কম্বোডিয়ার ধ্বংসলীলার তিরিশ বছর
দুঃসহ সেই স্মৃতি আজও দগদগে
বিমান নিচু দিয়ে উড়ছিল। মেকং নদীর ওপর দিয়ে। জায়গাটা ভিয়েতনামের পশ্চিমে। কম্বোডিয়ার ওপর দিয়ে যেতে গিয়ে অনুভব করছিলাম ওদেশের স্তব্ধতা। চারদিকে এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা।
কেউ কোথাও নেই। কোনও প্রাণের স্পন্দন নেই। নেই এমনকী কোনও প্রাণী। দেখে শুনে মনে হচ্ছিল এশিয়ার বিশাল জনসংখ্যা কম্বোডিয়ার সীমানায় এসে থমকে গেছে।
গ্রামের পর গ্রাম খালি।
চেয়ার, বিছানাপত্র, বাসনকোসন, মাদুর-চাটাই রাস্তার এখানে ওখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে। রাস্তার একপাশে একটা গাড়ি পড়ে আছে। পড়ে থাকা দুমড়ে মুচড়ে যাওয়া একটা বাইসাইকেল এর হতশ্রী চেহারা। বিদ্যুৎ সংযোগ ছিন্ন। ধানখেতে লম্বা লম্বা বুনো ঘাস গজিয়েছে।
এক সার দিয়ে। হাজার হাজার পুরুষ, নারী এবং শিশুর মৃত জৈবদেহাবশেষ থেকেই এই বুনো ঝোপজঙ্গলরা পেয়েছে বাঁচার রসদ, বড় হওয়ার সার। কম্বোডিয়ার গ্রামে সার দেওয়া একটা পর একটা কবর। সংখ্যায় হবে প্রায় ২০ লক্ষ। কম্বোডিয়া মানে এই বিশাল সংখ্যক মানুষের সমাধি।
কম্বোডিয়ার মোট জনসংখ্যার এক-চতুর্থাংশ ‘নিখোঁজ’।
১৯৪৫ সালে বেলসেন-এ নাৎসি মারণ ক্যাম্প মুক্ত হওয়ার পর ‘দ্য টাইমস’ পত্রিকার এক প্রতিবেদক লিখেছিলেন, ‘‘মানবকল্যাণের কল্পনার বাইরে কোনও কিছু বর্ণনা করা আমার কর্তব্য। ’’ ১৯৭৯ সালে কম্বোডিয়ায় পা রেখে আমারও ওই একই কথা মনে হচ্ছিল। ‘‘ইয়ার জিরো’’র সময় থেকে এ এমন এক দেশ বহির্বিশ্বের সঙ্গে যে রাষ্ট্রের যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।
১৯৭৫ সালের ১৭ই এপ্রিল সূর্যোদয়ের কিছু পরেই ‘ইয়ার জিরো’ বা ‘শূন্য বছর’ শুরু হয়েছিল।
পলপট-এর খমের রুজ গেরিলারা ঢুকে পড়ে রাজধানী নমপেন-এ। কালো পোশাক পরনে এই গেরিলার দল কম্বোডিয়ায় চওড়া রাস্তায় রীতিমতো দাপিয়ে বেড়িয়েছে। দুপুর একটার সময় শহর খালিকরে দিতে বলে গেরিলারা। বন্দুকের নলের সামনে হাসপাতালের বিছানা থেকে অসুস্থ, দুর্বল এবং আহতদের উঠে আসতে বাধ্য করা হয়। অনেক পরিবারের সদস্যরা অন্যের থেকে আলাদা হয়ে যান।
বৃদ্ধ এবং অক্ষমরা রাস্তার একপাশে পড়েছিলেন। কালো উর্দি পরনে গেরিলাদের কড়া হুকুম ‘‘সঙ্গে কিছু নিয়ে যেও না। আগামীকাল তোমরা ফিরে আসবে। ’’
সেই আগামীকাল আর কোনও দিনও আসেনি। দাস প্রথা শুরু হয়ে গিয়েছিল।
যাঁরা গাড়ির মালিক ছিলেন কিংবা বিলাসিতা করতেন; যাঁরা শহরে ছিলেন কিংবা আধুনিকতার চর্চা করতেন; যাঁরা বিদেশীদের জানতেন বা তাঁদের সঙ্গে কাজ করতেন তাঁরা প্রত্যেকেই বিপদের মুখে পড়েছিলেন। অনেকেরই মৃত্যুদণ্ড হয়েছিল। রয়াল কম্বোডিয়ান ব্যালে কোম্পানির পাঁচশ নৃত্যশিল্পীর মাত্র তিরিশ জন প্রাণে বেঁচেছিলেন। ডাক্তার, নার্স, ইঞ্জিনিয়ার, শিক্ষকরা না খেতে পেয়ে ধুঁকেছেন দিনের পর দিন। এভাবেই কেউ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছিলেন।
অনেককেই খুন করা হয়েছিল।
যখন আমি সেই নিঝুম শহরে প্রবেশ করছিলাম সারা শরীরে এক অদ্ভুত রুক্ষতা মনে হচ্ছিলো। নমপেন শহর আকারে ম্যান্চেস্টারের মতো। রাজধানীর রাজপথে হাঁটতে হাঁটতে আমার মনে হচ্ছিলো এ এমন এক শহর যেখানে পারমাণবিক বিপর্যয় ঘটে গেছে। নিষ্প্রাণ বহুতল ভবন ছাড়া এই বিপর্যয় কাউকে রেয়ত করেনি।
কোথাও বিদ্যুৎ নেই,পানীয় জল নেই। কোথাও দোকানপাট নেই,কোনওরকম পরিষেবাই নেই। রেলওয়ে স্টেশনে ট্রেনের শূন্য কামরাগুলো দাঁড়িয়ে আছে। ছড়ার কোনও বাঁধা সময় নেই। প্ল্যাটফর্মে এখানে ওখানে ছড়ানো কারও ব্যক্তিগত জিনিষপত্র, পোশাক পরিচ্ছদ।
দেখে মনে হচ্ছিলো এই জিনিসপত্রগুলোও গণকবরে শুয়ে আছে।
মোনিভং অ্যাভেনিউ ধরে আমি হাঁটছিলাম। গন্তব্য ন্যাশনাল লাইব্রেরি। গ্রন্থাগার আর গ্রন্থাগারের জায়গায় ছিল না। এর সমস্ত বই পুড়ে গিয়েছিলো।
দেখেশুনে আমার দুঃস্বপ্নের মতো লাগছিলো। গথিক রোমান ক্যাথলিক ক্যাথিড্রাল যেখানে মাথা উঁচুকরে দাঁড়িয়েছিলো তা পরিত্যক্ত জমিতে পরিণত হয়েছিলো। পাথরের পর পাথর ভেঙে জাওয়া ক্যাথিড্রালকে কার্যত আবর্জনার স্তূপই মনে হচ্ছিল। দুপুরের পর যখন বৃষ্টি নামলো পরিত্যক্ত রাস্তাঘাটগুলো দেখে মনে হচ্ছিলো টাকা দিয়ে ধোওয়া হচ্ছে। খমের রুজ গেরিলারা পালানোর সময় ব্যাঙ্ক অব কম্বোডিয়াকে বিস্ফোরক ব্যবহার করে গুঁড়িয়ে দিয়ে গিয়েছিলো।
প্রতিবার বৃষ্টির সময় ব্যাঙ্কের নতুন এবং অব্যবহৃত তাড়াতাড়া টাকার নোট নমপেন-এর রাস্তা ধুয়ে দিচ্ছিল।
ব্যাঙ্কের ভেতরে ঢুকতেই চোখ পড়লো কাউন্টারে। একটা চেকবুক খোলাই পড়েছিল কাউন্টারে। একটা খোলা লেজারের ওপর এক জোড়া গ্লাস। গোটা মেঝে জুড়ে গাদা গাদা কয়েন ছড়ানো।
পা হড়কে আমি মেঝের ওপর পড়ে গিয়েছিলাম।
প্রথম কয়েক ঘণ্টা বলতে গেলে এমনকী জনসংখ্যার বিষয়েও আমার কোনও ধারণাই ছিল না। কিছু মানুষজন যা চোখে পড়েছে দেখে অসংলগ্ন লেগেছে। একটা বাচ্চা ছেলে একটা আলমারির দিকে ছুটে গেলো দেখতে পেলাম। ওই আলমারিটাই বাচ্চাটার মাথা গোঁজার জায়গা।
ভাঙাচোরা স্টেশনে দেখা মিলল এক বৃদ্ধা মহিলা এবং তিনটে বাচ্চার। একটা পাত্রে শেকড় বাকড় পাতা মিশিয়ে গরমজলে ফোটাচ্ছিল ওরা। টাকা জ্বালিয়ে ওরা আগুন ধরিয়েছিল। কী পরিস্থিতি! যেখানে মানুষের সব কিছুই প্রয়োজন সেখানে মানুষ টাকা জ্বালিয়ে আগুন ধরাচ্ছে।
একটা প্রাথমিক স্কুলে গেলাম।
নাম তুওল স্লেং। এই স্কুলেই জেরা করা হতো। চলতো অকথ্য অত্যাচার এমনকী হত্যাও। লোহার খাটের নিচে আমি দেখতে পেলাম রক্ত আর গোছা গোছা চুল। দেখে শুনে মনে হচ্ছিল স্কুলের যে কোনও চিহ্নই বলছে ‘‘কথা বলা পুরোপুরি নিষিদ্ধ’’।
‘‘কোনও কিছু করার আগে ওয়ার্ডেন এর অনুমতি নিতেই হবে’’ একথাও বলা ছিল।
কিছু সময় পর বিকট আওয়াজ কানে এলো। এভাবেই কাটছিল কম্বোডিয়ার দিন এবং রাত। দুধ, ওষুধপত্র ছাড়া শিশুরা আমাশার মতো রোগে ভুগছিল। কম্বোডিয়ার সমাজের কঙ্কালসার চেহারাটই বেরিয়ে এসেছিল।
প্রথম সমীক্ষার ফলাফলে দেখা গিয়েছিলো অনেক মহিলা অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন।
কম্বোডিয়ার এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী পশ্চিমের দেশগুলো। কম্বোডিয়াকে একঘরে করে রাখা হয়েছিলো। কম্বোডিয়াকে মুক্তি দেয় ভিয়েতনাম। ১৯৭৫সালে নিজের দেশ থেকে আগ্রাসী আমেরিকাকে তাড়ায় ভিয়েতনাম।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিকসন এবং তাঁর জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হেনরি কিসিনজার এর নির্দেশেই কম্বোডিয়ায় বোমাবর্ষণ করেছিল আমেরিকা। সত্তরের দশকের গোড়ায় ভিয়েতনাম যুদ্ধকে কম্বোডিয়ায় ছড়িয়ে দিয়েছিল আমেরিকা। হাজার হাজার কৃষক মার্কিন বোমায় নিহত হন। মার্কিন রাষ্ট্রপতির এক ঘনিষ্ঠ শুনেছিলেন নিকসন কিসিনজারকে বলেছিলেন, ‘‘যদি এই গোপন বোমাবর্ষণ কাজ না করে তাহলে তা হবে তোমার গাধামি। ’’ পল পট-এর ক্ষমতা দখলের লক্ষ্যে এই পরিকল্পনা কাজে দিয়েছিল।
বোমাবর্ষণের পর যখন আমি কম্বোডিয়ায় এলাম কোনও পশ্চিমী ত্রাণ পৌঁছায়নি ওই দেশে। লন্ডনে নিজেদের বিদেশ দপ্তর বাঁচাতে মিথ্যে বলেছিল অক্সফ্যান। ভিয়েতনামীরা নাকি ত্রাণ আটকে দিয়েছিল। ১৯৭৯-এর সেপ্টেম্বর। লুক্সেমবার্গ থেকে প্রায় ৭০ হাজার শিশুর জন্য পেনিসিলিন, ভিটামিন, দুধ নিয়ে এক ডিসি-৮ জেট বিমান রওনা দিয়েছিল।
এই ত্রাণ গিয়েছিল ‘ডেলি মিরর’-এর পাঠকদের অর্থে। ‘ডেলি মিরর’-এর পাতায় আমার দুটো প্রতিবেদন এবং এরিক পাইপার-এর ছবি পাঠকদের নাড়া দিয়েছিল। ‘ডেলি মিরর’-এর ওই দুটো সংখ্যা ছিল ঐতিহাসিক। সংখ্যা দুটো সমস্ত বিক্রি হয়েছিল।
মিরর-এর পর ১৯৭৯-এর ৩০শে অক্টোবর আই টিভি সম্প্রচার করে আমার এবং প্রয়াত ডেভিড মনরোর তোলা তথ্যচিত্র।
নাম ‘ইয়ার জিরো : দ্য সাইলেন্ট ডেথ অব কম্বোডিয়া’। বার্মিংহামের এটিভি স্টুডিওয় চল্লিশ বস্তা চিঠি এসেছিল। প্রথম ক’দিনের মধ্যে ১০ লক্ষ পাউন্ড জমা পড়েছিল। ‘‘এটা কম্বোডিয়ার জন্য’’ লিখেছিলেন ব্রিস্টলের এক অনামী বাস চালক। সঙ্গে দিয়েছিলেন তাঁর এক সপ্তাহের উপার্জনের অর্থ।
এক বৃদ্ধা ভদ্রমহিলা তাঁর দু’মাসের পেনশন-এর অর্থ দিয়েছিলেন। এক অভিভাবক দিয়েছিলেন তাঁর জমানো অর্থের থেকে ৫০ পাউন্ড। ব্রিটিশ সমাজের সঙ্গে জড়িত শিষ্টতার চিহ্ন দেখা গিয়েছিল মানুষের আবেগের বহিঃপ্রকাশে। ব্রিটিশ নাগরিকরা অসংগঠিতভাবেই দিয়েছিলেন ২ কোটি পাউন্ডের বেশি। কম্বোডিয়ার স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ফিরিয়ে আনতে এই অর্থ কাজে লেগেছিল।
এই অর্থে নমপেন-এ পরিস্রুত জল সরবরাহ গড়ে তোলা হয়েছিল। হাসপাতাল এবং স্কুল তৈরি করা হয়। অনাথদের সাহায্য করা হয়। অত্যন্ত প্রয়োজনীয় এক কাপড়ের কারখানা ফের খোলা হয়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ব্রিটিশ সরকার কম্বোডিয়ায় অবরোধ জারি করেছিল।
এর বিরুদ্ধে অভূতপূর্ব জনবিক্ষোভ দেখা যায়। রাষ্ট্রসঙ্ঘে পলপট জমানাকেই সমর্থন চালিয়ে যাচ্ছিল থ্যাচার সরকার। এমনকী থাইল্যান্ড এবং মালয়েশিয়ার শিবিরে পলপট-এর ভাঙাচোরা বাহিনীর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও করে ব্রিটেন। গত মার্চে প্রাক্তন এস এ এস সৈনিক ক্রিস রায়ান এবং সংবাদপত্র সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘‘যখন বিদেশ সংবাদদাতা জন পিলজার আমাদের একদম পূর্বে খমের রুজকে প্রশিক্ষণ দিতে দেখেন, আমাদের দেশে ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া হয়। আমাদের খাবার এবং থাকার জন্য ১০ হাজার পাউন্ড দেওয়া হয়েছিল।
আমাকে তা ফেরত দিতে হয়েছিল। ’’
পলপট আজ মৃত। তার ঘাতকবাহিনীর অনেক সদস্যেরই মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের জন্য রাষ্ট্রসঙ্ঘ কিংবা কম্বোডিয়ার আদালতে বিচার চলছে। হেনরি কিসিনজার যাঁর বোমাবর্ষণের নির্দেশ ‘ইয়ার জিরো’র দুঃস্বপ্নের জন্য দায়ী তা আজও কম্বোডিয়ায় জীবন্ত। কম্বোডিয়ানরা গরিব।
ওদেশের মানুষ পর্যটন এবং কায়িক শ্রমের ওপরই নির্ভরশীল।
আমার কাছে তাঁদের চনমনেভাব রীতিমতো জাদুর মতো লাগে। কম্বোডিয়ার স্বাধীনতার পর ক’বছর এত বিয়ের অনুষ্ঠান আমি কখনও দেখিনি। কিংবা বিয়ের এতো আমন্ত্রণপত্রও কখনও পায়নি। কম্বোডিয়ানরা জীবন এবং আশার প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন এবং কম্বোডিয়ার এক শিশু একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষকে জিজ্ঞাসা করে, যেমন ১২ বছরের একটা ছেলে আমায় জিজ্ঞাসা করেছিল।
ছেলেটার চোখেমুখে ভয়ের লেশমাত্র ছিল না। ছেলেটা আমায় জিজ্ঞাসা করেছিল ‘‘তুমি কি আমার বন্ধু? বলো। ’’
(লেখক জন পিলজার-এর জন্ম এবং পড়াশোনা অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে। তিনি একজন যুদ্ধ সংক্রান্ত প্রতিবেদক, চলচ্চিত্রকার এবং নাট্যকার। )
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।