প্রান্তিক জনগোষ্ঠিগুলোর ভাষা ও জাতিগত অস্তিত্বের সাংবিধানিক স্বীকৃতি ও সমমর্যাদা দাবী করছি
মণিপুরি বর্ষপঞ্জি বা মারি-ফাম (মণিপুরাব্দ হিসাবেও পরিচিত) একটি চন্দ্রনির্ভর বর্ষপঞ্জি। বর্তমান ভারতের মণিপুর রাজ্যসহ আসাম, ত্রিপুরা ও বাংলাদেশে বসবাসরত মণিপুরিরা এই বর্ষপঞ্জি অনুসরণ করে। অষ্টাদশ শতকে মণিপুরের শাসকগোষ্টি তাদের নিজস্ব ধর্ম বিসর্জন দিয়ে গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্ম গ্রহন করার পর মহারাজ ভাগ্যচন্দ্রের শাসনামলে প্রাচীন মণিপুরি বর্ষপঞ্জির সাথে ভারতীয় উপমহাদেশের বহুলপ্রচলিত সৌর অব্দ শকাব্দ বর্ষপঞ্জীর সমন্বয় সাধন করা হয়। ঐ সংস্করনটি বর্তমানে মণিপুরী বৈষ্ণবরা তাদের বিভিন্ন ধর্মীয় এবং সামাজিক অনুষ্ঠানের দিন নির্ধারনের জন্য ব্যবহার করেন। গ্রেগরিয়ান সনের মতো মণিপুরি সনেও মোট বারোটি মাস এবং সপ্তাহে সাতটি দিন।
ইতিহাস
মণিপুর রাজ্যটির দুই হাজার বছরের পুরোনো লিখিত ইতিহাস রয়েছে। এরমধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো মণিপুরি রাজবংশের ইতিহাস 'চৈথারোল খুম্বাবা', যেখানে স্মরনাতীত কাল থেকে মণিপুরের রাজাদের কার্যক্রম এবং রাজ্যটির যাবতীয় ঘটনাবলী লিপিবদ্ধ করা। 'চৈথারোল খুম্বাবা' র ভাষ্য অনুসারে মণিপুরি বর্ষপঞ্জীর প্রচলন হয়েছিল খ্রীষ্টপূর্ব ১৩৫৯ সালে মহারাজ মারি ফামবলচা কৈকৈ (খ্রীঃপূঃ ১৩৬৯-১৩২৯) এর শাসনামলে। মনিপুরি বর্ষপঞ্জীর নাম হলো মারি-ফাম যা তাঁর নামের প্রথমাংশ। মণিপুরীরা ‘বছর’কে বলে থাকে ‘মারি’, সেটির উৎসও ঐ রাজার নাম।
মারি ফামবলচা রাজ্যভার গ্রহন করেন ২৫ বছর বয়সে খ্রীষ্টপূর্ব ১৩৫৯ সালে, সেই হিসাবে খ্রীষ্টপূর্ব ১৩৫৯ অব্দ হচ্ছে মারি-ফাম ২৫ বা ০০২৫ মণিপুরাব্দ। কাজেই ২০১০ খ্রীষ্টাব্দ হলো মারিফাম ৩৩৪৪ বা ৩৩৪৪ মণিপুরাব্দ।
মণিপুরি মাস
মণিপুরী চন্দ্রবছরে মোট ১২টি মাস। মাসগুলির নাম দেয়া হয়েছে বারোটি নক্ষত্রের নাম থেকে। মণিপুরিদের মিথলজিতে এবং প্রাচীন ধর্মের পুরাণগুলোতে গ্রহ এবং নক্ষত্রগুলোকে দেবতার সম্মান দেয়া হয়েছে।
প্রতি মাসে দিনের সংখ্যা ত্রিশ। বারোটি মাসের নাম হচ্ছে -
১. শাজিবু (এপ্রিল-মে)
২. কালেন (মে-জুন)
৩. ইঙা (জুন-জুলাই)
৪. ইঙেন (জুলাই -আগষ্ট)
৫. থওয়ান (আগষ্ট-সেপ্টেম্বর)
৬. লাংবন (সেপ্টেম্বর - অক্টোবর)
৭. মেরা (অক্টোবর-নভেম্বর)
৮. হিয়াঙ্গৈ (নভেম্বর-ডিসেম্বর)
৯. পোইনু (ডিসেম্বর-জানুয়ারি)
১০. ওয়াকচিং (জানুয়ারি -ফেব্রুয়ারি)
১১. ফাইরেল (ফেব্রুয়ারি -মার্চ)
১২. লমতা (মার্চ-এপ্রিল)
মণিপুরি সাতবারের নাম
মণিপুরি বর্ষপঞ্জি অন্যান্য সনের মতোই সপ্তাহে সাত দিনকে গ্রহণ করেছে এবং নামকরন অন্যান্য সনের মতোই গ্রহ ও তারকামন্ডলীর উপর ভিত্তি করেই করা মণিপুরি মৈতৈ ভাষায়। নামগুলো মণিপুরি বিষ্ণুপ্রিয়া ভাষায় এসে কিছুটা বিবর্তিত হয়েছে। সাতটি বার [মৈতৈ>বিষ্ণুপ্রিয়া (উৎস) এই ফরমেটে] হচ্ছে -
১. নঙমাইজিং > লাইমংসিং (সুর্যের নাম অনুসারে )
২. নিঙথৌকাবা > নিংথৌকাপা (চন্দ্রের নাম অনুসারে )
৩. লৈপাকপোকপা > লৈপাপোকপা (মঙ্গল গ্রহের নাম অনুসারে )
৪. য়ামসাকেইসা > ইমসাইসনা (বুধ গ্রহের নাম অনুসারে )
৫. সাগলসেন > সাঙনসেন (বৃহস্পতি গ্রহের নাম অনুসারে )
৬. ইরাই > ইরেই (শুক্র গ্রহের নাম অনুসারে )
৭. থামজা > থাঙচা (শনি গ্রহের নাম অনুসারে )
মণিপুরি মিথলজিতে এই সাতটি তারকার সাথে সাতজন লাইরেম্বী বা নারীদেবতার বিবাহের কথা পাওয়া যায়। এই সাতজন নারীদেবতা মণিপুরীদের সাতটি গোষ্ঠীর উপাস্য এবং তারা গোষ্ঠিগুলোকে প্রতিনিধিত্ব করে থাকেন।
যেমন লুয়াঙ গোষ্ঠীর দেবী থৈনু হচ্ছেন মঙ্গলের স্ত্রী, খুমন গোষ্ঠির দেবী তনথাঙনু বুধের স্ত্রী ইত্যাদি। এছাড়া মিথলজি অনুসারে সুর্য ও চন্দ্র বাদে অন্য তারকাগুলোর মুখগুলো নানান জীবজন্তুর আকৃতি পরিগ্রহ করেছে। যেমন, মঙ্গলের মাথা হলো মহিষের মতো, বুধের হাতির মতো , বৃহস্পতির হরিণের মতো ইত্যাদি।
আজ ৭ অক্টোবর ২০১০, বৃহস্পতিবার মণিপুরি বর্ষপঞ্জির হিসাবে ৩০ লাংবন, ৩৩৪৪ মারি-ফাম, সাগলসেন।
তথ্যসূত্র:
১. মুতাম ঝুলন সিংহ, ‘মণিপুর ইতিহাস’, ইম্ফাল ১৯৪৭, পৃষ্ঠা ৬
২. http://imarthar.blogspot.com
৩. Click This Link
৪. Click This Link
৫. Saroj Nalini Parratt,‘The Religion of Manipur’, 1980, page 35
৬. মঙ্গলবাবু সিংহ,‘বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষাতত্তর সমীক্ষা’ (৩য় খন্ড), পৃষ্ঠা ৮৯
৭. ড. কালীপ্রসাদ সিংহ, ‘প্রবন্ধমালা’ (১ম খন্ড), ১৯৮৩, পৃষ্ঠা ৩৫
৮. Cheitharol Kumbaba edited by L. Ibungohal Singh and N. Khelachandra Singh, Imphal, 1967 page 2, 45, 176, 178
মণিপুরি বর্ষপঞ্জির ডাউনলোড করতে পারেন এখান থেকে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।