আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সাপলুডু ২

পুরনো আমিটাই ভাল ছিলাম...

আজকে ভাবছিলাম একটা নতুন গল্প পোস্ট করব। কিন্তু ব্লগে গত দুইদিনে বেশ কিছু অসাধারণ পোস্ট পড়ে পড়ে এখন আর সাহস পাচ্ছি না। ভালও লাগছে না কেন যেন। লিখতে ইচ্ছে করছে না। তাই একটু স্মৃতিচারণ করেই না হয় সময়টা পার করি।

নিজের সাথে বোঝাপড়ার দ্বিতীয় পর্বটা না হয় সেরেই ফেলি। কেউ পড়ুক না পড়ুক আমার কিছু যায় আসে না। নিজের সাথেই কিছুক্ষণ কথা বলে যাই। নিজের সাথে কথা বলা হয় না সেওতো কম দিন হলো না। ছেলেবেলাটা সবার জন্যই অনেক মজার, অনেক উচ্ছ্বলতার।

আমারও হয়তো তাই ছিল। কিন্তু একসময় কেন জানি না নিজের জীবনের প্রতি, নিজের অতীতের প্রতি একটা অভিমান এসে ভর করেছিল। ভুলে যেতে চেয়েছিলাম অনেক কিছু। ভুলে গেছিও হয়তো। কিন্তু মাঝে মাঝে মনের গোপণ এক কোণে হঠাৎ হঠাৎ আলোর রেখা ছুটে যায়।

স্মৃতিগুলো ঘুটঘুটে অন্ধকার ঝড়ের রাতে বিজলী চমকানোর মতো সহসা উজ্জ্বল হয়ে ওঠে মাঝে মাঝে। খুব বেশি স্মৃতিকাতর হয়ে পড়ছি ইদানিং। এর একটা শেষ চাই আমি। তাই একটানে কিছু কথা লিখে ফেলি এখানে, দেখি স্মৃতিকাতরতার বেদনা কিছুটা হলেও যদি কমাতে পারি। আমার ছেলেবেলাটা কেটেছে আধা শহর আধা গ্রাম মতো একটা জায়গায়।

থানা সদর থেকে একটু বাইরে গজিয়ে ওঠা একটা মফস্বল ছিল সেটা। বাপ-দাদার ভিটা বলতে যা বোঝায় সেটা ছিল পাঁচ-ছ' কিলো দূরে একটা গ্রামে। একসময় শহর বলতে পাগল ছিলাম। কেউ শহরে যাচ্ছে দেখলেই বায়না ধরতাম ভীষণ রকম, শহরে নিয়ে যেতেই হবে। আর এখন শহরের নাগরিক কোলাহল ছেড়ে অনেক দূরে সবুজের কাছে কোথাও চলে যেতে পারলে মনে হয় অনেক কিছুই ছেড়ে দিতে পারতাম।

তাই হয়তো এত স্মৃতিকাতরতা। কেবলই শৈশবের সেই হারিয়ে যাওয়া সবুজের প্রতি দুর্বোদ্ধ এক টানে মন আকুলি বিকুলি করে ওঠে ক্ষণে ক্ষণে। খুব বেশি আগেকার কথা তাও নয়। তবুও ছেলেবেলার দেখা প্রকৃতির সেই সহজ-সরল-অদ্ভুত রূপ আর কখনো দেখব বলে মনে হয় না। খুব ছেলেবেলায় আমাদের ওখানটায় বিদ্যুত ছিল না।

বিদ্যুত পেয়েছি সম্ভবত তখন ক্লাস সিক্সে উঠেছি। তার আগের সময়টার প্রকৃতির সেই রূপ আমি কখনো ভুলতে পারব না। সন্ধ্যার পরে পরেই অনেক বাড়িতে কেরোসিনের হেরিকেন, কুপি এসব জ্বলে উঠত। বাচ্চা-কাচ্চারা সুর দিয়ে পড়াশুনা করত। তারও কিছুক্ষণ পরে পড়াশুনার পাট চুকিয়ে খাওয়া দাওয়া সেরে নানী-দাদীদের কোল আলো করে রূপকথার গল্প শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়ত তারা।

শুধু আমি অভাগা নানী-দাদীর আদর কি জিনিস বুঝি নি কখনো। তবুও তাতে খুব বেশি কষ্ট আমার নেই। অন্ধকারে জোনাকির মিটিমিটি। জোৎস্না রাতে অদ্ভুত মায়াবি চারপাশ। রূপালি আলোয় নেয়ে ওঠা আবছা সবুজ বন-বনানী কি যে অসম্ভব এক সৌন্দর্য নিয়ে হাজির হতো, বলে কখনো বোঝানো যাবে না।

এরকম জোৎস্নায় অনেক রাত পর্যন্ত প্রায়ই ঘুরতাম আমি, মা, আপু। বাড়ির পেছনটায় ছিল বেশ বড় একটা বনের মতো। অনেক ঝোপঝাড়, কিছু বুনে দেওয়া গাছ আর বেশিরভাগই বুনো গাছে ভরা ছিল সেটা। দিনের বেলাতেও কেমন একটা গা ছমছম করা ভাব কাজ করত। তবুও বাচ্চা বয়সের কৌতূহল সেই ভয়কে খু্ব কমই পাত্তা দিতে চাইতো, অজানাকে জয় করার একটা নেশা থেকেই হয়তো।

মাঝে মাঝেই বন্ধু-বান্ধবসহ অথবা একাই ঢুকে যেতাম ভেতরে। কখনো হঠাৎ কোন খসখস শব্দ পেয়ে চমকে উঠে পড়িমরি কের দৌড়ে বের হয়ে আসতাম ঊর্ধ্বশ্বাসে। একটু পড়ে আবার যেতাম। পেছনদিকটার একপাশে ছিল মসজিদ। মসজিদের পেছনে বিরাট এক বাঁশঝাড়।

তার নিচে অনেক দিনের পুরনো কিছু কবর। আর ছিল একটা ইয়া বড় কাঠবাদাম গাছ। সন্ধ্যার পরে কোথা থেকে যেন রাজ্যের যত বাঁদুড় এসে হাজির হতো গাছটাতে। বাদাম চুষে চুষে খেয়ে ফেলে দিত। মসজিদের টিনের চালে দড়াম দড়াম শব্দ করে পড়ত সেগুলো।

অনেক সময় অপ্রস্তুত মুহূর্তে চমকে উঠত অনেক বড় মানুষও। খুব মজা পেতাম মাঝে মাঝে। বাড়ির পেছনে বনটার মধ্যে বেশ কয়েকটা জায়গা ছিল দুষ্টু ছেলেদের খেলার জায়গা। আর বড়দের তাস খেলার জন্যও কিছু জায়গা নির্দিষ্ট করা ছিল। ঝোপের মধ্যে হঠাৎ পরিষ্কার করা কিছু ছোট ছোট জায়গা।

এগুলো আবিষ্কার করেছি বনের ভিতরে ঢুকে ছোট ছোট জামের মতো কি যেন একটা ফল সংগ্রহ করতে গিয়ে। তাছাড়া আরেকটা ফল ছিল আমরা বলতাম সেফটিপিন - ছোট ছোট পাকলে লাল হতো। আর ছিল বেতের ফল। নানান কিছু দিয়ে ঢেকে এগুলো লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করতাম যাতে অন্য কেউ না দেখতে পায়। পেকে গেলে পরে মজা করে খাব এই ভেবে।

কিন্তু প্রায়ই হতাশ হতে হত গিয়ে যখন দেখতাম কেউ একজন দেখে ফেলেছে আর নিয়েও গেছে। অথবা দেখিয়ে দেখিয়ে খাচ্ছে। বনের ভেতরে একটা ফলের গাছ ছিল বেশ লম্বা। আমি শুদ্ধ নাম জানি না। আমরা বলতাম কাউ গাছ।

ঢাকা শহরে একদুবার দেখেছি ফলটা। কাউ ফলের প্রতি ছিল সে এক অন্য রকম লোভ। কিন্তু ছোট মানুষ পারব কি করে? অনেক সময়ই গাছের নিচে গিয়ে শুধু তাকিয়ে থাকতাম। অথবা ঢিল ছুড়ে দুয়েকটা পেরে খাওয়ার বৃথা চেষ্টা করতাম। আর গাছের মালিকের দাবড়ানির ভয়তো ছিলই।

একটা ছিল আমরুল আর একটা জামরুল গাছ। সেই স্বাদ কেন জানি না এখন আর পাই না। অনেক দাম দিয়ে অনেক সুন্দর দেখে ফল কিনে খেলেও ছেলেবেলার মুখে লেগে থাকা স্বাদ এখনো ভুলতে পারি নি। অনেকগুলো আম গাছতো ছিলই। ছিল ঢিল ছুড়ে আম পেরে খাওয়া।

আরেকটা ছিল চালতা গাছ। এত বেশি চালতা হতে আমি আর এর পরে কোথাও দেখি নি। কতো মানুষ যে আসতো নানান জায়গা থেকে চালতা পেরে নিতে। মায়ের হাতের, আর আপুর হাতের বানানো সেই চালতা মাখানো আর চালতার আঁচার ওহ ভাবলেই জিভে জল চলে আসে। অনেক বড় একটা বড়ই গাছ ছিল আমাদের ঘরটার পাশের ঘরটার টিনের চাল জুড়ে।

একটু জোরে বাতাস বইলেই গড়গড় শব্দ করতে করতে বড়ই পড়ত মাটিতে। আর আমাদের সেকি ছুট! কার আগে কে নিবে এই প্রতিযোগিতা। আরেকটা প্রতিযোগিতা ছিল তাল কুড়ানো নিয়ে। বাড়ির পেছনটায় বনের পাশ ঘেসে ছিল দুটো তালগাছ। তালের সিজনে মাঝে মাঝে তাল পড়তো দড়াম দড়াম শব্দ করে।

বিশেষ করে সন্ধ্যার দিকে আর ভোরের দিকে। স্বাভাবিক ভাবেই ঐসময়টাতে বর্ষা থাকে আর থাকে কাদা। কে মানে কাদা আর ঠান্ডা লাগার ভয়। তাল পড়ার শব্দ মানেই লেখাপড়া, খাওয়া দাওয়া আপাতত ছুটি। আগে তালের কাছে যাওয়ার দৌড়ে প্রথম হই তার পরে দেখা যাবে অন্য কিছু।

আম কাটার জন্য ঝিনুকের খোল ঘসে ঘসে এক ধরনের অস্ত্র বানাতাম। কি সুন্দর করে আম কাটা যেত ওটা দিয়ে। এখন আর দেখি না ঐ জিনিস। ঝিনুক ঘসতে গিয়ে হাত কেটেছি কতবার। আর কাঠবাদাম কাটার সময় হাত কেটে ফেলেছিলাম একবার।

এখনও সেই দাগ আছে আমার বাম হাতের তর্জনিতে। খাওয়া মধ্যে আরও ছিল তালের শাস। দুইধরনের তালের শাস- একেবারে কচি তালের শাস আর পাকা তাল রেখে দিলে অনেকদিন পরে শেকড়, কান্ড গজাই গজাই ভাব হলে তখন যে শাসটা হয় সেটা। দুটোই অসাধারণ মজার। পাকা তালের শাস দিয়ে একধরনের মোরব্বা বানাতো মা- সে যে কি মজার হতো ওহ এখনই খেতে ইচ্ছে করছে।

বনে বনে ঘুরে বেড়িয়ে খেতাম গাব। দুধরনের গাব- একটা বুনো গাব আরেকটা বিলেতি গাব। একটা চুষে চুষে রস খাওয়া আরেকটার কেটে কেটে মাংস খাওয়া। অনেক মজার ছিল। বাড়ির পেছনে খোলা জায়গাটাতে নানা রকমের সবজি, লালশাক, পুঁইশাক, মাঁচা পেতে লাউ, চিচিঙা, করল্লা, শশা এইসব লাগানো হতো।

বেশ উৎসাহ উদ্দীপনার সাথে এসব কাজে যোগ দিতাম। মাটির থানা বানানো। পানি দিয়ে ভেজানো। গাছ লাগানো। তার পরে গাছ বড় হওয়ার জন্য অপেক্ষা করা।

প্রতিদিন অপেক্ষা করতে করতে অধৈর্য হয়ে যেতাম। পারলে একদিনেই টেনে বড় কের ফেলি এই অবস্থা। আর বড় হওয়ার পরে পাখি তাড়ানোর দায়িত্বতো ছিলই। বিরাট গুরুত্বপূর্ণ মনে হতো তখন নিজেকে। বিশেষ করে শশা খাওয়া জন্য টিয়ে, শ্যামা এইসব পাখি খুব জ্বালাতন করতো।

শামুক দিয়ে একধরনের মালা বানিয়ে ঝুলিয়ে দিতাম একটা আমড়া গাছ ছিল তার উপরে। আর সুতো বেধে তার মাথা থাকতো আমার হাতে ঘড়ের ভেতরে। মাঝে মাঝেই ঝুনঝুন ঝুনঝুন পাখি তাড়ানো হতো। কিযে মজা লাগতো তখন। আর লালশাক বা এইরকম কিছু চাষ করার আগে ছোট ছোট মাটির ঢেলা ভাঙা, মই দেয়া এসব কাজতো ছিলই।

শুপুড়ি গাছের খোল দিয়ে এক ধরনের টানা বাহন বানাতাম। একজন বা দুইজন বসে থাকতো খোলের গোড়ার দিকটায় আর আরেকজন বা দুজনে টেনে নিয়ে বেড়াতো এদিক সেদিক। কত যে মজা লাগত। আর কাঠের তক্তা দিয়ে মই বানিয়ে তাতে চড়িয়ে দেয়া হতো আমার মতো বাচ্চাদের, মাটির ঢেলা ছোট করার জন্য। মই দেয়ার কাজটা আসলেই অনেক মজার ছিল তখন।

সন্ধ্যার সময় মুরগীর খোপ পাহাড়া দেয়া ছিল আরেকটা বিরাট দায়িত্ব। অনেক মোরগ-মুরগী ছিল আমাদের। তবে যখন আরও অনেক বেশি ছিল সেই সময়টা আমার মনে নেই- অনেক বেশি ছোট ছিলাম তখন। শুনেছি ইয়া বড় বড় মোরগ ছিল। আর মা মজা করে বাজার থেকে কিনে আনা গয়না পড়িয়ে দিত মোরগগুলোর কানে, মাথার ঝুঁটিতে।

সন্ধ্যার সময় অনেকগুলা মোরগ-মুরগী গুণে গুণে ভেতরে ঢুকানো ছিল এক বিরাট কষ্টের কাজ। কেউ গাছে উঠে বসে থাকবে। কেউ হুদাই ভাব মারাতে এদিক ওদিক ঘুরবে। কেউ বাচ্চাকাচ্চা সামলাতে সামলাতে খোপে ওঠার কথা ভুলেই যাবে। আর বনের ভেতর শেয়াল মামারাতো ওৎ পেতে বসে থাকত খুব ভদ্র একখানা ভাব নিয়ে।

চোখের সামনে দেখেছি অনেক মুরগী নিয়ে বনের ভেতরে ঢুকে যাচ্ছে শেয়াল মশায়। প্রায়ই শেয়াল মারা অভিযান হতো। বড়রা লাঠিসোটা নিয়ে তাড়িয়ে বেড়াতো শেয়াল। গর্তে ঢুকে গেলে আগুন ধরিয়ে ধোঁয়া বানিয়ে বের করে আনা। কুকুর লেলিয়ে দেয়া আরো কত কি! কুকুরের সাথে শেয়ালের একটা অদ্ভুত ব্যাপার আছে।

কুকুর তাড়া করলে শেয়াল একধরনের গন্ধ ছাড়ে আর তাতে কুকুর বাবাজি দিক হারিয়ে গন্ধের চারপাশে ঘুরতে থাকে আর ততক্ষণে শেয়াল বাবাজি পগার পার হা হা হা। যাইহোক মোরগ-মুরগীর আরো একটা সমস্যা ছিল। প্রায়ই পাশের বাড়ির উঠতি মোরগ বা মুরগীর সাথে তারা ইলোপ কেইস ঘটাতো। খুঁজে খুঁজে তাদের বের করে নিয়ে আসা সে যে কি ঝামেলার কাজ ছিল তা আর বলতে। আর তারা কি সহজে আসতে চায়? একটা ছোট মোরগ পালতাম আমি ছোট থেকে।

মা-মরা মোরগ আহারে। খাওয়া দাওয়া করানো, ঘুম পাড়ানো এসব দায়িত্ব বেশ ভাল ভাবেই পালন করতাম। ঘুম পাড়াতাম হালকা হালকা গরম চুলার মধ্যে। কিন্তু আফসোসের কথা হলো একটু বড় হয়ে সে আমাকে আর চিনতেই পারল না। আরেকটা বেড়াল ছিল একসময় বিরক্ত হয়ে তাড়াতে চেষ্টা করলাম।

কিন্তু সে আর যেতে চায় না। বেশ কয়েকবার পানিতে চুবিয়েছি ওটাকে। কিন্তু ছেড়ে দিয়ে বাড়ি ফিরে আসার কিছুক্ষণ পরেই দেখতাম সে হাজির। আরেকটা ঘটনা মনে পড়ল। একটা খালাতো ভাই থাকতো আমাদের বাসায়।

একবার ঢিল ছুড়ে একটা কোকিল মেরেই ফেলল। হায় সে কি তার আফসোস। শেষে কাফন-টাফন পড়িয়ে কবর খুঁড়ে মাটি দিয়ে তারপরে খান্ত দিল। আমিতো ব্যাপক মজা পেলাম। তার কষ্টটা ঐদিন বুঝি নাই।

কিন্তু এখন বুঝি। কিছু কিছু ভাল মানুষ কেন যে শুধু কষ্টই পায় সারাজীবন জানি না। কখনো কখনো তাই বিশ্বাসের জায়গাটা নড়বড়ে হয়ে উঠতে চায়। বিদ্রোহ করতে ইচ্ছে করে। যেই ভাইটা একটা পাখি মেরে ফেলায় এত কষ্ট পেল, সেই ভাই আজ বিয়ের একযুগ পার হওয়ার পরও একবার বাবা ডাক শুনতে পারছেন না।

আমার কি যে কষ্ট লাগে মাঝে মাঝে বলে বোঝাতে পারব না। অনেক বড় হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আমি যে থামতে পারছি না। কি করব? যাক বড় হয়ে, আমিতো আমার সাথেই কথা বলছি। কেউ এ পর্যন্ত আসবে বলে মনে হয় না।

আমি বলেই চলি আরও কিছুক্ষণ। এবার খেলাধুলার কথা কিছু বলি। আধুনিক ছেলেমেয়ের মতো খেলাধুলার উপকরণ ছিল না আমাদের কিছুই। তারপরেও কত যে মজার মজার খেলা খেলতাম আমরা তার কোন শেষ নেই। যেটাকে বলে হাইড এন্ড সিক আমরা সেটাকে বলতাম কুক-পলান্তি।

লুকানোর পরে কু...ক বলে শব্দ করতো লুকানো খেলোয়ার। আর যে মগা থাকত তাকে খুঁজে বের করতে হতো লুকানোটাকে। আরেকটা গাছ বা অন্য কিছু ছিল যেটা ছুঁয়ে দিতে পারলে লুকানো খেলোয়ার মুক্ত। গাছ পাহাড়া দিবে মগা। পানিতে প্রায় একই ধরনের একটা খেলা ছিল।

আমরা বলতাম লুট-লুট। মাঝে মাঝে পানিতে হুটোপুটি করতে করতে পানির রঙ ভয়াবহ ঘোলা করে ফেলতাম আর চোখের রঙ হয়ে যেত টকটকে লাল। এর জন্য মুরুব্বীদের কত যে বকা খেয়েছি। আর মায়ের হাতের উত্তম-মধ্যম সেতো রোজকার খাওয়ার তালিকায়ই ছিল। আরেকটা খেলা ছিল বোম্বাস্টিক, টেনিস বল ছুড়ে পিঠ পোড়ানো।

গোল্লাছুট, দাঁড়িয়াবান্ধা, বৌচি, ডাঙ্গুলি, মার্বেল খেলা এগুলাতো ছিলই। আরেকটা খেলা ছিল নাম ভুলে গেছি- ক খ মাথা গুইজা ব, এরকম করে বলতাম। তার পর নাম বলতে বলতে একএক ধাপ করে এগিয়ে যাওয়া। খেজুরের বিচি দিয়ে অষ্টা-অষ্টা, ষোলগুটি, ন'পাইট, ছ'পাইট, তে'পাইট, বাঘ-বন্দী তারপরে রয়নার বিচি দিয়ে অদা-গদা এসব ইনডোর গেমসতো ছিলই। আর মেয়েলি খেলার মধ্যে কুতকুত, দাপ্পা-দাপ্পা, দড়ি-লাফ এগুলোও মাঝে মাঝে খেলতাম।

যদিও বন্ধু-বান্ধব খেপাবে এই ভয়ে খুব একটা খেলা হয় নি। অনেক খেলার নাম ভুলে গেছি আর যেগুলোর নাম বলেছি সেগুলোও মনে হয় ঠিক মতো বলতে পারি নাই বা শুদ্ধ বাংলায় কি বলে জানি না। এছাড়াও খেলার উপকরণের মধ্যে ঘুড়িতো ছিলই। শুপুড়ির খোলের গাড়ি, ছোট ছোট গাছে উঠে আসছে আমার পাগলা ঘোড়া, মাঝে মাঝে কোন কিছু ছাড়াই দুই হাত সাইকেল ধরার মতো করে পি-পি পি-পি করতে করতে দৌড়াতাম হা হা হা, ভেড়েন্ডা গাছের পাতা কেটে কেটে এক ধরনের জিনিস বানিয়ে আঙুলের মাথায় ঘুরাতাম অনেক সময় ধরেই। সুতোর মধ্যে বড় বোতাম ঢুকিয়ে সুতো পেঁচিয়ে একধরনের খেলনা বানাতাম।

এখন মাঝে মাঝে চিপসের প‌্যাকেটের সাথে দেয়- আমি নাম ভুলে গেছি। আর চিকন বাঁশ আর বাঁশের কঞ্চি দিয়ে কয়েক ধরনের খেলনা বানাতাম। একটা ছিল গুলি ফুটানোর জন্য আর আরেকটা চরকা ঘুরানোর জন্য। দু'মাথা ছিদ্র চিকন বাঁশের দু'পাশে দুটো ছোট বেতের ফল বা এইরকম কিছু ঢুকিয়ে একপাশ থেকে আরেকটা কঞ্চি দিয়ে পুশ করা ব্যাস টাস করে ছুটে যেত মাথার ফলটা- সেকি মজা। তবে চরকা বানানোটা বেশ কঠিন ছিল।

বিশেষ করে একপাশ বন্ধ চিকন বাঁশের মাঝখান বরাবর ছিদ্র করা আর সেই ছিদ্র দিয়ে সুতো ঢুকিয়ে ভেতরের কঞ্চির সাথে সুতো পড়ানো অনেক কঠিন কাজ ছিল। তবে চরকা ঘুরানোর মজার কাছে এসব কষ্ট কোন ব্যাপারই ছিল না। আর গুলতির কথাতো ভুলেই গেছি প্রায়। খুব একটা পাকা হাত ছিল না। তবুও মাঝে মাঝে চেষ্টা করতাম।

উঁইয়ের ঢিঁবি থেকে মাটি সংগ্রহ করে তা দিয়ে গুলি বানাতাম পুড়িয়ে। নিজে খুব একটা ভাল শিকারি ছিলাম না কিন্তু বড় ভাইদের পিছু পিছু গুলি হাতে ঘুরে বেড়ানো আর পাখি পড়লে তার পেছন পেছন ছোটার কাজটা অনেক উৎসাহ নিয়ে করতাম। এখন ক্লান্ত লাগছে। আর বলতে ইচ্ছে করছে না। হঠাৎ মায়ের কথা মনে পড়ছে খুব।

এমন কপাল নিয়ে জন্মেছি মায়ের সাথে খুব বেশিদিন একসাথে থাকা হয় নি, ছেলেবেলাটাই যা ছিলাম। প্রতিদিনই প্রায় মার খেতাম মায়ের হাতে। এখন খুব মিস করি সেই বকুনি আর শাসন। পথ চলতে চলতে কত সময় কত ভুল করে ফেলি। এখন আর কেউ নেই শাসন করার।

কেবলই মায়ের কথা মনে পরে যখন বুঝতে পারি ভুল করে ফেলেছি। মাঝে মাঝে খুব বেশি অপরাধী মনে হয় আবার অসহায়ও মনে হয়। কোথায় যে টেনে নিয়ে যাচ্ছি নিজেকে। মিছে মায়ার পেছনে ছুটে ছুটে ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছি দিনে দিনে। অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ এর দিকে তাকালে কেবলই অন্ধকার হয়ে আসে চারপাশ।

মায়ের কোল ছেড়ে যত দূরে সরে যাচ্ছি ততই যেন এই অন্ধকার আরও জেঁকে বসছে। মাঝে মাঝে কয়েকদিন চলে যায় মায়ের খোঁজ নিতে পারি না। কি মূল্য আছে এই অন্তহীন পথচলার। একদন্ড শান্তির জন্যইতো? সে শান্তি কি নেই শহর ছেড়ে অনেক দূরের সেই সবুজের কাছে কোথাও, মায়ের বুকের কাছে কোথাও? শুধু তথাকথিত উচ্চ-শিক্ষিত হওয়া আর ঠাঁট বজায় রাখার প্রতিযোগিতায় শামিল হতে গিয়ে নিজের শেকড়কেই ভুলে যাচ্ছি বারেবারে। ভুলে যাচ্ছি একদিন মায়ের কোলে শুয়ে জোৎস্না দেখতাম, রূপকথার গল্প শুনে বিস্ময়ে চোখ বড় বড় হয়ে থাকত আবার হঠাৎ আনমনে হেসে উঠতাম।

আর এখন দু'চোখ জুড়ে শুধুই ঘোরলাগা অনব' চোরাবালি।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।