আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কথাচ্ছলে মহাভারত- ১


[ কিছু কথাঃ দাদু মারা যাওয়ার পর আমি দাদুর অনেক বই থেকে একটি বই পাই ‘কাশীদাসী মহাভারত’- খুব উৎসাহ নিয়ে খুলে বসি এবং কবিতা দেখে একটু থমকালেও পড়তে থাকি, খুব ভাল লাগে। ভাইবোনরা উৎসুক হয়ে দেখতে এসে সরে পরে। তখন ঠিক করি যদি গল্পগুলো সরল গদ্যে করা যায়, কেমন হয়! অনেক উৎসাহ নিয়ে শুরুও করি। পরে খাতাটি যদিও হাত বদল হয়ে থাকে অনেকদিন! এখন উদ্ধার করে আপনাদের সাথে শেয়ার করছি। ] সৌতের প্রতি শৌনকাদি ঋষিগণের প্রশ্ন-জিজ্ঞাসা: "নারায়ণং নমস্কৃত্য নরঞ্চৈব নরোত্তমম্‌।

দেবীং সরস্বতীঞ্চৈব ততো জয়মুদীরয়েৎ। । " -নারায়ণ, নরোত্তম নর(ঋষি) ও দেবী সরস্বতীকে নমস্কার করে তারপর পুরাণ-মহাভারত আখ্যান পাঠ করবেন। কুলপতি মহর্ষি শৌনকমুনি নৈমিষারণ্যে বারোবছর ধরে একমনে তপোবনে যজ্ঞ করছিলেন। এসময় লোমহর্ষেণের পুত্র পুরাণকথক সৌতি-যিনি ব্যাসদেবের উপদেশে সর্বশাস্ত্রে দক্ষতা অর্জন করেন-ঘুরতে ঘুরতে সেখানে উপস্থিত হলেন।

তিনি মুনিদের আশীর্বাদ নিলেন। মুনিরা বসতে অনুরোধ করে যানতে চাইলেন তিনি কোথা থেকে আসছেন, কোথায় এতদিন ছিলেন। তখন সৌতি সবিনয়ে জানালেন যে – পরীক্ষিতের পুত্র জন্মেজয় সর্প বিনাশের জন্য যে যজ্ঞ শুরু করেন সেখানে মুনি শ্রেষ্ঠ বৈশম্পায়ন ব্যাস-রচিত কাব্য তাদের শোনান। মুনিরা যদি আজ্ঞা করেন তবে তিনি সেই কথা তাদের শোনাতে পারেন। মহাভারত রচনার পর ব্যাসদেব ভাবছিলেন কোন উপায়ে এই ইতিহাস শিষ্যদের পড়াবেন! তখন ব্রহ্মা তাঁর কাছে এসে বলেন- তুমি গণেশের স্মরণ নাও।

তিনি তোমার গ্রন্থের লিপিকার হবেন। ব্যাস গণেশকে অনুরোধ করলে তিনি সম্মত হন, তবে একটি শর্তে-যে তার লেখনী কোন সময়ই থামবে না। ব্যাস মনে মনে ভাবলেন তার রচনায় আটহাজার আটশ জটিল শ্লোক আছে। যার অর্থ কেবল তিনি ও তার পুত্র শুক জানেন। তাই তিনি গণেশের শর্ত মেনে বললেন- আমি যা বলে যাব আপনি তার অর্থ না বুঝে লিখতে পারবেন না।

গণেশ বললেন- তাই হবে। গণেশ সর্বজ্ঞ হলেও এইসব কূটশ্লোক লেখার সময় তাকেও ভাবতে হত। সেই অবসরে ব্যাস অন্য শ্লোক রচনা করতেন। মহাভারত রচনাঃ কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস বলছেন এবং গনেশ তা লিপিবদ্ধ করছেন মুনিরা বললেন সৌতির কাকাও সুত্রধর ছিলেন তার কাছেও অনেক কাহিনী শুনেছেন। সৌতিও যদি ভৃগুবংশের উৎপত্তি কি ভাবে হল তা জানান তবে তারা সুখি হবেন।

সৌতি তখন ভৃগু বংশের কথা বলতে শুরু করলেন। ব্রহ্মার পুত্র ভৃগু পুলোমাকে বিবাহ করেন। একদিন গর্ভবতী পুলোমাকে রেখে ভৃগু স্নানে গেলে হঠাৎ সেখানে একজন দৈত্য এসে পুলোমাকে হরণ করতে চাইল। পুলোমা তাকে ফলমূল দিতে গেলে কামে পীড়িত দানব তা নিল না। সে কুটীতে ঢুকে অগ্নিকে দেখতে পেল।

দানব অগ্নিকে বলল পুলোমার পিতা প্রথমে পাত্র হিসাবে এই দানবকে নির্বাচন করলেও পরে ভৃগুর সঙ্গে তার বিবাহ দেন। ভৃগুও এর কোন বিচার না করে কন্যাকে বিবাহ করেন। এতদিন পরে সে এসেছে তার অধিকার নিয়ে, অগ্নিই বলে দিন তার কি কর্তব্য। অগ্নি সব শুনে ভয় পেলেন। তিনি অনেক ভেবে বললেন দৈত্যই পূর্বে কন্যাকে বরণ করে কিন্তু বিধি মতে বিবাহ হয় ভৃগুর সঙ্গে, তিনি তার সাক্ষী।

তবু, ন্যায় মতে পুলোমা দৈত্যেরই ঘরনী। অগ্নির কথা শুনে দৈত্য শুকরের ছদ্মবেশে কন্যাকে হরণ করল। রাক্ষসের এই অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে পুলোমার গর্ভের পুত্র প্রবল তেজে বাহির হয়ে দৈত্যকে ভষ্ম করে দিলেন। এই পুত্রই পরে চ্যবনমুনি নামে বিখ্যাত হন। পুলোমা কাঁদতে কাঁদতে শিশুকে কোলে নিয়ে আশ্রমে ফিরলেন।

সেই সময় ব্রহ্মা সেখানে উপস্থিত হলেন। পুলোমার ক্রন্দন নিবারণের বহু চেষ্টা করলেন, কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার পুলোমা এত কাঁদলেন যে, একটি নদীর সৃষ্টি হল। ব্রহ্মা তার নাম রাখলেন- বধূসরা নদী। ব্রহ্মা চলে গেলেন, পুলোমাও শিশুকে নিয়ে আশ্রমে প্রবেশ করলেন। সেই সময় ভৃগু স্নান করে গৃহে ফিরলেন।

পুলোমার বিরস বদন দেখে তাঁর কারণ জিজ্ঞাসা করলেন। স্বামীকে দেখে পুলোমা আবার কেঁদে ফেললেন এবং সমস্ত ঘটনা বলে অগ্নির উপর সব দোষ দিলেন। ভৃগু সব শুনে ক্রোধে অগ্নিকে অভিশাপ দিলেন,“সর্ব ভক্ষ হও"”। ভয়ে অগ্নি বললেন তিনি যা জানতেন তাই বলেছেন এর জন্য মুনি কেন তাকে শাপ দিলেন! জেনেশুনে মিথ্যা কথা বললে তার নরক গমন হত। অগ্নি সকল দেবতাকে নিয়ে ব্রহ্মার কাছে গেলেন।

ব্রহ্মা সব শুনে অগ্নিকে আশির্বাদ করলেন,“সকল হইবে শুদ্ধ তোমার পরশে" । ব্রহ্মার আশির্বাদে অগ্নি খুশি হয়ে পুনরায় পৃথিবীতে এসে বসবাস শুরু করলেন। ........................ রুরুর সর্প-হিংসা: সৌতি তারপর বললেন - এরপর ভৃগুপুত্র হন চ্যবন, তাঁর পুত্র প্রমতি এবং প্রমতির পুত্র হলেন রুরু। রুরু মেনকার কন্যা প্রমদ্বরাকে বিবাহ করেন। রুরু তার পত্নীকে খুবই ভালবাসতেন।

একদিন সাপের কামড়ে প্রমদ্বরার মৃত্যু হল। রুরু দুঃখে বনে বনে কেঁদে বেড়াতে লাগলেন। তাকে কেঁদে বেড়াতে দেখে দেবতারা এক দেবদূতকে কারণ জেনে আসতে বললেন। দূত মর্তে এসে রুরুকে অনেক সান্তনা দিলেন। তবু রুরু স্ত্রীর জন্য বিলাপ করলে দূত বললেন একটি উপায় আছে, যদি রুরু তার অর্ধেক আয়ু প্রমদ্বরাকে দেন তবে সে বেঁচে উঠতে পারে।

রুরু অর্ধেক আয়ু দিতে সম্মত হলে প্রমদ্বরা পূর্ণ জীবন লাভ করলেন। স্ত্রী বেঁচে উঠলে রুরু প্রতিজ্ঞা করলেন, যত সাপ দেখবেন তাদেরকে হত্যা করবেন। এক হাতে দন্ড নিয়ে তিনি বনে বনে ঘুরতে লাগলেন এবং প্রচুর সাপ মারলেন। এভাবে বনে ঘুরতে ঘুরতে রুরু একদিন এক ভয়ংকর সাপের দেখা পেলেন। তাকে মারতে উদ্যত হলে সাপটি বলে উঠল-সে নিরিহ প্রাণী, তাকে যেন রুরু না মারেন।

রুরু তাঁর পরিচয় জানতে চাইলেন। সাপটি জানাল তাঁর নাম-ডুন্ডুভ। ডুন্ডুভ জানালেন তিনি মুনিকুমার ছিলেন। খগম নামে তার এক বন্ধু ছিল। তিনি তালপাতার সাপ তৈরী করে বন্ধুকে ভয় দেখান।

খগম ভয় পেয়ে অজ্ঞান হয়ে যান। জ্ঞান ফিরলে তিনি ডুন্ডুভকে শাপ দেন যে, ডুন্ডুভ হীনবীর্য সাপ হয়ে বনে থাকবেন। পরে করুনা করে বলেন-রুরুর সঙ্গে দেখা হলে তিনি মুক্ত হবেন। ডুন্ডুভ রুরুকে বলেন ভৃগুবংশে জন্মে রুরু ক্ষত্রিয়ের মত কাজ কেন করছেন! ব্রাহ্মণের এটা কাজ নয়- তাকেই দেখুক! সামান্য কারণে তার কি দূর্গতি! রুরুকে তিনি উপদেশ দিলেন ‘অহিংসা পরম ধর্ম’ পালন করতে এবং ভয়ার্ত জনকে রক্ষা করতে। পূর্বে রাজা জন্মেজয় সর্প যজ্ঞ করেছিলেন।

তবু ব্রাহ্মণের দয়ায় তখন সাপেরা বেঁচে যায়। আস্তিক নামে জরৎকারুর পুত্র এদের বাঁচান। এত শুনে রুরু জন্মেজয় ও আস্তিকের কাহিনী শুনতে চাইলেন। ডুন্ডুভ তখন বললেন যেকোন মুনিকেই এ সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করলেই তারা বলে দেবেন। এখন তিনি যাবার জন্য আজ্ঞা চান।

এত কথা বলতে বলতেই ডুন্ডুভ সাপ অপরুপ মানব মূর্তি ধারন করে অন্তর্ধান হলেন। রুরু পুনরায় আশ্রমে ফিরে এলেন এবং পিতা প্রমতির কাছে আস্তিকের উপাখ্যান শুনতে চাইলেন। ....................... উৎসর্গ: সকল ব্লগার বন্ধুকে ....................... পাদটীকাঃ সৌতি = এঁর প্রকৃত নাম উগ্রশ্রবা, জাতিতে সূত এজন্য উপাধি সৌতি। সূতজাতির কাজ ছিল সারথ্য ও পুরাণাদি কথন। শৈনকাদি = শৈনকমুনি এবং অন্যান্য।


 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।