কম্বোডিয়ায় ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৯ চার বছরের গণহত্যা আর নির্যাতনে ২০ লক্ষ মানুষ হত্যা করেছিলো খেমর-রুজ বাহিনী। বুর্জোয়া, সিআইএ'র এজেন্ট ইত্যাদি অভিযোগের ধুয়া তুলে খেমাররুজ গেরিলা বাহিনী ধরে নিয়ে যেতো নমপেনের আবাল-বৃদ্ধ-বনিতাকে। তারপর চলত নারকীয় নির্যাতন, ধর্ষন, অত্যাচার এবং হত্যা। এই নারকীয় খেমাররুজ বাহিনীর সবচেয়ে কুখ্যাত কমাণ্ডার কাইং গুয়েক ইয়াভকে (Duch) ৩০ বছর আগে কৃত অপরাধের জন্য ২০০৯ সালের ১৭ই ফেব্রুয়ারী বিচারের সম্মুখীন করা হয়। ১৬ মাসের বিচার প্রক্রিয়ার পর গতকাল (২৫-০৭-২০১০) কম্বোডিয়ার যুদ্ধাপরাধ আদালত খেমাররুজ নেতা ডুককে যুদ্ধাপরাধ, হত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতন, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধসহ বিভিন্ন অভিযোগ ৩৫ বছর সাজা দিয়েছে৷ কম্বোডিয়ার যুদ্ধাপারাধের এই বিচারটি বাংলাদেশের যুদ্ধাপারাধের বিচারে একটি গুরুত্বপূর্ণ নজির হিসেবে কাজে আসবে।
কম্বোডিয়ার যুদ্ধের ইতিহাস
১৯৫৩ সালে ফ্রান্সের কাছ থেকে স্বাধীনতা পাওয়ার পর কম্বোডিয়ার রাজা হলেন নরোদম সিহানুক। স্বাধীনতার পরপরই পলপটসহ অন্যদের তৎপরতায় কমিউনিষ্ট আন্দোলন দানা বাঁধছিল কম্বোডিয়ায়। এই আন্দোলনের পিছনে ভিয়েতনামের শ্রমজীবি শ্রেনির অগ্রনায়ক হো চি মিন-এর প্রত্যক্ষ ইন্ধন ছিল। প্রিন্স নরোদম সিহানুক ছিলেন সনাতনপন্থি। তিনি নির্মম উপায়ে কমিউনিষ্ট দমন করতে লাগলেন বটে - তবুও পলপটের নেতৃত্বে ষাটের দশকে কমিউনিষ্ট আন্দোলন আরও সক্রিয় হয়ে উঠতে থাকে কম্বোডিয়ায়।
ভিয়েতনামের কমিউনিষ্ট ভিয়েত কংরা তাকে বুদ্ধি পরামর্শ দিচ্ছিল। দুটি প্রতিবেশি দেশের অবস্থা তখন ভয়ানক জটিল। মার্কিন বিমান হামলা চলছিল ভিয়েতনামে; সীমান্ত পেরিয়ে এমন কী কম্বোডিয়াতেও বোমা বর্ষন করছিল মার্কিন বোমারু বিমানগুলি। কেননা, মার্কিন প্রশাসন ইন্দোচিনে কমিউনিষ্ট তৎপরাতার মূল শিকড় উপড়ে ফেলতে চায়! ১৯৬৭ সাল। পলপটের নেতৃত্বাধীন কম্বোডিও কমিউনিস্টরা একের পর এক সিহানুক নিয়ন্ত্রিত সরকারী বাহিনীকে আক্রমন করে করে পযুদর্স্ত করতে থাকে ।
প্রিন্স নরোদম সিহানুক ঠিক ঐ সময়টায় কম্বোডিয়ার কমিউনিষ্টদের নাম দিয়েছিলেন খেমার রুজ । অর্থাৎ, লাল খেমার। ৮ বছর গেরিলা যুদ্ধের পর ১৯৭৫ সালের এপ্রিল মাস সরকারী বাহিনীকে বিধস্ত করে লক্ষ লক্ষ খেমার রুজ গেরিলারা কম্বোডিয়ার রাজধানী নমপেনে প্রবেশ করে। ১৭ এপ্রিল খেমার রুজ গেরিলারা কম্বোডিয়ার শাসন ক্ষমতা দখল করে। খেমার রুজ গেরিলাদের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন পলপট।
খেমার রুজ গেরিলারা নমপেন দখল করার পলপট সরকার কম্বোডিয়ার নামকরণ করে “ডেমোক্রেটিক কাম্পূচিয়া”। তারপর নানাবিধ সংস্কারে নামে পলপট সরকার ভয়ঙ্কর এক হত্যাযজ্ঞে লিপ্ত হয়।
গনহত্যার কারণ
নমপেনবাসীর ওপর খেমার রুজ গেরিলাদের ছিল ভয়ঙ্কর ক্রোধ। খেমার রুজ গেরিলাদের চোখে নমপেনবাসী ছিল পাতি বুর্জোয়া: যারা সব সময় শস্তা ভোগ বিলাসে ডুবে থাকে, মদ খায়, নাইট ক্লাবে নাচে, যারা আমেরিকান কালচারে আসক্ত, দেশের প্রতি যাদের বিন্দুমাত্র টান নাই, যারা বিপ্লবে যোগ দেয়নি, যারা সব সময় কেবল আমেরিকার যাওয়ার ধান্দায় থাকে, গ্রামে যেতে চায় না, গ্রামের মানুষের দারিদ্র নিয়ে ভাবে না ইত্যাদি। খেমার রুজ গেরিলারা নমপেনবাসীর নাম দিয়েছিল: “মেকঙ নদীর বেশ্যা।
” কাজেই অস্ত্রের মুখে আমেরিকা-আসক্ত পাতি বুর্জোয়া নমপেনবাসী হাজার হাজার নারী-পুরুষ-শিশু এমনকি বৃদ্ধবৃদ্ধাকে হাঁটিয়ে নিয়ে যাওয়া হল গ্রামের দিকে। এপ্রিল-মে মাসের কড়া রোদ। তৃষ্ণা। ক্ষুধা। হাঁপাতে-হাঁপাতে পথেই মরল অনেকেই ।
যারা বেঁচে ছিল তাদের অনেকেই মারা গেল শ্রম শিবিরে। পালাবার কোন পথ নেই। চারিদিকে কারবাইন উঁচিয়ে খেমার রুজ গেরিলারা। সামান্য ত্রুটি-বিচ্যুতি হলেই গুলি। শুধু সাধারণ মানুষ নয়, পলপটেরই নির্দেশে লক্ষাধিক নিরীহ বৌদ্ধ ভিক্ষুকেও হত্যা করা হয়েছিল।
এককালের সুহৃদ ভিয়েতনামের সঙ্গে পলপটের সর্ম্পকের ফাটল ধরলে
১৯৭৮ সালে ভিয়েতনামী সৈন্যরা কম্বোডিয়ায় অনুপ্রবেশ করে। অনুপ্রবেশের অনেকগুলি কারণের মধ্যে পলপট সরকার কর্তৃক পরিচালিত অমানবিক গনহত্যা ছিল অন্যতম। ১৯৭৯ সালে অপ্রতিরোধ্য ভিয়েতনামী সৈন্যরা নমপেন দখল করার আগেই পলপটসহ খেমার রুজরা গেরিলারা পালিয়ে যায়। ভিয়েতনাম ছিল আমেরিকার শক্র। কাজেই, গনহত্যার অভিযোগ সত্ত্বেও আমেরিকা খেমার রুজ গেরিলাদের বিচার না করে বরং সাহায্যই করেছিল।
কম্বোডিয়ায় ১৯৯১ সাল পর্যন্ত ভিয়েতনামের আংশিক আগ্রাসন বলবৎ ছিল। গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চল ও বনে-জঙ্গলে পালিয়ে থাকা খেমাররুজরা ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত গেরিলা যুদ্ধ চালিয়েছিল। তবে, খেমার রুজ গেরিলাদের ওপর পলপট তার আধিপত্য দীর্ঘকাল বজায় রাখতে পারেনি। একদল খেমার রুজ গেরিলা বিদ্রোহ করে পলপটকে বন্দি করে। তার বিচার চলছিল।
বিচার করছিল খেমার রুজরাই। বিচার চলাকালীন সময়ে থাইকম্বোডিয়া সীমান্তের কাছে গহীন অরণ্যে একটি কাঠের বাড়িতে ১৯৯৮ সালের এপ্রিল মাসে পলপটের মৃত্যু হয়। পলপটের মৃত্যুর পর বাকী খেমাররুজ গেরিলারা আত্মসমর্থন করে। ১৯৯১ সালে প্যারিস শান্তি চুক্তির মাধ্যমে এবং পরবর্তীতে বিভিন্ন দলের আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে শাসনতান্ত্রিক রাজতন্ত্র, কোয়ালিশন সরকার ও বহুদলীয় গণতন্ত্রের মধ্য দিয়ে কম্বোডিয়ায় রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আসে। কম্বোডিয়ার যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে ট্রাইব্যুনাল গঠনের প্রস্তাব ও আলোচনা ১৯৯৭ সালে শুরু হলেও অফিসিয়ালী কার্যকর পদক্ষেপ শুরু হয় ২০০৬ সালে।
২০০৯ সালের ১৭ই ফেব্রুয়ারী কম্বোডিয়ার নমপেনে, কুখ্যাত কমরেড ডুককে দিয়েই শুরু হয়েছিল কম্বোডিয়ার যুদ্ধাপরাধীদের বিচার।
কম্বোডিয়ার যুদ্ধাপরাধের প্রথম রায় - বিভিন্ন পত্রিকার খবরের অংশবিশেষ (জুলাই ২৬, ২০১০)
কম্বোডিয়ায় জাতিসংঘ পরিচালিত যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল মানবতা-বিরোধী অপরাধ করায় এক খেমাররুজ নেতাকে ৩৫ বছর কারাদন্ড দিয়েছে। কারাদন্ডে দন্ডিত খেমাররুজ নেতার নাম কাইং গুয়েক ইভ। তিনি ডুক নামে সমধিক পরিচিত। তিনি খেমাররুজ শাসনামলের কারাগার প্রধান ছিলেন।
যুদ্ধাপরাধ আদালতের এই রায় গতকাল ছিল গোটা বিশ্বের অন্যতম আলোচিত খবর। ডুক খেমাররুজ শাসনামলে টুয়েল স্লেং কারাগার প্রধানের দায়িত্ব পালনকালে প্রায় ১৫ হাজার লোকের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। এছাড়া ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত খেমাররুজ শাসনামলে ২০ লাখেরও বেশি লোকের প্রাণহানির দায়ও ডুকের কাঁধে চাপে। ওই সময়কার মানবতাবিরোধী ও যুদ্ধাপরাধ সংঘটনের অভিযোগে তাকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। অনাহার ও অতিরিক্ত শ্রম চাপিয়ে দেয়ার কারণে মৃত্যু এবং বিভিন্ন অভিযোগে গণহারে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার কারণে এত বিপুল সংখ্যক লোক অকালে চিরবিদায় নেয়।
এসব গণহত্যায় নিজের অপরাধ স্বীকার করেছেন ডুক। তবে পুরোপুরি দায় নিতে চাননি৷ দাবি করেছেন, তিনি যা করেছেন, সব ওপরের নির্দেশেই৷ যদিও কম্বোডিয়ার জনগণ তা বিশ্বাস করেনি৷ আর জাতিসংঘের পৃষ্ঠপোষকতায় গঠিত আদালতও তা পুরোপুরি আমলে নেয়নি৷ তাই সাজা হয়েছে৷ আজ রায়ের সময় অবশ্য নিস্পৃহ দেখাচ্ছিলো ৬৭ বছর বয়সি খেমের রুজ কারাপ্রধানকে৷ আর নির্যাতিত অনেকেরই স্বজন ভেঙে পড়ে কান্নায়৷ তারা আদালতের রায়ে সন্তুষ্ট হতে পারেন নি। রায়ে অবশ্য বলা হয়েছে, অনুতাপ আর আদালতের কার্যক্রমে সহযোগিতা করায় ডুককে যাবজ্জীবন সাজা দেওয়া হয়নি৷
খেমাররুজ আমলের নিরাপত্তা কার্যক্রমের মূল কেন্দ ছিল ওই কারাগার। হাজার হাজার বন্দীকে এ কারাগারে নিয়ে আসা হত। পরে নিকটবতী ‘কিলিং ফিল্ড’ হিসেবে খ্যাত একটি ফলবাগানে নিয়ে তাদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হতো।
ডুকের বিচার কার্যক্রম প্রত্যক্ষ করতে নমপেনে স্থাপিত জাতিসংঘের বিশেষ আদালতে অসংখ্য কম্বোডিয়ান, সে সময়ে বেঁচে যাওয়া ব্যক্তি ও বৌদ্ধভিক্ষু ভিড় করেন। ডুককে ৩৫ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হলেও তাকে প্রকৃতপক্ষে ৩০ বছর সাজা খাটতে হবে। কারণ ৫ বছর তিনি বিনা বিচারে আটক ছিলেন। ১৯৯৯ সালে তাকে গ্রেফতার করা হয়। ক্যাম্বোডিয়ার যুদ্ধাপরাধ আদালতে এটাই প্রথম রায়৷ এই বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে পাঁচ বছর আগে৷ এতে ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় আট কোটি ডলার৷ যা বিদেশি বিভিন্ন দেশ ও সংস্থা থেকে অনুদান হিসেবে পাওয়া যাচ্ছে৷ প্রথম ধাপে ডুকসহ পাঁচজনের বিচার হচ্ছে পাঁচ বিচারক নিয়ে গঠিত আদালতে৷
খেমের নেতা ডুক শিক্ষক ছিলেন, স্কুলে গণিত পড়াতেন৷ শিক্ষক হিসেব তার সুনাম ছিলো৷ বলা হয়, ধীরস্থির প্রকৃতির দুক পরে হত্যার নির্দেশও দিতেন ঠাণ্ডা মাথায়৷ খেমের রুজ শাসন বসানের পর ডুক পালিয়ে যান৷ শোনা যায়, ৮০ এর দশকে রেডিও চায়নায় কাজ করছিলেন তিনি৷ কিছুদিন বিভিন্ন স্থানে শিক্ষকতাও করেন৷ এরপর এক যুগ আগে নাম ভাঁড়িয়ে দেশে ঢোকেন তিনি৷ খ্রিস্টান একটি দাতব্য সংস্থায় কাজ করছিলেন ডুক, কম্বোডিয়ার পশ্চিমাঞ্চলে৷ ১৯৯৯ সালে আইরিশ এক সাংবাদিক ডুকের পরিচয় ফাঁস করেন৷ এরপরই গ্রেপ্তার করা হয় তাকে৷ এখন তাকে ১৯ বছর জেল খাটতে হবে৷ তবে থিয়েরি সেং বলেন, ‘‘তার যে অপরাধ, তাতে অনেকবার যাবজ্জীবন সাজা দিলেও সাজা সম্পূর্ণ হয় না৷''
কম্বোডিয়ার যুদ্ধাপরাধ আদালতের রায় সারা বিশ্বের শান্তিপ্রিয় মানুষকে আশাবাদী করে তুলেছে।
সেইসাথে বিভিন্ন দেশের যুদ্ধাপরাধী ও মানবতার বিরুদ্ধে কৃতকার্যের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিচারের পথ সুগম ও সহজ করেছে। ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠাকল্পে মহামান্য আদালত ও বিচারকগন বিভিন্ন দেশের গুরুত্বপূর্ণ মামলাকে নজির হিসেবে গ্রহণ করেন। কম্বোডিয়ার যুদ্ধাপরাধ আদালতের এই রায় বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকে আরো সহজ ও ত্বরান্বিত করবে - আশা করি। কম্বোডিয়াবাসীকে এই বিচারের জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছিল ৩০ বছর। আমাদের অপেক্ষার সময় ৩৯ বছর পেরিয়ে গেছে! আর দেরি নয়, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাই।
তথ্যসূত্র:
১। কম্বোডিয়ার গনহত্যা: খেমার রুজ শাসনের এক বিভীষিকাময় অধ্যায়।
- ইমন জুবায়ের
২। সাবাশ কম্বোডিয়া!! বাংলাদেশেও শুরু হোক যুদ্ধাপরাধীদের বিচার
- জ্বিনের বাদশা
৩। ইত্তেফাক - জুলাই ২৭, ২০১০
৪।
ডয়চে ভেলে - ২৬-০৭-২০১০
৫। উইকিপিডিয়া
৬। https://bangla.amnesty.org
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।