বাসা থেকে বের হতেই স্যান্ডেলের ফিতাটা ছিড়ে গেল। সামনে মুচির দোকান নেই, হাটতে হবে বেশ কিছুক্ষন তারপর বামে গলিতে সুইটিদের বাসা, বারান্দার সামনে একজন মুচি বসে, রাতুলের বড়ই প্রিয় সেই মুচি মামা, এক সময় মামা ভাগ্নে ভাগাভাগি করে গোল্ডলিফ টানত, ধোয়ার সুখটানের পাশে, উকি দিয়ে দেখত সুইটি আসে নাকি। তারপর চোখে চোখে কিছুক্ষন প্রেম প্রেম খেলা।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে রাতুল, আজকে ওই মুচির কাছে যেতে ইচ্ছে করছে না। কিন্তু ফিতা ছিড়ে যাওয়ায় হাটতে অসুবিধাও হচ্ছে।
রাতুল গলিটার দিকে মোড় নেয়, দেখে মুচি তার সেলাই চালিয়ে যাচ্ছে।
--মামা, স্যান্ডেল টা একটু সেলাই কইরা দাও।
-- আরে, রাতুল মামা নাকি। কেমুন আসেন? এই দিকে আহেন না দেহি। আফায় ও গেল আপনেও উধাও হইয়া গেলেন, যানেন হাজী সাবে নাকি আরেকটা বিয়া করছে?
হাজী সাব, এলাকার কমিশনার, সুইটির বাবা।
ক্ষমতাশালী লোক, সাদা পাঞ্জাবি আর আতর দিয়ে মাখামাখি করে চলাফেরা করেন। ইট সিমেন্টের ব্যবসা আছে, এক পাল গুন্ডা বাহিনীও রয়েছে, গুন্ডা দেখলে রাতুলের ভয় লাগে, ওরা ছুড়ি মেরে সব কিছু নিয়ে যায়।
রাতুলের মধ্যে কোন ভাবালেশ নেই।
--মামা কইছিলাম না এই বুইরার ভিম্রত্তি হইছে, দেখলেন। মাইডারে বিদ্যাস পাঠাইয়া দিয়া এই আকাম করছে।
-- আচ্ছা, আমার স্যান্ডেল সিলাই কত লাগবে।
-- আরে ধুর আপনে, কত দিন পরে আসলেন, টেঁকা লাগব না একটু গল্প সল্প কইরা লই।
মুচি জর্দায় ক্ষয়ে যাওয়া কাল কাল দাত গুলা বের করে খ্যাক খ্যাক করে হাসে, হাসিটা খারাপ লাগে না রাতুলের। এখানে একটু বসা যায়।
--মামা বিড়ি টানবেন? গোল্ড লিফ না বেন্সন?
--গোল্ড লিফ
রাতুল সিগারেটের টান দিয়েই বারান্দাটার দিকে তাকায়, একটি দু তিন বছরের বাচ্চা মেয়ে খেলছে।
এটা কি সুইটির মেয়ে? নাহ ৬ মাস হল বিয়ে হয়েছে, এত তাড়াতাড়ি কেমনে বাচ্চা হবে, আর সুইটিতো আম্রিকা থাকে। নাহ!!!
--মামা হেরা এখন এইহানে থাকে না, গুলশান থাকে, বুইরায় জানে পাব্লিগে খিজলাইব, তাই গেছে গা। ওইডা ভারাইট্টার মাইয়া।
ধানমন্ডির ৭ নম্বরের পার্কে রাতুল আর সুইটি পাশাপাশি বসে আছে, উদাস মনে সুইটি ঘাশের উৎপাটন করছে, মসজিদে আজান দেয়। যোহরের আজান, পার্কের পেছনেই মসজিদ, মুসুল্লিরা নামাজ পরতে যাবেন।
মসজিদের সামনে বসে প্রেম করতে কেমন যেন লাগে। জোড়ায় জোড়ায় যুগলরা প্রেমে মগ্ন। সিকুরিটি গার্ড এশে লাঠি ঠুকে বলে, ঠিক হইয়া বসেন—এইডা বাসা না। রাজহাঁস গুলা পানি ছেড়ে উঠে, রোদ তাপাচ্ছে। সুইটির রাজহাঁস অনেক পছন্দ।
--বিয়ের পরে আমরা এইরকম দুইটা রাজহাঁস পালব।
-- ঠিক আছে।
-- এই বাবা না আমাকে তোমার সাথে দেখা করতে মানা করছে।
-- ঠিক আছে।
-- কি ঠিক আছে, তুমি কিচ্ছু বুঝনা।
আমার বিয়ের কথাবার্তা চলছে।
-- হুম।
-- কি হুম। তুমি একটা গাধা। তোমাকে দিয়ে কিচ্ছু হবে না, চল পালিয়ে যাই।
--কোথায় যাবা?
--যেখানে মন চায়, কিন্তু এই শহর ছেড়ে দূরে কোথাও।
--কিন্তু আমার কাছে তো ভাড়া নেই।
--লাগবে না, আমার কাছে আছে।
--তোমার বাবা??
সিগারেট প্রায় শেষ। মামা চা এর জন্য বলেছে, টং দোকান থেকে ময়লা কাপে এক কাপ চা এসে পড়লো।
--এই লন মামা। খান। আফার জামাই নাকি অনেক বড় ব্যবসাই। আম্রিকার ছিটিজেন।
-- কে বলল??
-- নাহ হুনছিলাম, এলাকার পোলাপানে কইতাছিল।
-- ও আচ্ছা।
-- চা শেষ করেন ঠাণ্ডা হইয়া যাইব।
রাতুল চা শেষ করে আরেকটা সিগারেট ধরায়।
মাঝরাতে হটাত একটা এসএমএস আসে,
--রাতুল তুমি পালাও, বাবা তোমাকে গুন্ডা দিয়ে মেরে ফেলার ব্যবস্থা করেছে।
রাতুল পালায় না, কই যাবে? মেসে বসে থাকে।
দুপুরের দিকে কিছু লোক এসে রাতুলকে ধরে নিয়ে যায়।
--এই পোলা, তোর নাম কি রাতুল?
--জী
--তুই নাকি আমার মাইয়ার লগে পেরেম করস??
--জী আমি ওকে ভালবাসি।
--আরে রাখ তোর বালবসা, তুই জানস আমি কেডা, বালুবাসা পিছন দিয়া ঢুকাইয়া মুখ দিয়া বাইর কইরা দিমু।
--জী আচ্ছা।
--কি তোর এত বড় সাহস আমার উপরে কথা,ওই মার ওরে।
ঢাকা মেদিকেলের ৩২-৩৩ ওয়ার্ডে শুয়ে আছে রাতুল। জামিলা বেগম কিছুক্ষন পর পর আচল দিয়ে চোখ মুছছে।
--আম্মা আব্বা আসছে।
--হুম নামাজে গেছে। তুই ক্যান ওই মস্তানগুলার লগে মারামারি করতে গেছিলি?
রাতুল বুঝতে পারে এখানে কিছু গণ্ডগোল আছে।
মতিন হাজী, হাজী সাব এক গাদা ফুল আর কিছু ফল ও খাবার দাবার নিয়ে হাজির। সাথে সুইটিও রয়েছে। মাথার কাছে এসে হাত বুলায়ে জিজ্ঞাসা করলেন
--কেমন আছো বাবা। ওরা তো তোমাকে মেরেই ফেলত যদি আমি না বাচাইতাম। আমিই তোমার মা কে খবর দিয়া আনছি।
--ধন্যবাদ চাচা। আমি আপনার কাছে অনেক ঋণী।
-- ও আপা পরশু আমার এক মাত্র মেয়ের বিয়ে, এই নিন কার্ড, অবশ্যই আসবেন।
-- এই রাতুল আসবা কিন্তু, সুইটির মুখে উজ্জ্বল হাসি।
রাতুল কে গোটা মুরগী দেওয়া হয়েছে।
সাথে আছে খাসির রেজালা, গরুর কাল ভুনা। রাতুল নিমগ্ন ভাবে মুরগীর রান চিবুচ্ছে, ওদিকে সুইটি তার জামাইয়ের সাথে ছবি তুলাতে ব্যস্ত।
--মামা রেজালা কই।
--খারান লইয়া আইতাছি
রবীন্দ্রসরবোরে বসে সুইটি তার বিবাহের প্লান তৈরি করছে।
--এই রাতুল বল না আমাদের বিয়েতে কয়জন দাওয়াত দিবা? তুমি বর যাত্রী নিয়ে আসবা ? নাকি একাই আসবা।
--দেখা যাক।
--তুমি না একটা!!!! আচ্ছা আমাদের বিয়েতে খাবারের মেন্যু কি হবে?
-- মুরগীর রোস্ট, খাশির রেজালা আর গরুর কাল ভুনা।
নাহ এগুলা চিন্তা করে আর লাভ নেই।
--এই দিকে কাল ভুনা টা একটু দিন তো।
রাতুল আবার কাল ভুনার দিকে মনোযোগ দেয়।
বারান্দাটি তে আগের সেই মানিপ্লান্ট গাছ গুলা নেই। একটি দোলনার নতুন সংযজন হয়েছে। নতুন জীবনের শুরু।
বাচ্চারা খেলছে, নিস্পাপ চেহারার ফুটে উঠছে, অদম্য জীবনীশক্তি।
--মামা সেলাই হইয়া গেছে।
--আচ্ছা মামা, এইবার যাই।
-- ঠিক আছে মামা আবার আইসেন।
রাতুল উঠে হাটা দেয়। কিছুদুর যাবার পরই একটি গর্তে পরে আবার আরেকটি ফিতা ছিরে যায়। স্যান্ডেলটা সেলাই করতে হবে।
কিন্তু গলিটার দিকে এখন আর ফিরে তাকাতে ইচ্ছে করছে না।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।