১৯৪৫ সালে জামাল আব্দুন নাসের ও ইংরেজদের মধ্যে চুক্তি হয়। ইখওয়ান ‘ইঙ্গ মিশর’ চুক্তির বিরোধিতা করে। ফলে ইখওয়ান কর্মীদের উপর চালানো হয় দমন, পীড়ন ও নির্যাতন। কয়েক সপ্তাহের মধ্যে পঞ্চাশ হাজার নেতা-কর্মীকে কারাবন্দী করা হয়। এর মধ্যে ছয়জন কেন্দ্রীয় নেতা ছিলেন।
তাঁদের মধ্যে সাইয়েদ কুতুবও ছিলেন। সে সময় তিনি ছিলেন জ্বরে আক্রান্ত। তিনি অসুস্থতায় বিছানায় কাতরাচ্ছিলেন। একজন সামরিক অফিসার ঘরে ঢুকলেন। তার সাথে ছিল অনেক সশস্ত্র সিপাহী।
তারা রোগশয্যায় শায়িত সাইয়েদ কুতুবের হাতে ঐধহফ ঈঁঢ় পরিয়ে তাঁকে কারাগারের দিকে নিয়ে চললেন। তাঁকে কোন গাড়িতে না চড়িয়ে পায়ে হেঁটে যেতে বাধ্য করা হল। অত্যধিক অসুস্থতার কারণে রাস্তায় চলার পথে তিনি বারবার অজ্ঞান হয়ে পড়েন। হুঁশ ফিরে এলে মুখে উচ্চারিত হতো ইখওয়ানের প্রিয় স্লোগান ‘আল্লাহু আকবর ওয়া লিল্লাহিল হামদ। ’ কারাগারের ভিতর প্রবেশের সাথে সাথে হিংস্র হায়েনার দল তাঁর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে।
দু’ঘণ্টা যাবৎ জেলের অন্ধকার কক্ষে অমানবিক নির্যাতন চালানো হয়। তাঁর উপর এক ভয়ংকর কুকুর লেলিয়ে দেওয়া হয়। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কুকুরটি সাইয়েদ কুতুবের পায়ে কামড় দিয়ে টেনে হেঁচড়ে এদিক সেদিক নিয়ে যায়। এরপর তাঁকে একটি নির্জন কক্ষে নিয়ে যাওয়া হয়। সাইয়েদ কুতুব নির্যাতনে ক্ষত-বিক্ষত।
তার শরীর থেকে রক্ত ঝরছে। এমন অবস্থার পরও তাকে রিমান্ডে নিয়ে একের পর এক বিভিন্ন প্রশ্ন করা হয়। দীর্ঘ সাত ঘণ্টা যাবৎ প্রশ্ন পর্বের মাধ্যমে মানসিক নির্যাতন করা হয়। এই ধরনের নির্যাতনের ফলে সাইয়েদ কুতুব শারীরিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়লেও মানসিকভাবে ছিলেন খুবই সবল। ঈমানী বলে তিনি ছিলেন বলীয়ান।
কখনো নির্যাতনের সীমা বৃদ্ধি পেলে তিনি মুখে উচ্চারণ করতেন ‘আল্লাহু আকবর ওয়া লিল্লাহিল হামদ। ’ রাতে তাকে একটি অন্ধকার প্রকোষ্ঠে রাখা হতো। সকাল বেলা খালি পায়ে প্যারেড করতে বাধ্য করা হতো। এভাবে অমানুষিক নির্যাতনে তার বুকের ব্যথা, ঘাড়ের ব্যথাসহ সকল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে ব্যথা-বেদনার সৃষ্টি হয়। তিনি নানা ধরনের রোগে আক্রান্ত হন।
যার ফলে ১৯৫৫ সালের ২ মে তাকে সামরিক হাসপাতালে পাঠানো হয়। সাইয়েদ কুতুবের শিষ্য ইউসুফ আল আযম লিখেছেন- “সাইয়েদ কুতুবের ওপর বর্ণনাতীত নির্যাতন চালানো হয়। আগুন দ্বারা সারা শরীর ঝলসে দেওয়া হয়। পুলিশের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কুকুর লেলিয়ে দিয়ে শরীরের বিভিন্ন স্থান রক্তাক্ত করা হয়। মাথার ওপর কখনো উত্তপ্ত গরম পানি ঢালা হতো।
পরক্ষণে আবার খুবই শীতল পানি ঢেলে শরীর বরফের ন্যায় ঠান্ডা করা হতো। পুলিশ লাথি, ঘুষি মেরে একদিক থেকে অন্যদিকে নিয়ে যেত।
এমনও হয়েছে যে একাধারে ৪ দিন একই চেয়ারে বসিয়ে রাখা হয়েছে; কোন খানাপিনা দেয়া হয়নি। তাঁর সামনে অন্যরা পানি পান করতো অথচ তাঁকে এক গ্লাস পানি দেওয়া হতো না। সাইয়েদ কুতুবের ওপর এইভাবে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন সত্ত্বেও তিনি সময় পেলেই জেলে দাওয়াতী কাজ করতেন।
ইখওয়ানুল মুসলিমীন নিয়ে ভাবতেন ও বিভিন্ন পরিকল্পনা করতেন। তিনি ঈমানী চেতনায় এত বেশি উদ্দীপ্ত ছিলেন যে, কোন সময়ই অন্যায়ের সাথে আপোষ করতে চাননি। কারাগারে যাওয়ার ১ বছর পরই সরকারের পক্ষ থেকে প্রস্তাব দেওয়া হয় যে, ’’যদি আপনি ক্ষমা চেয়ে কয়েকটি লাইন লিখে দেন, যা বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশ করা হবে, তাহলে আপনাকে মুক্তি দেওয়া হবে। আপনি জেলের কষ্টকর জীবন থেকে মুক্তি পেয়ে ঘরে আরামে থাকতে পারবেন’’। উক্ত প্রস্তাব শুনে সাইয়েদ জবাব দিলেন- “আমার অবাক লাগে যে, এ সকল লোকেরা মযলূমকে বলছে যালিমের কাছে ক্ষমা ভিক্ষা চাইতে।
আল্লাহ্র শপথ! যদি কয়েকটি শব্দ উচ্চারণের ফলে আমাকে ফাঁসির মঞ্চ থেকে নাজাত দেয় তবু আমি তা বলতে প্রস্তুত নই। আমি আমার রবের দরবারে এমনভাবে হাজির হতে চাই যে, আমি তাঁর উপর সন্তুষ্ট আর তিনি আমার উপর সন্তুষ্ট। ”জেলখানায় যখনই তাকে ক্ষমা চাইতে বলা হত, তিনি বলতেন- “যদি আমাকে কারাবন্দী করা সঠিক হয়, তাহলে সঠিক সিদ্ধান্তের উপর আমার সন্তুষ্ট থাকা উচিত। আর যদি অন্যায়ভাবে আমাকে কারাগারে আটক রাখা হয়, তাহলে আমি যালিমের কাছে করুণা ভিক্ষা চাইতে রাজি নই। ”এরপর সরকারের পক্ষ থেকে টোপ দেয়া হয়, তিনি যদি সম্মত হন তাহলে তাকে শিক্ষা মন্ত্রণায়ের দায়িত্ব দেয়া হবে।
সাইয়েদ এ প্রস্তাব শুনে প্রতিক্রিয়ায় বলেন- “আমি দুঃখিত। মন্ত্রীত্ব গ্রহণ আমার পক্ষে সে সময় পর্যন্ত সম্্ভব নয়, যতক্ষণ না মিসরের পুরো শিক্ষাব্যবস্থাকে ইসলামী ছাঁচে ঢেলে সাজাবার এখতিয়ার দেয়া না হবে।
সাইয়েদ কুতুবকে ‘তাররা’ কারাগারে রাখা হয়েছিল। সেখানে ইখওয়ানের আরও ১৮৩ জন কর্মী ছিল। তাদের সাথে পরিবার পরিজনকেও দেখা করতে দেয়া হত না।
একবার ‘আব্দুল্লাহ্ মাহের’ ও ‘আব্দুল গাফফার’ নামক দু’জন ইখওয়ান কর্মীকে তাদের আত্মীয়-স্বজন দেখতে আসেন। কিন্তু তাদের সাথে আত্মীয়দের সাক্ষাতের সুযোগ দেয়া হয়নি, বরং তাদের দেখতে আসার শাস্তিস্বরূপ কারাগারে আটক রাখা হয়। কারাবন্দী ইখওয়ান কর্মীরা উক্ত অমানবিক ঘটনার প্রতিকার চেয়ে কারা তত্ত্বাবধায়কের নিকট আবেদন জানান। কিন্তু ফল হল উল্টো। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নির্দেশে কারাগারে অস্ত্রে সুসজ্জিত সৈন্যরা প্রবেশ করে।
সৈন্যরা অগ্নিগোলা বর্ষণ করতে থাকে। ঘটনাস্থলেই ২১ জন ইখওয়ান কর্মী শাহাদাত বরণ করেন, ২৩ জন মারাত্মক আহত হন। রক্তে রঞ্জিত হয় তাররা কারাগার। এ ঘটনার পর মন্ত্রী পরিষদের সচিব সালাহ দাসুফী তদন্তে আসেন। তদন্তে কি হয় এ ভয়ে সকলেই তটস্থ হয়ে পড়ে।
না, যাদের গুলিতে রক্তের স্রোত বইছে তাদের কিছুই হয়নি। ইখওয়ান কর্মীদের উপর কড়া নজর রাখার নির্দেশ দিয়ে চলে গেলেন যালিম সরকারের সচিব মহোদয়।
আল্লাহ্ সাইয়েদ কুতুবকে এক বিরাট যাদুকরী সম্মোহনী শক্তি দিয়েছিলেন। কারাগারের সকলেই তাঁকে শ্রদ্ধা করতো, সম্মান করতো। তাঁর কাছে সকল কথা খুলে বলতো।
কারাগারের বিভিন্ন বিষয় তিনি মীমাংসা করতেন। হাজতী, কয়েদীদের পরস্পরে ঝগড়া হলে তিনি বিচার করতেন। তাই তাঁকে উপাধি দেয়া হয় ‘কাজী উস সিজন’ -কারাগারে বিচারপতি। যখন কোন কয়েদীকে অন্য স্থানে স্থানান্তর করা হত তিনি তাকে বিদায় দিতেন। তাঁকে খাবারের কোন কিছু দেয়া হলে তা অন্যদের মাঝে বিতরণ করতেন।
জেল সুপার, জেল ডাক্তার সবাই তাকে ভালবাসতো। তিনি কারাবন্দীদের খোঁজ-খবর রাখতেন। এমনকি কারাগারে যেসব প্রাণী থাকতো, তিনি তাদেরও যত্ন নিতেন, খাবার দিতেন। তিনি তাঁর আচরণে সবার মন জয় করেন। একবার তিনি অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে দীর্ঘদিন চিকিৎসাধীন ছিলেন।
কারাসঙ্গী অন্যরা তাঁর খিদমত করতেন। তিনি হাসপাতাল আঙ্গিনায় অন্যদের সাথে খোশ-গল্প করতেন। তিনি ছিলেন খুবই ধৈর্যশীল। ইখওয়ান নেতৃবৃন্দ পরামর্শের জন্য কারাগারে গেলে স্বাভাবিকভাবেই পরামর্শ দিতেন। কখনও কখনও ছোট বোন হামিদা কুতুবের মাধ্যমে পরামর্শ পাঠাতেন।
সাইয়েদের কারাজীবনে মানসিকতার কোন পরিবর্তন ঘটেনি। একবার আদালতের কাঠগড়ায় তিনি দাঁড়ানো। তাঁর ভাই-বোনেরা তাঁকে দেখতে এসেছেন। সবাইকে দেখে তিনি মুচকি হাসলেন। আল্লাহ্র কাছে দোয়া করলেন এবং ধৈর্যের উপদেশ দিলেন।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।