নুতন পুরাতন সব লেখাতেই আপনার মন্তব্য প্রত্যাশিত।
গত পোস্টের শেষ দিকের অংশ বিশেষ উল্লেখ করে এই পর্বে কথা শুরু করি। কারন এরই ধারাবাহিকতায় আজকে সামনে আগানোর ইচ্ছা আছে। গত পর্বের আলোচনার প্রায় শেষাংশ ছিল-
“ঝড় হলে পাতা নড়ে, না পাতা নড়লে ঝড় হয় এই তফাৎটা আমাদের বুঝতে হবে। শিল্পোন্নত বিশ্বে বিশ্ববিদ্যালয় শুধু নেচারের কজ (কারণ) আর এফেক্ট (ফলাফল) নিয়ে অবিরাম গবেষনা করে চলে বা এটা নিত্য নুতন জ্ঞানের খোঁজে সদা মরিয়া এক মহাপ্রতিষ্ঠান, ব্যাপারটা কিন্তু মোটেও এরকম আদর্শিক নয়।
বরং, ইন্ডাস্ট্রীর মুনাফার জন্য, তার নিরাপত্তার জন্যে আবশ্যকীয় যে জনবল ও গবেষনা সেটা সম্পাদনই এযুগে তার প্রাথমিক লক্ষ্য। এই লক্ষ্যেই তার প্রতিষ্ঠা , তার এগিয়ে আসা, তার কর্মযজ্ঞ। ইন্ডাস্ট্রীর অর্থেই সে প্রত্যক্ষ বা পরক্ষভাবে পরিপুষ্ট। আর তাই বিশ্ববিদ্যালয় কেন গবেষনা করেনা, কেন তারা এটা ওটা বানিয়ে বিশ্বকে তাক লাগায়ে দেয়না এই চিন্তাটাই অপরিপক্ক, আদ্যিকালের চিন্তা। কেন? কারণটা আগেই বলেছি, ঝড় হলে পাতা নড়ে, পাতা নড়লে ঝড় হয়না।
আধুনিক গবেষনার উদ্যোক্তা বিশ্ববিদ্যালয় নয়, এটা তার সামর্থের বা মুরোদের মধ্যেই নাই, এর উদ্যোক্তা লগ্নী পুঁজির মহাকারবারীরা। তাই সুনির্দিষ্ট কি নিয়ে গবেষনা হবে,সমস্যার কোন জায়গাটা খোঁড়াখুঁড়ি করতে হবে, গবেষনার টোটাল ম্যান-আওয়ার কত হবে, গবেষনার ফলাফল প্যাটেন্ট আকারে আসবে না পেপার হিসাবে পাব্লিশ হবে, প্যাটেন্ট হলে কোন মহাদেশে কত বৎসরের জন্য প্যাটেন্ট হবে তার পুঙ্খানুপুঙ্খ মাস্টারপ্লান ,অর্থ, আনুষাঙ্গিক সাপোর্ট আসে কর্পোরেশন বা ইন্ডাস্ট্রী থেকে। ”
তার মানে যেটা দাঁড়াচ্ছে যেখানে কর্পোরেশন নাই, ইন্ডাস্ট্রী নাই ,বুদ্ধি বৃত্তিক শিল্পে পুঁজির বিনিয়োগ নাই সেখানে রিসার্চ নাই, থাকার কথা না। আদর্শ বিশ্ববিদ্যালয়ের যে চিত্র আমাদের মনে আঁকা সেরকম একশতটি বিশ্ববিদ্যালয় থাকলেও নয়। পশ্চিমে রিসার্চ করে ইন্ডাস্ট্রী, তাদের RND সেকশন।
গবেষনা কাজের একটা অংশ সংঘটিত হয় বিশ্ববিদ্যালয়কে নিয়ে, প্রজেক্ট আকারে। এক ম্যান-ইয়ার থেকে শুরু করে একাধিক ম্যান-ইয়ারের প্রজেক্ট হতে পারে । উদাহরণ হিসাবে বলা যায় এরকম এক ৮ ম্যান-ইয়ার প্রজেক্টে ২ থেকে ৩ জন ছাত্রকে বিশ্ববিদ্যালয় ৪ বছর রিসার্চ করায়ে পি এইচ ডি দিতে পারে। এক ম্যান ইয়ার প্রজেক্টে বিনিয়োগকৃত মিনিমাম ক্যাপিটাল হতে পারে আনুমানিক ১২৫ K(হাজার) USD। আরও অনেক কথা বলা যেত, পাঠক চাইলে সেটা পরে কমেন্টে বা আলোচনায় আসতে পারে।
তবে এই হোল আধুনিক গবেষনা বা রিসার্চের মূল কথা, মূল স্রোতের সারমর্ম। এর সাথে বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিক কিছু ক্ষীণ ধারাও আছে, তবে সেটা শেষ পর্যন্ত ধর্তব্যের মধ্যে পড়েনা।
বাংলাদেশে কেন রিসার্চ হয়না এই উত্তরটা পাঠকের কাছে এতক্ষনে নিশ্চয় পরিস্কার। যে দেশে ইন্ডাস্ট্রী বলতে বোঝায় বড়জোর গার্মেন্টস, আরও পরিস্কার করে বললে ঢাকা কেন্দ্রিক বহুতল ভবনে স্থাপিত দর্জির দোকান, সেদেশে রিসার্চ কথাটা স্রেফ একটা তামাশা। তাই গবেষনার কথা উঠলেই আমাদের সনাতন যে চিন্তা বাইডিফল্ট বিশ্ববিদ্যালয় চত্ত্বরে গিয়ে আছড়ে পড়ে এবং সেখানে আঁতিপাতি করে সমাধান খুঁজতে থাকে, সেই চিন্তার মধ্যেই আছে শতভাগ গলদ।
যতদিননা পর্যন্ত কোন অঞ্চলে সেই পর্যায়ের বুদ্ধিবৃত্তিক শিল্প প্রতিষ্ঠিত হবে অথবা সেখানে মূল ধারার স্বাধীন বুর্জোয়া শ্রেণীর উত্থান ঘটবে যারা ভারী শিল্প-কারখানা প্রতিষ্ঠা করে ভোগ্যপন্যে তৈরী আর তার উৎকর্ষ সাধনের প্রতিযোগীতায় মরণপণ লড়ায়ে অবতীর্ণ হবে ততদিন পর্যন্ত সেখানে গবেষনার প্রয়োজনীয়তা থাকবেনা। আর প্রয়োজনীয়তা না থাকলে, গবেষনা হবেনা। শুধু জ্ঞানের জন্য জ্ঞান এটা একটা বাকওয়াস। কারন আজকের গবেষনা মানেই ভোগ্যপণ্য তৈরী আর তার উৎকর্ষ সাধনের গবেষনা। লগ্নী পুঁজির নিরাপত্তা প্রদানের গবেষনা।
এই গবেষনা চালাবার কোনো তাড়না যেমন বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুভব করার কথা নয় তেমনি মূল যে কথা, এটা চালাবার মতো মুরোদও তার থাকার কথা নয়।
সুতায় যখন জট লাগে তখন প্রান্তদুটা ধরতে পারাটাই জট খোলার প্রাথমিক শর্ত। এদিক ওদিক টান লাগালে ঘটনাটা আরও জটিল থেকে জটিলতর হয়, এটা বোঝা দরকার। না বুঝতে চাইলে তর্ক চিরন্তন গোলক ধাঁধার মধ্যে চক্কর খেতে থাকবে, যেমন আজ খাচ্ছে। কখনো আঙ্গুল উঠবে শিক্ষকের যোগ্যতার দিকে, কখনো তার স্বল্প বেতনের দিকে, কখনো নীতি নৈতিকতার দিকে, কখনো রিসার্চের জন্য সরকারী অর্থের অপ্রতুলতার দিকে, কেউ অভাব বোধ করবে চিপ ফ্যাব্রিকেশনের মতো আধুনিক গবেষনাগারের, কেউ মাল্টিমিডিয়া সমৃদ্ধ ক্লাস রুমের আবার কেউবা ক্লাস রুমে এসি সহ ভার্সিটি আঙ্গিনায় বড়সড় গাড়ি পার্কিং স্পেসেরও।
এরই মাঝে কেউ কেউ মওকা মতো কচিশিশুদের গবেষনামুখী সুপ্ত চেতনা উজ্জীবিত করতে জেলায় জেলায় পদধুলি রেখে দেশের তাবৎ মিডিয়া জগৎ কাঁপায়ে দিবে। কোন সরকার হয়ত বিশ্বব্যাঙ্কের চিকিৎসাপত্রের আলোকে শিক্ষকদের মোটাতাজা একটি আলাদা বেতন স্কেল ঘোষনা দিয়ে সমস্যার সমাধান খুঁজবে, কোন সরকার এসে গবেষনার জন্য কিছুদিন মোটাসোটা অর্থের প্রজেক্ট বরাদ্দ শুরু করবে। কিন্তু কি নিয়ে হবে এই গবেষনা? আছে কোন প্রায়োরাটাইজড লিস্ট বা হোম ওয়ার্ক? সমস্যার কোন জায়গাটা নিয়ে খোঁড়াখুঁড়ি হবে? কোথায় হবে এর ফলাফলের ব্যবহার? কয়দিন চলবে এভাবে? টাকাটা নিশ্চয় ছাপাইয়া বিতরণ হইবেনা। কাজের কাজ যেটা হবে কয়েকমাস ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে আর মিডিয়াতে একটা গবেষনা অনুকুল ধুন্দুমার কান্ড চলবে। রাত সাড়ে এগারোটার পরে টিভি চ্যানেলে দিশী বিজ্ঞানীদের বিদিশী অভিজ্ঞতার বয়ান হবে।
মানে আমি যখন ওখানে ছিলাম তখন... ... ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু এটা নিশ্চিত, ফুলফল তো অনেক দূরের কথা, শেষ অবধি সেই গবেষনার গাছে একটা কচি পাতাও ধরবেনা। আসলে তলাটা চরার যে জায়গায় আটকে গেছে সেখানে হাত লাগায়ে নৌকায় ধাক্কা না দিতে পারলে এদিক ওদিক শত জোরাজুরীতেও ওটা নড়বেনা। নদী প্রধান গ্রামাঞ্চলে যারা বড় হয়েছেন তারা এটা ভাল বুঝবেন। যে বাউন্ডারির মধ্যে কোন গানিতিক সমস্যার সমাধান নাই, নিঃরন্তর সেই বাউন্ডারির মধ্যে সমাধান খুঁজে কি হবে ।
সোজা কথায় আংটি যদি আমার পুকুরঘাটে হারায় তবে তাল গাছে খুঁজতে উঠে লাভটা কি। যাহোক উপরের কোনটাই যে মূল বাধা নয় সেটা গত ৪ পর্বে এক এক করে আমরা মূল পোস্ট ও সংশ্লিষ্ট কমেণ্টে উলটে পালটে দেখেছি।
প্রথম পর্বে যখন আলোচনা শুরু করি তখন যে বুঝটা নিয়ে আমাদের যাত্রা শুরু হয় সেটা ছিল এরকম -“কোন বিষয়ই সমসাময়িক ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের বাইরে নয়, আলোচ্য বিষয়বস্তুতো নয়ই। তারপরেও উদ্দেশ্য থাকবে তৃতীয় বিশ্বের প্রচলিত দলীয় অস্থিরতার (রাজনৈতিক বলা হয়তো ভুল হবে) বাইরে গিয়ে আর কোন কোন মূল বিষয় আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় গুলিকে উল্লিখিত বিশ্বমানের আবিষ্কার বা মৌলিক চিন্তা থেকে দূরে ঠেলে রাখছে সেটা অনুধাবনের প্রচেষ্টা। ” সেখানে একটা ধারণা হয়তো মনের অজান্তে কোথাও ঘাপটি মেরে ছিল যে এই সমস্যার সমাধান বিশ্ববিদ্যালয় ডোমেইন এর মধ্যে সম্ভবত কোথাও লুকিয়ে আছে।
কিন্তু এই চিন্তাটা সমাজে আর দশটা রেডিমেড চিন্তার মত যে অপরিচ্ছন্ন আর ধোঁয়াটে চিন্তা সেটা এখন পরিস্কার। তাই বিশ্ববিদ্যালয়কে শতভাগ কার্যকরী প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেও আলোচ্য সমস্যা থেকে উত্তরণ সম্ভব না। কেন সম্ভব নয় সেটা কিস্তি-১ থেকে ৪ এ আলোচনার চেষ্টা করেছি। বিশ্ববিদ্যালয় ডোমেইনে আমাদের এই সমস্যার সমাধান নাই, যেমন বিশ্বের কোথাও নাই। তাই দৃষ্টি ফিরাতে হবে অন্য জায়গায়, নৌকার যে জায়গা চরায় আটকে আছে সেখানে।
সেই জায়গাটাও গত কিস্তি-৪ এ চিহ্নিত করার চেষ্টা হয়েছে। আর তাই “আধুনিক গবেষনায় সায়েন্স বা টেকনিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় গুলির দীর্ঘ ব্যর্থতা, মূল কারনটা কোথায়?” এই আলোচ্য ইস্যুটা ট্রান্সলেট হয়ে যেটা হবে সেটা হচ্ছে -“এই অঞ্চলে বুদ্ধিবৃত্তিক বা আধুনিক ভারীশিল্প কারখানা প্রতিষ্ঠা বা স্বাধীন বুর্জোয়া শ্রেনীর উত্থানের দীর্ঘ ব্যার্থতা। মূল কারনটা কোথায়?”। ৫ পর্বের দীর্ঘ আলোচনার এখানে একটা তবে ইতি টানা যাক। বাকিটুকু কমেন্টে আলোচনা হতে পারে।
সকলকে ধন্যবাদ।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।