আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

পাপগল্প: কাঠফাটা চৈত্রের পাপ...

প্রকৃতিকে করো তব দাস-চে দ্য আইডল (ব্লগার নং - ৩১৩৩৯)

শেষ চৈত্রের দাবদাহে গ্রামের লেজে স্থির পুড়তে থাকা অল্প-বিস্তর আম কাঁঠাল কড়ই শাল আর বাঁশের জঙ্গলে কাঠ ফাটলে নাভীর বটগাছের ছায়ায় শার্টখোলা যুবক আর গামছাজড়ানো বুড়োদের আনাগোনা বাড়ে। ছেঁড়ালুঙ্গির কোণায় কপাল আর দাঁড়ির ঘাম মুছতে মুছতে বৃদ্ধ চোখ মাঝে মাঝে তাকায় সূর্যপানে। উত্তরবাংলার এ গ্রামটি কাঠফাটা চৈত্রে বিস্তৃত মাঠ আর শুকনো জলাধার নিয়ে মূর্ত মরু। বাতাসের ধূলি সস্তা বিড়ির গন্ধ নিয়ে বটের গোড়ায় পাতা হাতলবিহীন চেয়ারে বসা রমিজ মাতব্বরের চোখে মুখে ঢুকে পড়লে সে থুথু ফেলে হাঁক ছাড়ে। কথা কও না ক্যান মিয়া রা?হাঙ্গাদিন রইদে পুড়ুম নাহি? রমিজ মাতব্বরের পাশে আরো দুইখান চেয়ার।

ওগুলোর ও কোন হাতল নেই। ডানে গ্রামের ভাঙ্গাচোরা প্রাইমারি ইস্কুলের ছায়েদ মাষ্টার আর বামে সকালের মক্তবের লালচোখ হুজুর আর পান্জেগানা মসজিদের তাহের ইমাম। ছায়েদ মাষ্টারের খুকখুক কেশে বোধহয় গরম গিলে নেয়। ঘটনা টা দেখছে কেডায়? সামনের চারকোণা ভীড়ে গুন্জন বাড়ে। চোখগুলো পরস্পর কানাকানি করে।

ডানপাশ থেকে উঠে দাঁড়ায় আবুল। সবগুলো চোখ গ্রামের বাইরে বিস্তৃত মাঠে বর্গাচাষি চৈত্ররোদ পোড়া আবুলের কালো মুখ ছুঁয়ে স্থির হয় বটের শিকড়ে। ওখানে হাঁপানির টানে কুঁজো হয়ে কাঁপছে কফিল। সে ও একবার বসে যাওয়া চোখ মেলে দেখে আবুলের কালো মুখ। তারপর পাশে বসা স্ত্রীর কানের কাছাকাছি ফিসফিস করে।

বউ,ভয় পাইস না। বাঁচনের লাইগা করছি। অন্যায় হবি ক্যান? প্রত্যুত্তরে তিনমাসের ছেলে টাকে বুকে চেপে ধরে ফুঁপিয়ে উঠে কফিলের বৌ। রমিজ মাতব্বর খ্যাক করে উঠে। ঐ কুত্তার জন্ম।

কান্দস কি জন্যি?পাপ করণের সময় মনে ছিলো না? ইমাম সাহেব কিছু বলেন না। নিশ্চুপ সামনের ঘর্মাক্ত ভীড় ও। ছায়েদ মাষ্টার বিরক্ত হয়। আবুল চুপ কইরা আছস ক্যান?যা দেখছোস ক। আবুল কাশে।

কফিলের কাঁপন দেখে। বৌ টার ঘোমটা দেখে। আবুলের হয়ত খারাপ লাগে। কফিলের সাথে বাজারের লাল চা কিংবা মাঝে মাঝে বৌ টার আলুভর্তা ভাতের কথা মনে পড়ে। আবুল হয়ত চুপ থাকতে চায়।

কিন্তু রমিজ মাতব্বরের লাল চোখের ধমক তার দৃষ্টি ফিরিয়ে আনে। তারপর আরো গনগনে হয়ে উঠা বাতাসে কাঁপা কাঁপা শব্দগুলো ছড়াতে থাকে। ঘটনা টা সে নিজ চোখেই দেখেছে। গতকাল দুপুরে যখন সূর্য মাথার উপর আগুন ধরিয়ে দিচ্ছিলো আর চড়চড় করে ফেটে যাচ্ছিলো বিস্তৃত পোড়া মাঠ। মাঠের পরে দূরে আরেক টা গ্রাম।

সেখান থেকে ফিরছিলো কফিল। একহাতে ছেলেটা আরেক হাতে কাপড়ের পুঁটলি নিয়ে পেছনে কফিলের বৌ। ঐ গ্রামে বৌ টার বাপের বাড়ি। কফিল আর তার বৌ ফিরছে ও বাড়ি থেকেই। বাতাসের ধুলা আর মাথায় আগুন কফিলের হাঁপানির টান বাড়ায়।

পায়ের তলায় টগবগ ফুটছে তপ্ত জমিন। ছাপা শাড়ি আর পুরানো সায়া ব্লাউজের ভেতর দরদর ঘামতে ঘামতে বৌ টা কফিলের হাঁপানি অনুসরণ করে। পা কমে আসে তার। পাল্লা দিয়ে বাড়ে টান। তারপর হঠাৎ জমিনের আলে লুটিয়ে পড়ে কফিল।

বুক ধক করে উঠে বৌ টার। আগুন জমিনে ছেলে টা কে রেখে তুলে ধরে স্বামীর মাথা। দরদর ঘাম ঝরছে জুলফি আর খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি বেয়ে। কি করবে বুঝতে পারে না বৌ। হঠাৎ ঠোঁট নড়ে কফিলের।

বাতাস টানে। বাতাসের সাথে ধুলা ঢুকে। খকখক কাশে। ফিসফিস করে,পানি। বৌ বুঝতে পারে না।

বুঝতে পারে না গামছা দিয়ে বাতাস করতে থাকা আবুল ও। কফিল আবার বাতাস টানে। আবার ফিসফিস করে,পানি। পানি। দুই জোড়া চোখ চারপাশে তাকায়।

মাঠের দুপাশে দুটো গ্রাম। আগুন রোদে ঝাপসা দেখায়। অনেক দুর। আবুল দৌড়ায়। পানির জগ খালি।

আবার দৌড়ায়। মাঠের মাঝখানে কাটা নালা খটখটে শুকনো। কয়েকটা আগাছা গুল্ম কফিলের মতই যেন হাঁপাচ্ছে। তারপর সে দৌড়ে ফিরে আসে যেখানে কফিলের পাশে তার বৌ টা উপুড় হয়ে আছে। আবুল থমকায়।

নিজের চোখ কে বিশ্বাস হয় না। চোখ কচলায় সে। না। ঠিকই দেখছে সে। মাথা ঘুরে উঠে তার।

আবুলের দূরভাবনায় আসে না এটা। কখনো শুনে নি কোথাও। অথচ আগুন রোদের এই সূর্যের তলে আজ সে দেখছে তা। আবুল প্রথমে ভেবেছিলো,বৌ টা বুঝি নিজের ছায়া দিয়ে কফিলকে আড়াল করছে সূর্যের কাছে। কিন্তু আবুলের রেটিনায় অন্য বিম্ব সৃষ্টি হয়।

বৌ টার চোখে জল আর ব্লাউজ খুলে তিন মাসের ছেলের চোষনে পরিস্ফুটিত স্তন চেপে চেপে পানি দিচ্ছে কফিলের মুখের ভেতর। সংস্কারপূর্ণ আবুলের অর্ধমৃত মস্তিষ্ক তপ্ত হয়ে উঠে চৈত্রের মাঠের চেয়ে বেশি। কাঁপতে কাঁপতে বলে,ভাবী কি করতাছো?পাপ হইব যে! বৌ টা তাকায়। তখনো চোখের কোণায় জলবিন্দু। কিন্তু দৃষ্টি স্থির।

বলে,পানি না খাওয়াইলে উনার দম আটকায়া যাইত। আমি ছাওয়াল টারে নিয়া কই যাইতাম? চৈত্রের ফাটা মাঠের বুকে এই ঘটনা চাপা পড়ে যেতে পারত। কিন্তু আবুলের কম্পন সেদিন সন্ধ্যায় ও থামে নি বলে গ্রামের লোক দের কানে কানে পৌঁছাতে দেরি হয় নি। রমিজ মাতব্বর কিংবা ছায়েদ মাষ্টার কিংবা তাহের ইমামের কান ও বাকি থাকে না। আবুলের সাক্ষ্য শেষে ইমাম সাহেব চেঁচিয়ে উঠেন।

নাউজুবিল্লা। স্ত্রীর দুধপান। কোরান হাদীস এটারে কয় গুনাহ। কবীরা গুনাহ। খোদার গজব পড়ব এ গেরামে! অদৃশ্য আশু গজবের ভয়ে ভীড়ে কাঁপন বাড়ে।

গুন্জন বাড়ে। কফিলের ছেলে টা একটু কেঁদে উঠে। ফোঁপানি বাড়ে বৌ টার। কফিল আবার ফিসফিস করে,ভয় পাইস না। জান বাঁচাইছোস তুই।

পাপ হবি ক্যান! কিন্তু পাপ হয়। সামাজিক ঈশ্বরের কাছে পাপ। প্রাকৃতিক ঈশ্বরের শাস্তি দেরি হলে ও সামাজিক ঈশ্বরের দেরি হয় না। এ ঈশ্বরের সামনে মিইয়ে থাকে সারা জমায়েত। এমন কি স্ত্রীর কানের কাছে কফিলের সাহসি স্বর ও! সামাজিক ঈশ্বরের আদেশে দুটো থাপ্পড় হজম করে কফিল বৌ কে তালাক দেয়।

কিন্তু বৌ টা কাঁদে না। এমন কি ছেলে টা ও না। সস্তা ব্লেডে দুটো মাথা ন্যাড়া করা হয়। তবু ও বৌ টা কাঁদে না আর। শুধু কফিলের হাঁপানির টান বাড়ে।

শাস্তি শেষ হয় না। কাঁচা বাঁশের কঞ্চির পঞ্চাশ পঞ্চাশ বেত বরাদ্দ হয়। মাথার উপর সূর্যের তেজ আরো বাড়ে। মনে হয় আজ সব পুড়ে যাবে। দরদর ঘামতে ঘামতে ভীড়ে নির্জনতা বাড়ে।

কেউ কেউ নিঃশ্বাস ও চাপে হয়ত! কফিল মাটি তে লুটিয়ে পড়ে। পিঠ বেয়ে রক্ত ঝরে। ফিসফিস করে সে। পানি.. কফিলের ফিসফিসানি বৌটার কানে যায় না। ব্লাউজ ছিঁড়ে বুকের কিছু অংশ উদোম পড়ে থাকে।

সেখানে চোখ রেখে রমিজ মাতব্বর হয়ত কফিলের মত পানির তৃষ্ণায় ভুগে। কিংবা ছায়েদ মাষ্টার কফিলের ভিটা টার দৈর্ঘ্য প্রস্থ মাপে কিংবা তাহের ইমাম তসবিহ গুনতে গুনতে মসজিদের টাকা মেরে দেয়ার দায় হতে অব্যাহতি খোঁজে। হঠাৎ রমিজ মাতব্বরের তৃষ্ণা চুকিয়ে কিংবা ছায়েদ মাষ্টারের পরিমাপ আর তাহের ইমামের দায়মুক্তি স্থগিত করে তীব্র শব্দে কেঁদে উঠে কফিলের তিন মাসের ছেলে টা। ======================================= কৃতজ্ঞতা: জন স্টেইনবেকের নিষিদ্ধ উপন্যাস 'দ্য গ্রেপস অব র‌্যাথ'।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।