মূল : অজিত হরি সাহু
তরজমা : হোসেন মাহমুদ
একটি বালক এবং নদীর মধ্যে দণ্ডায়মান ছিল একটি পর্বত। বালকটির বয়স ছিল কম, নদীটি ছিল ছোট, কিন্তু পর্বতটি ছিল বিরাট।
ঘন জঙ্গলে ঢাকা পর্বতটি নদীকে আড়াল করে রেখেছিল। কিন্তু বালকটি জানতো যে নদীটি সেখানে আছে এবং কোথায় আছে, দেখতেই বা কেমন। সে নিজের চোখে নদীটি দেখেনিÑ কিন্তু গ্রামের মানুষদের কাছে নদীটির কথা সে এত বেশি শুনেছিল যে তার মনের ভেতর একটি সুস্পষ্ট ছবি আঁকা হয়ে গিয়েছিল।
নদীতে মাছ আছে, পাথর আছে, স্রোত আছে আর স্রোতের ঘূর্ণি আছে। আসলেই নদীটি সম্পর্কে জানতে তার কিছুই বাকি ছিল না শুধু বাকি ছিল নদীর পানি স্পর্শ করা এবং নিজের চোখে দেখা।
পর্বতের বিপরীতে একটি পাহাড়ের ওপর তাদের বাড়ি। বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে সে উপত্যকার দিকে তাকিয়ে নদীটির কথাই ভাবছিল। তার বয়স প্রায় বারো বছর।
বলিষ্ঠ শরীর, মাথায় অবিন্যস্ত কালো চুল, দু’টি উজ্জ্বল কালো চোখ। চেহারা ভালো, গায়ের রঙ বাদামি। তবে তার হাত ও পায়ের চামড়া ছিল রুক্ষ, ফাটা। তার পা ছিল খালি। জুতো কেনার সামর্থ্য তার ছিল না তা নয়।
আসলে খালি পায়ে থাকতেই সে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করত। সরাসরি পাথরের উষ্ণতা ও ঘাসের শীতলতা অনুভব করতে তার ভালো লাগত। যেহেতু সে জুতো পরত না তাই জুতো পরা ও খোলার ঝামেলাও তার ছিল না।
সকাল এগারোটা বেজে গিয়েছিল। বাবা-মা কেউই আজ সন্ধ্যার আগে বাড়ি ফিরবেন না।
সাথে রুটি নিয়ে বেরিয়ে পড়া যেতে পারে, সে ভাবল। পথে বুনো ফল-টল পাওয়া যাবে। সেগুলো কিছু তুলে নেয়া যেতে পারে। অনেকদিন ধরেই এরকম একটি সুযোগের অপেক্ষায় ছিল সে। এমন সুযোগ অনেকদিন আর নাও আসতে পারে।
বহুদিন পর বাবা-মা জরুরি প্রয়োজনে সারাদিনের জন্য আত্মীয়স্বজনের সাথে দেখা করতে গেছেন। তাকে তারা একা রেখে গেছেন বাড়িতে। তার যাতে কোন অসুবিধা না হয় সে জন্য কিছু খাবারও তৈরি করে রেখে গেছেন মা, যার মধ্যে আছে রুটি, দুধ ও দু’টি ডিম। সে যদি সন্ধ্যার মধ্যে তাদের ফেরার আগেই বাড়ি ফিরে আসতে পারে তাহলে তারা কিছুই টের পাবেন না।
সে বাড়ির মধ্যে ফিরে আসে।
একটি খবরের কাগজের মধ্যে রুটি জড়িয়ে নেয়। তারপর সব ঘরের দরজা ও জানালা ভালো করে বন্ধ করে। আর দেরি করা ঠিক হবে না। বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে সে।
নদীতে যাবার পথটি প্রথমে কিছুদূর ঢালু হয়ে উপত্যকায় নেমে গেছে, তারপর উপরে উঠতে উঠতে ঘুর পথে বিরাট পর্বতের ভেতর দিয়ে অগ্রসর হয়েছে।
কাঠুরে, দুধওয়ালা, খচ্চর চালকসহ গ্রামবাসীরা এপথে সবসময় চলাচল করে। তবে পর্বতের ওপারে বা নদীর কাছে কোন গ্রাম নেই।
পথে এক কাঠুরের সাথে বালকটির দেখা হয়। নদীটা আর কতদূরেÑ জিজ্ঞেস করে সে। কাঠুরে লোকটা বেঁটে, কিন্তু শক্তিশালী।
তার মুখের চামড়া বিবর্ণ ও ভাজপড়া। বোঝা যায়, ঝড়-বৃষ্টি বরফের অত্যাচারেই এই অবস্থা। তার প্রশ্নের জবাব দেয় কাঠুরিয়াÑ
: সাত মাইল।
ঠিকই বলেছে সে ভাবে। এ সময় কাঠুরে প্রশ্ন করে
: তুমি এটা জানতে চাইলে কেন?
: আমি নদীটা দেখতে যাচ্ছি।
: তুমি কি একা?
: হ্যাঁ।
: কিন্তু নদীতো অনেক দূরে। সেখানে পৌঁছুতে আরো তিন ঘণ্টা লেগে যাবে। তারপর তোমাকে আবার ফিরতে হবে। তখন অন্ধকার হয়ে যাবে।
তাছাড়া পথ ভালো নয়।
বালকটি কাঠুরেকে আশ্বস্ত করার জন্য বলে
: আমি খুব ভাল হাঁটতে পারি।
আসলে বাড়ি ছেড়ে হেঁটে এক মাইলের বেশি দূরে কখনোই যায়নি সে। এটি ছিল বাড়ি থেকে তার স্কুলের দূরত্ব। যাহোক, সে দ্রুত চলতে শুরু করে।
এদিকে কাঠুরে বিস্মিত চোখে বালকটির গমনপথের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। বাজার থেকে ফেরার পথে ছেলেটি ফিরল কি না সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে কাঠুরে মনে মনে ভাবে।
বেশ ঢালু পথ। তাই বালকটিকে বেশিরভাগ সময়ই দৌড়াতে হচ্ছিল। আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ।
এরকম পথে চলা সহজ নয়। দু’বার সে পা পিছলে গড়িয়ে পড়তে পড়তে রাস্তার পাশে থাকা ঝোপে আটকে গেল। একবার পথ থেকে সরে বেশ খানিকটা নিচেও নেমে গেল সে। বেশ কষ্টে আবার উপরে উঠে এলো। তবু গোটা পথে পাহাড়ের অপরূপ সবুজ দৃশ্য মুগ্ধ করে রাখল তাকে।
সারা পাহাড়কে ঢেকে রেখেছে ঘন সবুজ ফার্ন, ছোট গাছগাছালি, তাদের গায়ে বেড়ে ওঠা লতাপাতা। এক জায়গায় গাছের পাতা ও ফার্নের আবরণ সরিয়ে মাথা তুলেছে বিশাল এক সোনালি রঙের ডালিয়া। মনে হচ্ছে, জায়গাটি আলোকিত হয়ে উঠেছে। শিগগিরই সে উপত্যকায় নেমে এল। এখান থেকে পথ সোজা উপরে উঠে গেছে।
এ সময় উল্টো দিক থেকে আসা এক তরুণীর দেখা পেল সে। তার হাতে একটি বাঁকা ছুরি যা ঘাস কাটার জন্য ব্যবহার করা হয়। নাকে ও কানে রিং ঝুলছে। দু’হাতে অনেক ভারী চুড়ি।
বালকটি জিজ্ঞেস করে তরুণীকে, আচ্ছা, নদীটা আর কত দূর?
তরুণীটি নদীর কথা হয় জানেই না অথবা অন্য কারো কথা ভাবছিল।
তাই অন্যমনস্কভাবে জবাব দিল
: তা বিশ মাইল হবে।
জবাব শুনে হেসে উঠল সে। তারপর চলতে শুরু করল। হঠাৎ কোত্থেকে যেন একটি তোতাপাখি উড়ে আসে। পাখিটি তার মাথার ওপর দিয়ে উড়তে থাকেÑ যেন তাকে সঙ্গ দিচ্ছে।
চড়াই-এর পুরো পথটিই তার সাথে সাথেই রইল পাখিটা। তারপর গাছের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেল।
পথের পাশেই একটি ক্ষীণকায় পাহাড়ি ঝর্ণা। একটু থেমে ঝর্ণা থেকে পানি খেয়ে তৃষ্ণা মিটিয়ে নেয় সে। পানি ঠাণ্ডা এবং ক্লান্তি দূরকারী।
ফলে তার তৃষ্ণা আরো বেড়ে যায়। আবার পেটপুরে পানি খায় সে। পাহাড়ের যে দিকে সে ছিল সেখানে সূর্য অবাধে আলো ছড়িয়ে চলছিল। ধুলোময় পথ ও পাথর বেশ উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। পায়ে পাথরের গরম ছোঁয়া অনুভব করে সে।
এক ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে হাঁটছে, সুতরাং অর্ধেক পথ এতক্ষণে পেরিয়ে এসেছে বলে তার ধারণা। তখনও সামনে এক পাল ছাগল তাড়িয়ে আনা একটি বালককে দেখতে পায় সে। জিজ্ঞেস করে
: নদীটা আর কত দূরে?
গ্রাম্য ছেলেটি তার দিকে চেয়ে বন্ধুত্বের হাসি হাসে। বলে : বেশি দূরে নয়। আর একটি পাহাড় পেরোলেই দেখবে পথ সোজা নদীর দিকে নেমে গেছে।
ছেলেটিকে দেখে মনে হচ্ছিল কে ক্ষুধার্ত। সে তার ব্যাগ খুলে রুটি বের করে সমান দু’ভাগে করে। তারপর একটি ভাগ ছেলেটির দিকে বাড়িয়ে দেয়। পাহাড়ের কিনারে দু’জন বসে পড়ে। নীরবে খাওয়া শেষ করে তারা।
দু’জনে এক সাথে চলতে থাকে। পরস্পর কথা বলতে থাকে অনর্গল। তাদের কথা যেন শেষ হওয়ার নয়। গল্পে গল্পে ছেলেটি পায়ে পাথরের গরম ছোঁয়া, সূর্যের প্রখর তাপ, কতটা পথ পেরিয়ে এসেছে এবং সামনে কতটা পথ আছে তার সব কিছুই ভুলে যায়। কিন্তু কিছুক্ষণ পর সঙ্গী গ্রাম্য ছেলেটি আরেকটি পথে অগ্রসর হয়।
সে তখন বাস্তব জগতে ফিরে আসে।
ছাগলের পাল নিয়ে ছেলেটি চলে যায়। সে আবার একা হয়ে পড়ে। পথের ওপর বা নিচের দিকে আর কাউকে দেখতে পেল না। তাদের নিজের বাড়িটি পাহাড়ের এ জায়গা থেকে চোখে পড়ে না, অন্য দিকে নদীটিও দেখা যায় না।
এ সময় একাকীত্ব ও ক্লান্তি তাকে চেপে ধরে। সাথে যদি কেউ থাকত তাহলে বোধ হয় এমনটি হতো না। একাকী হওয়ার কারণে ক্লান্তি ও নিঃসঙ্গতায় আক্রান্ত হয়ে পড়েছে সে। ঐ ছেলেটির সাথে সবটুকু রুটি খেয়ে ফেলা ঠিক হয়নি বলে তার মনে হলো। এরপর ক্ষুধা লাগলে সে কী খাবে? মনটা চিন্তায় ভারী হয়ে ওঠে।
এদিকে ফিরে যেতেও মন চাইছে না। অর্ধেকের বেশি পথ চলে এসেছে, নদীটি তাকে দেখতেই হবে। না দেখে বাড়ি ফিরবে না সে। ফিরে গেলে ব্যর্থতার এ লজ্জা সারাজীবন তাকে বয়ে বেড়াতে হবে।
বালকটি এগিয়ে যেতে থাকে।
রোদের তীব্র তাপ, ধুলাভরা পাথর ছড়ানো পথ, পর্ণ কুটির ও বিস্তৃত ধানের মাঠের কিনার দিয়ে সে চলতে থাকে। এক সময় এমন এক জায়গায় পৌঁছে, সেখানে আর কোন মাঠ বা পর্ণ কুটির কিছুই নেই আছে শুধু জঙ্গল, সূর্য ও একাকীত্ব। কোথাও জন-মানুষের কোন চিহ্ন নেই। চারদিকে গাছ, পাথর, কাঁটাঝোপ, নানা রকম ফুল আর অখণ্ড নীরবতা। তবে এ নীরবতার রূপ সম্পূর্ণ আলাদা।
কেমন যেন ভীতি জাগায়। ঘর বা রাস্তার নীরবতার মত নয় যেন মহাশূন্যের অসীম বিস্তৃতি বা অজ্ঞাত কিছু। কোথাও কোন প্রাণীর সাড়া নেই
বালকটির পায়ের নিচে ঘাস চাপা পড়ার ক্ষীণ শব্দ শুধু শোনা যায়। পাইন গাছগুলোর অনেক ওপরে ঘুরপাক খেয়ে চলেছে একটি বাজপাখি।
সামনে পথ একটি তীক্ষè বাঁক নিয়েছে।
বাঁকটি ঘুরতেই সমস্ত নীরবতা ভেঙে চারপাশ শব্দমুখর হয়ে ওঠে। নদীর কল গর্জনের শব্দ শোনা যায়। অনেক নিচে উপত্যকার ওপর দিয়ে নদীটি প্রবল বেগে ছুটে চলেছে।
নদী দেখে মুহূর্তের জন্য বালকটি সম্বিৎ হারিয়ে ফেলে। পর মুহূর্তেই দৌড়াতে শুরু করে নদীর দিকে।
পাথরে হোঁচট খেয়ে পড়ে যায়। উঠে আবারও দৌড়াতে থাকে।
হাঁটু পানিতে দাঁড়িয়ে আছে সে। আহ! অবশেষে নদীটির দেখা পেয়েছে।
মুগ্ধ বিস্ময়ে সে চেয়ে থাকে নদীর দিকে।
কী সুন্দর স্বচ্ছ পানি! কী ঠাণ্ডা! তার সারা শরীর ও মন জুড়িয়ে যেতে থাকে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।