বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, পুন্য হউক, পুন্য হউক, পুন্য হউক, হে ভগবান। বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ, পুর্ন হউক, পূর্ন হউক, পূর্ন হ্উক, হে ভগবান। রবীন্দ্রনাথ
কম্বোডিয়ার আঙকর নগরের প্রায় আটশ বছরের পুরনো বেয়ন মন্দির । সেই সময়কার প্রবল প্রতাপশালী খেমার রাজা সপ্তম জয়বর্মন ছিলেন মন্দিরটির প্রতিষ্ঠাতা। মন্দিরটি তৈরি করা হয়েছিল বেলেপাথর, কাঠ ও লাটেরাইট দিয়ে ।
[এক ধরনের ঘন সূক্ষ্মরন্ধ্রযুক্ত মাটিকেই লাটেরাইট বলা হয়। ] সময়ের দংশনে কাঠের চিহ্ন খুঁজে পাওয়া না-গেলেও বেলেপাথর ও লাটেরাইট আজও অক্ষুন্নই রয়েছে।
প্রায় আটশ বছরের পুরনো এই ঐতিহাসিক স্থানটি কম্বোডিয়ার রাজধানী নমপেন শহর থেকে প্রায় ৩২০ কিলোমিটার উত্তরে। কম্বোডিয়ার উত্তরে কুলেন পাহাড়। সেই পাহাড়ের দক্ষিণে তোনলি সাপ হ্রদ।
হ্রদটি, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সর্ববৃহৎ হ্রদ; একই সঙ্গে বিশ্বের অন্যতম সুপেয় জলের উৎসও বটে। তো, উত্তরে কুলেন পাহাড় আর দক্ষিনে তোনলি সাপ হ্রদ;- মাঝখানের সমতল ভূমিই আঙকর প্রদেশ। রাজধানী সিয়েম রিয়াপ। নদীর নামটিও সিয়েম রিয়াপ: আঙকর প্রদেশের বুক চিরে বয়ে গেছে। আঙকর প্রদেশের পুব থেকে পশ্চিমে ১৫ মাইল, আর উত্তর থেকে দক্ষিণে ৫ মাইল জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে আঙকর ।
কম্বোডিয়ায় খেমাররাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। কম্বোডিয়ার মধ্যযুগীয় খেমার সভ্যতার কেন্দ্র ছিল আঙকর।
কম্বোডিয়ার মানচিত্র। উত্তরে তোনলি সাপ হ্রদ। আঙকর প্রদেশ।
রাজধানী সিয়েম রিয়াপ।
১৮৬৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে কম্বোডিয়ায় ছিল ফরাসী ঔপনেবেশিক শাসন। তার আগ পর্যন্ত নবম শতক থেকে আঙকর-কেন্দ্রিক খেমার রাজারা সুদীর্ঘ ৬০০ বছর ধরে রাজত্ব করেছিল । যে সভ্যতার প্রভাবে খেমারদের রাজ্যটির নাম হয়েছিল কামবুজাদেসা বা কম্বোজদেশ । কম্বোজদেশের রাজধানীই ছিল আঙকর।
বস্তুত, খেমার সভ্যতা মূলত ভারতীয় সভ্যতারই পূর্বমুখি সম্প্রসারন। আরও খোলাখুলি বললে বলতে হয় কম্বোজদেশের খেমার সভ্যতার মূলে ঠিক উত্তর ভারতীয় আর্য সভ্যতা ছিল না- ছিল দক্ষিণ ভারতীয় অনার্য দাবিড় সভ্যতা। নবম শতক থেকে দক্ষিণ ভারতে তামিল সভ্যতার ব্যাপক উত্থান লক্ষ করা যায়। তামিলদের সেই সামাজিক-সাংস্কৃতিক বিপ¬¬বের কেন্দ্রে ছিল ‘চোল’ বংশ। সুদূর দক্ষিণের ‘তাঞ্জোর’ ছিল চোল সাম্রাজ্যের রাজধানী।
[যদিও প্রাচীন কি মধ্যযুগে কোনও সুবৃহৎ সাম্রাজ্যেরই কেন্দ্রটি কখনোই অপরিবর্তিত থাকেনি। পরবর্তীতে যেমন চোলদের রাজধানী হয়েছিল গঙ্গাইকোন্ডাচোলাপুরম। এই শহরের নামের মানেটা একটু পরে বলছি। ] নৃতাত্ত্বিক ও ভাষাগত দিক থেকে দক্ষিণ ভারতের চোল সাম্রাজ্যটি ছিল অনার্য দ্রাবিড়; যদিও লোকসমাজে গৃহিত ধর্মটি ছিল আর্য। চোল রাজারা প্রায় সবাই ছিলেন শৈব।
শিব অবশ্য বেদ-উত্থিত আর্যদেবতা ছিলেন না; শিব ছিলেন অনার্য দেবতা। অবশ্য সেই খ্রিস্টপূর্ব সময়েই শিবের আর্যীকরণ সম্পন্ন হয়ে গিয়েছিল। তবে শৈবমতের পাশাপাশি বৈষ্ণব ধর্মেরও স্থান ছিল দাক্ষিণাত্যে।
আর, এ সব কৃত্যই আঙকর সভ্যতায় প্রতিফলিত হতে দেখি।
শ্রেষ্ঠ চোল নৃপতি ছিলেন রাজেন্দ্র চোল [১০১২-১০৪৪]।
তিনি চোল রাজ্যের শক্তিমত্তা জানিয়ে দেওয়ার জন্য বারবার চিনে দূত প্রেরণ করেছিলেন । একাদশ শতকের প্রথম ভাগে গাঙ্গেয় অববাহিকাসহ বাংলাও ছারখার করেছিলেন রাজেন্দ্র চোল। সে জয় স্মরণে নতুন এক রাজধানী নগর গড়লেন। নাম: গঙ্গাইকোন্ডাচোলাপুরম; অর্থ- [চোলদের নগর;যারা গঙ্গাকে জয় করেছে। ] রাজেন্দ্র চোল-এর সময়ে চোলদের প্রভাবপ্রতিপত্তি ইন্দোচিন অবধি বৃদ্ধি পেয়েছিল ।
অবশ্যই নৌপথে। মালয়, সুমাত্রা ও যবদ্বীপ নিয়ে ছিল শ্রীবিজয়া রাজ্য। রাজেন্দ্র চোল শ্রীবিজয় রাজ্যের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান পরিচালনা করেছিলেন।
তাই বলছিলাম, কম্বোজদেশের খেমার সভ্যতার মূলে ঠিক উত্তর ভারতীয় আর্য সভ্যতা ছিল না- ছিল দক্ষিণ ভারতীয় অনার্য দাবিড় সভ্যতা। দক্ষিণ ভারতীয় সভ্যতার ভিতে আর্য ধর্ম থাকায় দক্ষিণ ভারতীয় সভ্যতায় আর্য ভাষার সংশ্লিষ্টতা থাকাই স্বাভাবিক।
কেননা, ‘সংস্কৃতভাষী শুদ্ধাচারী দক্ষিণী ব্রাহ্মণ’ বলে একটা কথা ভূ-ভারতে প্রচলিত রয়েছে। কাজেই, ‘আঙকর’ শব্দটির উদ্ভব সংস্কৃত শব্দ ‘নগর’ থেকে হতেই পারে । খেমাররা সংস্কৃত ‘নগর’ শব্দটি উচ্চারণ করে ‘অনকর’। তা থেকেই ইংরেজিতে Angkor.
কাজেই, কম্বোজদেশে সংস্কৃত শব্দ মোটেও বিরল নয়। যেমন, ‘সুপথ’।
খেমার ভাষায় লেখা প্রথম কম্বোডিয় উপন্যাসটি বেরয় ১৯৩৮ সালে। [ততদিনে দেশটিতে ফরাসীরা ছাপাখানা স্থাপন করে ফেলেছে। ] তো, সেই খেমার ঔপন্যাসিকের নাম ছিল রিমকিন। উপন্যাসের নাম: ‘সুপাথ’। [সুপথ?]
[শব্দটাকে যদি আমরা বাংলা ‘সুপথ’ বলে চিহ্ণিত করি তা হলে কী এক দুর্জ্ঞেয় অনুষঙ্গে বার্মার পটভূমিতে রচিত শরৎচন্দ্রের ‘পথের দাবী’ উপন্যাসটির কথা মনে পড়ে যায় না কি?]
খেমার ভাষায় মিশে গিয়েছে এমন কতগুলি সংস্কৃত শব্দ নিয়ে এবার আলোচনা করা যাক।
(১) Jaya =বিজয়; জয় শব্দটা খেমার ভাষায় প্রায় অবিকৃতই থেকে গেছে। যেমন, বেয়ন মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতার নাম জয়[বর্মন]। (২) Varman = ঢাল বা প্রতিরক্ষাকারী। বর্ম শব্দ থেকেই কি বর্মন শব্দের উদ্ভব? এক প্রভাবশালী খেমার রাজার নাম সূর্যবর্মন। অবশ্য ঠধৎসধহ মানে শব্দটা দিয়ে নাকি খেমার ভাষায় sun-god ও বোঝায়।
তো? (৩) baray= জলাশয় বা কৃত্রিম হ্রদ। শব্দটা ‘গড়খাই’ থেকে উদ্ভূত কিনা তা ভাবতে হবে। (৪) Gopura =তোরণদ্বার। গোধূলি বেলায় রাখাল বালকেরা গরু নিয়ে নগরের তোরণদ্বার দিয়ে নগরে ফিরছে-Gopura শব্দটি এমন একটি চিত্রকল্প তৈরি করে বৈ কী। (৫) Esvara or Isvara = শিব।
লক্ষণীয় ঈশ্বর নয়, শিব! ভাষা কিংবা শব্দের মাহাত্ব এখানেই। (৬) Prasat =স্তম্ভ। একে প্রাসাদ বলে সহজেই চেনা যায়। (৭) Srei = রমনী। এই Srei শব্দটা কি শ্রী (মতী) থেকে উদ্ভুত? (৮) Ta = পূর্বপুরুষ অথবা ঠাকুর্দা।
‘দাদা’ শব্দটাই কি কম্বোজ রাজ্যে এসে Ta হয়ে গেল? কম্বোজদেশটি সবাই যে দক্ষিণ ভারতীয় -এমন ভাবার কারণ নেই। তৎকালে বাংলার তাম্রলিপ্তি [এখন তমলুক] বন্দরটিও বেশ জমজমাট ছিল। থেকে জাহাজে উঠে অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় বঙ্গবাসীর পূর্বদিকের কম্বোজদেশে যাত্রা করা অস্বাভাবিক নয়। (৯) Thom;-এই খেমার শব্দটা মানে বৃহৎ। থান থেকে কি ‘থোম’ হয়নি? ধাম থেকেও হতে পারে।
ধাম? বেশ বড় একটা বিষয়ের ইঙ্গিত করে। (১০) Wat = মন্দির। বিশেষ করে বৌদ্ধমন্দির। (১১) বিষ্ণুলোক।
তো, কম্বোজদেশের খেমার সাম্রাজ্য বলতে বরাবরই আঙকরকেই বোঝাত।
তার কারণ আছে। ব্যাপারটা অনেকটা ভূমধ্য সাগরের ক্রিট দ্বীপের মিনিয় সভ্যতার মতো। রাজপ্রাসাদই নগর। তেমনি, স্বর্নযুগে আঙকরের মোট জনসংখ্যা ছিল অন্তত দশ লক্ষের মতন। নবম শতক থেকে মধ্য-পঞ্চদশ শতক অবধি নাগরিক কর্মকোলাহলে সমুজ্জ্বল ছিল আঙকর।
তার পরেই আঙকরের বিভা ম্লান হয়ে যেতে থাকে।
আঙকরের বেয়ন মন্দিরের বর্ননা দিয়ে এ লেখা আরম্ভ করেছি। এবার আঙকরের আরেকটি বিখ্যাত মন্দিরের কথা বলি। আধুনিক কালের প্রত্নতত্ত্ববিদেরা যে মন্দিরটিকে সবিস্ময়ে বলেছেন-the world's largest single religious monument.ভাবা যায়? প্রাচীন মিশর না, প্রাচীন গ্রিসের দেলফি না, দক্ষিণ আমেরিকার মায়া-অ্যাজটেক না, কিংবা এমনকী পূর্ব ভারতের জগন্নাথ কি কোনারকও নয়- কম্বোজদেশের দেশের মন্দির আঙকর ওয়াত!
কাজেই, কম্বোজদেশ নিয়ে আমরা উৎসাহিত হয়ে উঠতেই পারি।
খেমার রাজা ২য় সূর্যবর্মন ছিলেন বিষ্ণুর উপাসক।
তিনিই আঙকর ওয়াত নির্মান উদ্যোগ নেন। সময়টা ১১১৩ খ্রিস্টাব্দ। কথিত আছে-in the course of combat, Suryavarman lept onto his rival's war elephant and killed him, just as the mythical bird-man Garuda slays a serpent.
রাজার নাম, রণহস্তি, উপকথার গরুড় পক্ষী-এ সবই [দক্ষিণ] ভারতীয় উপাদান।
তো, সূর্যবর্মনের সমসাময়িক দাক্ষিণাত্যে চোল রাজারা শৈব হলেও ভারতবর্ষজুড়ে সেই প্রাচীন কাল থেকেই আদি বৈষ্ণব ধর্মের প্রাধান্য বরাবরই ছিল। এমন কী বাংলাতেও।
বাংলাতে আর ক’দিন পরেই শ্রীচৈতন্যদেব গানে গানে মিছিল করে গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মের প্রচার করে বৃন্দাবন-নদীয়ায় ভাগবত প্রেমের প্লাবন বইয়ে দেবেন। যেহেতু, কম্বোজদেশের সঙ্গে ভারতবর্ষের যোগাযোগ বরাবরই ছিল ঘনিষ্ট; কাজেই, আঙকর ওয়াতের অধিপতি দেবতাটি যে বিষ্ণু; শিব নন, তা তেমন বিস্ময়কর নয় । এমনও তথ্য পাওয়া যায় যে- ওই সময়ে আঙকর ওয়াতকে নাকি খেমাররা বলত ‘বিষ্ণুলোক’।
কিন্তু, একটু আগেই বলা হলো- খেমার শব্দ Wat = বৌদ্ধ মন্দির। অথচ আঙকর ওয়াত ছিল বিষ্ণু মন্দির।
কী এর কারণ? বিষ্ণু [হিন্দু] মন্দিরের নাম আঙকর ওয়াত হলো কেন? ওয়াত মানে তো খেমার ভাষায় বৌদ্ধ মন্দির। আসলে, ইতিহাস, শব্দ ও ভাষার ব্যাপারটাই কেমন যেন। গোলমেলে! একনিষ্ঠ ঐতিহাসিকও এ কারণে মাঝে মাঝে বিভ্রান্ত বোধ করেন। যেমন, Despite Angkor Thum's origins in Buddhism, it reflects the typical allegorical architectural pattern of Hindu temples, which symbolize the entire Hindu cosmology . বৌদ্ধমন্দির আঙকর থোম-এর মূলে বৌদ্ধ সংস্কৃতি হলে তাকে ঘিরে কেন allegorical architectural pattern of Hindu temples [বা বৈদিক] আবহ? আসলে, শব্দ, ভাষা ও ইতিহাসের ব্যাপারটাই যেন কেমন। গোলমেলে! একনিষ্ঠ ঐতিহাসিকও এ কারণে ধাঁধার সমাধান না করতে পেরে মাঝে মাঝে হতাশায় ভোগেন।
বিভ্রান্তি আরও রয়েছে। নবম শতকে আঙকরের রাজধানী ছিল হরিহরলয়ে। দ্বাদশ শতকে যশোধরপুর। এই নামগুলি কি দক্ষিণী? মোটেও নয়। কেমন-উত্তর ভারতীয় মনে হয়।
অথচ, খেমার সভ্যতা যে চরিত্রে দক্ষিণী তা বোঝানোর চেষ্টা চলছে। রামেশ্বরম কি ...কাভেরিপত্তনম কি চিদাম্বারাম। কথা এখানেই শেষ নয়। চোলদের দক্ষিণের রাজবংশের নাম পান্ডু। পান্ডু শব্দটা বাঙলায় একেবারে অপরিচিত নয়।
তো, পরিশ্রমী খেমার শ্রমিকেরা আঙকর ওয়াতের চতুপার্শ্বে গভীর পরিখা খনন করেছিল সম্ভবত রাজা ২য় সূর্যবর্মনের নির্দেশে। আজও সেই সব জলশূন্য গভীর গড়খাই আঙকর গেলে চোখে পড়ে। রাজা ২য় সূর্যবর্মন সম্ভবত ভেবেছিলেন, নিয়মিত পূজা দিলে আঙকর রক্ষা করবেন দেবতা বিষ্ণু; কার্যত তা হয়নি। পুবদিকের চাম অধ্যূষিত চম্পারাজ্যটি ছিল কম্বোজদেশের শক্ররাজ্য। চাম সৈন্যরা ১১৭৭ খ্রিস্টাব্দে আঙকর আক্রমন করে অশেষ রক্ত ঝরিয়েছিল ।
আঙকরের রাজধানী তখন যশোধরপুরে। দেবতা বিষ্ণু, বরাবরের মতোই, ছিলেন নির্বিকার। যাহোক। এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর রাজা সপ্তম জয়বর্মন শক্রদের আঙকর থেকে বিতাড়িত করে সিংহাসনে বসলেন। তখন খ্রিস্টাব্দ ১১৮১।
যুদ্ধের দাবানলে যশোধরপুর প্রায় বিধস্ত হয়ে গিয়েছিল। রাজা সপ্তম জয়বর্মন সেই বিধস্ত নগরটি পরিত্যক্ত ঘোষনা করে তার সামান্য উত্তরে নতুন একটি নগর নির্মানের উদ্যোগ গ্রহন করলেন। অনুমান করি, নতুন রাজধানীর নকশা রাজা সপ্তম জয়বর্মনই করেছিলেন। কেননা, কম্বোজদেশবাসীসহ ও বিশ্বের শ্রেষ্ট পুরাতাত্ত্বিকগন ও ঐতিহাসিকগন এক মত পোষন করেন যে - রাজা সপ্তম জয়বর্মন-ই সর্বশ্রেষ্ঠ খেমার নৃপতি। কাজেই তাঁর নকশায় অন্তভূক্ত ছিল নগরটি নগর ঘিরে থাকা [বর্তমান কালের হিসেবে] ১০০ মিটার প্রশস্ত পরিখা; যা একই সঙ্গে প্রতিরক্ষা ও জলের উৎস হিসেবে কাজ করবে।
পরিখার ওপর দিয়ে মূল চত্তরের দিকে চলে যাওয়া অসংখ্য হাঁটা-পথ [causeways] । নগরের পুব ও পশ্চিম দিকে বিশাল বিশাল দুটি কৃত্রিম হ্রদ বা baray বা গড়খাই। মূল চত্বরটি চতুস্কোন। যেটি ঘিরে ২৬ ফুট উঁচু দেওয়াল। পূর্ব-পশ্চিম, উত্তর-দক্ষিণে প্রসারিত দেওয়ালের দৈর্ঘ্য হবে ৩৯,০০০ ফুট ।
দেওয়ালে থাকবে খোদিত নকশা; পূর্বপুরুষের ও সাম্প্রতিক যুদ্ধের খেমার বীরত্ব। প্রতিটির দেওয়ালের মাঝখানে মাঝখানে গোপারা বা অলংকৃত তোরণদ্বার।
নগর নির্মান শেষে রাজা সপ্তম জয়বর্মন নগরটি নাম দেন ‘আঙকর থুম’ । Angkor is a Khmer term meaning "city." It comes from the Sanskrit nagara. Thom is a Khmer term meaning "big." (Angkor Thom means "big city.") এক বাঙালি ঐতিহাসিকের মতে ‘আঙকর থুম’ = নগরধাম । এই রকম নামকরনের সম্ভাব্য কারণটি আগেই কিঞ্চিত ব্যাখা করা হয়েছে।
তা হলে, ভারতীয় কিংবা বঙ্গীয়করণের ফলে আঙকর ওয়াত হলো ‘বিষ্ণুলোক’ এবং ‘আঙকর থুম’ = নগরধাম।
‘আঙকর থুম’ নগররের কেন্দ্রীয় মন্দিরটিই ‘বেয়ন’। যে মন্দিরটি সম্বন্ধে এ লেখার প্রারম্ভে বলা হয়েছে- অপরাহ্নের উজ্জ্বল রোদে বেয়ন মন্দিরের প্রাঙ্গনটি ঝলমল করছিল । প্রায় আটশ বছরের পুরনো মন্দির বেয়ন। ...
এখন সবচে গুরুত্বপূর্ন প্রশ্ন এই-রাজা সপ্তম জয়বর্মন পূর্বপুরুষ সকল রাজাই ছিলেন শৈব কিংবা বৈষ্ণব।
। অথচ বেয়ন মন্দিরটি বৌদ্ধ। কী এর কারণ?
চম্পা রাজ্যের চাম সৈন্যরা আঙকর আক্রমন করে আঙকর ওয়াত তছনছ করেছিল, দেবতা বিষ্ণু আঙকর
রক্ষা করতে ব্যর্থ হওয়ায় রাজা সপ্তম জয়বর্মন হিন্দু ধর্মের ওপর হতাশ হয়েই বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহন করেছিলেন-কম্বোজদেশে এমন একটা ধারণা প্রচলিত রয়েছে। হতে পারে। তা ছাড়া তখন দ্বাদশ শতাব্দী চলছে।
ভারতবর্ষ থেকে তখন বৌদ্ধধর্ম প্রায় উৎখাত হয়ে যাচ্ছিল। বাংলায় পাল যুগ শেষ হয়ে বৌদ্ধবিরোধী সেনদের আমল চলছে । বৌদ্ধদের ওপর নানান নিপীড়ন চলছে বঙ্গদেশে। তথাগতর ধর্মটি অবশ্য আরও আগেই দক্ষিণ চিন সমুদ্রের উত্তর উপকূলে ছড়িয়ে পড়েছিল। বাংলার অতীশ দীপঙ্কর যুবক বয়েসে জ্ঞান অর্জনের উদ্দেশে সুমাত্রা যাত্রা এসেছিলেন।
তিনিও তা হলে সুদূর পূর্বাঞ্চলের পথটি দেখিয়ে দিয়েছিলেন? তখন দশম শতক। তার দুশো বছর পর দ্বাদশ শতকে তথাগতর বাণী এক মহৎ খেমার রাজার আনুকূল্য পেল এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর। আলোচনার এই রকম একটা চিত্তাকর্ষক পর্যায়ে আমরা রাজা সপ্তম জয়বর্মনের ছবিটি দেখে নিতে পারি।
কখনও ফ্রান্সের গিমে যাদুঘরে গেলে রাজা সপ্তম জয়বর্মনের ভাস্কর্যটি সরাসরি দেখতে পাবেন। আঙকর থুম নগরের চতুর ভাস্কর কি ইচ্ছাকৃত ভাবেই রাজার মুখটায় বুদ্ধ-বুদ্ধ ভাব [হয়নি যদিও] এনেছেন? হতেই পারে।
তখন আঙকর থুম-এ থেরবাদী বৌদ্ধধর্মের জয়জয়াকার। নতুন নগরের নতুন ধর্ম। নতুন ধর্ম ও পুরনো মদে নাকি ঝাঁঝ বেশি থাকে। আমাদের এই লেখায় সেই প্রসঙ্গটিও আসবে। তো, রাজা সপ্তম জয়বর্মনের ভাস্কর্যটি ফ্রান্সের গিমে যাদুঘরে কেন? কম্বোডিয়ায় ছিল ঔপনেবেশিক ফরাসী শাসন।
তা ছাড়া গিমে যাদুঘর তো ...
আঙকর মধ্যযুগীয় খেমার রাজা সপ্তম জয়বর্মনের স্বপ্নের নগর। গড়খাই,তার ওপর অনেকগুলি causeway.[ causeway-র বাংলা কী হবে?] নগর প্রাচীর। মূল নগর চত্বর; যার মাঝমধ্যিখানে বৌদ্ধ মন্দির: বেয়ন ।
একটা কথা স্বীকার করতেই হয়- বিশ্বের জাতিধর্মনির্বিশেষে প্রত্যেক মানুষেরই বৌদ্ধ ধর্মের প্রতি বিশেষ আকর্ষন ও শ্রদ্ধা রয়েছে। বেয়ন মন্দিরের কারণে নগরধাম বৌদ্ধধর্মের এক পবিত্র পিঠস্থান হয়ে উঠেছে বলা যায়।
আঙকর সম্বন্ধে মার্কিন পুরাতাত্ত্বিক Peter T. White লিখেছেন- Altogether, these creations of great conquerors and artisans embodied an integrated concept of the universe rooted in myth and deep religious belief, and hence a combination of physical and spiritual grandeur found elsewhere only in ancient Greece and Egypt, among the Maya and Aztecs, and in the medieval Europe of the Gothic cathedrals. That is what Angkor was.
১৯৯২ সালে UNESCO আঙকরকে World Heritage Site ঘোষনা করেছে।
(আপনারা অনেকেই কম্বোডিয়ার আঙকর ওয়াট এর কথা শুনে থাকবেন। মনে রাখতে হবে-আঙকর ওয়াট এবং আঙকর থোম এর মধ্যে পার্থক্য আছে। দুটি দু জায়গায়। অবশ্য সিয়েম রিয়েপেই।
এই লেখাটি আঙকর ওয়াট নিয়ে নয়-আঙকর থোম নিয়ে। )
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।