আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

হিংসা যখন প্রবল আকার

াে্রন্সাস্

দীপিকা ঘোষ : হিংসায় উন্মত্ত পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে অহিংস নীতিতে বিশ্বাসী, ভারতের বাপুজী মোহনচাঁদ করমচাঁদ গাঁধী একটি চিরন্তন সত্যবাণী উচ্চারণ করেছিলেন স্বদেশবাসীর উদ্দেশে দাঁড়িয়ে। যিনি ব্রিটিশ শাসিত ভারতবর্ষে স্বদেশী আন্দোলনে নেতৃত্বদান করেছিলেন, তাঁর পরাধীন দেশবাসীর প্রতি আহ্বান ছিল, সহিংস নীতি পরিত্যাগের। ওল্ড টেস্টামেন্টের সেই বিখ্যাত উক্তিটিকে সাবধান বাণী হিসেবে তাই উচ্চারণ করেছিলেন বারবার। কারণ তিনি তাঁর স্বদেশবাসীকে ভালোবেসেছিলেন। তাদের রক্ষা করতে চেয়েছিলেন সকল অকল্যাণের স্পর্শ থেকে।

তিনি তাই বলেছিলেন – ‘অ্যান আই ফর অ্যান আই উইল ওনলি মেক দ্য হোল ওয়ার্ল্ড ব্লাইন্ড’। এই উক্তিরই মর্মবাণী উচ্চারিত হয়েছিল- মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সিভিল রাইটস এবং সমতা প্রতিষ্ঠার সংগ্রামী গণনেতা, ডক্টর মার্টিন লুথার কিংয়ের মন্তব্যেও। কেননা তিনিও আন্তরিকভাবে চেয়েছিলেন, সব মার্কিন নাগরিকের জন্যই সুকল্যাণ প্রতিষ্ঠা হোক। জগতে যাঁরা মানবহিতৈষী, শান্তি এবং কল্যাণ প্রতিষ্ঠার প্রতি অঙ্গীকারাবদ্ধ, তাঁদের সবার উদ্দেশ্য আর অভিপ্রায়ই হয়ে থাকে গঠনমূলক কর্মধারার প্রবর্তন। যে কর্মকা- সহিংসার উন্মত্ততায় দেশ এবং জাতির জীবনে ধ্বংসাত্মক প্রতিফলন ঘটায়, তাকে তাঁরা সর্বদাই সযতেœ এড়িয়ে চলেন সবার মঙ্গল সাধনের জন্য।

জগৎকে, রাষ্ট্রকে, সমাজকে ভালোবাসেন বলে এই বিখ্যাত উক্তিটির মর্মধারা তাঁদের সকলের জীবনেরই তাই মর্মবাণী হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু বাংলাদেশের বহু রাজনৈতিক আদর্শের আব্রু পরিহিত তথাকথিত ভদ্র জনগণ ও মানবহিতৈষীদের হররোজের জীবনচিত্র এবং বাতচিত লক্ষ্য করুন। জীবনের অন্যসব শুভ অভিপ্রায় ছাপিয়ে নয়াপল্টনের সিংহদ্বার থেকে নির্দেশ পেয়ে হিংসাবৃত্তিই যখন কেবল মহা ভায়োলেন্স হয়ে নির্বিচারে ছড়িয়ে পড়ছে, তখনো তারা নির্লজ্জভাবে চুইয়ে পড়ে বলছেন – সুষ্ঠু নির্বাচন সম্পন্ন করার জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডই প্রধান কথা। সেটা না করে যে রীতিতে নির্বাচন হওয়ার কথা বলা হচ্ছে, সেটা একদলীয় নির্বাচন ছাড়া অন্য কিছু নয়। বাংলাদেশের জনসাধারণ এই নির্বাচনকে কিছুতেই মেনে নেবেন না।

জনসাধারণ অগণতান্ত্রিক দানবগোষ্ঠীর দেশব্যাপী সংঘটিত নিত্যকার দানবীয় হত্যাযজ্ঞকে কি মেনে নিচ্ছেন? হিংসার প্রচ-তায় যারা গাড়িতে গাড়িতে পেট্রল বোমা নিক্ষেপ করে পুড়িয়ে মারছে জীবন্ত মানুষ, কুটিল হায়েনার মতো কাপুরুষোচিত নোংরা কৌশলে সহস্র মানুষ হত্যা করতে উপড়ে ফেলছে রেললাইন, গাড়ি ভাঙছে, বৃক্ষহীন বাংলাদেশে বৃক্ষ নিধন ঘটাচ্ছে, সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্পে জ্বালিয়ে দিচ্ছে গণমানসের শুভবুদ্ধি, তাদের দানবীয় উল্লাসের এই অকারণ ঔদ্ধত্যকে মেনে নিচ্ছেন তো বাংলাদেশের সাধারণ জনসমাজ? প্রেমহীনতায়, বিবেকহীনতায়, বিচারহীনতায় এই যে গোটা দেশ জুড়ে সহস্র বিনাশের রূপ অন্ধ পৈশাচিকতায় উন্মাদ হতে হতে এরা ছড়িয়ে দিচ্ছে, তাতে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডটা কোথা থেকে তৈরি হবে, এই প্রশ্নের জবাব কি মানবহিতৈষীরা দিয়েছেন বাংলাদেশের জনতাকে? জামাতপন্থী কমরেডরা, সন্ত্রাসপ্রেমিক মানবহিতৈষীরা,টেরোরিস্ট কর্মকা-ে সন্তুষ্টচিত্ত এসব বহুরূপী আদর্শের ভদ্রলোকেরা কি জানেন, যতোই তারা আব্রু পরার চেষ্টা করুন, তাদের আসল চেহারা কিন্তু সবার কাছেই স্পষ্ট হয়ে গেছে? জনসাধারণ এবং টেরোরিস্ট গ্রুপ দুপক্ষই জেনে গেছে মুখোশের আড়ালে মূলত কোন কর্মকা-কে তারা উল্লাসভরে সাপোর্ট করছেন। যারা কথায় কথায় যুদ্ধাপরাধী শক্তির সমর্থক, শুরু থেকেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী, সেই রাজনৈতিক দল বিএনপিকে গভীর নর্দমার পাঁক থেকে টেনে তুলে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলের পাশে স্থান দিয়ে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডের তত্ত্বকথা আউড়ে মূলত এরা কোন নারকীয় উদ্দেশ্য যে সাধন করতে চান, সচেতন মানুষের দৃষ্টির সম্মুখে সেই দৃশ্যচিত্রও উন্মোচিত। তাই তাদের বক্তব্য শুনে মনে মনে এরা তাদের ঘেন্না করেন এবং এটাও বুঝতে পারেন কী কারণে এরা বিগলিত মানবহিতৈষী হয়েও এখন মহাব্যাপক ভায়োলেন্সের বিরুদ্ধে এমন নির্দয়ভাবে নিশ্চিন্ত। নির্লিপ্তভাবে নিশ্চুপ। হিউম্যান ডেভেলপমেন্টের অনেকগুলো নির্ধারিত বেসিক পয়েন্টের একটি হলো, প্রাত্যহিক জীবন সম্বন্ধে মানব চরিত্রে সুকুমারবৃত্তির উন্মেষ এবং নৈতিক চেতনালাভ।

সমাজে মানুষ কাক্সিক্ষত সিভিল স্বাধীনতা তখনই উপভোগ করার যোগ্যতা লাভ করে, যখন বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় অধিকার লাভের সঙ্গে সঙ্গে মানবজাতির প্রকৃতিতে এই দুই বৈশিষ্ট্য উল্লেখযোগ্যভাবে বিকশিত হয়ে ওঠে। কারণ জগতে যা কিছু সুন্দর ও কল্যাণময়, তাদের সবারই ভিত্তি রচিত হয় এসব নীতিবান হিতৈষী মানুষদের শুভ কামনা এবং সচেতন সহযোগিতার দ্বারা। আর স্বার্থ˜গ্ধময় নীতিহীন মানুষের দ্বারা সমাজে যা সৃষ্টি হতে পারে তা কেবল হরর মুভির সোচ্চার ভয়াবহতা। যে ভয়াবহতার উন্মত্ত পৈশাচিকতা এখন বাংলাদেশের সমস্ত প্রাঙ্গণল জুড়ে ছড়িয়ে। আপাদমস্তক মিথ্যেবাদী বিএনপির মিথ্যাচারে, তাদের নিত্যসঙ্গী টেরোরিস্ট দানবদের দানবীয় মুখরতায়, আব্রু পরিহিত ভাববাদীদের লেভেল প্লেয়িংয়ের অর্থহীন প্রলাপবাক্যে, মানবহিতৈষীদের নির্লজ্জ নীতিহীনতায়, জামাতপন্থী কমরেডদের পাপাচারে, সহস্র আদর্শের রাজনীতিকদের ভ্রষ্টতায় বাংলাদেশের বাঙালি জাতির একটি অংশ এতোটাই অন্ধ বিরাগে আবৃত হয়ে গেছেন যে তারা প্রতি মুহূর্তেই নিজেদের আচার আচরণ দিয়ে প্রাচীনকালের গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটলের সেই বিচার-বিশ্লেষণকেই প্রমাণ করে চলেছেন।

অ্যারিস্টটল বলেছিলেন Ñ ‘ম্যান ইজ বাই নেচার এ সোশ্যাল এনিম্যাল’। আর বিখ্যাত জার্মান দার্শনিক কান্ট বলেছিলেন- মানব সমাজে দুই শ্রেণীর মানুষ বসবাস করেন। নীতিহীন ও নীতিবান। নীতিহীন মানুষেরা মূলত তাদের পশু প্রবৃত্তির দাসত্ব করে। নীতিবান সেই অশুভ প্রবৃত্তি দমন করে নৈতিকতার জয়গান করেন।

সমাজের সব রকম কল্যাণসাধন এই নীতিবানদের দ্বারাই সূচিত হয়ে পরিসমাপ্তি লাভ করে। কারণ মানব আদর্শের চারটি স্তম্ভÑ সত্য, প্রেম, বিবেক, প্রজ্ঞা এঁরাই বয়ে নেবার দায়িত্ব বহন করেন চিরকাল। যে অশনি সংকেতের দৃষ্টান্ত হররোজ সৃিষ্ট করে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক গতিধারাকে এরা রুদ্ধ করতে চাইছে, বিএনপির নেতৃত্বাধীন বিরোধী দল যেখানে অহরহ প্রমাণ করে দিচ্ছেÑ কোনো পলিটিক্যাল ভিশন দিয়ে নয়, কোনো গঠনমূলক কমিটমেন্টের মাধ্যমে নয়, কোনো জনকল্যাণসূচক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেও নয়, প্রত্যেক পলকে শত শত অনৈতিক ষড়যন্ত্র সফল করার মাধ্যমেই বাংলাদেশের গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রাকে ধ্বংস করতে তারা অমানবিকভাবে দ্বিধাদ্বন্দ্বহীন, সেখানে তখন শুভবুদ্ধিসম্পন্ন সমস্ত স্তরের দেশবাসীদের ভেবে দেখা দরকার, আর কোনো ধ্বংসাত্মক কর্মসূচির প্ল্যাটফরম তাদের তৈরি করতে দেয়া উচিত কিনা। কারণ, হিংসার প্রবলতায় প্রেতের মতো এমন উল্লাসমুখর হবার কারণ তাদের একটাইÑ একাত্তরে নির্মম হত্যাকা-সহ অজস্র হিংস্র পাপাচারে যারা লিপ্ত হয়েছিল, হিংসার প্রচ-তা দিয়েই তাদের বিচারের পথরুদ্ধ করে মানবসভ্যতাকে আরো একবার কালিমালিপ্ত করা। বাংলাদেশের স্থপতি বিশ্বের বুকে বাঙালি জাতির পরিচয়পর্বের যে অঙ্গন তৈরি করেছিলেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মাধ্যমে, তাকে চিরতরে নিশ্চিহ্ন করে ফেলা।

এই কর্মকা- অনুষ্ঠিত করতে প্রলাপপন্থী ভাবভাদী, জামাতপন্থী কমরেড, মানবহিতৈষী রাজনীতিক, আব্রু পরিহিত তথাকথিত ভদ্রজন, বিগলিত মানবদরদী এবং টেরোরপন্থী জাতীয়তাবাদীদের আদর্শে কোনো রকম ফারাক নেই। এবার এই মহাসত্যকে এখন যতো দ্রুত দেশবাসীকে খোলাসা করে বোঝানোর দায়িত্ব পরিসমাপ্ত করা যাবে, যতোই এই অপশক্তিকে শক্ত হাতে দমন করার সুব্যবস্থা গৃহীত হবে, ততোই মঙ্গল হবে গোটা বাঙালি জাতির। অ্যালবার্ট আইনস্টাইন বলেছিলেনÑ ‘দ্য ওয়ার্ল্ড ইজ এ ডেঞ্জারাস প্লেস টু লিভ নট বিকজ অফ দ্য পিপল হু আর ইভিল, বাট বিকজ অফ দ্য পিওপল হু ডু নট ডু এনিথিং অ্যাবাউট ইট’। বসবাসের জন্য জগৎবিশ্ব বিপজ্জনক সত্যি, তবে সেটা শয়তানদের উপস্থিতির কারণে নয়। বিপজ্জনক তাদের জন্যই, যারা এদের বিরুদ্ধে কখনো কোনো কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করেন না।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।