছর ধরে এলএনজি আমদানির কার্যক্রমের প্রচার ও ব্যয়ভার চালিয়ে তা বাতিল করা—এগুলো বিদ্যুৎ উৎপাদন অবকাঠামো ও জ্বালানি জোগাড়ের ক্ষেত্রে প্রশাসনের দুর্বলতা অল্প কয়েকটি উদাহরণ। তাই জনগণের কাছে সরকারের দেওয়া ২০২০ বা ২০৩০ সালে বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের হিসাবগুলো কেবলই রাজনৈতিক স্লোগান বলে মনে হতে পারে।
ড. বদরূল ইমাম: অধ্যাপক, ভূতত্ত্ব বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।