কত কিছু যে করতে চাই, তবুও কিছু করতে না পারার দায়ে মাথা খুঁটে মরি ।
১।
ভোর ৬ টা ৪২ মিনিট। হালকা অন্ধকার। বাইরে তুমুল বৃষ্টি।
বেসিনের সামনে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ কাঁদলাম। কলের পানি আর চোখের পানি মিশিয়ে দিলাম বেশ কিছুক্ষণ। বারান্দায় যাওয়া যায়। কিন্তু একজন পূর্ণবস্ক তরুণকে কাঁদতে দেখে আশেপাশের ফ্লাটের মানুষ কী ভাববে !
কলের পানিতে যতবার চোখের পানি ধুচ্ছি, আয়নায় চোখ পড়ছে। কি ভীষণ করুণ দেখাচ্ছে মুখটা।
এটা আমি নিজে ! ভাবতেই কেমন লাগে ! আমার চেহারা এত করুণ? এত ! খুব ইচ্ছা করল একটা ছবি তুলে রাখি। একসাথে মানুষের মনে কতকিছুই না খেলা করে। আমি কান্না চেপে রাখতে পারছি না। কোনভাবেই না।
ছবি তুলে রাখতে পারব না।
এত দামী সেলফোনটা পকেটমার হবার পরে, নতুন যে সস্তা সেলফোনটা নিলাম ওটায় ক্যামেরা নেই। আরও বড় কথা আছে, অতক্ষণ শুয়ে শুয়ে কেঁদেছি। বালিশের নিচে থেকে সেলফোনটা কখন বের হয়ে গালের নিচে এসে পড়েছে বুঝিনি। কথা শোনার স্পিকারের ভেতর দিয়ে চোখের পানি ঢুকে গেছে বোধহয়। কল দিলাম, “আপনার ডায়ালকৃত নাম্বারটা এই মুহূর্তে ব্যস্ত আছে” – কথাটা বড় ফ্যাঁসফ্যাসে শোনাল।
এখনও আমার নাম্বার ব্লাকলিস্টেড।
তার কি সে অধিকার আছে? বেইমান।
২।
বেশ কয়েকদিন আগে ভেবেছিলাম প্রতিদিন কী করি না করি, ডায়রিতে ছোট ছোট নোট রাখব। ইউনিভার্সিটি থেকে দুপুর বেলা এসে গোসল করছিলাম আর ভাবছিলাম।
মনে মনে ঠিক করে রেখেছিলাম যে কী কী লিখব আর লিখব না। “আজ এমন আহামরি কিছুই হয় নি লেখার মতন। তবে শুরুটা ত হল। দেখাই যাক না, ঘটনা কোথায় যেয়ে দাঁড়ায়। ”
পরে আর মনে করে লেখা হয় নি।
কিন্তু সেই সন্ধ্যা থেকেই বোধহয় আমার কাহিনীর শুরু। অন্তত এখন যে কাহিনীর শেষ হল, দীর্ঘ তিনটা বছর পর। আজও আহামরি কিছুই হয়নি লেখার মত, তবে আহামরি অনেক কিছুই হল কাঁদার মত। এক ছেলে, একজন তরুণ কখন ভেঙ্গে পড়ে? তার কি সেটা উচিত? উচিত অনুচিত জানি না, সেও ত মানুষ। অন্তত কাঁদার অধিকার ত তার আছে।
এতে মহাবিশ্বের কিছুই যায় আসে না। সবকিছু যেভাবে চলছিল, সেভাবেই চলতে থাকবে।
৩।
১১ টা থেকে ক্লাস আছে। ক্লাসে যেয়ে মন খারাপ ভাবটা কমাতে পারি।
কিন্তু হঠাৎ করে যদি মনটা আবার খারাপ হয়ে উঠে? ক্লাসে যদি নিজেকে সামলাতে না পারি।
আমি মোটেই দুর্বল মানুষ না। আমার অনুভূতি খুব শক্ত। তবে, সবচেয়ে শক্ত মানুষটারও ত একটা দুর্বল জায়গা থাকে।
এবার সত্যি সত্যি সব শেষ হয়ে গেল।
সব শেষ। আমার এখনও কেন যেন বিশ্বাস হচ্ছে না। কতবার ত এমন হল। কতবার ত আমি ফিরিয়ে দিলাম। কখনও এমন লাগে নি।
কিন্তু এবার কেন ! আর আজকের দিনটার জন্যেই ত গত ২০টা দিন পাগলের মত অপেক্ষা করলাম। উফফ, অপেক্ষার সে কি কষ্ট। তাহলে আজকের তারিখটা আসার দুদিন আগে থেকেই কেন সব অনুভূতি এভাবে মোচড় খেল? কেন আজকে আমাকে বেসিনের সামনে দাঁড়িয়ে ভাবতে হয়, - আমার মুখটা এত করুণ কেন?
৪।
সন্ধ্যায় প্রতিদিন রুটিন করে ইলেক্ট্রিসিটি যায়। এই টাইমটা ঘরে বসে কী করব? এলাকাতে ঠিক মনের মতন তেমন ছেলেও নাই।
মানে, তেমন একটা বন্ধু নেই। বড় বয়সে এলাকা পরিবর্তন করলে যে সমস্যা হয় আর কি !
রুবাইয়াত একটু এরোগেন্ট হলেও ছেলেটা খুব ভাল। সন্ধ্যায় ইলেক্ট্রিসিটি না থাকলে ওর সাথে বসে থাকি। মাঝে মাঝে স্পোকেন ইংলিশ প্র্যাকটিস করি। মাঝে মাঝে সার্কিট এনালাইসিসের বুলি কপচাই।
নইলে শুধুই গ্যাঁজাই।
আমি আর রুবাইয়াত বসে ছিলাম, একটা ছোট পাঁচিলের উপর। “ভাই,বাদাম খাওয়া” – মোড়ামুড়ি করে রাজি হয়ে গেলাম। “ঐ বাদামঅলা ভাই, এদিক আসেন। ৫টাকার বাদাম দ্যান।
ত, আছেন ক্যামন ?”
বাদামঅলার বাদাম দেবার ধরণে আমি হতভম্ব। “ভাই কি স্বর্ণের ভরি হিসেবে মেপে দিতেছেন? ৫ টাকায় বাদামের কয় ভরি?”
লোকটা হেসে ফেলল। অন্ধকারে অতক্ষণ ভালভাবে খেয়াল করিনি। তার কুপির আলোতে তাকে ভালভাবে খেয়াল করলাম। আরে, একেবারে হাস্যোজ্জ্বল মুখ।
“ভাই প্রতিদিন কয়টাকা ইনকাম হয়?”
সে ত মনে হল খুব সন্তুষ্ট। “এক দেড়শ হয়। বাই ত বুঝেনই, এলাকায় এহন মানুষ বাদাম বেশি খায় না। ”
এক দেড়শ টাকা ইনকামে সে খুশি কিভাবে থাকে বুঝলাম না। “আপনার এক দেড়শ তে হয়?”
“খাইয়া না খায়া থাহি।
এক দেড়শতেই চলব বাই। আর ত দুই একডা দিন। ঢাহায় থাকুম না। বাড়িত যামুগা। ভাড়ার টাকা ডা ত জমাইতে হইব নাহি?”
আমি তার টাকা দিয়ে বললাম, “হুমম।
জমান। ”
বাদামঅলা হাসি হাসি মুখে বলল, “বাই দুয়া কইরেন। বাড়িত যামুগা। এহন যাই। ”
এত অল্পতেই সে কত খুশি।
এতে মহাবিশ্বের কিছুই যায় আসে না। সবকিছু যেভাবে চলছিল, সেভাবেই চলতে থাকবে।
৫।
সেদিন দেখা বাদামঅলার কথা কেন টেনে আনছি মনে নেই। এখন আবার খারাপ লাগতেছে।
ছেলেদের কাঁদা ভাল না। তবু কেন মানুষ ভেঙ্গে পড়ে ?
আমি কী করি নি? সব করছি। সব। তবুও আমার জীবনের এই দিনটা আসল, এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।