নুতন পুরাতন সব লেখাতেই আপনার মন্তব্য প্রত্যাশিত।
এই পর্বে কথা শুরু করার আগে পূর্ব-আলোচনার একটা সারমর্ম দাঁড় করানো জরুরী। জরুরী এইজন্য যে আলোচনার লক্ষ্য বিক্ষিপ্ত ভাবে ডালপালা না ছড়িয়ে যেন ক্রমশ একমুখী হয়ে উঠে। দীর্ঘ যাত্রায় সময়ে সময়ে পেছন ফিরে না দেখলে সামনে আগানোটা অনেকসময় শক্ত হয়। মাইলফলকের দু’এক লাইনের সারসংক্ষেপ যাত্রাকে তাই গন্তব্যের পথে সুস্থির রাখে।
সুনির্দিষ্ট একটা প্রশ্নকে সামনে রেখে আমাদের পথ চলা। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় গুলির গবেষনার ক্ষেত্রে ব্যর্থতার মূল কারণটা খুঁজে ফেরা। পুরো আলোচনাকে দুটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। ১) প্রথম ধাপে গবেষনা উপযোগী জনবল সামান্য হলেও তৈরী হচ্ছে কিনা সেটা আমরা তিন পর্বে যাচাই করে দেখেছি ২)দ্বিতীয় ধাপে যেটা নিয়ে আমরা ভাববো সেটা হলো যদি যৎকিঞ্চিত জনবল আমরা তৈরী করতে সক্ষমও হয়ে থাকি তবে কেন সেই জনবল আদৌ কোন অবদান রাখতে পারছেনা । উত্তর খোঁজার জন্য চটজলদি অনেক চিন্তাও আমাদের চারপাশে রেডি হয়ে আছে, প্রত্যক সমাজেই সেটা থাকে।
রেডিমেড বলেই সেটা গুরুত্বহীণ বা মাপে মিলবেনা এরকমটা বলি না, তবে উলটে পাল্টে না দেখলে বিপদের সম্ভাবনা শতভাগ এটুকু বলা যেতে পারে। এই রেডিমেড চিন্তাগুলি যাচাই বাছাই এর সাথে সাথে গত তিন পর্বে যেটা করা হয়েছে তা হচ্ছে প্রথম ধাপের অনুসন্ধান, অর্থাৎ অবকাঠামো, ল্যাব ও শিক্ষক এই তিন মূল স্তম্ভের বর্তমান অবস্থা গবেষনার জন্য জনশক্তি তৈরীতে কতখানি সক্ষম সেটা এক এক করে বিবেচনায় আনা।
প্রথম ভাগের বা তিন পর্বের সারমর্মটা কি? সারমর্ম যেটা দাঁড়িয়েছে সেটা হল শত প্রতিকূলতার মাঝেও কিয়দংশ ছাত্র এই সিস্টেমের ভিতর দিয়ে বের হয়ে আসছে বা আসবে যারা গবেষনা কার্যক্রমে প্রতিভার সাক্ষর রাখতে সক্ষম বা অন্য ভাবে বললে, যতো সামান্যই হোক, এই সিস্টেম গবেষনা উপযোগী ম্যানপাওয়ার তৈরী করতে সক্ষম। নিঃসন্দেহে আশা ব্যঞ্জক কথা। তবে কতখানি আশাব্যঞ্জক, পুরপুরি? না, এধরনের প্রশ্ন তোলাটা হয় অভিসন্ধিমূলক নয়তো দেশের মাটি, মানুষ আর পরিস্থিতির সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক নাই।
এই জায়গায় আরেকটু যোগ না করলে পাঠকের কাছে রং সিগন্যাল চলে যাবার সমূহ সম্ভাবনা আছে। তাই আবার বলি ,বিশ্ববিদ্যালয়গুলার বর্তমান হালহকিকত গবেষনা উপযোগী জনবল তৈরীর জন্য সন্তোষজনক বা এ নিয়ে আমাদের দুঃশ্চিন্তার আর কোন কারনই নাই, এরকম কোন মেসেজ এই বক্তব্যে নাই। বরং যেটা বলা হচ্ছে, যতো সামান্যই হোক , এই সিস্টেম গবেষনা উপযোগী জনবল তৈরী করতে সক্ষম। পাঠক যদি আগের পর্ব ও সংশ্লিষ্ট কমেন্ট-আলোচনা গুলো একটু রিভিউ করে নেন তবে আর ভুল বোঝাবুঝির অবকাশ থাকবে বলে মনে হয়না।
উপরের কথা যদি সত্য হয় তবে অবধারিত ভাবে আলোচনার দ্বিতীয় অংশে যে প্রশ্ন আমাদের দুয়ারে হানা দিচ্ছে তা হোল এই উপযুক্ত ম্যানপাওয়ার গুলো দিয়েও কেন তবে আমার দেশে রিসার্চ হচ্ছেনা।
একটু বিস্তারে যাই, একটা প্রশ্ন নিয়ে এই প্রসঙ্গে কথা শুরু করি। প্রথমে দেখি গবেষনা বলতে আমরা যা বুঝছি বা আমাদের অবচেতন মনে গবেষনার যে ছবিটা আঁকা সেই গবেষনাটা আসলে কাদের প্রয়োজন, কাদের দরকার, কারা শেষ বিচারে এর মূল বেনিফিসিয়ারী? উত্তরটা খুঁজতে হলে সতর্ক হতে হবে, স্থান আর কাল কে বিবেচনায় রাখতে হবে। তাই গবেষনায় যারা এই পৃথিবী গ্রহটির পথ প্রদর্শক সেই পশ্চিমের প্রেক্ষাপটকে মাথায় রেখে আজকে ২০১০ এ বসে ব্যাপারটা খুব সংক্ষেপে বোঝার চেষ্টা করি। স্টীম ইঞ্জিন পরবর্তী সময়ে পশ্চিমে কারখানা, মালিক ,শ্রমিক ,শ্রমের নুতন ধারণা যেমন ধীরে ধীরে পরিপুষ্ট হয়েছে তেমনি এই সকল উপাদানের ইনসাফ ভিত্তিক আন্তঃসম্পর্ক খুঁজতে গিয়ে অনেক রক্তপাত আর সংগ্রাম ইতোমধ্যেই ঘটে গেছে। সেখানে সমাজের কাঠামো,সমাজের ফাইবার বিভিন্ন সময় বিভিন্ন দিকে মোচড় খেতে খেতে আজ আপাতঃ স্থির একটা অবস্থানে পৌঁছেছে।
আর সেই বিবর্তিত সমাজ কাঠামোতে গবেষনাটা আসলে কাদের জন্য সেটার উত্তর দিতে গিয়ে সতর্ক হতে হবে। পশ্চিমকে মাথায় রেখে দু’ চারটি প্রশ্নের উত্তর খুঁজে দেখা যাক।
গবেষনা দিয়ে ছাত্র কি করবে, গবেষনা কি ছাত্রের প্রয়োজনে?
প্রশ্নই আসেনা। গবেষনা সে করল কি না করল সেটা তার ব্যক্তিগত খায়েশ। কেউ যদি আপেল গাছের নীচে বসে কোন ঘটনার গাণিতিক মডেল স্বেচ্ছায় দাঁড় করাতে আগ্রহী হয়ে উঠে সেটা তার ব্যক্তিগত ইচ্ছা অনিচ্ছা।
নিজের ভাললাগায় যেমন একজন লেখক হয়ে উঠে, তেমনি নিজের আগ্রহে সাধনায় কেউ গবেষক হয়ে উঠতে পারে। এটা তার আপন মর্জি,তার অস্তিত্ত্বের প্রশ্ন নয়।
গবেষনাকাজ কি বিশ্ববিদ্যালয়ের টিকে থাকার প্রশ্ন?
মোটেই না। ছাত্রকে সার্টিফিকেট দিতে একপ্রস্থ গবেষনার নাটক লাগে, একটা দুইটা পেপার লাগে ঐ পর্যন্তই তার প্রয়োজন। জ্ঞানের কান্ডারী হিসাবে একটা এলিট ভাব সে ধরে ঠিকই তবে কেন গবেষনা বা নুতন জ্ঞানের খোঁজ তার আবশ্যকীয় কর্তব্য-কর্ম সেটার কোন বস্তুনিষ্ঠ ব্যাখ্যা সে হাজির করতে পারেনা।
কারণ অতিশয় সোজা, তার বেঁচে থাকার জন্য, তার অস্তিত্বের জন্য গবেষনার কোন প্রয়োজনই নাই, আসলেই নাই। শুধু জ্ঞানের জন্য জ্ঞানের খোঁজ,সমাজের উন্নতির জন্য জ্ঞানের খোঁজ এগুলো স্রেফ তার বাকওয়াস।
তাহলে রিসার্চের প্রয়োজনটা কাদের? কারা শেষ বিচারে এর মূল বেনিফিসিয়ারী?
হালজামানার জীবন চক্রের স্বরূপটা এরকম, জন্ম নাও, ভোগ কর অতঃপর মারা যাও। কনজিউম এন্ড কনজিউম। জীবনের উপলব্ধি এখানে ভোগে।
। কি ভোগ করবে সে?ভোগ মানে বোঝানো হচ্ছে পণ্যের ব্যবহার। জন্ম নেবার পর লাল রঙের একটা ঝুনঝুনি ক্রয়ের মধ্যে দিয়ে ভোগের এই যাত্রা শুরু। এই কথাকয়টা বলার উদ্দেশ্য এটাই যে, জীবন মানে যদি পন্যের আনলিমিটেড ভোগ হয় তবে সেই সমাজে বা বাজারে পন্যকে অবশ্য অবশ্য তার পন্যগুন নিয়ে হাজির হতে হবে। হতে না পারলে বিনিয়োগকৃত পুঁজি মার খাবে, ব্যবসা লাটে উঠবে।
পণ্যকে তাই ভোগ্যপণ্য হিসাবে বাজারে হাজির হতে হলে গবেষনার কোন বিকল্প নাই, এপথে তাকে নিরন্তর হাঁটতেই হবে । গবেষনা বা রিসার্চ তাই শেষ পর্যন্ত একান্তই শিল্পকারখানার। এটা ইন্ডাস্ট্রীর প্রাণ ভ্রোমরা,তার মুনাফার প্রশ্ন, তার অস্তিত্ত্বের প্রশ্ন, টিকে থাকার প্রশ্ন।
কি নিয়ে তবে গবেষনা? এক কথায় গবেষনা মানে আজ পণ্য তৈরী আর তার উৎকর্ষ সাধনের গবেষনা,পন্যকে ভোগ্যপন্য করে তোলার গবেষনা। সি,আর,টি থেকে এল,ই,ডি স্ক্রীনে আসার গবেষনা, মোবাইল ফোনে বাটন টেপা নাকি ইদানিং আনস্মার্ট কাজ, তাই সেন্সেটিভ টাচ স্ক্রীনে উত্তরণের গবেষনা,GSM থেকে 3G হয়ে LTE তে উত্তরণের গবেষনা, অল্প জ্বলানীতে বেশী বেশী পথ পাড়ি দেবার গবেষনা ইত্যাদি।
তাহলে এই কামের জন্য যে নুতন নুতন জ্ঞানের খোঁজ দরকার আর তাকে আমল করার জন্য যে জ্ঞান-শ্রমিক বা রিসার্চার দরকার তার সাপ্লায়টা দিবে কে। তাই ফলশ্রুতিতে এই জনবল তৈরীর জন্য আবার একটা আলাদা কারখানার অভাব অনুভূত হলো। সেই অভাব পূরনের জন্য ইন্ডাস্ট্রীর সাপোর্টে, তার অর্থে পশ্চিমে নুতন নুতন টেকনিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় তৈরী হতে থাকল বা ইতোমধ্যে প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলি সেই জ্ঞান কারখানার অভাব পূরণ করতে নিজের গতানুগতিক কাঠামো পূনর্বিন্যাস করে এগিয়ে আসলো। আর তাই বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে শেষ বিচারে লগ্নী পুঁজির মুনাফার জন্য অত্যাবশকীয় নুতন জ্ঞান আর জনবল তৈরীর কারখানা। সুশীল ভাবে একে নামকরণ করলে শোনায় বিশ্ববিদ্যালয়।
ঝড় হলে পাতা নড়ে, না পাতা নড়লে ঝড় হয় এই তফাৎটা আমাদের বুঝতে হবে। শিল্পোন্নত বিশ্বে বিশ্ববিদ্যালয় শুধু নেচারের কজ আর এফেক্ট নিয়ে অবিরাম গবেষনা করে চলে বা এটা নিত্য নুতন জ্ঞানের খোঁজে সদা মরিয়া এক মহাপ্রতিষ্ঠান, ব্যাপারটা কিন্তু মোটেও এরকম আদর্শিক নয়। বরং, ইন্ডাস্ট্রীর মুনাফার জন্য, তার নিরাপত্তার জন্যে আবশ্যকীয় যে জনবল ও গবেষনা সেটা সম্পাদনই এযুগে তার প্রাথমিক লক্ষ্য। এই লক্ষ্যেই তার প্রতিষ্ঠা , তার এগিয়ে আসা, তার কর্মযজ্ঞ। ইন্ডাস্ট্রীর অর্থেই সে প্রত্যক্ষ বা পরক্ষভাবে পরিপুষ্ট।
আর তাই বিশ্ববিদ্যালয় কেন গবেষনা করেনা, কেন তারা এটা ওটা বানিয়ে বিশ্বকে তাক লাগায়ে দেয়না এই চিন্তাটাই অপরিপক্ক, আদ্যিকালের চিন্তা। কেন? কারণটা আগেই বলেছি, ঝড় হলে পাতা নড়ে, পাতা নড়লে ঝড় হয়না। আধুনিক গবেষনার উদ্যোক্তা বিশ্ববিদ্যালয় নয়, এটা তার সামর্থের বা মুরোদের মধ্যেই নাই, এর উদ্যোক্তা লগ্নী পুঁজির মহাকারবারীরা। তাই সুনির্দিষ্ট কি নিয়ে গবেষনা হবে,সমস্যার কোন জায়গাটা খোঁড়াখুঁড়ি করতে হবে, গবেষনার টোটাল ম্যান-আওয়ার কত হবে, গবেষনার ফলাফল প্যাটেন্ট আকারে আসবে না পেপার হিসাবে পাব্লিশ হবে, প্যাটেন্ট হলে কোন মহাদেশে কত বৎসরের জন্য প্যাটেন্ট হবে তার পুঙ্খানুপুঙ্খ মাস্টারপ্লান ,অর্থ, আনুষাঙ্গিক সাপোর্ট আসে কর্পোরেশন বা ইন্ডাস্ট্রী থেকে।
আজ এই পর্যন্তই থাক।
দেশের কথা আজ মোটেই হয়নি। আলোচনাটা পশ্চিমেই সীমাবদ্ধ ছিল। দ্বিতীয় ভাগের যে প্রশ্নের উত্তরটা খুঁজতে গিয়ে এত কথা মানে ”উপযুক্ত ম্যানপাওয়ার গুলো দিয়েও কেন তবে আমার দেশে রিসার্চ হচ্ছেনা” সেটা আবার এসে বিস্তারে বলা যাবে। তবে কিছুটা উত্তর মনোযোগী পাঠক নিশ্চয় এতক্ষণে পেয়ে গেছেন। সঙ্গে থাকবেন আশা রাখি।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।