শঠের ছলের অভাব হয় না। জামায়াত-বিএনপি-হেফাজতী আমির বেগম জিয়া এখন বলছেন, তিনি ক্ষমতায় গেলে নতুন ধারার রাজনীতি করবেন। সহ অবস্থানের রাজনীতি করবেন। তিনি প্রতিহিংসায় বিশ্বাস করেন না।
তাঁর এ কথা অনেকে ইতোমধ্যে বিশ্বাস করছেন এবং বিশ্বাস করে কেউ কেউ চমকে উঠেছেন।
যেমন নতুন ইংরেজী দৈনিক ঢাকা ট্রিবিউন যা ইতোমধ্যে অনেক পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সমর্থ হয়েছে। এই দৈনিকটি তাদের প্রথম পাতায় একটি রিপোর্ট করেছে সেখানে দেশের অনেক মানুষের মনের প্রশ্ন ফুটে উঠেছে। ওই রিপোর্টে বলা হয়েছে, বেগম জিয়া নতুন ধারার রাজনীতির কথা বলেই আবার জাতীয় শোক দিবসে ‘সঠিক নয়’ এমন একটি জন্ম দিনের কেক কাটলেন। তার ভিতর দিয়ে মানুষের মনে প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।
যারা বেগম জিয়ার এই প্রতিশ্রুতিকে বিশ্বাস করছেন তাঁদের কথা মনে হলে সেই ঠগী আমলের প্রতারিত সহজ সরল মানুষগুলোর মুখটাই চোখের সামনে ভেসে ওঠে।
সিøম্যানের ঠগী দমনের পরেও এখনও বাংলা প্রবাদ রয়ে গেছে ‘ঠগের বাড়ির নিমন্ত্রণ। ’ তাই এই উপমহাদেশের শঠের উদাহরণ দিতে গেলেই ঠগীদের কথা বলতে হয়। ঠগীরা প্রয়োজন মতো এমনি করে মিথ্যে, মিষ্টি ও ভাল ভাল কথা দিয়ে পথচারীকে ভুলিয়ে ফেলত। তারপরে সুযোগ বুঝে তাদের হত্যা করে সব লুণ্ঠন করে নিত। ওই মানুষদের ভিতর কেউ যদি বেঁচে থাকতেন তাহলে পরে তাঁর চোখের সামনে ভেসে উঠত ওই ছবি, হয়ত ভাবতো অমন সুন্দর কথা বলা, মিষ্টি মুখের মানুষগুলো এভাবে হত্যা করল? আমাদের বাংলাদেশে এখন অনেক পুলিশ অফিসার উচ্চ শিক্ষিত।
ক্রিমোনলজিতে অনেক পড়াশোনা আছে এমন কিছু পুলিশ অফিসারের সঙ্গে কথা বলে যেটা বুঝেছি, আমরা বইয়ে যেটা পড়ি বাস্তবেও সেটা সত্য। আসলে অধিকাংশ বড় বড় প্রতারক, সুদর্শন এবং প্রয়োজনে তারা অনেক ভাল কথা বলে। তাই বেগম জিয়া অনেক ভাল কথা বলার পরেও ১৫ আগস্ট তাঁর জন্মদিন পালন করলে তাতে আশ্চর্য হবার কিছু নয়। বরং সত্য বিবেচনায় এটাই স্বাভাবিক। এছাড়া একটি রাজনৈতিক সত্য এখানে সকলের উপলব্ধি করা দরকার যে, ১৫ আগস্ট তো জামায়াত-বিএনপি- হেফাজতী এরা উল্লাস করবেই।
তারা এখনও তাদের মনের প্রকৃত সত্যটি প্রকাশ করে উল্লাস করতে পারছে না, ততটুকু বিজয় তারা এখনও অর্জন করতে পারেনি বলে এটাকে বেগম জিয়ার জন্মদিন সাজিয়ে উল্লাস করছে। কিন্তু এই সত্য তো আমাদের মানতে হবে যে, জামায়াত-বিএনপি-হেফাজতী এদের প্রকৃত জন্মদিন ১৫ আগস্ট। ১৫ আগস্ট যদি এই শক্তি সামরিক সদস্যদের সহযোগিতায় বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করতে না পারত; যদি তারা ওই হত্যাকা-ের ভিতর রাষ্ট্রের চরিত্র ও সংবিধান পরিবর্তন করতে না পারত তাহলে কি বাংলাদেশের মাটিতে তাদের জন্ম হতো? ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের আগে বাংলাদেশের মাটিতে একাত্তরের পরাজিত এই রাজকার-আলবদর শক্তির আর কোন মতেই নবজন্ম নেবার কোন উপায় ছিল না। ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ভিতর দিয়ে তাদের সেই নব জন্ম হয়েছে। তাই এটা মূলত ওই স্বাধীনতা বিরোধী গোষ্ঠীর জন্মদিন।
যতদিন সামরিক শাসকরা ছিল এ দেশে। আওয়ামী লীগ জাতীয়ভাবে শোক দিবস পালন করতে পারত না, ততদিন এই শক্তি এ দিবসকে নাজাত দিবস হিসেবে পালন করত। ১৯৯০-এ এরশাদের পতনের পর, ধীরে ধীরে বাংলাদেশে স্বাধীনতার সপক্ষ শক্তি আবার সংগঠিত হচ্ছে। বিশেষ করে শিক্ষিত তরুণ সম্প্রদায়ের ভিতর স্বাধীনতার চেতনা ও বঙ্গবন্ধুকে আঁকড়ে ধরার একটি আকুতি দেখা যাচ্ছে। এমনকি আমরা এও দেখেছি, ১৯৯১-এর ১৫ আগস্ট বিএনপি ক্ষমতায় এলে যখন বঙ্গবন্ধু হত্যা দিবসকে শোক দিবস হিসেবে পালন করেনি, তখন ওই দিন আওয়ামী লীগ অর্ধ দিবস হরতালের ডাক দেয়।
যার মূল উদ্দেশ্য ছিল শোক দিবস উপলক্ষে জাতীয় ছুটি। সেদিন বিরাট অংশ সেটাকে সমর্থন করে। একটি বিদেশী প্রচার মাধ্যমের জন্যে রিপোর্ট প্রস্তুত করতে গিয়ে অনেক তরুণের সঙ্গে কথা বলি। তারা সেদিন বলে, আমরা এদিনটিকে অন্যভাবে দেখি, তাই রাজনীতি না করলেও এই হরতালকে সমর্থন করি। কারণ বঙ্গবন্ধু আমাদের ন্যাশনাল হিরো।
তিনি ছাড়া আমাদের সামনে কোন আইডল নেই।
এই তরুদের একটি অংশের সঙ্গে প্রতারণা করে ও স্বাধীনতাবিরোধী শক্তিকে সংগঠিত করে পাশাপাশি দেশের একটি তরুণ শ্রেণীকে স্বাধীনতাবিরোধী চিন্তাধারায় গড়ে তুলে জামায়াত বিএনপি ও বর্তমানের হেফাজত এই পর্যন্ত এসেছে। এবং এগিয়ে যেতে চাচ্ছে। তাই বাস্তবে ১৫ আগস্ট এই শক্তির জন্মদিন হলেও তারা বলতে পারে না ১৫ আগস্ট বাংলাদেশের স্বাধীনতা ধূলিসাতের চেষ্টার দিন। এই দিন স্বাধীনতাকে ধূলিসাত করতে না পারলেও তারা নিজেদের সংগঠিত করতে পেরেছে।
তাই এটা তাদের জন্মদিন। সকলের মনে রাখা উচিত এই শক্তির মূল উৎস পাকিস্তান ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশকে ইসলামিক প্রজাতন্ত্র হিসেবে উল্লেখ করেছিল। পাকিস্তান যতটা চেয়েছিল বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেও পাকিস্তানের এ দেশের দোসরা সেটা সেদিন পারেনি। তবে তারপরেও ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৯০ অবধি বার বার সংবিধানকে ক্ষত বিক্ষত করে তারা তাদের অবস্থান শক্তিশালী করেছে। আর সে সব কিছু সম্ভব হয়েছে ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট তারা ঘটাতে পেরেছিল বলে।
তাই আমরা যেমন ১৬ ডিসেম্বর পালন করি, ২৬ মার্চ পালন করি ওরা তো ১৫ আগস্ট পালন করবেই। ওরা এখনও প্রকাশ্যে এই সত্য বলতে পারে না যে, ১৫ আগস্ট মূলত তাদের বিজয় দিবস। এ কারণে তারা এখন আপাতত এটা বেগম জিয়ার জন্মদিন হিসেবে উৎসব করে কেক কেটে আনন্দ করে। তাছাড়া বাংলাদেশে বিশ্বাসী কোন মানুষের পক্ষে কি কখনই জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর হত্যাকা-ের দিনে কেক কেটে উল্লাস করা সম্ভব?
তবে বাংলাদেশের মানুষকে মনে রাখতে হবে, ১৫ আগস্টে নব জন্ম পাওয়া এই স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি ধীরে ধীরে সংগঠিত হচ্ছে। এবং তারা এগিয়ে চলেছে।
এ দেশের মানুষ যদি তাদের শঠতার কাছে পরাজিত হয়। তারা ধর্মের নামে যে ছলনা, প্রতারণা করছে তার দ্বারা যদি বিভ্রান্ত হয়, তাহলে তার পরিণতি খুবই খারাপ হবে। কারণ, সত্যি সত্যি যদি এই স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি অর্থাৎ জামায়াত-বিএনপি ও হেফাজতীরা এ দেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিকে পরাজিত করতে পারে। তখন কিন্তু তারা আর কোন রাখ ঢাক করবে না। তখন তারা ১৫ আগস্টকে হয় স্বাধীনতা দিবস বা জাতীয় দিবস না হলে তাদের বিজয় দিবস হিসেবে ঘোষণা করবে।
দেশের মানুষ একটু লক্ষ্য করলে দেখতে পাবেন, বর্তমানের এই আঠারো দলীয় জোটে বা হেফাজতীদের মধ্যে অনেক নেতা আছে যারা বিভিন্ন সময়ে বক্তব্য রাখতে গিয়ে বলে, ১৫ আগস্ট এই দেশ মূলত তাঁবেদারমুক্ত হয়। এই তাঁবেদার কথাটির ভিতর দিয়ে তারা বলতে চায় মূলত স্বাধীনতা লাভ করে। এমনকি যাঁরা গোলাম আযমের আত্মজীবনী পড়েছেন তাঁরা দেখতে পাবেন গোলাম আযম নানানভাবে তার আত্মজীবনীতে বহুবার বলেছে, ১৫ আগস্ট দেশ প্রকৃত মুক্তিলাভ করে।
বেগম জিয়া শুধু জামায়াত-হেফাজত ও বিএনপির আমির নন, তিনি বর্তমান বাংলাদেশে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির প্রতীকও। আমাদের দেশে অনেক বুদ্ধিজীবী আছেন তাঁরা বার বার দুই নেত্রী বলে বেগম জিয়াকে নিয়ে আসতে চান শেখ হাসিনার সমান্তরালে।
ওই সব বুদ্ধিজীবী মূলত স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির এই প্রতীকের গায়ে একটি স্বাধীনতার খোলস পরিয়ে তাকে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে ও স্বাধীনতাবিরোধী শক্তিকে এগিয়ে যেতে সাহায্য করেন। কিন্তু বাস্তব সত্য হলো তিনি বাংলাদেশের অভ্যন্তরে থাকা স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির ঐক্যের প্রতীক। শুধু ঐক্যের প্রতীক নন, তিনি ধর্ম ব্যবসাকে পুঁজি করে সাধারণ মানুষকে শঠতার মাধ্যমে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির কাতারে নিয়ে এসেছেন। দেশে গত প্রায় ৩৯ বছর ধরে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির আর্থিক শক্তি এত বেশি হয়েছে যে, দেশের বুদ্ধিজীবী নামধারী, সুশীল নামধারী বড় একটি অংশ অর্থের বিনিময়ে শয়তানের কাছে আত্মা বিক্রি করে দিয়েছে। এবং এরা বেগম জিয়াকে এই খোলস পরাতে প্রতিনিয়ত সাহায্য করছে।
আর তারা আত্মাটি এমনভাবে বিক্রি করেছে যে অবশিষ্ট তাদের কিছু নেই। তাই ১৫ আগস্ট যখন বেগম জিয়াকে ঘিরে ১৯৭৫-এর খুনীদের উত্তরাধিকারীরা ও খুনের সুবিধাপ্রাপ্তরা কেক মুখে উল্লাস করে তখন ওই বুদ্ধিজীবীরা আহত হন না। বরং আজকাল তারা কেউ কেউ কেক খান।
তাই বেগম জিয়া আজ যতই নতুন রাজনীতি, নতুন ধরনের সরকারের নামে ঠগীর জাল পাতুন না কেন, তাঁরা ১৫ আগস্টের কেকের উল্লাস প্রমাণ করেছে, আবার এ দেশে নরহত্যা হবে, যা তিনি স্বেচ্ছাসেবক দলের জনসভায়ও আবরণ মাখিয়ে বলেছেন যে, ‘মানুষ ক্ষিপ্ত হয়ে আপনাদের ওপর হামলা চালাবে। ’ অর্থাৎ তিনি জামায়াতের যে হত্যা পরিকল্পনা আছে, যে হামলার পরিকল্পনা আছে সেটা অনুমোদন করলেন।
আর এটা ঘটেছে ১৫ আগস্টের মধ্যরাতের কেকের উল্লাসের পর। এই উল্লাসের পর তাই বলা যায়, তারা যদি মানুষকে প্রতারিত করতে পারে তাহলে আবার দেশে ভয়ঙ্করভাবে ফিরে আসবে হাওয়া ভবন। আর এবার ২১ আগস্ট আসবে না, আসবে ১৫ আগস্টের মতো যা বিএনপির অনেক নেতা ইতোমধ্যে বলেছেন, আরেকটি ১৫ আগস্ট হবে। শিবির যে আলবদরের উত্তরাধিকার হিসেবে আরেকটি ১৪ ডিসেম্বর আরো ভয়াবহভাবে ঘটাবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। আর এগুলো সম্পন্ন করতে পারলে সেদিন বেগম জিয়ার খোলসটি পড়ে যাবে।
খসে যাবে ১৫ আগস্টে বেগম জিয়ার জন্মদিন পালন করার খোলসটি। তার বদলে সেদিন তারা উদ্যতভাবে দম্ভভরে তাদের বিজয় দিবস ঘোষণা করবে ১৫ আগস্টকে। আর সেদিন যদি স্বাধীনতার পক্ষ শক্তির কেউ অবশিষ্ট থাকেন তিনি দেখতে পাবেন ১৫ আগস্ট সত্যি সত্যিই বেগম জিয়াদের জন্মদিন।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।