ঘূর্ণিঝড় মহাসেন বঙ্গোপসাগরে পাঁচ দিনে যে শক্তি অর্জন করেছিল, কয়েক ঘণ্টার বৃষ্টিপাতে তা ক্ষয় হয়ে যায়। ফলে বাংলাদেশের উপকূল অতিক্রমের সময় দুর্বল হয়ে পড়ে ঘূর্ণিঝড়টি।
গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল সাতটার দিকে পটুয়াখালীর খেপুপাড়ায় আঘাত করে ঝড়টি চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে পৌঁছানোর আগেই দুর্বল হয়ে পড়ে। বিকেল চারটায় মিরসরাইয়ের পাশ দিয়ে খাগড়াছড়ি হয়ে বাংলাদেশ অতিক্রম করে মহাসেন। আবহাওয়া অধিদপ্তর এসব তথ্য জানিয়েছে।
আবহাওয়া দপ্তরের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, সকাল সাতটার দিকে মহাসেনের অগ্রভাগ খেপুপাড়ায় প্রবেশ করে, নয়টার দিকে উপকূল অতিক্রম করে যায়। এ সময় ঘণ্টায় ৯০ থেকে ১০০ কিলোমিটার বেগে ঝোড়ো হাওয়া বয়ে যায় এবং উপকূলে পাঁচ-ছয় ফুট জলোচ্ছ্বাসের সৃষ্টি হয়।
মহাসেনের আঘাতে দেয়ালধসে, গাছ পড়ে ও বজ্রপাতে দেশের বিভিন্ন উপকূলে মোট ১৮ জন নিহত হন। ফসল ও সম্পদেরও অনেক ক্ষতি হয়েছে। শুরুতে ঘূর্ণিঝড়টি চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার উপকূলের দিকে এগোলেও শেষ পর্যন্ত না যাওয়ায় সেখানে তেমন কোনো ক্ষতি হয়নি।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের পরিচালক শাহ আলম প্রথম আলোকে বলেন, ভারী বৃষ্টির কারণে মহাসেনের শক্তি ক্ষয় হয়। এ ছাড়া ঝড়টি উপকূলে পৌঁছানো ও অতিক্রম করার সময় জোয়ার শেষ হয়ে ভাটা শুরু হয়েছিল। এতে জলোচ্ছ্বাসের প্রভাবও কম হয়।
প্রথম আলোর প্রতিনিধিরা জানান, বরগুনাতেই সাতজন নিহত হন। এ ছাড়া ভোলায় চারজন, কলাপাড়ায় তিনজন, চাঁদপুরে দুজন এবং পটুয়াখালী ও মঠবাড়িয়ায় একজন করে মারা যান।
এ ছাড়া ঝড়ের প্রভাবে রাজধানীসহ দেশের বেশির ভাগ এলাকায় দিনভর বৃষ্টি হয়। সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হয়েছে খেপুপাড়ায় ২৩২ মিলিমিটার। এসব এলাকায় প্রবল বৃষ্টির কারণে বাড়িঘর ও রাস্তার বেশ ক্ষতি হয়েছে। বরগুনা, ভোলা ও পটুয়াখালীতে বেড়িবাঁধ ভেঙে অনেক গ্রামে পানি প্রবেশ করেছে।
তবে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী বলেছেন, ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলায় আগাম প্রস্তুতির কারণে জানমালের ক্ষয়ক্ষতির ঝুঁকি কমেছে।
গতকাল দুপুরে নিজ মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে মন্ত্রী এ কথা বলেন।
বৃষ্টির কারণে দুর্বল মহাসেন: আবহাওয়া দপ্তরের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, ঝড়টি সকাল সাতটায় খেপুপাড়ায় আঘাত হানে। এ সময় বাতাসের গতিবেগ ছিল ৯০ থেকে ১০০ কিলোমিটার। পটুয়াখালী-বরগুনা-বরিশাল হয়ে ঝড়টি মেঘনা নদী দিয়ে চাঁদপুরের দিকে যাওয়ার সময় আরও বৃষ্টিপাত হওয়ায় এর গতি কমে ৪০ থেকে ৬০ কিলোমিটারে দাঁড়ায়। শেষ পর্যন্ত এটি পার্বত্য চট্টগ্রামের খাগড়াছড়ি অতিক্রম করে ত্রিপুরার দিকে যাওয়ার সময় এর গতিবেগ ছিল ২৫ কিলোমিটার।
আবহাওয়া দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ঘূর্ণিঝড়টি ১১ মে বঙ্গোপসাগরের আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে সৃষ্টি হওয়ার পর শুরুতে প্রচুর পরিমাণে জলীয় বাষ্প সঞ্চয় করে। পরে এর প্রভাবে শ্রীলঙ্কা ও ভারতের তামিলনাড়ু উপকূলে প্রচণ্ড বৃষ্টি হয়। ১৩ মে থেকে ঝড়টির গতিমুখ বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চল ও মিয়ানমারের রাখাইন উপকূলের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা থেকে ঘূর্ণিঝড় মহাসেনের কারণে বড় ধরনের মানবিক বিপর্যয়ের আশঙ্কা করা হয়।
গতকাল বেলা তিনটা পর্যন্ত পটুয়াখালীতে ১২২, বরিশালে ৯৫ ও মাদারীপুরে ৫০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে।
চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপজেলায় ৩৭ থেকে ৪০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। রাজধানীতে সকাল থেকে থেমে থেমে বৃষ্টি হলেও সকাল ছয়টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত সব মিলিয়ে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ছিল ৪৫ মিলিমিটার। আবহাওয়া দপ্তর থেকে আজও দেশের বিভিন্ন স্থানে ভারী ও অন্যান্য স্থানে মাঝারি বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা আছে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে।
ক্ষয়ক্ষতি: ঘূর্ণিঝড়ে বরগুনা ও পটুয়াখালীতে সবচেয়ে বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। বরগুনার ছয়টি উপজেলার ৪২টি ইউনিয়নে এক হাজারের বেশি বসতঘর, পাঁচটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়েছে।
উপড়ে পড়েছে অসংখ্য গাছপালা। প্রবল বর্ষণ ও জোয়ারের পানিতে ভেসে গেছে জেলার প্রায় ৭০০ মাছের ঘের ও তিন হাজারের বেশি পুকুরের মাছ। জেলার বেশির ভাগ এলাকা হাঁটুপানির নিচে ডুবে গেছে।
ঘূর্ণিঝড় মহাসেনের আঘাতে পটুয়াখালীর কলাপাড়া (খেপুপাড়া) উপজেলা লন্ডভন্ড হয়ে গেছে। বিধ্বস্ত হয়েছে ঘর, উড়ে গেছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভবন, উপড়ে পড়েছে গাছ ও বিদ্যুতের খুঁটি।
সাগর থেকে ফুঁসে ওঠা জোয়ারে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে কুয়াকাটা সৈকত।
উপজেলার রামনাবাদ, আন্দারমানিক নদী থেকে ফুঁসে ওঠা জোয়ারে অনেক মাছের ঘের, পুকুর তালিয়ে ভেসে গেছে মাছ। কলাপাড়া উপজেলা সদরের সঙ্গে সমুদ্রসৈকত কুয়াকাটাসহ প্রত্যন্ত অঞ্চলের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে।
সকাল নয়টায় বরিশালের উপকূলীয় এলাকায় মহাসেন আঘাত হানে। ঝড়ে জেলার ১০ উপজেলার অনেক কাঁচা ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
তবে কোনো হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি। উপজেলার বেলতলা ফেরিঘাটের পন্টুন ডুবে গেছে।
ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানার আশঙ্কায় চট্টগ্রাম নগরের বিভিন্ন বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এক দিন আগেই গরমের ছুটি পেয়েছে। অবশ্য কলেজগুলো গতকাল বন্ধ ছিল। মহাসেনের কবল থেকে রক্ষা পেয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছে কক্সবাজার উপকূলের ১৫ লাখ মানুষ।
গতকাল দুপুর দুইটায় কক্সবাজারকে বিপদমুক্ত ঘোষণা করা হয়। এরপর আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে আশ্রয় নেওয়া লোকজন ঘরে ফিরতে শুরু করে। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।