আমার খুব কষ্ট হয়, যখন RAJAKAR বানানটা বাংলা বর্ণমালায় লিখা হয়। এটা বর্ণমালার জন্য অপমান।
মধ্যরাতের আসামী (প্রথমাংশ)
-'কোথায় যাওয়া হচ্ছে?'
আমি একবার ঢোক গিললাম।
-'টুট-টুকের বাজার। '
-'এতো রাত্রে টুকের বাজারে কি?'
ভাববাচ্যে কথা হচ্ছে।
মনে হয় আমার লেভেল মাপার চেষ্টায় রত। র্যাবের এই দলটা নিয়মিত টহলে ছিল। আমার কপাল খারাপ! লিচু চোর তো তবু মালির ঘাড়ে পড়েছিল। কিন্তু আমি ম্যাংগোপিপল হয়েও পুরা মালিকের ঘাড়েই পড়েছি। বাংলাদেশে বিভিন্ন আলোচিত মৌসুম থাকে।
আর্মি সিজন, কেয়ারটেকার সিজন। ওই সময়টা ছিল পুরাই র্যাব সিজন। মামারা তখন ক্ষমতার তুঙ্গে। সুতরাং কোমরের কাছে জগদ্দল হয়ে থাকা চারটে নল যেন কামানের ব্যারেল মনে হচ্ছিল।
আমি প্রশ্নের উত্তর দেবার আগেই একজন বললো'
-আই.ডি কার্ড আছে কোন?
হালে পানি পেলাম।
জানি, মানিব্যাগের ভেতর আছে। লেমিনেটিং করা। বৃষ্টিতেও অটুট থাকে।
মুখে বললাম, 'আছে'।
পকেট হাতড়ে খুঁজে বের করতে গিয়ে খোঁচা খেলাম নলের।
একজন হাত বাড়িয়ে কার্ডটা নিল। ইতোমধ্যে গাড়ির টেল লাইট আর কেবিন লাইট জ্বালানো হয়েছে। সেই আলোতে আমার আই.ডি কার্ড দেখে তার বত্রিশ দন্ত বিকশিত হয়ে গেল।
বললো, 'কইছিলাম না স্যার, ভার্সিটির পোলা? এইগুলা বদের হাড্ডি। '
আমার মনে হল, যেন আমি ভার্সিটির স্টুডেন্ট থাকা না থাকার উপর নির্ভর করছে তার চাকরীর মেয়াদ।
আই.ডি কার্ড গাড়ির ভেতরে চলে গেল।
একটু পর মনে হল, কোমরে লেগে থাকা চারটে শীতল বস্তুর চাপ কিছুটা শিথিল। একটু নড়েচড়ে দাঁড়ালাম। আসলে নল গুলো সরিয়ে নেয়া হয়েছে। ঠান্ডায় অসাড় শরীরে তাই স্পর্শের অনুভূতিটা লেগে আছে।
গাড়ি থেকে নেমে এলেন আরেকজন।
-'কোথায় যাচ্ছিলেন? এ এলাকা তো ভালো না'। এতো রাত্রে চলাফেরা করাটা ঠিকনা, জানেন না?'
সম্বোধনের উন্নতি দেখে হাফ ছেড়ে বাঁচলাম।
-'বললাম, উপায় ছিলনা। আসলে প্রয়োজনটা জরুরী কিনা!'
-'প্রয়োজন গুলো দিনের আলোয় সেরে নিলেই কি ভালো নয়?'
তর্ক করতে ইচ্ছে করছিল না।
শুনেছি বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা, পুলিশে ছুলে ছত্রিশ, আর র্যাব ছুঁলে ঘা'এর কোন ব্যাপার নেই। সোজা কর্তন। ধর তক্তা মারো পেরেক টাইপ। আদ্যোপান্ত বললাম তাকে। শুনে একেবারে বিশ্বাস করেছে তা নয়, তবে নরম হয়েছেন বোঝা গেল।
বললেন, 'ঠিক আছে, আপনি যান। আমরা পেছন পেছন আসছি'।
আমার স্বস্তির নিঃশ্বাসটা বোধ করি বাতাসের বেগকে একটু বাড়িয়ে দিল। রাস্তায় পড়ে থাকা সাইকেলটা তুলে নিয়ে তার পিঠে চড়ে বসলাম। মনে মনে বললাম, 'গার্ড অফ অনার'।
জোরে বলিনি। শুনলে খবর আছে!
টের পাচ্ছিলাম পেছন পেছন গাড়িটা আসছে। যথারীতি হেডলাইটটা বন্ধ। জীপের ড্রাইভারের প্রতি কিছুটা শ্রদ্ধা জাগল। ব্যাটার চোখটা বিলাই চোখ।
যাই হোক, অবশেষে পৌঁছলাম টেম্পু স্ট্যান্ডে। ধু-ধু মরুভূমি। পেছনে তাকিয়ে দেখি গাড়িটা দাঁড়িয়ে আছে। বুঝলাম, আমার শেষ না দেখে এরা ছাড়বেনা। কিন্তু মাথায় তখন অন্য চিন্তা, টেম্পু না পেলে পিচ্চিগুলার কি হবে! টেনশন লাগছে।
দিশেহারাও লাগছে কিছুটা।
ইউরেকা!
পেছনে গাড়িটা তখনো দাঁড়ানো। আমি ড্রাইভারদের থাকার ঝুপড়ি ঘরের দরজায় কিল মারলাম।
-'এই যে মামা, কেউ আছেন?' কোন সাড়া নেই। খালি নাকি? তাহলে তো সব্বোনাশ! আড়চোখে গাড়িটা দেখছি।
আছে তখনো। আমি আবার কিল মারলাম। এভাবে কিছুক্ষণ ধাক্কানোর পর চরম বিরক্তি নিয়ে একজন দরজা খুলল।
-'কিতা অইছে? দরজা ধাক্কান কিতার লাগি?'
বললাম, ট্যাম্পু লাগবে। ইমার্জেন্সী।
-'অইতোনা। যাওগি। '
আমি বললাম, যাওয়া লাগবেই মামা। আপনি না পারেন, অন্য কাউকে ম্যানেজ করে দেন।
মামায় ট্রাম করলো।
-'এতো মাতেন ক্যানে? কইলাম অইতোনা!'
এবার আমি ওভার ট্রাম করলাম,
-'পিছনের গাড়িটা দেখছেন? র্যাবের গাড়ি?
সে তাকিয়ে দেখলো ঘুম ঘুম চোখে।
বললাম, 'তাহলে আমি উনাদেরকে বলি, যে, আপনি যেতে চাচ্ছেন না, উনারাই এসে কথা বলুক?
বুঝলাম পাশার দান আমার হাতে। ভয় যে পেয়েছে বুঝতে পারছি। খালি দোয়া করছি, গাড়িটা যেন না যায়। র্যাব প্রজাতির প্রতি কৃতজ্ঞতায় আমার মন ভরে উঠেছে।
'এই আর একটু'! পেছনে তাকিয়ে বললাম। এতোদূর থেকে তারা শুনতে পাবার কথা না। এমনি বললাম। ভাবখানা এই যে, আমি তাদের সাথেই এসেছি।
-'কই যাইরায়?'
-'এই তো মদিনা মার্কেট পয়েন্টে।
কত নিবেন?
-চাইরশ ফঞ্চাশ ।
-'মামা, দিনের বেলায় তো একশ টাকাও না। রাত্রে চারশ টাকা ক্যান? রাত্রে কি রাস্তা বাড়ে?' মুখে বললাম ঠিকই, মনে মনে বললাম, 'মামা এতো কম চাইলা ক্যান'?
-'দুইশ পঞ্চাশে যাবেন? নাকি উনাদেরকে পাঠাব কথা বলতে?'
-'আর বিশ টেগি বাড়াই দিলান মামা। বাদলা রাইত। '
-'আচ্ছা, ট্যাম্পু বের করেন।
আমি ট্যাম্পুর পিছনে বসা। সাইকেলটাও তুলে নিয়েছি পেছনে। ফেরার সময় ইচ্ছে করেই র্যাবের গাড়ির কাছে গেলাম। থ্যাঙ্কস দিলাম। অথচ কেন থ্যাঙ্কস দিলাম, তা তাঁরা কোনদিনও জানবেনা।
এই টেম্পু মামাও জানবেনা, উদুর পিন্ডি কিভাবে বুধোর ঘাড়ে চেপেছে। আমার মনে কোন অপরাধবোধ কাজ করছেনা। প্রথমতঃ আমার প্রাণের চেয়েও প্রিয় এই ছেলে মেয়েগুলোর জন্য আমি কোন একটা যা হোক ব্যবস্থা করতে পেরেছি। দ্বিতীয়তঃ আমি এই ট্যাম্পুমামাকে চারশ' পঞ্চাশ টাকাই দেব। বাড়তি টাকাটা নাহয় সবাই ভাগ করে দেব।
তাতে নিজেদের টাকায় চলা সংগঠনের আয়ে কোনরকম চাপ পড়বেনা।
আমি দূর থেকেই দেখতে পাচ্ছি একদল উৎসুক চোখ চেয়ে আছে আমার অপেক্ষায়। ওদের উৎকন্ঠিত অপেক্ষা দেখে মনটা বিষণ্ণ হয়ে উঠল। হায়! একদিন এই ক্যাম্পাস ছেড়ে, এদের ছেড়ে চলে যাব! কিভাবে থাকব?
ট্যাম্পু চলছে।
আমি মনে মনে আবৃত্তি করছিঃ
একদিন তরীখানা থেমেছিল এই ঘাটে লেগে
বসন্তের নূতন হাওয়ার বেগে।
তোমরা শুধায়েছিলে মোরে ডাকি-
'পরিচয় কিছু আছে নাকি? যাবে কোনখানে?'
আমি শুধু বলেছি-'কে জানে'?
নদীতে লাগিল দোলা, বাঁধনে পড়িল টান
একা বসি গাহিলাম যৌবনের বেদনার গান
সেই গান শুনি, কুসুমিত তরুতলে তরুণ-তরুণী
মোর হাতে হাত লয়ে কহিলঃ
'এ আমাদেরই লোক'
আর কিছু নয়,
সে মোর প্রথম পরিচয়।
সেতারেতে বাঁধিলাম তার
গাহিলাম আরবার
'মোর নাম এই বলে খ্যাত হোক'-
'আমি তোমাদেরই লোক'।
আর কিছু নয়।
এই হোক শেষ পরিচয়।
(পরিচয়ঃ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
(কবিতাটি ঈষৎ সংক্ষেপ করা হয়েছে।
যতটুকু মনে আছে, ততটুকুই দিলাম)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।