আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

পাপগল্প: অসামাজিক

প্রকৃতিকে করো তব দাস-চে দ্য আইডল (ব্লগার নং - ৩১৩৩৯)
আসমানডারে বাইন্ধা থুইছে! রমিজ হাসে। অথবা এমনভাবে ফাঁকা ঠোঁটের ভেতর কালচে দাঁতের সারি ঝুলিয়ে রাখে যে মনে হয় সে হাসছে। আকাশ টাকে কেউ একজন সাদা দড়িতে বেঁধে রেখেছে। রমিজের চোখে এটা বিস্ময় জাগায়। সে আবার বলে,বাইন্ধা থুইছে! রমিজের কথায় এবার আর আকাশ আসে না।

সে আকাশের দিকে ও তাকায় না। তার চোখ থাকে মাটি তে। মাটি তে বসে কাটাকুটি করে আর আনমনে প্রশ্ন করে,আসমানডারে বাইন্ধা থুইছে কেডায়? রমিজের কাটাকুটি অত্যন্ত অমনোযোগে দেখে একজন। কেরামত। আকাশটাকে ও দেখে।

আসলে আকাশ দেখে না। নীল দেখে। কেরামতের মনে হয়,গতকাল বৌকে কিনে দেয়া শাড়ির সাথে আকাশের তফাত শুধু লম্বালম্বি সাদা দাগে। চায়ের গেলাসে দু'চামচ চিনি গুলতে গুলতে সে রমিজের উত্তর দেয়। কৌতুক করে বলে,আল্লায়! রমিজের কাটাকুটি বন্ধ হয়ে যায়।

সে অবাক চোখ তুলে বলে, আল্লায়? আল্লা কিডা? কেরামতের হাত থেকে চায়ের গেলাস নিয়ে এক চুমুক দিয়ে থু করে ফেলে দেয় একজন। ক্যারামইত্যা, ধুদের কি আকাল পড়ছে রে?নাকি গরুর ওলান ভাইবা বৌর ওলান থেইকা নিয়া আসছস? কেরামত সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে রমিজের দিকে তাকায়। তার মনে হয় রমিজ মজার একটা প্রশ্ন করেছে যে আল্লা কে! কেরামত আল্লার কথা ভাবে। বলে, এইডা ত রমিজ্যা শক্ত কথা। তয় আল্লা ব্যাবাক করবার পারে।

আসমান রে বাইন্ধা থুইবার পারে। রমিজ হাসে। তার মনে হয় কেরামত ঠিক কথা বলেছে। আল্লা সব পারে। তার আবার মনে হয়,যারা সব পারে তারাই আল্লা।

সে বলে,তর কতা ঠিক হলি পরে ত চ্যারমন সাব ও আল্লা। কেরামতের কাছে এই কথা টাও মজার মনে হয়। তবুও সে বলে, চ্যারমন সাব আল্লা হবি ক্যা, হ্যায় কি আসমান বাইন্ধা থুইবার পারে? রমিজ মাথা দোলায়। তাও ত ঠিক। রমিজের কথার ফাঁকে কেরামত আরেক গেলাস চা বানায়।

রমিজের দিকে বাড়িয়ে ধরে। নে, খা। রমিজ চা খায়। বিড়ি চেয়ে নিয়ে টানতে থাকে। অন্য একজনের গলা পাওয়া যায়।

ও ক্যারামত, তর বৌ নাকি পোয়াতি হইছে? কামডা কি তুই নিজে করছস, না রমিজ্যার মত বৌডারে ভাগা দিছিলি? রমিজ হাসে। হো হো করে হাসে। হাসতে হাসতে লুটিয়ে পড়ে মাটি তে। কেরামত সেই একজনকে চোখ রাঙায়। আমার বৌরে লয়া বাজে কতা কইবা না।

তইলে কিন্তুক ভালা অইব না। সে একজন ভয় পায় না। বলে, বাজে কতা কি সাধে কই? চ্যারমানের পোলা ত আর মইরা যায় নাই! চেয়ারম্যানের ছেলের কথা শুনে রমিজের হাসি থেমে যায়। সে বিড়ি টা জোরে আছাড় মারে। সেই একজনের গলা চেপে ধরে সজোরে।

নটির পুলা, তরে মাইরালামু কইলাম। তারপর তার চোখ আবার যায় আকাশে। সাদা দাগ কিছু টা হালকা। তবু রমিজ হাসতে হাসতে বলে, চ্যারমন সাব আসমানডারে বাইন্ধা থুইছে! হঠাৎ সে দৌড় দেয় জোরে আর ছোট ছোট ছেলে রা লুঙ্গি কাঁধে ফেলে তার পেছনে দৌড়ায় আর তার সাথে সুর মিলিয়ে বলে, চ্যারমন সাব আসমানডারে বাইন্ধা থুইছে! অনেক পরে সেই একজন কে কেরামত বলে, তুমি মিয়া বেয়াক্কল আছ ম্যালা! হ! হাচা কথা কইলে সবতে বেয়াক্কল! তয়, তুমার বৌডারে সাবদান থাকতি কইয়ো। চ্যারমানের পুলা ডা কাইলকা বাড়িত আইছে! সেদিন দুপুরবেলা কেরামতের চায়ের দোকানে জটলা হয়।

সবাই রমিজের কথা টা নাড়ায় চাড়ায়। উল্টে পাল্টে দেখে। রমিজ সবাইকে বলে বেড়াচ্ছে যে চ্যারমন সাব আল্লা অইয়া গ্যাছে! গাঁয়ের ভাঙা মসজিদের ইমাম সাব সব শুনে হাজী গামছায় মুখ মুছতে মুছতে বলে, নাউজুবিল্লাহ! ইমামের সাথে পুরো জটলা সমস্বরে বলে, নাউজুবিল্লা। তাদের এই মাত্র মনে হয় যে রমিজ মানুষ হিসেবে ফেলনা হলেও তার কথা টা ফেলনা না। কবীরা গুনাহের কাজ।

চেয়ারম্যান সাব রে আল্লার সাথে তুলনা! শিরক হয়েছে। ইমাম কে ছাড়াই সবাই আরেকবার বলে, নাউজুবিল্লা! দুপুরে ভাতঘুমের গড়াগড়ি দিতে দিতে কেরামতের মনে হয় যে রমিজ খুব একটা ভুল বলে নি। কিন্তু সে স্বীকার করে না। তার পোয়াতি বৌয়ের তলপেটে হাত বুলাতে বুলাতে সে বলে, রমিজ্যা শিরক কইরা ফেলছে। চ্যারমন সাব রে আল্লার লগে তুলনা দিছে।

পঞ্চায়েত রা সালিস ডাকছে। কেরামত সুখবোধ করে এই ভেবে যে তার বৌয়ের পেটে যে সন্তান এসেছে তার জনক একমাত্র সে। কেরামত বৌয়ের গায়ে হাত বুলায়। গাল ধরে। ঠোঁট ধরে।

সে রমিজের কথা ভাবে। হঠাৎ চোখে একটি লাশের খাটিয়া ভাসে। খাটিয়ার কোণা ধরে চুপচাপ বসে থাকা রমিজের কালো মুখ টা ভাসে। সে শিউরে উঠে নীল শাড়ি দিয়ে বৌয়ের ফুলে থাকা পেট ঢেকে দেয়। সেদিন দুপুর গড়ালে কেরামতের চায়ের দোকানের সামনে পঞ্চায়েত বসে।

ইমাম সাব সমবেত ভাবে নাউজুবিল্লা বলে উঠলে চেয়ারম্যান সাব কেশে উঠেন। ওপাশে বসে থাকা চেয়ারম্যানের ছেলের দিকে তাকিয়ে রমিজ হেসে উঠে। হাসতে হাসতে সে বলে, চ্যারমন সাব আল্লা অইয়া গ্যাছে। হ্যায় ব্যাবাক করবার পারে। হ্যায় আসমানরে বাইন্ধা থুইবার ও পারে।

চেয়ারম্যানের খুব একটা মনে হয় না যে রমিজ বড় অপরাধ করেছে, তবুও ইশারায় রমিজের গালে থাপ্পড় মারতে বলে। রমিজের চোখে পানি জমে তবুও সে হাসে। পঞ্চায়েত মনে করে যে রমিজ মহাপাপ করেছে তাই তার অনেক বড় শাস্তি হওয়া উচিৎ। তারা এ ও ঠিক করে যে ধারাবাহিক শাস্তির প্রথম ধাপ হবে একশ' বেত্রাঘাত। রমিজের দুই হাত পা আর পিঠে লাল মোটা দাগ ফুটতে শুরু করে।

চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। ঝাপসা চোখের ভেতর সে চেয়ারম্যানের ছেলে কে দেখতে পায়। তার মনে হয় যে চেয়ারম্যানের ছেলে বলছে, তার কোন দোষ নাই। টাকার বিনিময়ে রমিজ ই তুলে দিয়ে গেছে। আর বৌ টা যে পোয়াতি ছিলো সে বুঝতে পারে নি।

রমিজের মনে হয় যে কিছুক্ষণের মধ্যে বৌ টা একটা রক্তপিন্ড বিয়োবে। রমিজের মুখে হাসি মুছে যায়। বিভ্রম হয়। সে দেখতে পায়, তার বৌ টা একগাদা রক্তের ভেতর হাবুডুবু খায়। বৌটার নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসে।

চোখ বন্ধ হয়ে আসে। রমিজ চিৎকার করে হাতের কাছে পড়ে থাকা আধলা ইটা তুলে ছুঁড়ে মেরে হাঁফাতে থাকে। কেরামতের মনে হয় যে রমিজ ইটা টা লক্ষ্যে লাগাতে পারে নি বলে চেয়ারম্যানের বদলে তার ছেলে টা দু'ভাগ হয়ে যাওয়া মাথা নিয়ে কাত হয়ে পড়ে। কিন্তু তার বিভ্রম হয়। কেননা সে দেখতে পায়, রমিজ আবার হাসছে আর বলছে,চ্যারমন সাব আসমানডারে...! কিন্তু শেষ করতে পারে না।

চেয়ারম্যানের চামচার লাঠির আঘাতে রমিজের ও মাথা দু'ভাগ হয়ে পড়ে। কেরামত ঝাপটে ধরে দেখে যে রমিজ আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে আর আকাশ টা গাঢ় নীল। কেরামতের মনে হয় বৌয়ের তলপেট ঢেকে দেয়া নীল শাড়ি টা আকাশ হয়ে গেছে। তবুও সে ভয় পায় না। বৌয়ের তলপেট আবার ঢেকে দেয়ার তাগিদ পায় না।

সে রমিজের দিকে তাকায়। তার বিভ্রম হতে পারে আবার সত্য হতে পারে, সে শুনতে পায় যে রমিজ বলছে, আসমানের বান্ধন খুইলা গ্যাছে!
 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।