আমি এই আমাকে খুঁজে ফিরি সবার মাঝে………………….. তোমাদের মধ্যে কেউ ততক্ষণ পর্যন্ত প্রকৃত মুসলমান হতে পারবে না যতক্ষণ পর্যন্ত সে তার ভাইয়ের জন্য সেটাকেই পছন্দ করে যা সে নিজের জন্য ভালো মনে করে। আল-হাদিস ইউরোপীয় রেনেসাঁর অনুসারীরা দীর্ঘ কাল ধরে জড়বাদী দর্শন ও বস্তুবাদী জীবন এবং খৃস্টধর্মের বোধ, বিশ্বাস ও সংস্কৃতির মধ্যে সঙ্গতি সাধন করে চলার যথাসাধ্য চেষ্টা করে যাচ্ছিলো। কারণ ধর্মের বন্ধন থেকে তখনো তারা মুক্ত হতে পারেনি। খৃস্টজগতে তখনো ধর্মীয় প্রভাব বিদ্যমান ছিলো। তাছাড়া নৈতিক ও ধর্মীয় স্বার্থেরও দাবী ছিলো নামেমাত্র হলেও এমন একটি ধর্মীয় ব্যবস্থা বহাল রাখা, যা সম্প্রদায়ের সকলকে একসূত্রে বেঁধে রাখবে এবং দেশ ও জাতিকে নৈতিক ও সামাজিক অবক্ষয় থেকে রক্ষা করবে।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাদের লজ্জাই পেতে হলো। কারণ বস্তুবাদী সভ্যতার গতি এত প্রবল ছিলো যে, ধর্ম ও ধর্মীয় রীতি-নীতিগুলো তার সাথে পাল্লা দিয়ে উঠতে পারলো না। ফলে জড়বাদ ও আধ্যাত্মিকতার মাঝে সহাবস্থান নিশ্চিত করা তখন প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছিলো এবং সেজন্য কষ্টকর কৃত্রিমতার আশ্রয় নিতে হচ্ছিলো, যাতে মেধা, শক্তি ও সময়ের শুধু অপচয় ঘটছিলো, যার কোন প্রয়োজন ও সার্থকতা তারা দেখতে পাচ্ছিলো না। তাই শেষ পর্যন্ত তারা লোকলজ্জা ও কপটতার বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে এলো এবং প্রকাশ্যে ধর্মহীনতা ও বস্তুবাদকে জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যরূপে গ্রহণ করে নিলো। এই সময়সন্ধিক্ষণে সমগ্র ইউরোপে বিপুল সংখ্যায় কবি, লেখক, সাহিত্যিক, শিক্ষক সমাজ ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর আবির্ভাব ঘটলো, যারা সম- তালে জড়বাদের শিঙ্গায় ফুঁক দিতে শুরু করলেন এবং কলমের জাদুময়তা দ্বারা মনমস্তিষ্কে বস্তুবাদের বিষ ছড়াতে লাগলেন।
নীতি ও নৈতিকতা এবং জীবন ও সামাজিক মূল্যবোধ সবকিছুরই তাদের কাছে ছিলো বস্তুবাদী ব্যাখ্যা। কখনো তারা প্রচার করতেন আত্মস্বার্থদর্শনের মাহাত্ম, কখনো বা অবাধ ভোগবাদের মহিমা।
মেকিয়াভেলি (১৪৬৯-১৫২৭ খৃঃ) ও অন্যান্য রাষ্ট্রবিজ্ঞানী আরো আগেই ধর্ম ও রাষ্ট্রের বিভাজন এবং সামাজিক ও ব্যক্তিক চরিত্রের ভিন্নতার দর্শন প্রচার করেছিলেন। তাদের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত ছিলো, ধর্ম যদি মানতেই হয় তাহলে তার সীমানা হবে ব্যক্তির ব্যক্তি- জীবন। রাষ্ট্র ও রাজনীতিতে তার প্রবেশাধিকার থাকবে না।
তাদের মতে জীবনে রাষ্ট্রের ভূমিকা ও গুরুত্ব হবে সবকিছুর ঊর্ধ্বে। পরকাল বলে যদি কিছু থাকে তাহলে খৃস্টধর্মের সম্পর্ক হলো পরকালের সঙ্গে। সুতরাং ধার্মিক লোকেরা গীর্জা ও ধর্মব্যবস্থার জন্য প্রয়োজনীয় হলেও সমাজ ও রাষ্ট্রের পক্ষে উপযোগী ও কল্যাণকর হতে পারেন না। কেননা ধর্মীয় বিধিবন্ধন ও বাধ্যবাধকতার ঘেরাটোপে আবদ্ধ থাকতেই তারা ভালোবাসে। তাই রাষ্ট্র ও জনস্বার্থের জন্য অপরিহার্য হলেও ধর্মীয় বিধান ও নৈতিক মূল্যবোধ থেকে তারা সরে আসতে পারে না।
শাসক ও রাষ্ট্রনায়ককে প্রয়োজনে শৃগালের ধূর্ততা ও শঠতা দেখাতে হয়। দেশ, রাষ্ট্র ও জনগণের সামান্য স্বার্থও যদি নিহিত থাকে তাহলে নির্দ্বিধায় তাকে মিথ্যা, কপটতা, ধোকা ও প্রতারণার আশ্রয় নিতে হবে। এ নতুন আহ্বান অত্যন- জনপ্রিয়তা লাভ করলো এবং ভৌগলিকতাবাদ ও জাতীয়তা- বাদ (যা প্রাচীন ধর্মের স্থান দখল করেছিলো) এ নতুন দর্শনকে পূর্ণ পৃষ্ঠপোষকতা দান করলো। ইউরোপের কবি-সাহিত্যিক, লেখক-শিল্পী ও বুদ্ধিজীবীসমাজ বিশেষ করে ফরাসিবিপ্লব ও তার পরবর্তী সময়ে নীতি ও নৈতিকতার সকল শাশ্বত মূল্যবোধ এবং প্রতিষ্ঠিত সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করলো তদুপরি তারা পাপ ও পাপাচারের সৌন্দর্য মানুষের সামনে চিত্তাকর্ষক ভাষায় তুলে ধরলো। ভোগস্বাধীনতার এই প্রবক্তাদের মূল বক্তব্য ছিলো, ব্যক্তিজীবনে মানুষ যাবতীয় নৈতিক দায়দায়িত্ব থেকে মুক্ত এবং তার পূর্ণ অধিকার রয়েছে অবাধ আনন্দ-বিনোদনের এবং জীবন ও যৌবনের পরিপূর্ণ উপভোগের।
এ জীবন, এ যৌবন খুব অল্প সময়ের। সুতরাং জীবনের স্বাদ ও যৌবনের আনন্দ যত পারো ভোগ করো। ইন্দ্রিয় আনন্দ ও বস্তুগত লাভ ছাড়া জীবনের আর সবকিছু তারা অস্বীকার করতো। এককথায় পশুবৃত্তি ও পাশবপ্রবৃত্তির চরিতার্থতাই ছিলো ভোগবাদী ও বস'বাদী জীবনের মূল কথা।
এভাবে উনিশ ও বিশশতকের ইউরোপীয় জীবন মূলত মূর্তি- পূজক গ্রীক ও রোমকদের বস্তুবাদী জীবনেরই এক জীবন- প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠলো।
বস্তুত এটা ছিলো প্রাচীন গ্রীক ও রোমান জাহেলিয়াতের নতুন সংস্করণ যা উনিশ শতকে খুব যত্নের সাথে তৈরী করা হয়েছিলো। প্রাচ্যের খৃস্টধর্ম গ্রীক ও রোমক সংস্কৃতির যেসকল রেখা ও চিত্র মুছে ফেলেছিলো উনিশশতকের ইউরোপীয় চিত্রকররা সেগুলো যেন আরো উজ্জ্বল ও উদ্ভাসিত -রূপে পরিবেশন করলেন। প্রাচ্যসংস্কৃতির প্রভাবে ইউরোপের যে অবদমিত স্বভাব, সেটা যেন নতুন করে আরো শক্তি নিয়ে মাথাচাড়া দিলো। এতে অবশ্য অবাক হওয়ার কিছু নেই। কেননা আজকের ইউরোপীয় জাতিবর্গ মূলত গ্রীক ও রোমকদেরই সুযোগ্য বংশধর।
বর্তমান পাশ্চাত্য সভ্যতা এবং প্রাচীন গ্রীক ও রোমান সভ্যতার মধ্যেও রয়েছে অতি নিকটসাদৃশ্য। ইউরোপের বর্তমান ধর্মীয় জীবনও আত্মিকতা ও আধ্যাত্মিকতা থেকে ততটাই মুক্ত যতটা ছিলো প্রাচীন গ্রীক ও রোমকদের ধর্মীয় জীবন; যেমন ডক্টর হ্যাশ গ্রীক সভ্যতার আলোচনা প্রসঙ্গে উল্লেখ করেছেন।
আত্মশুদ্ধি ও আত্মসংযম, নৈতিকতা ও ধার্মিকতা, ইশ্বরভীতি ও পরকালপ্রীতির অনুপস্থিতি এবং বিনোদন ও ক্রীড়াসক্তির প্রাবল্যের যে চিত্র ঐতিহাসিক লেকী গ্রীকদের ধর্মবোধ প্রসঙ্গে উল্লেখ করেছেন তা একই ভাবে এবং আরো চড়া মাত্রায় আধুনিক ইউরোপের জীবনেও ছিলো। এবং তা সেই ধর্মব্যবস্থার স্বাভাবিক ফল যা ইউরোপ গ্রহণ করেছিলো, কারণ আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আত্ম- নিবেদন এবং তার উপাসনায় পরিপূর্ণ আত্মনিমগ্নতার সঙ্গে এ ধর্মব্যবস্থা কিছুতেই খাপ খেতে পারে না। তদ্রূপ তা ছিলো বিজ্ঞানী ও দার্শনিকদের বিভিন্ন ধ্যান-ধারণা ও বাদ-মতবাদ প্রচারের অনিবার্য ফল, যা ইউরোপে বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলো এবং এমনকি তা ধর্মের স্থান দখল করে নিয়েছিলো।
ইউরোপের বস্তুবাদী সমাজে আপনি দেখতে পাবেন, মানুষ বস্তুগত স্বাদ-আনন্দ ভোগ করার এবং জীবন ও যৌবনের মজা লুটে নেয়ার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ে যেমন পিপাসার্ত পানিতে ঝাঁপ দেয় কিংবা যেমন পতঙ্গ আগুনে ঝাঁপ দেয়, ঠিক যেমনটি সক্রেটিস তার সময়ের গ্রীক গণতান্ত্রিক আদর্শ যুবকের চিত্র অঙ্কন করেছিলেন। তদ্রূপ এখানে আপনি দেখতে পাবেন ধর্মবিশ্বাসে দ্বিধা-সংশয় এবং ধর্মীয় বিধি-বিধান ও জীবনব্যবস্থার প্রতি একই অনাস্থা ও উপহাস, যা ছিলো রোমে মুক্তবুদ্ধির চর্চা শুরু হওয়ার পর।
খৃস্টবাদ নয়, ইউরোপের ধর্ম বস্তুবাদ
এতে কোন সন্দেহ নেই যে, আধুনিক ইউরোপের ধর্ম, যা তার হৃদয় ও আত্মাকে এবং আবেগ ও চিন্তাসত্তাকে নিয়ন্ত্রণ করে সেটা খৃস্টধর্ম নয়, বরং জড়বাদ ও বস্তুবাদ। যিনি খুব নিকট থেকে ইউরোপকে অবলোকন করেছেন এবং বইয়ের পাতা ছেড়ে জীবনের পাতায় ইউরোপীয়দের মানস ও মানসিকতা অধ্যয়ন করেছেন, এ সত্য তিনি অবশ্যই উপলব্ধি করবেন; এমনকি বইয়ের পাতা থেকেও তা বোঝা যাবে, যদি কেউ ধর্মীয় বাহ্যিকতা দ্বারা প্রতারিত না হয়, যা রাষ্ট্রগুলো নিছক ঐতিহ্যের প্রতীকরূপে গ্রহণ করে থাকে; তদ্রূপ যদি কেউ গীর্জার ধর্মীয় অনুষ্ঠানে ব্যাপক অংশগ্রহণ দ্বারা বিভ্রান্ত না হয়, যা মানুষ শুধু জীবনবৈচিত্র্য ও আত্মিক বিনোদনরূপে করে থাকে। জার্মান নও মুসলিম মুহম্মদ আসাদ তার ‘সঙ্ঘাতের মুখে ইসলাম’ গ্রন্থে সুস্পষ্ট ভাষায় তা উল্লেখ করেছেন।
তিনি বলেন- ‘এটা অবশ্য ঠিক যে, পাশ্চাত্যে এখনো কিছু লোক ধর্মীয় আবহে চিন্তা করে এবং জীবন যাপন করে। তাদের যথাসাধ্য চেষ্টা থাকে ধর্মীয় চিন্তা ও বিশ্বাসকে সভ্যতার মূল চেতনার সঙ্গে সঙ্গতি বিধান করে চলার। কিন্তু তারা বিরল ব্যতিক্রম। সাধারণভাবে একজন ইউরোপীয়, সে গণতান্ত্রিক হোক বা ফ্যাসিবাদী, পঁজিবাদী হোক বা সমাজতন্ত্রী, শ্রমজীবী হোক বা বুদ্ধিজীবী, জীবনে সে একটিমাত্র ধর্মের সঙ্গেই পরিচিত, আর তা হলো জড়বাদ ও বস্তুবাদ। জড়জাগতিক উন্নতিই হলো এ ধর্মের একমাত্র উপাসনা এবং এ চিন্তা-চেতনাই হলো এর মূলমন্ত্র যে, জীবন যেন হয় আরো সহজ, ভোগের আনন্দে আরো পরিপূর্ণ এবং স্বভাব ও প্রকৃতির সকল বাধাবন্ধন থেকে মুক্ত-স্বাধীন।
শিল্পকারখানা, প্রেক্ষাগৃহ, নৃত্যালয় এবং বিদ্যুৎকেন্দ্র ও রাসায়নিক গবেষণাগার হলো এ ধর্মের গীর্জাঘর, আর পুরোহিত হলেন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার, পূঁজিপতি, শিল্পপতি এবং চিত্রতারকা ও ক্রীড়াবিদ, যারা রেকর্ড ভাঙ্গেন এবং গড়েন। শক্তির এই বাঁধভাঙ্গা উন্মত্ততা ও ভোগ-আনন্দের এই বে-লাগাম উন্মাদনার অনিবার্য ফল এই হলো যে, সমাজ ও সভ্যতায় পরস্পর প্রতিদ্বন্দ্বী বিভিন্ন দলের উদ্ভব হলো এবং প্রতিটি দল অস্ত্রসজ্জিত হয়ে চাহিদা ও স্বার্থগত সঙ্ঘাতের কারণে প্রতিপক্ষকে ধ্বংস করার নেশায় মেতে উঠলো। পক্ষান্তরে সভ্যতার অঙ্গনে মানুষের এমন এক নতুন সংস্করণ তৈরী হলো যারা বিশ্বাস করে যে, লাভ ও মুনাফাই হলো সুনীতি ও সুচরিত্র, আর বস্তুবাদী সফলতাই হলো জীবনের একমাত্র আদর্শ মানদণ্ড এবং ন্যায় ও অন্যায়ের মাঝে পার্থক্যরেখা। ’ তিনি আরো বলেন- ‘পাশ্চাত্যসভ্যতা আল্লাহর অস্তিত্ব খোল্লামখোল্লা অস্বীকার করে না, কিন্তু বাস্তবে এ সভ্যতার চিন্তা- ব্যবস্থায় আল্লাহর কোন স্থান এবং ঈশ্বরচিন্তার কোন অর্থবহতা নেই। ’
ইউরোপের সমাজসভ্যতা ও ধর্ম- ব্যবসার এ বিপর্যস্ত- চিত্র এমন এক ব্যক্তি পরিবেশন করেছেন যিনি খৃস্টধর্ম ত্যাগ করে ইসলাম গ্রহণ করেছেন এবং পাশ্চাত্যের বস্তুবাদী জীবনের কাঁটাবন থেকে ইসলামের আধ্যাত্মবাদী জীবন-উদ্যানের ছায়ায় আশ্রয় গ্রহণ করেছেন, এটা যদি তাঁর বক্তব্যের মূল্যায়নের পথে বাধা হয় তাহলে আমাদের কাছে আরো জোরালো সাক্ষ্য রয়েছে, যা আপনাকে বুঝিয়ে দেবে যে, সত্যি সত্যি এ রাষ্ট্রধর্মটি তার প্রধানতম কেন্দ্রে প্রভাব ও প্রতাপ এবং সজীবতা ও প্রাণশক্তি হারিয়ে ফেলেছিলো।
ফলে নতুন প্রজন্ম ধর্মের সঙ্গে সম্পর্ক ও সম্পৃক্তির ধারণাই প্রত্যাখ্যান করে বসেছিলো। আমরা এখানে যার সাক্ষ্য তুলে ধরবো তিনি ইউরোপের বরেণ্য শিক্ষাবিদ এবং ইংরেজীভাষার শীর্ষস্থানীয় লেখক-গবেষক। লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন ও মনস-ত্ত্ব বিভাগের প্রধান প্রফেসর C.E.M. Joad তার সুবিখ্যাত গ্রন্থ Guide to Modern Wickedness এ বলেন, ‘বিশোর্ধ্ব বিশজন ছাত্র-ছাত্রীর কাছে আমার প্রশ্ন ছিলো, তাদের কতজন ন্যূনতম অর্থে খৃস্টান? মাত্র তিনজনের উত্তর, হ্যাঁ। সাত-জনের মন্তব্য, বিষয়টি নিয়ে তারা কখনো ভাবেনি। বাকি দশজন পরিষ্কার ভাষায় বলেছে, খৃস্টধর্মের প্রতি তাদের বৈরী মনোভাব রয়েছে।
আমি মনে করি, খৃস্টধর্ম যারা মানে, আর মানে না তাদের মধ্যে এই যে অনুপাত, এ ভূখণ্ডে তা বিচ্ছিন্ন নয় এবং অস্বাভাবিকও নয়। তবে এটা ঠিক যে, পঞ্চাশ বা বিশবছর আগে এ প্রশ্ন একই ধরনের কোন দলকে করা হলে অনুপাতগত দিক থেকে উত্তর অনেক ভিন্ন হতো। সুতরাং বলা যায়, যারা ক্যানন ব্যারির সঙ্গে একমত যে, খৃস্টধর্মের কোন নবজাগরণ বিশ্বকে উদ্ধার করতে পারে, তাদের সংখ্যা কমতেই থাকবে। বস্তুত এ মতের পক্ষে আমি যুক্তির শক্তি দেখতে পাচ্ছি না। হতে পারে, এটা তার স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষা।
তবে বুঝতে হবে যে, স্বপ্ন চিন্তা ও ভাবনার জন্ম দিতে পারে; তথ্য, সাক্ষ্য ও যুক্তি সৃষ্টি করতে পারে না। পরিস্থিতি ও পূর্বলক্ষণ বরং এটাই প্রমাণ করে যে, আগামী শতাব্দীতে খৃস্টীয় গীর্জার মৃত্যু ঘটবে। এ মতের সমর্থনে একটি দৈনিক পত্রিকার একটি খবর তুলে ধরছি- ‘সাতাত্তর বছর বয়সের এক ব্যক্তি একটি পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছে, যা পবিত্র ধর্মগ্রনে'র প্রাচীন কপিগুলো কার্তুস, কৃত্রিম রেশম ও কাগুজে মুদ্রার কাঁচামালে রূপান্তরিত করতে পারে। এ যন্ত্রটি কার্ডিফ ও অন্য আটটি কারখানায় স্থাপন করা হয়েছে এবং তাওরাতের প্রাচীন কপি দ্বারা রীতিমত যুদ্ধের অস্ত্র তৈরী করা শুরু হয়ে গেছে। আর উদ্ভাবক ভদ্রলোক, যিনি ছিলেন ফকীর, এ সুবাদে হয়ে গেলেন আমীর।
’
মাননীয় প্রফেসর তার বক্তব্যের সমাপ্তি টেনেছেন তাওরাতেরই একটি বাক্য দ্বারা, আর আমার ধারণায় ক্যানন ব্যারির মত যাজক ও ধর্মনেতাদের সম্বোধন করার জন্য এর চেয়ে সুন্দর বাক্য আর হতে পারে না। বাক্যটি হলো, ‘যার দু’টি কান আছে সে যেন শ্রবণ করে’। একই লেখক তার দ্বিতীয় গ্রন্থ Philosophy of Our Times-এ লিখেছেন- ‘কয়েক শতাব্দী ধরে ইংল্যান্ডের চিন্তা-চেতনায় অর্থচাহিদা ও সম্পদ-লিপ্সা জেঁকে বসেছে। বস'ত বিগত দু’শবছর সম্পদ অর্জনের চাহিদাই ছিলো এ দেশের কর্মোদ্যমের মূল চালিকাশক্তি ও প্রধান অনুঘটক। এখনো মানুষ রাজনীতি, শিল্প-সাহিত্য, চলচ্চিত্র ও বেতার প্রচার থেকে, এমনকি কখনো কখনো গীর্জার ধর্মীয় মঞ্চ থেকেও অর্থোপার্জন ও সম্পদসঞ্চয়ের প্রণোদনা ও প্ররোচনা পেয়ে আসছে।
সর্বসূত্রে এখনো তাদের এ শিক্ষাই দেয়া হচ্ছে যে, সুসভ্য ও সমুন্নত জাতি তারাই যাদের মধ্যে সম্পদস্পৃহা চরমোৎকর্ষ লাভ করেছে।
এই যে সম্পদপূজা ও অর্থলিপ্সা, এটা আমাদের ধর্মবিশ্বাস ও ধর্মীয় চেতনার বিরোধী। কারণ ধর্ম হচ্ছে দারিদ্র্য-অনুরাগী এবং বিত্তপ্রাচুর্যের নিন্দাকারী। ধর্ম বলে, সততা ও পুণ্যমনস্কতায় একজন দরিদ্র একজন বিত্তশালীর চেয়ে অগ্রগামী। এভাবে যদিও ধর্মপ্রজ্ঞা ও ধর্মীয় সুনীতির দৃষ্টিতে ঈশ্বর-উপাসনা ও স্বর্গপ্রবেশের জন্য দারিদ্র্যই অধিকতর উপযোগী, কিন্তু মানুষ ‘ধর্মকথা’ ও গীর্জীয় সুবচন অনুসরণে আগ্রহী নয়।
এখনো তারা প্রতিশ্রুত স্বর্গীয় সম্পদের চেয়ে নগদ জাগতিক সম্পদেই বেশী আগ্রহী। সম্ভবত তাদের ধারণা, জীবনের শেষভাগে পাপস্বীকারের মাধ্যমেই তাদের পরকাল নিরাপদ হয়ে যাবে, যেমন স্ফীত ‘ব্যাংকব্যালেন্স’ দ্বারা জাগতিক জীবন ও ভোগ-উপভোগ নিশ্চিত হয়ে আছে। সমকালের এই সাধারণ চিন্তাকে স্যামুয়েল বাটলার তার গ্রন্থে এভাবে প্রকাশ করেছেন- ‘কতিপয় অর্বাচীন লেখক-চিন্তাবিদ ভাবেন, একই মস্তিষ্কে যুগপৎ আমরা ঈশ্বরচিন্তা ও বিত্তচিন্তা করতে পারি না। আমিও স্বীকার করি, তা সহজ নয়। কিন্তু পৃথিবীর কোন কাজটি কবে সহজ হয়েছে?! মোটকথা, আমাদের নীতি ও বোধ যাই হোক, বিদ্যমান বাস্তবতা এটাই অর্থলিপ্সা ও সম্পদাসক্তিতে আমরা আকণ্ঠ নিমজ্জিত এবং আমাদের কার্যত বিশ্বাস, সম্পদই হচ্ছে ব্যক্তি ও রাষ্ট্রের বড়ত্বের সঠিক মানদণ্ড।
এই চিন্তা-চেতনা থেকেই পৃথিবীতে দু’টি চালিকা- নীতি জন্মলাভ করেছে এবং তাদের বিরাট ঐতিহাসিক গুরুত্ব রয়েছে। প্রথমত হস্তক্ষেপমুক্ত অর্থনীতির মৌলধারণা, যা ঊনিশ শতকে অতি প্রবল ছিলো। এ মূলনীতির প্রবক্তারা দাবী করেন, সর্বোত্তম মুনাফাই হচ্ছে মানুষের যাবতীয় কর্মোদ্যগের ভিত্তি। তাদের মতে হৃদয়ের আনন্দাবেগ কর্মের উৎস নয়, বরং সম্পদ- ভোগের আনন্দই হচ্ছে মূল চালিকাশক্তি। দ্বিতীয় মূলনীতিটি বিশশতকে প্রায় অপ্রতিহত গতিতে ধেয়ে এসেছিলো, যা মার্কসীয় মতবাদরূপে পরিচিত।
এ মূলনীতির শিরোনাম হলো অর্থবণ্টনব্যবস্থা এবং এর মূলকথা হলো, মানবসমাজে অর্থনৈতিক ব্যবসার উদ্ভবের মূল ভিত্তি হলো জীবনে অর্থের অনিবার্য প্রয়োজন। বস্তুত অর্থ-প্রয়োজন ও অর্থ- ব্যবসাই ধর্ম, সাহিত্য, নীতি, চরিত্র, জ্ঞান ও যুক্তি এবং শাসন ও প্রশাসনব্যবস্থার জন্ম দেয়। বলাবাহুল্য যে, এ দুই মতবাদের এ বিপুল জনপ্রিয়তা কিছুতেই সম্ভব হতো না, যদি নারী-পুরুষ নির্বিশেষে আমাদের দেশবাসী অতিসম্পদমুখী ও অর্থলিপ্সু না হতো। হাঁ, এটা এজন্যই সম্ভব হয়েছে যে, নারী-পুরুষ সকলেই লক্ষণীয়ভাবে বিত্ত-প্রাচুর্যকেই সৌন্দর্য ও জৌলুসের ভিত্তিরূপে গ্রহণ করেছে। ’
একই গ্রন্থের অন্যত্র তিনি বলেন- ‘যে জীবনবোধ এ যুগের চিন্তা-চেতনাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে তা এই যে, জীবন ও জগতের সবকিছু পকেট ও পাকস্থলীর দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার্য।
সুপ্রসিদ্ধ মার্কিন সাংবাদিক মিস্টার জনগুন্থার তার Inside Europe গ্রন্থে এ চরম বস্তুবাদী মানসিকতা বড় সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন, তিনি বলেন- ‘ইংরেজজাতি সপ্তাহের ছয়দিন পূজা করে ব্যাংক অব ইংলেন্ডের, আর সপ্তম দিন হাজিরা দেয় গীর্জায়। ’
ইউরোপের বস্তুবাদী স্বভাব ও পরিণতি
এটা তো খুবই স্বাভাবিক যে, যারা অনন্ত জীবনে বিশ্বাসী নয়, তদুপরি ক্ষণস্থায়ী জীবনের ক্ষণিক ভোগ-বিলাস এবং ব্যক্তিগত ও জাতীয় উচ্চাভিলাষ ছাড়া যাদের মহৎ কোন লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নেই এবং যাদের অন্তরে আল্লাহর প্রতি ভয় ও ভালোবাসা নেই তাদের কাছে কীভাবে আশা করা যায় যে, বিপদে-দুর্যোগে ও ঝড়তুফানের মুখে তারা আল্লাহকে ডাকবে এবং আল্লাহর কাছে কাকুতি-মিনতি ও আত্মনিবেদন করবে! দেখুন, আল্লাহকে বিশ্বাস করতো বলে মুশরিকরাও বিপদে যেভাবেই হোক আল্লাহকে ডাকতো। কোরআন বলছে- ‘যখন বিশাল ঢেউ তাদের উপর আছড়ে পড়ে তখন তারা আল্লাহকে ডাকে শুধু তাঁর প্রতি নিবেদিত হয়ে, আর বলে, যদি আপনি উদ্ধার করেন আমাদের এই বিপদ থেকে, অবশ্যই আমরা শোকরগুজার হবো। (অবশ্য বিপদশেষে তারা তা ভুলে যায়। ) কিন্তু ইউরোপের এ জনগোষ্ঠী বস্তুবাদী চিন্তা-চেতনায় এতই আচ্ছন্ন এবং জড়জাগতিক ‘কার্যকারণ’ দর্শনে এমনই অভ্যস-, সর্বোপরি তাদের অন্তর এতই আল্লাহবিমুখ, এতই রুক্ষ-কঠিন ও অনুভূতিহীন যে, কোরআনের এ আয়াতের তারাই যেন বাস্তব চিত্র, বরং তাদেরই সম্পর্কে যেন তা নাযিল হয়েছে।
আল্লাহ বলছেন- ‘আর আপনার পূর্বে বিভিন্ন জাতির কাছে আমি অহী প্রেরণ করেছি (কিন্তু তারা তা গ্রহণ করেনি), অনন্তর তাদের আমি পাকড়াও করেছি বিপদ ও দুর্যোগ দ্বারা, যাতে তারা কাকুতি-মিনতি করে। তো কত না ভালো হতো, যদি তারা বিগলিত হতো তাদের কাছে আমার বিপদ নেমে আসার পর, কিন্তু হৃদয় তাদের কঠিন হয়ে গিয়েছিলো, আর তারা যা করতো, শয়তান তাদের সামনে তা মনোহররূপে তুলে ধরেছিলো। ’ অন্য আয়াতে- ‘আর পাকড়াও করেছিলাম তাদেরকে আযাব দ্বারা, কিন্তু তারা তাদের প্রতিপালকের প্রতি বিনীত হয়নি ও কাকুতি-মিনতি করেনি। ’ উপরের আয়াতদু’টির আয়নায় ইউরোপের চিত্র ও চরিত্র অবলোকন করুন। বিশ্বযুদ্ধের কঠিন সংকটকালে ইউরোপের বিভিন্ন দেশের শাসক ও রাষ্ট্রনায়ক জাতির উদ্দেশ্যে যেসব ভাষণ ও বক্তব্য-বিবৃতি দিতেন তাতে বিগলিত হৃদয়ে সাহায্যের জন্য আল্লাহর প্রতি আত্মনিবেদন ও কাকুতি-মিনতির কোন ভাব ও ছাপ আপনি দেখতে পাবেন না।
একই ভাবে জাতি ও জনগোষ্ঠীর চরিত্র ও কর্মকাণ্ডেও এর কোন ছোঁয়া ও চিহ্ন খুঁজে পাবেন না। সবসময় তারা মত্ত ছিলো মওজ ও মজা, ফুর্তি ও স্ফূর্তি এবং গরম হৈহুল্লুড়ে; এমনকি তখনো যখন নেমে আসতো মৃত্যুর বিভীষিকা। পাশ্চাত্যের লেখক, সাহিত্যিক ও চিন্তাবিদগণ এটাকে চরম প্রতিকূলতার মুখে অদম্য সাহস ও মনোবল বলে গর্ব ও গৌরব বোধ করেন। ব্রিটিশ পার্লামেন্টে শীর্ষস্থানীয় জনৈক নেতা গর্বভরে বলেছেন, ‘ব্রিটিশ-জাতি কোন পরিস্থিতি ও দুর্যোগের সামনে কখনো ভাঙ্গেনি এবং মচকায়ওনি। তারা সটান দাঁড়িয়ে থেকেছে মাথা উঁচু করে।
’ প্রমাণরূপে তিনি বলেন- ‘সিঙ্গাপুরের আকাশ থেকে যখন ঝাঁকে ঝাঁকে জাপানী বোমা পড়ছিলো তখনো সেখানে বৃটিশদের নাচগান ও আনন্দ-বিনোদনে ছেদ পড়েনি এবং কোন অনুষ্ঠান বন্ধ হয়নি। ’
কিন্তু আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসে নিবেদিত একজন মুমিনের দৃষ্টিতে এটা সাহস ও সাহসিকতা এবং মন ও মনোবলের দৃঢ়তা নয়, বরং এটা মুর্দাদিলের কঠিনতা, আত্ম-বিস্মৃতি ও ভোগস্ফূর্তির উন্মত্ততা। ইউরোপপ্রবাসী জনৈক ভারতীয় ‘লন্ডনের একটি রাত’ শিরোনামে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বিমানহামলা- কালীন স্মৃতিকথায় লিখেছেন- ‘দিন-রাতের লাগাতার বিমানহামলায় অতিষ্ঠ হয়ে আমি ও বন্ধুরা ঐ রাতে নাচগানের একটি জমকালো জলসার আয়োজন করলাম। আমরা যখন উদ্দাম আনন্দে উন্মত্ত তখন হঠাৎ বিমান হামলার সাইরেনে জলসা স্তব্ধ হয়ে গেলো। বিহ্বলতা কাটিয়ে ওঠার পর একজন জানতে চাইল, ‘চলবে, না বন্ধ?’ সবার আগে ফুর্তিবাজ এক তরুণী বলে উঠলো, ‘মরতে হয় নেচে-গেয়ে হেসে-খেলেই মরি!’ ব্যস, নাচে-গানে, উদ্দাম আনন্দে জলসা আবার উন্মাতাল হয়ে উঠলো।
জলসা তো জলসা, পুরো এলাকা যেন উল্লাসে উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়লো।
লেখক আরো বলেন, এর পর তো রেওয়াজ হয়ে গিয়েছিলো যে, সন্ধ্যায় সাইরেন বাজতো, বিমান আসতো, আলো নিভতো, কামান গর্জে উঠতো এবং অন্ধকার আকাশে আতশবাজির ফুলঝুরি শুরু হতো। তখন পেক্ষাগৃহে ছবিপ্রদর্শনের মাঝখানে পর্দায় লেখা ভেসে উঠতো, ‘বিমানহামলা চলছে, ছবিও চলবে, কেউ আশ্রয়- কেন্দ্রে যেতে চাইলে রাস্তা বামে নীচের দিকে। ’ কিন্তু কেউ উঠতো না, ছবির প্রদর্শন যথারীতি চলতে থাকতো। ’ রঙ্গতামাশা ও ফুর্তিবাজির এই উন্মাদনা এবং গাফলত ও আত্মবিস্মৃতির এই নির্জীবতার নমুনা প্রাচীন গ্রীস ও রোমের সমাজজীবনেই শুধু পাওয়া যায়।
ইতিহাসের পাতায় আছে, পাম্পেই নগরীর জেগে ওঠা আগ্নেয়গিরি যখন লাভা উদ্গীরণ শুরু করলো তখন একদিকে আকাশ থেকে অগ্নিবৃষ্টি হচ্ছে, অন্যদিকে গলিত লাভার প্রবাহ ধেয়ে আসছে। সময় তখন বিকেল। বিশহাজার দর্শক- ধারণক্ষমতার বিশাল এমফি থিয়েটার পরিপূর্ণ। হিংস্র পশুর দন্ত-নখরের আঘাতে জীবন- মানুষের ছিন্নভিন্ন হওয়ার বীভৎস দৃশ্য সবাই পাশবিক আনন্দে উপভোগ করছে। ঠিক তখন হলো ভূমিকম্প।
যে যেখানে ছিলো, ভস্ম হয়ে গেলো। যারা বের হতে পারলো তারা ধাক্কাধাক্কি ও ঠোকা- ঠুকিতে এবং পদপিষ্ট হয়ে খতম হলো। অল্পক’জন ভাগ্যবান শুধু নৌকা ও জলযানে করে প্রাণ বাঁচাতে পারলো। সুদীর্ঘ আঠারোশ বছর শহরটি পৃথিবীর মানচিত্র থেকে অপসৃত ছিলো। উনিশ শতকে এসে জানা গেলো, শহরটি নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়নি, গলিত লাভার নীচে চাপা পড়েছে শুধু।
দীর্ঘ খননকার্যের পর কুদরতের ইনতিকাম ও প্রতিশোধের জীবন- নমুনারূপে পুরো শহরটি আবার যেমন ছিলো, পৃথিবীর মানচিত্রে ভেসে উঠলো। আলকোরআনের সতর্কবাণী- ‘জনপদের অধিবাসীরা কি এ বিষয়ে নির্ভয় যে, তাদের কাছে আসবে না আমার আযাব সকাল বেলা, যখন তারা খেলাধূলায় মশগুল থাকবে!’ যুদ্ধের বিভীষিকার সময়, যখন মাতালেরও নেশা কেটে যায় এবং পাষাণ হৃদয়ও বিগলিত হয়ে আল্লাহকে স্মরণ করে, তখন ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী মিস্টার চার্চিল যেভাবে বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণ উদ্যাপন করেছেন তার বিবরণ রয়টারের সংবাদদাতার মতে- ‘ওয়াশিংটন। পয়লা জানুয়ারী, ১৯৪২। গত রাতে বিদায়ী বছর ও নতুন বছর যখন এক বিন্দুতে, মিস্টার চার্চিল তখন সরকারি ট্রেনে কানাডা থেকে যুক্তরাষ্ট্রের পথে। মিস্টার চার্চিল স্যার সারলিস বারটালকে সঙ্গে করে অকস্মাৎ ট্রেনের রেস্টুরেন্টে প্রবেশ করলেন।
মুখে সিগার, হাতে শ্যাম্পেন। সফরসঙ্গীরা দেখে অবাক! কারণ যুদ্ধ তখন ঘোরতর। মিস্টার চার্চিল মৃদু হেসে গ্লাসে চুমুক দিয়ে বললেন, ‘বিদায়ী বছর ১৯৪১-এর নামে পান করছি; সেই বছর যা আমাদের নিয়ে এসেছে পরিশ্রম, ক্লানি- ও বিজয়ের দিকে। ’ তখনই ঘড়িতে বিদায়ী বছর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলো এবং নতুন বছর প্রথম শ্বাসটি গ্রহণ করলো। সবাই চার্চিলকে অভিনন্দন জানালো।
আর তিনি দুই সফর- সঙ্গীকে দু’হাতে ধরে নৃত্যের তালে তালে গান গাইলেন। পরে দরজার দিকে অগ্রসর হয়ে বললেন, আপনারা আনন্দিত থাকুন। ঈশ্বর আমাদের বিজয় দান করুন। সকলে তখন তুমুল করতালি ও উদ্দাম নৃত্যের মাঝে গান গাইতে লাগলো, আর মিস্টার চার্চিল ভি চিহ্ন প্রদর্শন করে উৎফুল্লচিত্তে আপন কম্পার্টমেন্টে ফিরে গেলেন। ’
ধর্মহীন এই বস'বাদী স্বভাব ও প্রবণতার সঙ্গে ধর্মের শিক্ষা ও ধর্মীয় চিন্তা-চেতনাকে তুলনা করে দেখুন।
আল্লাহকে যারা বিশ্বাস করে এবং ভয় করে যুদ্ধবিগ্রহ ও বিপদ-দুর্যোগের সময় তাদের আচরণ ও কর্মপন্থা কত ভিন্ন তা কিছুটা হলেও বোঝা যায় কোরআনের এই আয়াতে- ‘হে ঈমানদারগণ, যখন তোমরা কোন দুশমনদলের সম্মুখীন হও তখন অবিচল থেকো, আর আল্লাহকে বেশী করে স্মরণ করো, যাতে তোমরা সফলকাম হও। ’
ছাহাবা কেরাম বলেন, ‘যখন কোন পেরেশানির বিষয় ঘটতো, নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সঙ্গে সঙ্গে নামাযে দাঁড়িয়ে যেতেন। সীরাতে ইবনে হিশামে গাযওয়ায়ে বদরপ্রসঙ্গে আছে, নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছাহাবা কেরামের সারি সোজা করলেন, তারপর ‘আরীশ’-এ দাখেল হলেন। সেখানে তাঁর সঙ্গে শুধু আবু বকর (রা) ছিলেন, অন্য কেউ ছিলো না। তিনি তখন জারজার কাঁদছিলেন এবং আল্লাহ তা‘আলা বিজয়ের যে ওয়াদা করেছেন তা পূর্ণ করার মিনতি জানাচ্ছিলেন।
তাঁর একটি নিবেদন ছিলো- ‘হে আল্লাহ, যদি আজ এই জামা‘আত হালাক হয়ে যায় তাহলে তো তোমার ইবাদত হবে না!’
বিভিন্ন ঐতিহাসিক, বুদ্ধিবৃত্তিক ও স্বভাবগত অনিবার্য কারণে ইতিহাসের প্রাচীনতম সময় থেকেই জড়বাদ ও বস্তুবাদই হয়ে পড়েছিলো পাশ্চাত্যের জীবন ও সভ্যতার প্রতীক। ইউরোপের রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক নবউত্থান সেটাকে নতুন গতি ও শক্তি দান করেছে মাত্র। প্রাচ্য ও পাশ্চাতের বহু বিদগ্ধ পণ্ডিৎ পাশ্চাত্যসভ্যতার এ বস্তুবাদী বৈশিষ্ট্যটি সম্যক অনুধাবন করতে পেরেছেন। প্রাচ্যের বিদগ্ধ জ্ঞানী ও দূরদর্শী পর্যটক আব্দুর রহমান আলকাওয়াকিবী বর্তমান শতাব্দীর শুরুতে রচিত طبائـع الاستبداد গ্রন্থে লিখেছেন- ‘পাশ্চাত্যের জীবন আগাগোড়া বস্তুবাদী জীবন। মানুষ সেখানে নিছক বস্তুবাদের পূজারী।
স্বভাবে কঠোর, আচরণে কঠিন, সম্পর্কে বিষয়ী, অতি আত্মকেন্দ্রিক এবং অতি প্রতিশোধপরায়ণ। প্রাচ্যের খৃস্টবাদ যে সকল উচ্চতর মানবিক গুণ ও বৈশিষ্ট্য এবং ভাব ও আবেগ তাকে দান করেছিলো তার কিছুই যেন এখন অবশিষ্ট নেই। যেমন, জার্মানরা স্বভাবে প্রকৃতিতে খুবই নিষ্ঠুর। তারা মনে করে, দুর্বলের বেঁচে থাকার অধিকার নেই; মৃত্যুই তার প্রাপ্য। তাদের দৃষ্টিতে সকল মহত্ত্বের মূলে হচ্ছে ‘শক্তি’, আর শক্তির উৎস সম্পদ।
জ্ঞান ও বুদ্ধিচর্চায় তারা আগ্রহী এবং গৌরব ও মর্যাদা অর্জনে বদ্ধপরিকর, তবে সম্পদ লাভের জন্য। ল্যাটিন ও ইটালীয়রা স্বভাবতঃ আত্মতুষ্ট ও রগচটা। তারা ভাবে, বুদ্ধির পরিচয় হলো বাধাবন্ধন- হীনতায়, জীবনের সার্থকতা হলো লজ্জাহীনতায় এবং মর্যাদা হলো পোশাক-সৌন্দর্যে, আর প্রতিপত্তি হলো প্রাধান্য অর্জনের মধ্যে। ’ পাশ্চাত্যের স্বভাব ও প্রকৃতি এবং ভাবধারা ও মনস্তত্ত্বের এটি হচ্ছে সবচে’ নির্ভুল ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ ও নিখুঁত চিত্রাঙ্কন। আমরা মনে করি, মরহূম আলকাওয়াকিবী নিছক উদাহরণ হিসাবে জার্মান-ইটালী দুই জনগোষ্ঠীর কথা বলেছেন, অন্যথায় কিছু পার্শ্ববিষয় ও কিছু জাতীয় বৈশিষ্ট্য বাদে বস্তুপূজা, সম্পদলিপ্সা, আত্মকেন্দ্রিকতা, স্বার্থপরতা, আচরণের কঠোরতা ইত্যাদি ক্ষেত্রে পাশ্চাত্যের সকল জাতি অভিন্ন।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।