উতঙ্কের উপাখ্যানঃ
উতঙ্ক তৃতীয় শিষ্য। ইনিও গুরু গৃহে থেকেই শিক্ষাগ্রহণ করতেন।
একদিন গুরুকে যজ্ঞের কারণে বাইরে যেতে হলে তিনি উতঙ্ককে বললেন –গৃহে থাকবে এবং দেখবে কিছু যেন নষ্ট না হয়।
এই বলে তিনি যজ্ঞ করতে চলে গেলেন।
একদিন গুরু পত্নী উতঙ্ককে ডেকে বললেন –তোমার হাতে স্বামী গৃহের সব অর্পণ করে গেছেন এবং লক্ষ রাখতে বলেছেন যেন কিছু নষ্ট না হয়।
আমি ঋতুমতী হয়েছি, তা যেন নষ্ট না হয় তা দেখার দায়িত্বও তোমার। তুমি আমায় গ্রহণ কর।
সব শুনে উতঙ্ক চমকে উঠলেন, বিস্মিতও হলেন। ভেবে ভেবে তিনি আতঙ্কিত হলেন। কারণ গুরু গৃহের কিছু যেন নষ্ট না হয় তা দেখতে বলেছেন।
কিন্তু ঋতু রক্ষা তিনি করতে পারেন না। একে পরের স্ত্রী, তার উপর গুরু পত্নী – মহাপাপ।
তিনি গুরু পত্নীকে বুঝালেন –গুরু পিতার সমান এবং তার স্ত্রী মায়ের মত।
এর কিছুদিন পর গুরু গৃহে ফিরলেন। গুরু পত্নীর মনে উতঙ্কের উপর রাগ ছিল।
তিনি স্বামীকে বললেন উতঙ্ক যখন গুরুদক্ষিণা দিতে চাইবে তখন যেন তাকেও বলা হয়।
পরে গুরু ধিরে ধিরে সকল ঘটনা জানতে পারলেন এবং উতঙ্কের উপর খুশি হয়ে তাকে আশির্বাদ করে বললেন –তুমি সর্ব শাস্ত্রে পারদর্শি হবে। শুনে শিষ্য যোড়হাতে গুরুকে দক্ষিণা দিতে চাইলেন।
গুরু বললেন –আমি তোমার কাছে কিছু চাই না। তবে গুরুদক্ষিণা দিতেই হলে আমার স্ত্রী যা চান তাই তাকে দিও।
শিষ্য গুরুপত্নীর সামনে গিয়ে যোড়হাতে দাড়ালেন।
গুরু পত্নী অনেক ভেবেচিন্তে বললেন তিনি পৌষ্যরাজের মহিষীর শ্রবণ কুন্ডল অর্থাৎ কানের দুল চান। সাতদিনের মধ্যে এনে দিতে না পারলে তিনি উতঙ্ককে শাপ দেবেন।
উতঙ্ক গুরুকে সব বললেন। গুরু তাকে আশির্বাদ দিলেন।
গুরুর আশির্বাদ নিয়ে শিষ্য যাত্রা শুরু করলেন। পথে তার এক বৃষভ অর্থাৎ ষাঁড়ের সাথে দেখা হল। সে পুরীষ বা মল ত্যাগ করে দাড়িয়ে ছিল। সে উতঙ্ককে ডেকে সেই গোবর খেতে বললো, এতে তার ভাল হবে। উতঙ্ক খেতে না চাইলে বৃষ তাকে গুরুর দিব্যি দিল।
বাধ্য হয়ে উতঙ্ককে সেই মল খেতে হল।
সেখান থেকে উতঙ্ক পৌষ্যরাজার গৃহের অভিমুখে গমন করলেন। পৌষ্যরাজার কাছে কুন্ডলের আবেদন করলে তিনি উতঙ্ককে রাণির কাছে পাঠালেন। রাণী কান থেকে দুই কুন্ডল উতঙ্কের হাতে দিলেন।
কুন্ডল পেয়ে উতঙ্ক গুরুগৃহে যাত্রা শুরু করলেন।
সঙ্গে সঙ্গে তক্ষকও তাকে অনুসরণ করল। ব্রাহ্মণকে ছোঁয়ার শক্তি তার নেই, তাই সন্ন্যাসীর ছদ্মবেশে তার পিছু পিছু চলতে লাগলো।
উতঙ্ক অনেক পথ চলার পর এক সরোবর দেখে সেখানে স্নান করতে নামলেন। ঘাটে রাখা বস্ত্রের মধ্যে থেকে তক্ষক কুন্ডল দুটি চুরি করলো। উতঙ্ক জলের মধ্যে থেকে দেখলেন সন্ন্যাসী কুন্ডল নিয়ে একটি গর্তে প্রবেশ করছেন।
উতঙ্ক তাড়াতাড়ি উঠে এসে গর্তে হাত ঢোকাতে যায়, কিন্তু আঙ্গুলও ঢোকে না। বিষণ্ণ মনে তিনি নখ দিয়ে গর্ত খুড়তে শুরু করলেন।
এই ঘটনার কথা ইন্দ্র জানতে পেরে দুঃখিত হলেন এবং তখনই নিজের বজ্রের সাহায্যে ছিদ্র এত বড় করলেন যে সে পথে উতঙ্ক পাতালে চলে গেলেন। সেখান থেকে তিনি অনেক কিছু দেখলেন-চন্দ্র, সূর্য, তারাদের যাতায়াতের পথ, মাস, বছর এবং ছয় ঋতুর সদন।
কিন্তু অনেক খুঁজেও সেই সন্ন্যাসীর দেখা পেলেন না।
উতঙ্ক চিন্তিত হলেন।
তখন অশ্বরূপী অগ্নি তাকে বললেন -আমায় গুরুজ্ঞানে বিশ্বাস কর। আমি তোমায় আজ্ঞা করছি আমার গুহ্যে অর্থাৎ মলদ্বারে বাতাস কর।
গুরুর নাম শুনে উতঙ্ক দেরি না করে কিছু না পেয়ে মুখ দিয়েই মলদ্বারে বাতাস করলেন।
গুহ্যে ফুঁক দিতেই মুখ দিয়ে ধোঁয়া বের হল যা নাগলোকে অন্ধকার ডেকে আনল।
সকল নাগ এত ধোঁয়ায় অবাক হল।
বাসুকি চরের মাধ্যমে তক্ষকের সব বৃত্তান্ত শুনে রেগে গেলেন। তাকে ডেকে পাঠান হল। তক্ষক এলে তাকে সকলে মিলে শাসন করল এবং ব্রাহ্মণকে কুন্ডল ফিরিয়ে দিতে বললো।
কুন্ডল ফিরে পেয়ে উতঙ্ক খুশি মনে অশ্বের কাছে ফিরে গেলেন।
অশ্ব পিঠে করে তাকে সপ্তমদিন গুরুগৃহে নিয়ে এলো।
গুরুগৃহে ফিরে উতঙ্ক দেখলেন গুরুপত্নী জল হাতে দাঁড়িয়ে আছেন শাপ দেওয়ার জন্য। তিনি মুখ দিয়ে যে মুহূর্তে শাপ নির্গত করছিলেন সেই মুহূর্তে উতঙ্ক কুন্ডল দুটি তার হাতে দিলেন। কুন্ডল পেয়ে গুরুপত্নী সন্তুষ্ট হলেন।
গুরুকে উতঙ্ক পথের সকল ঘটনা জানালেন।
গুরু বললেন গোবর যে বৃষ খাওয়ালেন, তিনি আসলে ইন্দ্র-তিনি তোমায় অমৃত খাওয়ালেন। সন্ন্যাসীর বেশে যেই তক্ষক কুন্ডল চুরি করে গর্তে ঢুকলো, তখনই তার ভাগ্য রসাতলে গেল। অশ্বরূপে যিনি তোমায় সাহায্য করলেন তিনি আমার পরম প্রিয় অগ্নি।
এতশুনে উতঙ্কের মনে সাপেদের উপর রাগ হল। কারণ তারা বিনা দোষে তাকে এত কষ্ট দিল।
তিনি ঠিক করলেন সাপদের উচিত শিক্ষা দিতে হবে। এরপর তিনি গুরুকে প্রণাম করে রাজা জন্মেজয়ের কাছে গেলেন।
উতঙ্ক রাজাকে বললেন –রাজা, তুমি পিতার শত্রুদের যতক্ষণ না শাসন করবে ততক্ষণ তোমার পুত্র ঋণ শোধ হবে না। চন্ডাল তক্ষক তোমার পিতাকে দংশন করে, একথা সংসারে সবাই জানে। তোমার উচিত প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য নাগকুলের বিনাশ ঘটান।
উতঙ্কের কথায় রাজা জন্মেজয় বিস্মিত হয়ে মন্ত্রীদের কাছে সত্য ঘটনা জানতে চাইলেন। জন্মেজয় জানতেন ব্রহ্মশাপে পিতার মৃত্যু হয়। তক্ষকের দংশনের কারণ তিনি মন্ত্রীদের কাছ থেকে জানলেন।
..........................................
উৎসর্গ: সকল ব্লগার বন্ধুকে
..........................................
আগের পর্ব:
কথাচ্ছলে মহাভারত - ১৫
Click This Link
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।