পুরনো আমিটাই ভাল ছিলাম...
১
লেখার প্রতি টান-টা দিনে দিনে বেড়ে যাচ্ছে। জানি না কেন, হয়তো ব্লগে আসার পর থেকেই। কিছু মানুষের উৎসাহ আর কিছু জেদ দুইয়ে মিলে শেষ পর্যন্ত যদি লেখক হয়ে ওঠা যায় তাতে আমার খুব একটা আপত্তি নেই। শিক্ষানবীশ কালটা আর কতদিন স্থায়ী হবে জানি না। তবে এই কয়দিনে একটা উপলব্ধি হয়েছে- লেখাটা আরও অনেক ধীরে শুরু করতে হবে যতটা ভেবেছিলাম তার চেয়েও।
তাড়াহুড়া করে পোস্টের সংখ্যা হয়তো বাড়ানো যাবে কিন্তু সত্যিকার অর্থে আমার যেটা চাওয়া তা হয়তো হয়ে উঠবে না ওভাবে। আমি শিখতে চাই, প্রতিনিয়তই শিখতে চাই। শিখছিও অনেক কিছু প্রতিদিন। অনেকের কথা মনে ধরে যাচ্ছে। চেষ্টা করি মন্তব্যেও যেন নতুন কিছু বের হয়; হয়েছেও অনেক কিছু, শিখতে চাই বলেই হয়তো।
একজনের একটা কথা মনে পড়ছে- মন্তব্যগুলো নাকি মূল গল্পের মধ্যে আরো অনেকগুলো গল্প। এখন আমারও তাই মনে হয়। কারণ মন্তব্যগুলো থেকে প্রতিনিয়ত নতুন কিছু ধারণা নতুন কিছু উপলব্ধি হচ্ছে। এই যেমন এই লেখাটা লিখছি - এটাও কিন্তু একটা মন্তব্যের ফলশ্রুতি। একজন বলেছেন- নিজেকে ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে মুগ্ধ করে ফেলুন সবাইকে।
খুব ভাল লেগেছে কথাটা। সবাইকে মুগ্ধ করা, সেটা হয়তো আর কখনোই হয়ে উঠবে না। কিন্তু নিজেকে ভাঙ্গতে আমার কোন আপত্তি নেই। নিজের প্রতি অধিকারটা মনে হয় নিজেরই সবচেয়ে বেশি বা হয়তো পুরো অধিকার দিয়ে দেয়ার মতো কাউকে খুঁজে পাই নি এখনো। তাই নিজেই নিজেকে ভেঙ্গে ভেঙ্গে গড়ার চেষ্টা করছি অনেকদিন থেকেই।
আর এখন সেই ভাঙ্গা-গড়াটা শুরু করতে চাই লেখালেখি দিয়ে। একটা কথা আমি বিশ্বাস করি- প্রত্যাশার চাপ সৃজনশীলতাকে পঙ্গু করে দেয়। তাই নিজের জন্যই নিজেকে ছাড়িয়ে যেতে চাই প্রতিনিয়ত একটু একটু করে।
২
ব্লগে অনেক সীমাবদ্ধতা আছে। লেখা বেশি বড় হয়ে গেলে পাঠক বিরক্ত হয়।
না পড়েই হয়তো অনেকে মন্তব্য করে। কম কথায় একটা পূর্ণাঙ্গ কিছু দাঁড় করানোর মতো অবস্থা এখনও আমার হয় নি। তাই হয়তো কবিতা লেখা হয়ে উঠবে না কখনো। আমি চাই আমার মতো করে লিখতে। আমার অনুভূতিগুলো বুনে দিতে চাই প্রতিটা শব্দের সাথে, প্রতিটা বাক্যের সাথে।
সবকিছু মিলিয়ে একটা অর্থপূর্ণ কিছু যদি দাঁড় করাতে পারি তখনই কেবল আমার তৃপ্তি। সবাই কোন না কোন কষ্ট বুকে চেপে ঘুরে বেড়ায়। ব্লগে এসে তাই হয়তো অনেকেই মজার কিছু, হাসির কিছু, খেয়ালি কিছু খোঁজে। এইখানেও আমার সমস্যা। কেন জানি না লিখতে গিয়ে দুঃখ দুঃখ একটা ভাব নিজের অজান্তেই চলে আসতে চায় সবসময়।
খুব ভাল করে জানি মানুষকে খুশি করা বা হাসানো অনেক কঠিন কাজগুলোর একটি। তার চেয়ে অনেক বেশি সহজ মানুষকে কাঁদানো, মানুষের মন খারাপ করে দেয়া। কমেডি লেখা হয়তো তাই কখনোই আমাকে দিয়ে হবে না। তাই সহজ কাজটাই আপাতত করে দেখি। তাও আদৌ পারব কি না তাতেও আমার সন্দেহ আছে।
আর এর বাইরে বড়জোর খেয়ালি কিছু হতে পারে। খেয়ালিপনা ভাল লাগে। নাগরিক ব্যস্ততার ভীরে উদাসীন পথিকের খেয়ালিপনা এসে ভর করে প্রায়ই। হঠাৎ এরকম কোন এক ক্ষণে কোন এক খেয়ালি সৃষ্টি হয়তো পথ খুঁজে নেবে তার মতো করে।
৩
কিছু কিছু পরিবর্তন লক্ষ্য করছি ইদানিং।
আগে লিখতে গিয়ে বসে থাকতে হতো। শব্দগুলো কেমন আড়ষ্ট হয়ে থাকত। পাশাপাশি বসতে রাজ্যের যত লজ্জা এসে ভীর করত ওদের মনে। বাক্যগুলো অপূর্ণই থেকে যেত যথারীতি। তাই মাঝে মাঝে জোর করে চ্যাঙদোলা করে ধরে নিয়ে আসতে হতো।
জোর করে শব্দগুলো সাজানোয় যা হবার তাই হতো। ওদের চোখে-মুখের অস্বঃস্তি পুরো লেখার পরিবেশটাকেই অসহায় অপ্রস্তুত করে তুলতো প্রায়ই। আর এখন প্রথম প্রেমের লজ্জাটুকু ভেঙ্গে যাওয়ার মতো শব্দগুলো কাছে আসে, পাশাপাশি বসে, হাতে হাত চোখে চোখ রাখে, হেসে কুটিকুটি হয় কখনো কখনো। চাইলেই সার সার দাঁড়িয়ে যেতে খুব একটা আপত্তি করে না। সমস্যা হচ্ছে অতটা রুচিশীল কিছু এখনো হয়ে উঠছে না।
তবুও হাল ছেড়ে দেব না ভাবছি। দেখি একটু খেলা করে - শব্দের সাথে খেলা - বাক্যের সাথে খেলা - অনুভূতির সাথে খেলা। আমি চাই লেখাগুলো জীবন্ত হয়ে উঠুক। বাক্যগুলো একটা একটা ছবির মত জমা হয়ে যাক আমার স্মৃতিবাড়িতে। চোখ বুঝলেই যেন স্থিরচিত্র হয়ে ভেসে ওঠে তারা।
কবে পারব জানি না। আদৌ পারব কিনা তাও জানি না। পারব হয়তো একদিন।
৪
নিজেকে নিয়ে, নিজের স্মৃতি নিয়ে বড্ড অনীহা ছিল আমার এই কয়েকদিন আগেও। কিন্তু ইদানিং খুব বেশি স্মৃতিকাতর হয়ে পড়ছি কেন জানি না।
ধুলোপড়া স্মৃতিগুলো হঠাৎ ঝড়ো হাওয়ায় আকুলি বিকুলি করে উঠছে যেন। বুকের ভেতরে অনেক দূর থেকে ভেসে আসে রাখালি বাঁশির সুর। সেই ছেলেবেলায় ছুটে যেতে ইচ্ছে করে বারবার। কত যে সখ ছিল বাঁশি শেখার। হয় নি আজও।
আর হয়তো হবেই না। তবুও যদি পারি শব্দের ঢেউয়ে ঢেউয়ে সুর তুলতে, দূর দূর অজানা থেকে ভেসে আসা কোন এক মন-কেমন-করে-দেয়া বাঁশির সুর; কিছুটা হয়তো পূর্ণতা পাবে ইচ্ছেটা। সবার হয় কিনা জানি না, আমার হয় একটা জিনিস, ছোট বেলা থেকেই হচ্ছে; কিছু কিছু কথা, কিছু কিছু গল্প, কিছু কিছু দৃশ্য স্মৃতির আধারে স্থিরচিত্রের মতো জমে আছে। চোখ বুজলেই দেখতে পারি একদম জীবন্ত। এমনকি সেই ধারাপাতের বড় বড় অক্ষরের বইটাও চোখে ভাসে যখন ছোট-খাট যোগ-বিয়োগ করতে যাই।
কোন কোন বিষয় কেন যে জমা হয়ে আছে বুঝতে পারি না। তবুও কোন এক অপ্রস্তুত মুহূর্তে হঠাৎ স্থিরচিত্র ভেসে ওঠে ভেতরের চোখের পর্দায়। কত বন্ধু, কত মানুষ যে আপন ভেবে কত গল্প বলেছে আমার কাছে তার কোন হিসেব নেই। হয়তো ভালবাসতো বলেই। কিন্তু অনেক কিছুই তার ভুলে গেছি, ভুলে যেতাম।
পরে কোন এক সময়ে জিজ্ঞেস করলে মনে করতে না পেরে হঠাৎ অপ্রস্তুত হতাম। কয়েকদিন আগেও ভাবতাম ভুলে গিয়েই হয়তো ভাল হয়েছে। হৃদয় খুড়ে কষ্ট তুলে আনতে কার ভাল লাগে?* কিন্তু ইদানিং মনে হচ্ছে- ভুলে না গেলে অনেক অনেক গল্প হয়ে যেত আজ এখানে। অনেক গল্পই হয়তো আর বলা হবে না। তবুও খুব ভেতর থেকে একটা কোরাস শোনা যায়- আসছি, আমরা আসছি।
হ্যাঁ ফিরে আসছে অনেক কিছু আবার। বিশেষ করে ছেলেবালার যেই স্মৃতিগুলো একেবারে ভুলে যেতে বসেছিলাম তারা এখন রোজ এসে কড়া নেড়ে যায় স্মৃতিবাড়ির দরজায়। ধুলো-বালি ঝেড়ে ছাপছুতর হয়ে কেমন সোনালী সোনালী হয়ে উঠছে দিনে দিনে। অনেক বেশি মায়া মায়া লাগে। কাজ করতে করতে হঠাৎ আনমনে হারিয়ে যাই সেই অসম্ভব সুন্দর সময়গুলোতে।
চোখ বুজে ঘুরে বেড়াতে তো আর টাইম-মেশিন লাগে না। তাই পোড় খাওয়া মন হাসপাশ জীবনের বাঁধন ছিঁড়ে উড়ে বেড়ায় সময়ের পরতে পরতে, এ-ডাল থেকে ও-ডালে, পাতায়-পাতায়, শিরায়, উপশিরায়। কখনো নদী হয়ে ছোটে, অনুভূতির নদী, জীবন যেখানে সত্য, যেইখানে বয়ে চলে ধলেশ্বরী। * নদীর বুকে নীল নীল আকাশ, পেঁজা পেঁজা আদর আদর মেঘেদের প্রতিচ্ছবি। অভিমানী প্রেমিকার চোখে জমে ওঠা টলটল জল।
ছলাৎ ছলাৎ নৃত্য।
৫
শুধু একটা সমস্যা হয়ে যাচ্ছে। খুব বেশি স্মৃতিকাতর হতে হতে সুতো গেছে ছিঁড়ে। ঘুড়ি হয়ে উড়ে গেছে মন। আমি বসে থাকি একা নিঃসঙ্গ নাটাইখানা হাতে।
ঘুড়ি উড়তে.. উড়তে.. উড়তে... কখনো খুব ছেলেবেলায় ঝড়ের পরে আম-কুড়ানোদের দলে। কখনো একটু বড়বেলায় সবুজ স্কুল মাঠের আকাশে উড়ে বেড়ানো অন্য ঘুড়িদের সাথে। কখনো আরেকটু বড়বেলায় উপশহরের পা ছুঁয়ে চলা নদীটার একটা নির্জন ঘাটে। কখনো বড়বেলায় কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া, জারুল, বকুল, সোনালু, শিউলী, মহুয়ার মায়ায় জড়িয়ে থাকা একটা স্বর্গখন্ড, কয়েকটা লাল-বেগুণী গালিচার মতো পথে। কখনো একচোখা দৈত্যের দেশে।
কখনো এ্যাকিলিসের ডেরায়। কখনো হেক্টরের আকাশে উড়ে বেড়ানো ঈগলের সাথে। কখনো জ্বলতে থাকা ট্রয় নগরীর ছাঁই-ভস্ম-অন্ধকারে। কখনো ইডিপাসের দেশে স্ফিংক্স এর ডানায়। কখনো মারমেইড, সি নিম্ফের দেশে।
কখনো অসহায় লিডার আর্তচিৎকারময় বাতাসে। কখনো নির্ঘুম লেডি ম্যাকবেথের জানালার পাশে। কখনো কিউপিডের প্রাসাদে সাইকির নিরালা ঘরে। কখনো সাগর সৈকতে মায়াময় মারবেল-মানবী এ্যান্ড্রমিডার সৌন্দর্য্যে মুগ্ধ বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকা পারসিউসের আনমনে থেমে যাওয়া পাখার পাশে। কখনো জলসিঁড়ি, জলঙ্গি, ধলেশ্বরী নদীতীরে।
কখনো হরিপদ কেরানির ধ্বসে যাওয়া দেয়ালের স্যাঁতস্যাঁতে ঘরে। আবার কখনো নদীর ওপারে মাঠের মাঝখানে বুড়ো নিঃসঙ্গ গাছটার ডালে। আরও কতো জায়গায় যে উড়ে উড়ে ছুটে যায় ঘুড়ি তার কোন শেষ নেই। আমি ক্লান্ত হয়ে যাই একসময়। গুছিয়ে উঠতে পারি না কিছুই।
অনেকগুলি স্থিরচিত্র ভাসতে থাকে চোখের সামনে। আমি অসহায়ের মতো তাকিয়ে থাকি। সাজাতে পারি না তাদের একটার পরে একটা।
=================================================
লেখাটা আমার এক বড় ভাইয়ের জন্য। বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার রুমমেট ছিলেন।
আমার জীবনে যার যার কাছ থেকে যা কিছু শিখেছি তার প্রায় সবগুলোই বলে দিতে পারব। কিন্তু ওনার কাছ থেকে যা শিখেছি তার কোন হিসেব আমার কাছে নেই, রাখতেও চাই না। আমাকে সবচেয়ে বেশি অনুপ্রেরণা আর উৎসাহ দিয়ে থাকেন এই মানুষটা। যতবার কথা হয় তিনি বলবেন- অনেক ভাল ..... হতে হবে কিন্তু! এই একটা কথা আমার কত যে ভাল লাগে তিনি হয়তো কখনো জানবেন না। আমি একটা হাঁদারাম! মানুষের ভালবাসাই পেয়ে গেলাম, কিছুই দিতে পারি নি বিনিময়ে।
মাত্র দুইদিন আগেই তিনি বাবা হয়েছেন। অনেক অনেক আদর গুসিগুসি জুনিয়র বাবুটার জন্য। যে আলো নিয়ে এলে। লুকিয়ে রেখনা যেন। ছড়িয়ে দিও মানুষের মাঝে।
জানি না বাবা হওয়ার অনুভূতি কি রকম। কিভাবে জানব? বেঁচে থাকলে আর সব প্লান ঠিক থাকলে আরও পাঁচ-ছ' বছর অপেক্ষা করতে হবে হয়তো। কিন্তু চারপাশে যা দেখছি তাতে তার-আগের ধাপগুলো পার হওয়ার কথা ভাবতে সাহস পাই না। ইদানিং মাথার ভেতর গ্লুকোজের স্বল্পতা টের পাচ্ছি প্রায়ই...!
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।