আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

চিত্রনায়িকা কেয়া অথবা, এক বোতল খাঁটি সরিষা তেলের গল্প

একজন নির্বোধের বয়ান মানিক জলিল ভাইকে বলল, আষাঢ় মাইসে গল্প বলার আর জায়গা পাচ্ছো না? ওই মানিক তোরে আমার কতা বিশ্বাস করতি কেডা বলিছে? বিশ্বাস না করলি পরে চইলে যা, বইসে রইছিস ক্যান? মেজাজ খারাপ করে জলিল ভাই বললেন। সাথে সাথে মানিক লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল। চোখের পলক না ফেলে জলিল ভাইয়ের চোখের দিকে তাকিয়ে রইল মিনিট খানেক। শেষে জলিল ভাইয়ের দিকে মেয়ে মানুষের মতো একটা ভেংচি কাটল। আর কোনো কথা না বলে জোর পায়ে স্থান ত্যাগ করল আমার বাল্যবন্ধু মানিক।

প্রতিবার ঢাকা থেকে ফিরে জলিল ভাই আমাদের সাথে ঢাকার গল্প বলেন। বরাবরই আমি মনোযোগ দিয়ে তার কথা শুনি। কিন্তু মানিক জলিল ভাইয়ের কথার ভেতর একটা না একটা প্রশ্ন করবেই। আজও মানিক জলিল ভাইয়ের সব কথা চাপাবজি বলে উড়িয়ে দিল। এতোক্ষণ আমি চুপ করেই ছিলাম।

জলিল ভাইয়ের কথা আমি অন্তত অবিশ্বাস করি না। আমাদের গ্রামের সবচেয়ে সুদর্শন হলেন এই জলিল ভাই। ঠিক যেন সিনেমার নায়ক। জলিল ভাইয়ের নিয়মিত ঢাকায় যাতায়াত। কিছুদিন পর পর গ্রামে ফিরে আসেন সুন্দরী নায়িকাদের সাথে তোলা ছবি নিয়ে।

আমাদের সেইসব ছবি দেখান, আর গরগর করে বলে যান এটা অমুক নায়িকা, ওটা তমুক। সুতরাং তার কোনো কথা অবিশ্বাস করার মধ্যে আমি নেই। সুন্দরী নায়িকাদের সাথে তো আর যে সে গিয়ে ছবি তুলতে পারে না! আজ ছবি দেখানোর পাশাপাশি একটি ঘটনা বললেন, যা শুনে মানিক আষাঢ়ে গল্প বলে চিৎকার করে উঠেছে। কিন্তু আমার তা মনে হচ্ছে না। জলিল ভাইয়ের মুখে ঘটনাটি শুনে অবিশ্বাস করার মতো কোনো কিছু খুঁজে পেলাম না।

চোখ বন্ধ করে যেন নিজেই দেখতে পেলাম, জলিল ভাই যা বলেছেন তা অতি সত্যি কথা। চোখের সামনেই ভেসে উঠল ছবির মতো করে। জলিল ভাইয়ের জায়গায় নিজেকে কল্পনা করতে লাগলাম। জলিল ভাইয়ের ভাগ্য দেখে হিংসায় জ্বলে পুড়ে মরতে ইচ্ছে হলো। এই প্রথম জলিল ভাই হতে না পারার জন্য আফসোস হচ্ছে।

এখন যদি মানিক আমার আফসোসের কথা জানতে পারত, তাহলে কি পচানটা না পচাত মানিক! বাংলা সিনেমার নায়িকা কেয়ার সাথে নাকি জলিল ভাইয়ের ভাব-ভালোবাসা চলছে। লাজ-শরমের মাথা খেয়ে জলিল ভাইয়ের কাছে ইনিয়ে বিনিয়ে নায়িকা কেয়ার ছবিটা চাইলাম, জলিল ভাই, আপনাদের দু’জনকে পাশাপাশি খুবই মানিয়েছে। যদি আমাকে এই ছবিটি দিতেন। আপনাদের দু’জনের একটা স্মৃতি হিসেবে আমার কাছে রেখে দিতাম আর কি!’ কথা শুনে জলিল ভাই আমার পিঠে ঠাস করে এক চড় বসিয়ে দিয়ে বললেন, আরে ওই রফিক, আমার কাছে তোরা এতো লজ্জা পাচ্ছিস ক্যান? সামান্য একটা ফটো নিবি! এতো চিন্তার কি আছে? নে নে ছবিডা তোর কাছে রাইখে দে। উদার জলিল ভাই কেয়ার ছবিটি আমাকে দিয়ে দিলেন।

২। আষাঢ় মাস। সন্ধ্যার পর থেকে গুড়িগুড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। ডিজিটাল যুগের কারেন্ট আসে আর যায়। বৃষ্টির কারণে কারেন্ট ভয়ে পালিয়েছে আরো আগেই।

কখন আসে কে জানে। পড়ার টেবিলে হারিকেনের আলোয় নায়িকা কেয়ার মুখখানি দেখে মনই ভরছে না যেনো। দিনের আলোয় ভালো করে দেখা যেতো। আগামী কালকের সূর্যের মুখ দেখা যাবে কিনা তারও ঠিক নেই। তবু সুর্য দেখার আশা নিয়ে ঘুমাতে গেলাম।

সকালে ঘুম থেকে উঠতে বরাবরই আমার দেরি হয়। আজ একটু বেলা করেই ঘুম ভাঙ্গল। যথারীতি সুর্যমামার দেখা নেই। পুকুর ঘাটে জলিল ভাইয়ের সাথে দেখা। আমাকে দেখেই বললেন, রফিক আমি তো বিকেলেই ঢাকা চইলে যাচ্ছি, তুই যাবি নাকি? ঢাকায় একদিন থাইকে পরের দিন চইলে আসপো।

ঢাকায় তো আমার যাওয়ার অনেক ইচ্ছে, কিন্তু আম্মা অনুমতি না দিলে যেতে পারবো না জলিল ভাই। নতুন একটা সিনেমায় অভিনয়ের ব্যাপারে কথা বলতে যাবেন জলিল ভাই। এফডিসি দেখার লোভ সামলাতে না পেরে একবাক্যে রাজি হয়ে গেলাম আম্মার অনুমতি না নিয়েই। আম্মাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে জলিল ভাইয়ের সাথে সন্ধ্যায় বাসে উঠলাম। ৩।

পরের দিন দুপুর নাগাদ ঢাকায় পৌঁছলাম। বাবারে বাবা দ্বিতীয়বার আর ঢাকায় আসার নাম মুখে আনবো না। শুনেছি ঢাকা শহরে জ্যাম হয়, কিন্তু ঢাকা যেতেও জ্যামে পড়তে হবে? এই জ্যামের কারণে ছয় ঘন্টার পথ ষোল ঘন্টা লাগল। জলিল ভাইয়ের বন্ধুর বাসায় উঠে বিশ্রাম নিলাম আমরা। সন্ধ্যার পর কারওয়ান বাজার এফডিসির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লাম জলিল ভাইয়ের সাথে।

বৃষ্টি মাথায় নিয়ে পথ চলছি। এফডিসিতে ঢুকেই বড় বড় লাইটের আলোতে কয়েকজন নায়ক-নায়িকার আনাগোনা চোখে পড়ল। এদেরই সিনেমায় দেখি। পথের মধ্যেই এক লোকের সাথে জলিল ভাইয়ের কথাবিনিময় শুরু হলো। লোকটি জলিল ভাইয়ের হাত ধরে দোলাতে দোলাতেই বলল, জলিল ভাই সিনেমায় নামছেন না কেন, আপনার তো টাকা পয়সার অভাব নেই।

চেহার-সুরতও তো খারাপ না। ইচ্ছে করলে নিজেই নায়ক-প্রযোজক-পরিচালক হয়ে যেতে পারেন। লোকটির কথা শুনে জলিল ভাই সরাসরি কোনো উত্তর না দিয়ে শুধু রহস্যময় হাসি দিলেন। এর মানে কি বুঝলাম না? লোকটি কি বুঝল কে জানে? লোকটি মৃদু হেসে পাশ কাটিয়ে চলে গেল। ৪।

সামনে এগিয়ে যেতে এক জায়গায় দেখি গানের শব্দ ভেসে আসছে। নিশ্চিয় গানের শুটিং চলছে। ঝর্ণার পানির বদলে সরাসরি বৃষ্টিতেই নায়ক-নায়িকা বৃষ্টিভেজা গানের দৃশ্যে অভিনয় করছে। পরিচালকের মাথায় বুদ্ধি আছে বটে, ছবির বাজেট কমাচ্ছেন। জলিল ভাইয়ের পেছন পেছন হাঁটছি।

চেয়ার উপর পা তুলে বসা একজনের কাছে গিয়ে থামলেন। কানের কাছে মুখ নিয়ে কি যেন বললেন লোকটিকে। লোকটি মাথা ঝাকালেন জলিল ভাইয়ের কথায়। জলিল ভাই এবার আমার কানে কানে জানালেন, উনি পরিচালক। সালাম দিতে হবে।

পরিচালকের পাশ থেকে সরে এসে পেছনে দাঁড়ালাম আমরা। বৃষ্টির পানিতে নায়ক-নায়িকাকে ভালো করে চেনা যাচ্ছে না। কিছুক্ষণ পর পরিচালক ‘কাট কাট’ বলে চিৎকার করে উঠলেন। নায়ক-নায়িকা দৌড়ে বিশাল সাইজের ছাতার নিচে এসে দাঁড়াল। নায়িকার দিকে ভালো করে তাকানোর সুযোগ পেলাম।

কপাল ভালো নায়িকাও আমার দিকে তাকালো। দুই জোড়া চোখ এক হলো। এক জোড়া চোখ আমার আর অন্য জোড়া চোখ হলো নায়িকার। নায়িকাকে এবার চিনতে দেরি হলো না। আমার পড়ার টেবিলের ড্রয়ারে যে ছবিটি তালাবন্ধ করে রেখেছি, যে ছবিটি জলিল ভাইয়ের কাছ থেকে আবদার করে নিয়েছিলাম! এই সেই বিখ্যাত বাংলা ছবির নায়িকা কেয়া।

আমাদের দু’জনের চোখের পলক পরছে না। কিন্তু ভেবে পাচ্ছি না কেয়া কেন জলিল ভাইয়ের দিকে তাকাচ্ছেন না বা কথা বলছেন না। আমি হলাম গ্রামের ভূত, নাঙ্গলা কৃষক, আমাকে দেখে হ্যাবলার মতো তাকিয়ে থাকার কি হলো? তবে কি আমাকেই হ্যাবলা মনে করছে! গ্রাম থেকে আসা একজন হ্যাবলাকে দেখছে! ৫। নায়িকা কেয়াকে সাদা শাড়িতে সুন্দর লাগছে। বৃষ্টি ভেজা মুখ।

মায়াবী লাগছে দেখতে। মাথায় আসে না কেয়া কেনো প্রথম সারির নায়িকা হতে পারছে না। ওফু বিশ্বাস থুক্কু অপু বিশ্বাস মুখের মধ্যে গোটা গোটা দাগ (মতান্তরে ব্রণ) নিয়ে কিভাবে এতোদিন দর্শকের বুকে ঝড় তুলে যাচ্ছে। কেয়া মেয়েটিতো অপু’র চেয়ে শতগুন বেশি সুন্দরী। ভাবনায় ছেদ পড়ল অচেনা এক ছোকরার ডাকে।

আমাকে নায়িকা ডাকছে। কোন নায়িকা আমাকে ডাকবে! ভেবে পেলাম না। আষাঢ়ের আকাশ মাথায় ভেঙ্গে পড়ল যেনো। ভাইকে দেখিয়ে বললাম, আমাকে না ওনাকে ডাকছে। ছোকরাটা জোর দিয়ে বলল, ম্যাডাম আপনারেই যাইতে কইছে।

জলিল ভাইও মুচকি হেসে আমাকে যেতে বললেন। ছোকরার পেছন পেছন যাচ্ছি। মেকআপ রুমের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। আমাকে রেখে ছোকড়া ভেতরে ঢুকে গেল। তখনই ভেতর থেকে আমার ডাক পড়ল।

ভয়ে ভয়ে গেলাম মেকআপ রুমে। ভেতরে যাওয়ার সাথেই ছোকড়াটা কেটে পড়ল মেকাপরুম থেকে। নায়িকা কেয়া আমাকে চেয়ার দেখিয়ে বসতে বলল। আমার দিকে নায়িকা তার কালো চোখ জোড়া তুলে তাকাল। ও চোখে চোখ রাখতে পারছি না।

মিহি কন্ঠে বলল, এখানে আমার মোবাইল নম্বর আছে। সময় করে কল দিও। তখন বাকি কথা হবে। কাঁপা হাত কেয়ার দিকে বাড়িয়ে দিলাম। কোনো কথা এখনো গলা দিয়ে বের হলো না আমার।

চলে আসার সময় কেয়া আবার ডাকল। থমকে দাঁড়ালাম। পেছনে ফিরে তাকাতেই কেয়া সামনে চলে এলো। তারপর সুঁরেশ মার্কা খাঁটি সরিষার তেলের বোতল আমার হাতে দিয়ে বলল, সুঁরেশ মার্কা সরিষার তেল আমার খুব প্রিয়। এই আকালের বাজারে এক বোতল খাঁটি সরিষার তেল পেয়ে আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়লাম।

আহারে এই আনন্দ বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না, ঘুম ভেঙ্গে গেল। ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১৮৬ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.