আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

শান্ত নদীটি পটে আঁকা ছবিটি......

. আমার নাইবা হলো পারে যাওয়া...
শান্ত নদীটি পটে আঁকা ছবিটি। ছোটবেলা থেকেই নদীর প্রতি কি যেনো এক টান, এক আকর্ষন অনুভব করতাম। নদীকে আমার খুব আপন মনে হয়। খুব ছোটবেলায় এক খালার বাসায় বেড়াতে যেয়ে খালাতো ভাইটির মুখে আধো আধো বোলে প্রথম শুনেছিলাম নদীর কথা। “আমাদেল ছোত নদী তলে বাঁকে বাঁকে”......... তখন থেকেই নিজের মনের মাধুরী মিশিয়ে এঁকে গেছি কতনা ছবি।

ছোট্ট একটি নদী, উঁচু পাড়ে সাদা কাশের বন। চিকচিকে সাদা বালুচরে বাদামী রঙের শালিখের ঝাকের মেলা, মাটির হাড়িকুড়ি ভর্তি গরু-গাড়ী ক্যাঁচড়-ক্যাঁচড় করে পাড় হয়ে যাচ্ছে। ছোট ছোট ছেলে-মেয়ে পানিতে ঝাপুর-ঝুপুর করছে, গামছা দিয়ে ছোট মাছের ঝাঁক ধরছে। কখনো নদী দুর্বার গতিতে ছুটে চলছে। গেরুয়া বসন পরা নদী যেনো আমারই মত চঞ্চল, অস্থিরমতি।

তোলপাড় করছে, ফুঁসছে, ভাঙ্গছে। চারিদিকে ভাঙ্গনের শব্দ। প্রথম নদীর সাথে মিতালি আমার ৬ বছর বয়সে। নদী নয়, নদ। ব্রহ্মপুত্র নদ।

শহরের এক পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া এই নদ আমায় ভিষন ভাবে আকর্ষন করতো। ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে সার্কিট হাউজের মাঠের ধারে ছিলো সারি বাধা বকুল ফুলের গাছ। ভোরে উঠে ছুটে যেতাম সেখানে। কোঁচড় ভরে ফুল তুলে কখনো ঘরে নিয়ে আসতাম, কখনো বা বর্ষার ভরা নদীর পাড়ে বসে মুগ্ধ হয়ে পানির ঘুর্নী দেখতে দেখতে ফুলগুলি ঢেলে দিতাম। দেখতাম, কি নিমিষে ফুলগুলো হারিয়ে যেতো স্রোতের তোড়ে।

শীতে ব্রহ্মপুত্র যেনো শান্ত-শিষ্ট সুবোধ বালক। চরে অসংখ্য কাশ-ফুল ফুটে থাকতো। নদী তীরে সার বেধে যাযাবর বেদে নৌকা আমায় মন্ত্র-মুগ্ধের মতো আকর্ষিত করতো। তাদের জীবন-যাপন আমায় এতোটাই মুগ্ধ করতো যে আমি মনে মনে সংকল্প করেছিলাম, বড় হয়ে আমি যাযাবর বেদে হবো। নদীর বুকে ভেসে বেড়াবো দেশে দেশে।

কিন্তু ওদের মত সাপ নাড়াচাড়া করবোনা। সাপ দেখলেই আমার গা ঘিন ঘিন করে। সকালে বেদেনীরা দল বেধে মাথায় চারকোনা বাক্সে সাপ, বেতের চুবড়িতে আলতা, কাঁচের চুড়ি, স্নো, পাউডার নিয়ে বেড়িয়ে পড়তো। নানা রকম শিকড় বাকড় দিয়ে তারা দাঁতের পোঁকা বের করতো, মোষের শিং দিয়ে বিষ রক্ত টেনে বের করতো। সারাদিন শহরের অলিতে গলিতে তারা সুর করে ডেকে যেতো, “সাপের খেইইইইইলচুড়িইইইইই, দাঁতের পোঁক ফেলিইইইইইই, শিঙ্গা লাগাইইইইইইই, তাদের সেই সুরেলা ডাক শুনলে কেমন যেনো নেশা লাগতো।

বিকেলে তারা নৌকায় ফিরে আসতো। বাক্স, চুবড়ি, পিঠে ঝোলানো বাচ্চা নামিয়ে নদীতে গোসল করে নৌকার পাটাতনে টিনের বালতিতে বানানো মাটির চুলায় রান্না করতো মাছের ঝোল-ভাত, বেগুন-পোড়া। আমি বসে বসে খুব মনোযোগ দিয়ে তাদের এই ভাসমান ঘর সংসার দেখতাম। কাজের ফাঁকে ফাঁকে কখনো তারা আমার সাথে কথা বলতো। বাচ্চাগুলো কি নির্ভয়ে নদীতে ঝাপুর-ঝুপুর করতো।

মায়েদের কোন বারন নেই, ধমক নেই, ওরা যেনো জলের স্বাধীন বাসিন্দা। বংশী নদীকে প্রথম দেখি সাভারের কর্ণপাড়ায়। শান্ত এই নদীটি আমার খুব ভালো লেগেছিলো। উঁচু পাড় নেই, বালুর চর নেই, লালমাটির মাঝখান দিয়ে এঁকেবেঁকে বয়ে চলা বংশীতীরে দেখা পেয়েছিলাম বেদের বহরের। কোন চেনা মুখ না দেখলেও তাদের খুব আপনারজন মনে হয়েছিলো।

নদীতীরে ঝিনুকের খোলের স্তুপ দেখে জেনেছিলাম, তারা এগুলো খুলে মুক্তোর সন্ধান করেছে। যে দুদিন ওখানে ছিলাম, সারাদিন নদীর বুকে ঝিনুকের বুকে মুক্তো খুঁজে বেড়িয়েছিলাম। মুক্তো না পেলেও বংশী নদীকে মুক্তো করে মনের ঝিনুকে বন্দী করেছিলাম। বহুদিন পর সে নদীর তীরেই আমার “মা” আমাদের জন্য অনেক যত্ন করে “আশ্রয়” তৈরী করেছিলেন। কতো সকাল, বিকেল সে নদীতীরে বাবলার ছায়ায় বসে কাটিয়েছি।

কতো পুর্নিমা দেখেছি সে নদীর জলে। গভীর রাত পর্যন্ত সে নদী তীরে বসে থাকতাম। যদিও ঘরের জানালা দিয়েই নদী দেখা যায়। তবুও নদীতীরে বসলে মনে হতো আমি আর নদী অনেক কাছা-কাছি। সারি বাঁধা সেই বাবলার সারি আজ নেই।

নেই সেই আগের বংশী নদী। আমিই কি সেই আগের মতো আছি? গোপালগঞ্জের জলিরপাড়ে দেখা পেয়েছিলাম কুমার নদের। খালু ছিলেন টোল ইন্সপেক্টর। নদী তীরেই উনার অফিস আর বাসা। সেই কুমার নদের তীরেও কাটিয়েছি একটি মাস।

সে নদেই প্রথম শুশুক দেখেছিলেম। কালো কালো শুশুকগুলি ডিগবাজি দিয়ে উপস্থিতি জানান দিতো। নদীতে বাধানো ঘাটে গোসল করেছি খালাতো ভাই-বোনের সাথে। ঘাটের সিড়ির খাঁজে হাত ঢুকিয়ে চিংড়িমাছ বের করে ছুড়ে দিতাম পাড়ের সবুজ ঘাসের উপর। তীরে দাঁড়ানো উতফুল্ল ছেলে-মেয়েরা সেগুলো কুড়িয়ে নিয়েছে।

তখন নতুন সাতার শিখেছি মাত্র। ভাইয়া গোসল করার সময় ডুব দিয়ে নৌকার তলায় চলে গিয়েছিলো। মাথা উঠাতে পারছিলোনা। ভাগ্যি ভালো নৌকার মাঝিরা কি করে যেনো বুঝতে পেরে ভাইয়াকে উদ্ধার করেছিলো। সে যাত্রা ভাইয়া প্রানে বেঁচে গেলেও আমাদের নদীতে গোসল নিষেধ হয়ে গেলো।

গোসল নিষেধ হলেও নদীর সামনে থেকে নদীতে না নেমে কি পারা যায়? অন্য দিক দিয়ে আমরা নদীতে নামতাম। একদিন নৌকায় করে নদী পার হয়ে একটি গ্রামে গিয়েছিলাম। সেখানে কি সুন্দর একটি গির্জা ছিলো। ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা যে স্কুলে পড়তো, সেটা গির্জার সিস্টাররা চালাতেন। নদীতীরে অনেক ঝাকড়া গাব গাছ ছিলো।

কমলা রঙের পাঁকা গাব খেয়ে বিঁচি দিয়ে নদীর বুকে হাতের জোর পরিক্ষা করতাম। কে কত জোরে ছুড়তে পারে। নদী তীরে গ্রাম্য হাট আর হাটুরে সেখানেই প্রথম দেখি। মৌ্লভীবাজারে মনুনদীর সাথে পরিচয়। সে নদীর সাথেও আমার অনেক সখ্যতা হয়েছিলো।

মনু নদীর পাড় ছিলো অনেক খাড়া। সেই খাড়া পাড় ধরে হাটতে হাটতে অনেক দূরে চলে যেতাম। মাঝে মধ্যে ঘরে ফিরতেও দেরী হয়ে যেতো। মায়ের বকুনি, পিটুনি তো নির্ধারিত ছিলো। রাগ করে মা বলতেন, "এই নিশি পাওয়া মানুষের মতো কোথায় ছুটিস? নদী কি তোকে যাদু করেছে"? যাদুই বোধহয় করেছে।

তাইতো আজো আমি সুযোগ পেলেই নদীর কাছে চলে যাই। মনু নদীর বুকেও আমার অনেক ভালোবাসা ছড়িয়ে আছে। ছড়িয়ে আছে পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, গড়াই, গোমতী, কালী, নদীর বুকেও। এখন সুরমা নদীর সাথে আমার মিতালি। চোখে দেখা না গেলেও সুরমার উপস্থিতি সব সময় অনুভব করি।

মাঝে মাঝে বিকেলে চলে যাই সুরমার তীরে। বসে বসে ঢেউ গুনি। নদীর সাথে কথা বলি। নদী নিশ্চয় আমার কথা শুনতে পায়। “ও নদীরে একটি কথা শুধাই শুধু তোমারে, বল কোথায় তোমার দেশ তোমার নেই কি চলার শেষ”।

নদীর সাথে এই কথপকথন আমার নিরবেই বয়ে চলে।
 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।