পর্ব - ১ পর্ব - ২
J. J. Thomson এর প্লাম পুডিং মডেল-
কোন কোন ক্ষেত্রে বলা হয় রেজিন-বান মডেল। যদিও এর কোনটিই টমসনের দেয়া নয়। প্রথম দিকে টমসন, লর্ড কেলভিনের মত ভোর্টেক্স এর ওপর ভিত্তি করে nebular atom হাইপোথিসিস তৈরী করেন। তবে ১৯০৪ সালে তিনি এ মতবাদ বাদ দিয়ে নতুন মডেলের ব্যাখ্যা দেন। এখানে তিনি নতুন আবিষ্কৃত ইলেক্ট্রনকে পরমাণুর অংশ হিসেবে বর্ণনা করেন।
তিনি প্রথম দিকে বিশ্বাস করতেন যে হাইড্রোজেন অ্যাটম দু’হাজারেরও অধিক ইলেক্ট্রন দিয়ে তৈরী। কেননা তার হিসেবে ইলেক্ট্রন, হাইড্রেজেন অ্যাটমের চেয়ে দু’হাজারেরও বেশী গুণ হালকা। কিন্তু দু’হাজারের বেশী ইলেক্ট্রন হলে তার চার্জ অত্যধিক ঋণাত্মক হবে। কিন্তু বাস্তবে পরমাণুসমূহ নিউট্রাল। তাই তিনি ১৯০৬ সালে তিনি প্রস্তাব করেন যে ইলেক্ট্রনের সংখ্যা মোটামোটিভাবে তার চার্জের সমান।
সেক্ষেত্রে হাইড্রোজেন অ্যাটমের ক্ষেত্রে তা মাত্র একটি।
এই ঋণাত্মক ইলেক্ট্রনগুলো কোনভাবে কোন ধরণের পজিটিভ চার্জ দিয়ে পরমাণুতে ব্যালান্সড্। সে সময় চার্জ আর মাসের ডিস্ট্রিবিউশান অজ্ঞাত ছিলো। তখন তিনি এই প্লাম-পুডিং মডেলের ব্যাখ্যা দেন। ব্যাপারটা অনেকটা একটা পজিটিভলি চার্জড্ গোলক (পুডিং), তাতে ইলেক্ট্রনগুলো বড়ইয়ের (প্লাম) মত ভেসে আছে; বা একটা বন রুটির ভেতর কিসমিসের মত।
বৃটেনের Philosophical Magazine এ ১৯০৪ সালের মার্চ মাসে তিনি এক লম্বা প্রবন্ধে তিনি এ মতবাদ ব্যাখ্যা করেন –
“The view that the atoms of the elements consist of a number of negatively electrified corpuscles enclosed in a sphere of uniform positive electrification, suggests, among other interesting mathematical problems, the one discussed in this paper, that of the motion of a ring of n negatively electrified particles placed inside a uniformly electrified sphere.”
- J. J. Thomson
এরপর বহু পৃষ্ঠাব্যাপী বর্ণনায় তিনি মোদ্দা কথা যা বলেন তা হচ্ছে ধণাত্মক চার্জের এক পিন্ডের ভেতর ইলেক্ট্রনগুলো বৃত্তাকার পথে ঘুর্ণায়মান। যদি কোন ইলেক্ট্রন কেন্দ্রের থেকে বাইরের দিকে সরে আসতে চায় তবে সেটা আরও বড় ধণাত্মক বলের আকর্ষণে পুনরায় কেন্দ্রের দিকে চলে যায়। এ দিয়ে তিনি বর্ণালী বিশ্লেষণের ধারণাও দিতে চেষ্টা করেন। যদিও তা খুব ভাল হয়নি। অর্থাৎ বর্ণালীর বিভিন্ন তরঙ্গ দৈর্ঘ্য বিভিন্ন বৃত্তাকার পথের শক্তির পার্থক্যের কারণে হয়।
পরবর্তীতে নীলস বোর এ ব্যাপারটা খুব ভালভাবে তার মতবাদে সফলতার সাথে ব্যাখ্যা করেন। প্রথমদিকে তার ছাত্র রাদারফোর্ডও এ মতবাদ বিশ্বাস করতেন। পরবর্তীতে ১৯০৯ সালের গোল্ড ফয়েল পরীক্ষায় এ মতবাদ ভুল প্রমাণিত হয়। তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে টমসনের থিওরী ফলো করে ক্লাসিকাল ফিজিক্স দিয়েই অংক কষে নিউক্লিয়াসের সাইজ বার করা যায়, যদিও তা যথেষ্টই ভুল হয়। কিন্তু একটা আইডিয়া করা যায়।
যাহোক সে দিকে আর না গিয়ে সংক্ষেপে এটাই বলা যায় যে টমসনের মডেল আর নাগাওকার স্যাটার্নিয়ান মডেলই ছিলো রাদারফোর্ড আর বোরের মডেলের পূর্বসুরী।
আর্নেস্ট রাদারফোর্ডের মডেল –
১৯০৮ সালে রাদারফোর্ড (Ernest Rutherford, 1st Baron Rutherford of Nelson) কেমিস্ট্রিতে নোবেল পান! তার award citation এ লেখা ছিলো -
"for his investigations into the disintegration of the elements, and the chemistry of radioactive substances."
যদিও রাদারফোর্ড একজন রসায়নবিদও ছিলেন, তাহলেও তার পুরস্কার পদার্থবিদমহলে কিছুটা কৌতুককর –নিউক্লিয়ার ফিজিক্সের জনক নোবেল জিতেছেন রসায়নে?
মজার ব্যাপার হোল তার জীবনের শ্রেষ্ঠ আবিষ্কারটি তিনি করেন ১৯১১ সালে, নোবেল জেতার তিন বছর পর।
১৮৯৫ সালের শেষ দিকে রন্জেন এক্স-রে আবিস্কার করেন। বছরের প্রায় শেষ দিকে তিনি এর ঘোষণা দেন। তিন সপ্তাহ পর ১৮৯৬ এর জানুয়ারীর ২০ তারিখে অঁরি বেকেরেল (Antoine Henri Becquerel) ফ্রেঞ্চ অ্যাকডেমী অফ সায়েন্সে Henri Poincaré এর কাছে এ সম্বন্ধে শুনতে পান।
তার মাথায় এলো যে, যে সকল বস্তু খুব উজ্জ্বল আলো বিকিরণ করে তারাও হয়তো এক্স-রে বিকিরণ করে। আসলে পনের বছর আগে তিনি ইউরেনিয়াম নিয়ে কাজ করতে গিয়ে দেখেছিলেন যে তা সূর্যের আলোয় খুব জোরালো বিকিরণ দেয় (যদিও আসলে সূর্যের আলোর কোন ভূমিকা নেই)। তিনি ১৮৯৬ ‘র ফেব্রুয়ারী তে ইউরেনিয়ামের লবণ যুক্ত একটি পাতলা পাতকে একটা কালো কার্ডবোর্ড বক্সের ওপর বসিয়ে সূর্যের আলোয় রেখে দেন। বক্সের ভেতর ছিলো ফটোগ্রাফিক ফিল্ম। ফিল্মের ওপর আবার একটা ছোট ধাতব টুকরাও ছিলো।
একদিন রাখার পর তিনি ফিল্মটা ডেভেলাপ করেন। হাঁ ফিল্মটা এক্সপোজড হয়ে গিয়েছিলো শুধু ধাতব টুকরার নীচের অংশটি ছাড়া। তিনি আরও নিশ্চিত হওয়ার জন্য (বৈজ্ঞানিকদের যা স্বভাব) এবার আবার পরীক্ষাটি করেন, তবে সাধারণ ধাতব টুকরার পরিবর্তে একটি Maltese Cross ব্যবহার করেন।
এবার তিনি এক শুক্রবার পরীক্ষাটি করতে যান। কিন্তু সেদিনটি ছিলো মেঘলা।
তাই তিনি সবকিছু একটা ক্লজেটের ড্রয়ারের ভেতর রেখে দেন। কিন্তু পরপর দু’দিন মেঘলা কেটে গেলো। তাই বিরক্ত হয়ে তিনি ঐ অবস্থাতেই ফিল্মটি ডেভেলাপের সিদ্ধান্ত নেন। অবশেষে ১৮৯৬ এর মার্চের ১ তারিখ রোববার তিনি ডেভেলাপ করে দেখতে পান যে সূর্যের আলো ছাড়াই ফিল্মটি এক্সপোজড হয়ে গিয়েছে, এমনকি সেই ক্রসের ছায়াও দেখা যাচ্ছে। সেদিন তেজস্ক্রিয়তা আবিস্কৃত হলো।
যদিও তা এক্স-রে’র মত হইচই ফেলেনি কিন্তু প্যারিসে কর্মরত দু’জন মেধাবী গবেষককে তা আকৃষ্ট করলো। এই মেরী এবং পিয়েরে কুরী বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে এর নাম দেন radioactivity। মেরী বলেছিলেন যে ইউরেনিয়ামের তেজস্ক্রিয়তা ইউরেনিয়ামের ভেতর থেকে আসছে। কথাটা এখন শুনলে খুব সহজ মনে হলেও যে সময়ের কথা তখনকার প্রেক্ষাপটে তা যথেষ্ট উদ্ভাবনীমূলক ছিলো।
আর্নেস্ট রাদারফোর্ড ১৮৯৬ থেকে কেমব্রীজে জে.জে. টমসনের ছাত্র হিসেবে গবেষণারত ছিলেন।
বেকেরেলের আবিস্কারে তিনিও কৌতুহলী হলেন।
১৮৯৮ এর জুলাই মাসে মেরী এবং পিয়েরে কুরী পোল্যান্ডের নামে নাম দেয়া পোলনিয়াম ধাতু আবিস্কারের ঘোষণা দেন। এই polonium নিয়ে গবেষণা করেই রাদারফোর্ড আলফা এবং বেটা পার্টিকেল আবিস্কার করেন।
কেমব্রীজে প্রথমে কাজ শুরু করলেও পরে তিনি কানাডার মন্ট্রিলের ম্যাকগিল ইউনিভার্সিটিতে যোগ দেয়ার অফার গ্রহণ করেন। বিয়ের জন্য তার কিছু অর্থের প্রয়োজন হয়েছিলো।
তিনি তার হবু স্ত্রীকে লিখেছিলেন –
“I am expected to do a lot of original work and to form a research school to knock the shine out of the Yankees!”
-Rutherford
তিনি একটা সীসার পাত্রে কিছু পোলনিয়াম রেখে দেখলেন যে তা থেকে বাইরে থেকে কোন তেজস্ক্রিয়তা দেখা যায় না। কিন্তু সীসার পাত্রে একটি ছিদ্র করে দিলে তা দিয়ে কিছু তেজস্ক্রিয় বিকিরণ ফটোগ্রাফিক প্লেটে ধরা পড়ে।
তিনি দেখতে পান যে এর দু’টি অংশ আছে। একটি অংশ পাতলা লেখার কাগজ দিয়েই থামিয়ে দেয়া যায়। তিনি এর নাম দেন আলফা-রে।
দ্বিতীয় অংশটি রাদারফোর্ডের ভাষায় one hundred times more penetrating। তিনি এর নাম দেন বেটা-রে। আলফা-রে ম্যগনেটিক ফিল্ডে অল্প বিক্ষিপ্ত হয়। বেটা-রে অনেক বেশী বিক্ষিপ্ত হয়।
পরবর্তীতে দেখা যায় যে এগুলো আসলে পার্টিকেল।
১৮৯৯ সালে রাদারফোর্ড তার ফলাফল প্রকাশ করেন। এরপর ১৯০০ সালে তিনি বিয়ে করতে নিউজিল্যান্ড চলে যান। তার আর গামা-রে আবিস্কার করা হলোনা। পরে ১৯০০ সালেই ফরাসী পদার্থবিদ Paul Ulrich Villard গামা রশ্মি আবিস্কার করেন।
১৯০০ সালেই ম্যাগনেটিক ফিল্ডের ডিফ্লেকশানের মাধ্যমে বেটা-পার্টিকেলের নেগেটিভ চার্জ ধরা পরে।
বেকেরেল বেটা-পার্টিকেলের e/m (charge to mass ratio) বার করে প্রমাণ করেন যে বেটা-পার্টিকেলগুলো আসলে ইলেক্ট্রন। তবে বেটা পার্টিকেলের ইলেক্ট্রন আর ক্যাথোড-রে’র ইলেক্ট্রনের মাঝে একটু পার্থক্য আছে। বেটা-পার্টিকেল অনেক বেশী গতি বেগ সম্পন্ন, প্রায় আলোর গতির ৯৫%। এখানে প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করা যায় যে ১৯০২ এর দিকেই গতির সাথে সাথে ভরের পরিবর্তনের বিষয়টি পদার্থবিদগণ বোঝা শুরু করেছিলেন।
আলফাগুলোকে প্রথমে ইলেক্ট্রক্যালি নিউট্রাল ভাবা হয়েছিলো।
কারণ প্রথম দিকের পরীক্ষায় এর ডিফ্লেকশান ধরা পড়েনি। পরে বোঝা গেল আসলে ওগুলো বেটার তুলনায় খুব ভারী। ১৯০৩ সালে রাদারফোর্ড খুব সূক্ষ্ম পরীক্ষায় আলফা কণার বিক্ষেপ ধরতে পারেন, এবং তা বেটার উল্টো দিকে। সুতরাং বোঝা গেল এরা ধণাত্মক। ১৯০৫ নাগাদ আলফার e/m বার করে এই সিদ্ধান্ত আসেন, যদি আলফার চার্জ হাইড্রোজেন আয়নের সমান হয় তবে এর ভর হাইড্রোজেন অ্যাটমের দ্বিগুণ।
অবশেষে ১৯০৮ সালে তিনি প্রমাণ করেন যে আলফা হচ্ছে আসলে হিলিয়ামের পরমাণু যেখানে দু’টো ইলেক্ট্রন নেই। সুতরাং তার চার্জ পজিটিভ 2e এবং তার ভর হাইড্রোজেন পরমাণুর চারগুণ। ১৯০২ সালে তিনি ভাবলেন গামা রশ্মি হচ্ছে সাংঘাতিক দ্রুত গতির বেটা পার্টিকেল। তার এই অনুমান অবশ্য ভুল ছিলো।
রাদারফোর্ড আলফার e/m বার করার জন্য টমসনের মতই ইলেকট্রিক এবং ম্যাগনেটিক ফিল্ড ব্যবহার করেছিলেন।
তবে তিনি ফটোগ্রাফিক ফিল্ম ব্যবহার করেন। তিনি মাপজোক করতে গিয়ে এক অদ্ভূত ব্যাপার দেখতে পান। তিনি দেখলেন যে পাতলা মাইকার শীটের ভেতর দিয়ে আলফাগুলোকে চালনা করলে ইমেজগুলো একটু ব্লারড্ হয়ে যায়, অথচ মাইকা (অভ্র) না থাকলে খুব স্পষ্ট ছবি আসে। তারমানে মাইকার পাতটি কোনভাবে আলফা পার্টকেলগুলোকে randomly ছোট ছোট কোণে (এক বা দুই ডিগ্রী) বিক্ষেপ ঘটাচ্ছে। তিনি বুঝলেন আলফাগুলো যেহেতু ইলেক্ট্রনের চেয়ে প্রায় ৮০০০ গুণ ভারী, আলফার গতিবেগ সাংঘাতিক, আর পরমাণুতে বড়জোড় কয়েক ডজন ইলেক্ট্রন থাকে, সুতরাং ইলেক্ট্রনের জন্য এই বিক্ষেপ ঘটছেনা।
অ্যাটমের ভর কোনভাবে তার পজিটিভ চার্জের সাথে সম্পৃক্ত। তিনি এও বুঝলেন, যে এই ছোট ছোট বিক্ষেপগুলোকে ভালমত পর্যবেক্ষণ করলে হয়তো পরমাণুর ভেতরের চার্জ ও ভরের ডিস্ট্রিবিউশান বোঝা যাবে। ইতোমধ্যেই ঐটুকু বিক্ষেপ ঘটানোর জন্য যে পরিমাণ ইলেক্ট্রিক ফিল্ডের প্রয়োজন তাই রাদারফোর্ডের কাছে বিস্ময়কর ছিলো।
১৯০৭ সালে রাদারফোর্ড ম্যাকগিল ইউনিভার্সিটি ছেড়ে ইউনিভার্সিটি অফ ম্যানচেস্টারে যোগ দেন। তার সাথে Johannes Wilhelm Geiger কাজ শুরু করেন।
রাদারফোর্ডের আলফা স্ক্যাটারিং এক্সপেরিমেন্টই প্রথম পরীক্ষা যেখানে আলফাদের সিস্টেম্যাটিক্যালি স্ক্যাটারিং ঘটানো হয় এবং ডিটেক্ট করা হয়। আজ একশ বছর পরও এটা কণা পদার্থবিদ্যার একটা স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিওর।
এখানে স্ক্যাটারিং ক্রস সেকশান বলে একটা বিষয় আলোচনা করতে হচ্ছে। ব্যাপারটা সহজে ক্রস সেকশান বা প্রস্থচ্ছেদ বলতে যা বোঝায় আসলে তাই। ধরা যাক একটা বল দিয়ে দ্বিতীয় আরেকটা বলকে আঘাত করা হবে, সেক্ষেত্রে দ্বিতীয় বলটা যত বড় হবে সংঘর্ষের সম্ভাবনা তত বেড়ে যাবে।
বৈজ্ঞানিকেরা প্রথমেই এই পরিমাপগুলো রেডি করে তার পর পরীক্ষা চালান। ডিফারেন্সিয়াল ক্রস সেকশান বলতে বোঝায় যে ক্রস সেকশানে একজন বৈজ্ঞানিক যে ধরণের ঘটনা (event) ঘটবে বলে আশা করছেন তাই। যেমন এক ডিগ্রী স্ক্যাটারিং এর জন্য কত বড় টার্গেট দরকার বা কত বড় টার্গেট হলে তিন ডিগ্রী স্ক্যাটারিং হতে পারে। অর্থাৎ এখানে বৈজ্ঞানিকেরা ট্রায়াল অ্যান্ড এরর ভিত্তিতে এগুলো বারবার পরিবর্তন করে তথ্য সংগ্রহ করেন। যেমন রাদারফোর্ড প্রথমে 100e চার্জ ধরে তার ক্যালকুলেশান করেছিলেন।
ডীপ ইনইলাস্টিক স্ক্যাটারিং বলতে বোঝাচ্ছে যে এটা পরমাণুর গভীরতম প্রদেশে প্রবেশ করতে সক্ষম, আর যেহেতু সেখানে সংঘর্ষ হয়ে যেতে পারে সেক্ষেত্রে টার্গেট আগের অবস্থায় ফিরে নাও আসতে পারে (inelastic)।
অবশেষে তারা দু’জনে মিলে সেই বিখ্যাত গোল্ড-ফয়েল এক্সপেরিমেন্ট শুরু করেন। পদার্থবিদগণ এটাকে Geiger-Marsden পরীক্ষা নামে ডেকে থাকেন।
এখানে B হচ্ছে প্রায় বায়ুশুন্য ধাতব পাত্র। T টিউব দিয়ে এটাকে বায়ুশুন্য করা হয়।
R স্থানে কয়েক মিলিগ্রাম রেডিয়াম রাখা হয়। সেটা ভেঙ্গে গিয়ে রেডন-২২২ তৈরী হয় এবং তা থেকে আলফা পার্টিকেল নির্গত হয়। রাদারফোর্ডের মূল রচনা থেকে-
“By means of a diaphragm placed at D, a pencil of alpha particles was directed normally on to the scattering foil F. By rotating the microscope [M] the alpha particles scattered in different directions could be observed on the screen S.”
এখানে S হচ্ছে জিংক সালফাইডের (ZnS) স্ক্রীন যেখান আলফা পার্টকেল হিট করলে ফ্লুরোসেন্স দেখা যায়। ব্যাপারটা ছিলো খুব কঠিন। প্রায় আধ ঘন্টা সম্পূর্ণ অন্ধকারে বসে থেকে চোখ অ্যাডজাস্ট করে নিতে হতো।
এরপর একজন অবজার্ভার মাত্র এক মিনিট সূক্ষ্মভাবে ঐ ফ্লুরোসেন্স দেখতে পেতো। এরপর তাকে আবার বিরতি দিতে হতো। এভাবে বহু সপ্তাহ ধরে হাজার হাজার অবজার্ভেশানের রেজাল্ট লিপিবদ্ধ করা হয়েছিলো। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায় যে, সেখানে সোনার পাতটি প্রায় চারশ পরমাণু পরিমাণ পুরু ছিলো।
হয়তো এই সুকঠিন কাজকে সহজ করার জন্যই গাইগার পরে গাইগার-কাউন্টার আবিস্কার করেন যেটা স্বাভাবিক আলোয় এই পালসগুলো গুণতে পারে।
তাদের পরীক্ষায় এক বা দু’ডিগ্রীর ডিফ্লেকশান ধরা পড়ে। এদিকে ১৯০৯ সালে গাইগার একজন Ernest Marsden নামের এক আন্ডারগ্র্যাজুয়েটকে ট্রেনিং দিচ্ছিলেন। তার জন্য এক্সপেরিমেন্টের দরকার পড়েছিলো। তখন রাদারফোর্ড তাকে বড় কৌণিক বিক্ষেপ করা যায় কিনা সেই পরীক্ষা করতে দিতে বলেন। এবার বড় ধরণের ডিফ্লেকশান্ ধরা পড়ে।
"I had observed the scattering of alpha-particles, and Dr. Geiger in my laboratory had examined it in detail. He found, in thin pieces of heavy metal, that the scattering was usually small, of the order of one degree. One day Geiger came to me and said, "Don't you think that young Marsden, whom I am training in radioactive methods, ought to begin a small research?" Now I had thought that, too, so I said, "Why not let him see if any alpha-particles can be scattered through a large angle?" I may tell you in confidence that I did not believe that they would be, since we knew the alpha-particle was a very fast, massive particle with a great deal of energy, and you could show that if the scattering was due to the accumulated effect of a number of small scatterings, the chance of an alpha-particle's being scattered backward was very small. Then I remember two or three days later Geiger coming to me in great excitement and saying "We have been able to get some of the alpha-particles coming backward …" It was quite the most incredible event that ever happened to me in my life. It was almost as incredible as if you fired a 15-inch shell at a piece of tissue paper and it came back and hit you. On consideration, I realized that this scattering backward must be the result of a single collision, and when I made calculations I saw that it was impossible to get anything of that order of magnitude unless you took a system in which the greater part of the mass of the atom was concentrated in a minute nucleus. It was then that I had the idea of an atom with a minute massive center, carrying a charge."
—Ernest Rutherford
কিছু কিছু বিক্ষেপ এত বড় ছিলো যে তা প্রায় বিপরীত দিকে চলে গিয়েছিলো। বড় অ্যাঙ্গেলের ডিফ্লেকশান টমসনের মডেল দিয়ে ব্যাখ্যা করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। তার মডেলে চার্জ সমভাবে পুরো অ্যাটম জুড়ে বিস্তৃত। বড় কৌণিক বিক্ষেপের জন্য খুব ভারী ধণাত্মক বস্তু প্রয়োজন। যদি পুরো অ্যাটম জুড়ে চার্জ থাকে তবে বিকর্ষণ বল হবে খুব ছোট।
গোল্ড-ফয়েল এক্সপেরিমেন্টের কৌণিক বিক্ষেপ ব্যাখ্যার জন্য ধণাত্মক চার্জকে খুব ছোট জায়গায় সীমাবদ্ধ হতে হবে।
এ পরীক্ষায় মোটামোটি তিনটি বিষয় স্পষ্ট হয়ঃ
১. বেশীরভাগ আলফা অবিক্ষিপ্ত অবস্থায় চলে গিয়েছে
২. কিছু কণার অল্প বিক্ষেপ ঘটেছে
৩. কিছু কণা প্রায় ছিটকে উল্টোদিকে চলে গিয়েছে
তারমানে পরমাণুর বেশীরভাগ অংশই শুন্য, এ কারণেই বেশীরভাগ আলফার কোন বিক্ষেপ হয়নি। পরমাণুর ভর ক্ষুদ্র আকৃতিতে কেন্দ্রীভুত, এবং তা পজিটিভলি চার্জড্। কেন্দ্রে পজিটিভ চার্জ না থাকলে কোন সময়ই কোন বিক্ষেপ হতোনা।
যে আলফাগুলো ভারী কেন্দ্রের কাছ দিয়ে যাচ্ছে বৈদ্যুতিক বিকর্ষণ বলের কারণে তাদের বিক্ষেপ ঘটছে।
যে কণাগুলো প্রায় কেন্দ্রে আঘাত করছে, তাদের বড় বিক্ষেপ ঘটছে।
রাদারফোর্ড বহু সময় ব্যয় করে ডিফ্লেকশানের পথ বের করলেন। তিনি দেখলেন যে বিক্ষেপগুলো বিলিয়ার্ড বলের সংঘাতের মত সরল রৈখিক নয়, বরং কিছুটা হাইপারবোলিক।
এরপর তিনি কুলম্বের সূত্র প্রয়োগ করে কিছু গাণিতিক হিসেব কষলেন। তার গণনা পুরোটাই ক্লাসিকাল ফিজিক্সের ওপর ভিত্তি করে ছিলো।
যখন একটা আলফা কেন্দ্রের কাছ দিয়ে যাচ্ছে তখন কেন্দ্র তাকে বিকর্ষণ করছে। এই বৈদ্যুতিক বিকর্ষণ বলকে দু’টো লম্বাংশকে ভাগ করা যায়, একটা তার গতি কমাবে আরেকটা তাকে পাশের দিকে ধাক্কা দিয়ে বিক্ষেপ ঘটাবে।
এবার আরেকটু অংক কষা যাক। কুলম্বের সূত্রানুযায়ী দু’টো চার্জের মধ্যবর্তী বিকর্ষণ বল পরস্পরের দূরত্বের বর্গের ব্যস্তানুপাতিক (inversely square)।
এখন দেখা যাক টমসনের মডেলের কি অবস্থা দাঁড়ায়।
পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ যেমন কেন্দ্রে শুন্য, পৃথিবী পৃষ্ঠে সর্বোচ্চ, আর পৃষ্ঠ থেকে যত দূরে যাওয়া যায় তত কমে যায়। সেভাবেই ধণাত্মক চার্জবাহী আলফাগুলোও পজিটিভলি চার্জড্ গোলকের পৃষ্ঠে সর্বোচ্চ বিকর্ষণ বল অনুভব করবে। এবং অ্যাটম পার হতে অতিক্রান্ত দূরত্বটুকুর সময়ই সেটা হবে।
এবার দেখা যাক এই ছোট বল কি পরিমাণ পাশের দিকে গতি সৃষ্টি করতে পারে। যদি আলফার প্রারম্ভিক ভরবেগ p হয় তবে-
এই গতিবেগ অতি সামান্য।
এ দিয়ে এমনকি এক ডিগ্রী বিক্ষেপও সম্ভব নয়। এমনকি যদি আলফা পার্টিকেল পরপর চারশটি পরমাণুর ডিফ্লেকশানও পার হয় তবুও তা দিয়ে বড় ডিফ্লেকশান ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। রাদারফোর্ড বললেন যে বিক্ষেপ যত বেশীই হোকনা কেন তা কেবল একটি পরমাণুর জন্যই ঘটছে।
এবার যদি পরমাণুর একটি কেন্দ্র কল্পনা করা যায় যার ব্যাসার্ধ দশ হাজার ভাগ ছোট তাহলে দাড়ায়-
এই বেগের মাধ্যমে ভাল বিক্ষেপই সম্ভব। রাদারফোর্ড খুব তুখোড় থিওরেটিশিয়ান ছিলেননা।
কিন্তু কয়েক সপ্তাহ পরিশ্রম করে তিনি ঠিকই সবকিছু গণনা করতে সক্ষম হলেন। তিনি আলফার স্ক্যাটারিং বোঝার জন্য ত্রিশ ফিট তারে ঝোলানো একটি ঝুলন্ত ইলেক্ট্রোম্যাগনেট যা পেন্ডুলামের মত দুলতো আর টেবিলের ওপর আরেকটি সমমানের চুম্বকের সাথে সামান্য ঘষা লাগত এরকম এক যন্ত্র ব্যবহার করেছিলেন। ম্যাক্সওয়েলের বৃহস্পতি বলয়ের ব্যাখ্যায় কেন্দ্রমুখী বল (যার কারণে এলিপ্টিকাল অরবিট হয়) না ধরে কেন্দ্র বিমুখী বল ধরলেই হাইপারবলিক পাথওয়ে পাওয়া যায়। তিনি “নিউক্লিয়াস” শব্দটি প্রচলন করেন এবং সোনার পরমাণুর নিউক্লিয়াসের ব্যাসার্ধ পরিমাপ করেন (বর্তমান স্বীকৃত রেডিয়াসের সাথে অবশ্য মিল নেই)।
তিনি তার পরমাণু মডেল বর্ণনা করেন যেখানে ধণাত্মক চার্জগুলো খুব ক্ষুদ্র এক নিউক্লিয়াসে কেন্দ্রীভূত আর ইলেক্ট্রনগুলো বৃত্তাকার পথে বিন্যস্ত।
এটাকে প্ল্যানেটারী মডেলও বলা হয় (সৌরজগতের সাথে মিল আছে বলে)। প্রায় বিশ পৃষ্ঠার এক আর্টিকেলে তিনি তার গবেষণা বর্ণনা করেন।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে গাইগার এবং মার্সডেন দু’জনই ওয়েস্টার্ন ফ্রন্টে চলে গেলেন (বিপরীত পক্ষে!)। রাদারফোর্ড ম্যানচেস্টারে এক বিশাল পানির ট্যাংকে সাবমেরিন আক্রমণ কি করে ঠেকানো যায় সে ব্যাপারে গবেষণা করলেন। সাথে সাথে তার পরমাণু গবেষণাও চালু রাখলেন।
১৯১৯ সালে তিনি নাইট্রোজেন গ্যাসকে আলফা দিয়ে আঘাত করে দেখালেন যে তাতে করে হাইড্রোজেন পরমাণুর উদ্ভব ঘটেছে। সংবাদপত্রে বিরাট হেডলাইন হয়েছিলো যে রাদারফোর্ড “split the atom”।
তার পরমাণু মডেলের সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিলো এর স্ট্যাবিলিটি। যদি ইলেক্ট্রনগুলো কক্ষপথে স্থির থাকে, তবে ধণাত্মক নিউক্লিয়াসের আকর্ষণে তা এক সময় কেন্দ্রে পড়ে যাবে। আবার যদি সমবেগে ঘুর্ণায়মানও হয় তবেও সমস্যা।
সমবেগে ঘোরার কারণে প্রতি মুহূর্তে এর গতিমুখ পরিবর্তনের জন্য ত্বরণ প্রয়োজন। নাহলে এটা সরল পথে উড়ে চলে যাবে। কিন্তু ত্বরাণ্বিত চার্জ শক্তি বিকিরণ করে। সুতরাং শক্তি বিকিরণের জন্য এটা শক্তি হারিয়ে আরও ছোট কক্ষপথে ঘুরতে বাধ্য হবে। এতে করে তার শক্তি হারানোর হার আরও বাড়বে।
তখন তার কক্ষপথ আরও ছোট হবে। অর্থাৎ একসময় তা ঘুরতে ঘুরতে কেন্দ্রে পড়ে যাবে। অর্থাৎ রাদারফোর্ডের মডেলে খুব অল্প সময়েয়ই পরমাণু ধ্বংস হয়ে যাবার কথা। কিন্তু বাস্তবে বেশীরভাগ পরমাণুই খুব স্ট্যাবল।
সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে রাদারফোর্ডের মডেলে সমস্যা আছে।
এ সমস্যা ক্লাসিকাল ফিজিক্স দিয়ে আর সমাধান সম্ভব হয়নি। ম্যাক্স প্লাংকের কোয়ান্টাম তত্ত্ব দিয়ে ১৯১৫ সালে নীলস্ বোর এর আংশিক সমাধান করেন।
লম্বা পথ পাড়ি দিয়ে আমরা নিউক্লিয়াসে পৌছে গিয়েছি। এরপর প্রোটন আর মিউওনের পালা। আমাদের দেশে অনেক শিক্ষিত লোকও দেখেছি যারা বৈজ্ঞানিক বলতে কেবল আইনস্টাইনকে বোঝেন।
অথচ রাদারফোর্ড, ম্যাক্স প্লাংক, নীলস্ বোর, শ্রোডিঞ্জার, ডি ব্রলি, বোলট্জম্যান এরা বর্তমান কোয়ান্টাম ফিজিক্স তথা কণা পদার্থবিদ্যার স্তম্ভের মত। অবশ্য কোয়ান্টাম ফিজিক্সে আইনস্টাইনেরও অসামান্য অবদান রয়েছে। মজার ব্যাপার হোল আইনস্টাইন বিশ বৎসর যাবৎ চেষ্টা করে ছিলেন কোয়ান্টাম ফিজিক্সের কিছু মতবাদ ভুল প্রমাণ করতে।
রাদারফোর্ড এক আশ্চর্য উদ্ভাবনী ক্ষমতার অধিকারী বৈজ্ঞানিক ছিলেন। ক্লাসিকাল নিউটোনিয়ান মেকানিকস্ দিয়ে তিনি যে ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়েছিলেন, পরবর্তীতে কোয়ান্টাম মেকানিকস্ দিয়েও তা সঠিক পাওয়া গিয়েছে।
নিউক্লিয়ার পদার্থবিদ্যার জনক এ মহান বৈজ্ঞানিকের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এ পর্ব শেষ করছি।
পরের পর্বগুলোতে বর্তমান দানবীয় বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতির পূর্বসূরীদের কিছু আলোচনা থাকবে। এরপর কোয়ান্টাম জগতে শুভ প্রবেশ। নীলস্ বোরের মডেল, বর্ণালীর কোয়ান্টাম ব্যাখ্যা, পরমাণুর ওয়েভ মেকানিকাল থিওরী, লেজার রশ্মির সামান্য আলোচনা, বিখ্যাত কোপেনহেগেন সম্মেলন (বর্তমানের ব্যর্থ সম্মেলনটি নয় অবশ্য), বোর-আইনস্টাইন ডিবেট ইত্যাদি পার হয়ে একসময় মূল আলোচ্য বিষয় QED’র পালা আসবে। তারপর এই সিরিজ শেষ হয়ে যাবে।
সবার প্রতি পড়ার আমন্ত্রণ রইলো।
পর্ব - ৪
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।