কিছুই কমু না..
১.
"লোকটা দৌড়াচ্ছে। পিছনে এক বাঘ তাড়া করতেছে। লোকটা জীবন হাতে নিয়ে দৌড়াচ্ছে। প্রচন্ড বেগে দৌড়াতে হচ্ছে আর কিছুক্ষণ পরপর পিছনে ফিরে থাকাতে হচ্ছে কখন বাঘটা কাছে চলে আসে আবার। দৌড়াতে দৌড়াতে একটু দূরে একটা গাছ দেখা গেল।
গাছের কাছে আসল। তাড়াতাড়ি গাছে বেয়ে উঠল। উঠে একটা ডালে উঠে বসল। নিচে বাঘটা এসে গাছের নিচে দাড়ি্য়ে আছে। যে পাশে বাঘ দাড়িয়ে আছে সেপাশ ছাড়া অন্য সবপাশে বিশাল গর্ত।
গর্তের মধ্যে বিরাট বিরাট সাপ, বিচ্ছু অন্য ভয়ংকর পোকামকড়। নিচে নামলেই বাঘে ধরবে। গাছ থেকে পড়ে গেলেই সাপে খাবে। এমন সময়ে দেখা গেল একটা সাদা পাখি আরেকটা কাল পাখি যে ঢালে সে বসে আছে সে ঢালে ঠোঁট দিয়ে আঘাত করতেছে আর ঢালটা আস্তে আস্তে কেটে যাচ্ছে। ঢাল কেটে গেলেই সে গর্তে পড়ে যাবে।
মহাভয়ংকর অবস্থা। সে চিন্তা করে কাঁপতেছে প্রচন্ডভাবে। হঠাৎ তার মাথায় একটা কি যেন পড়ল। উপরের দিকে থাকিয়ে দেখে একটা মধুর চাক। সেখান থেকে ফোঁটা ফোঁটা মধু পড়তেছে।
একটু চেখে দেখল সে জিবে নিয়ে। খুব মিষ্টি। সে গাল হা করে মধু খেতে আরম্ভ করল। মধুর চাকের দিকে হা করে মধু খেতে খেতে সে বাঘের কথা, গর্তের কথা, সাপের কথা, পাখির কথা ভুলে গেল। সে সুমিষ্ট মধুর জগতে হারিয়ে গেল।
"
হঠাৎ লোকটার স্বপ্ন ভেংগে গেল। বুঝল এতক্ষণ সব স্বপ্ন ছিল। এরকম অদ্ভুত স্বপ্ন দেখার কারন কি সে বুঝতে চেষ্টা করল। এক বুজুর্গ লোক ছিলেন এলাকায় যিনি স্বপ্নের ব্যাখ্যা করতেন। সকাল উঠেই তার কাছে গেল।
তিনি সব শুনে বললেন "আসলে এটা সব মানুষের জন্যই বাস্তবতা, স্বপ্ন নয়। যে বাঘটাকে দেখলেন সেটা আজরাইলের প্রতিমূর্তী। মৃত্যু যে আমাদের প্রতিমুহুর্ত্যে তাড়া করতেছে সেটাই এটা বুঝাচ্ছে। গর্তটা হল কবর। কবরের আযাব বুঝাচ্ছে গর্তের মধ্যে সাপ, বিচ্ছু দিয়ে।
পাখি দুটা দিন আর রাতকে বুঝাচ্ছে। গাছের ঢালটা হল আমাদের হায়াত। রাতদিন কাটতে কাটতে আমাদের হায়াত ফুরিয়ে যাচ্ছে। যেকোন সময় মৃত্যু হবে আর কবরে যেতে হবে। মধুটা হচ্ছে দুনিয়ার লোভ, সম্পত্তি, টাকা পয়সা।
আর দুনিয়ার লোভে পড়ে আমরা মৃত্যুর কথা, কবরের কথা, হায়াতের কথা সব ভুলে বসে আছি, আছি দুনিয়ের সুখ নেওয়ার তালে। "
২.
এই কাহিনীটা ছিল ক্লাশ ফাইভে থাকাকালীন সময়ে শুনা। সাইদীর ওয়াজের ক্যাসেট ছিল আমার কাজিনের কাছে। সেখানে প্রথম সাইদীর ওয়াজে শুনেছিলাম এটা। চট্টগ্রামে সাইদী'র সম্মেলন "ইসলামী সমাজকল্যান সংস্থা" নামক জামাত শিবিরের একটা সংগঠনের ব্যানারে হয়।
সম্মেলনের নাম "তাফসীরুল কোরআন মাহফিল"। আমার এক চাচাতভাই সাইদীর খুব ভক্ত ছিল। সাইদীর ওয়াজের সব ক্যাসেট উনার কাছে ছিল। আমার সাইদীর সাথে পরিচয় খুব ছোট বয়সে। চাচাতভাইয়ের বাসায় সাইদীর ওয়াজের ক্যাসেট শুনলাম।
বলতে দ্বিধা নেই যে সাইদীর ওয়াজ মনে খুব দাগ কেটেছিল। আমি প্রায়ই সাইদীর ওয়াজ শুনার জন্য চাচাতভাইয়ের কাছে যেতাম। সাইদীর কন্ঠ খুব সুন্দর। কোরাণের আয়াতগুলো অসাধারণ কন্ঠে পড়েন। নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে দেখলে যে কেউ তার ওয়াজ পছন্দ করবে।
স্বপ্নের কাহিনীটা শুনে প্রায়ই রাতে আমি দঃস্বপ্ন দেখে জেগে উঠতাম। দিনের বেলায় পিছনে বাঘের ভয়ে থাকতাম। মৃত্যুর চিন্তাটা খুব ছোট বেলায় ঢুকে গিয়েছিল মনে। সাইদীকে ভীষন পছন্দ করা শুরু করলাম। বাসায় আব্বা এসব আনতে দিতেননা।
সাইদীর ওয়াজ শুনতেছি বললে বাসা থেকেই বের করে দিবেন। তাই লুকিয়ে লুকিয়ে সাইদীর ওয়াজ শুনতাম কাজিনের বাসায় গিয়ে।
আরেকটু বড় হওয়ার পর সাইদীর ওয়াজ অনেক অনেক বার শুনা হয়ে গেছে। ক্লাশ এইট-নাইনে উঠার পর আমি সাইদী এক্সপার্ট হয়ে গেলাম। সাইদীর সব ওয়াজ মুখস্ত।
এমনকি নতুন ওয়াজের ক্যাসেটেও আমার জন্য নতুন কিছু ছিলনা। তার ওয়াজের প্যাটার্ন, কখন কোরাণের কোন আয়াত বলবে সব আমার আগে থেকেই জানা। তাই আগের মত আর তার ওয়াজে তেমন মজা পাইনা। আস্তে আস্তে সে সময়ে আমি রাজনীতি সম্পর্কেও সচেতন হচ্ছি। দেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম সম্পর্কে পড়তেছি।
মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে জানতেছি। নিয়মিত দৈনিক পত্রিকা পড়া শুরু করলাম। যাযাদি তখনও দালালি শুরু করেনি। তাই যাযাদি গোগ্রাসে গিলতাম। জামাতিদের সম্পর্কে ধারণা পরিষ্কার হল।
উল্লেখ্য পাঠ্যপুস্তকে রাজাকারের কথা লিখা থাকলেও কোথাও কারা সেই রাজাকার সেটা লেখা থাকতনা। কোন একটা সাপ্তাহিকে সাইদী সম্পর্কে আর্টিকল পড়লাম। নিজামী, গোআ'দের কাহিনী পড়লাম। স্থানীয় কিছু বড়ভাইদের কাছ থেকে এ ব্যাপারে আরও জানলাম। সাইদীর প্রতি যে মোহ ছিল সেটা গিয়ে চরম ঘৃণা জন্ম নিল।
গোআ হয়ে গেল আমার থলিতে সবচাইতে বড় গালি। আমরা বন্ধুরা কাউকে গালি দিতে চাইলে বলতাম "শালা, তুই একটা গোলাম আজম। "
৩.
কিন্তু তখনও সাইদীর ব্যাপারে একটা বিষয়ে আমার মনে খটকা থেকে গেল। এই লোকটার ওয়াজে এখন খালি আ'লীগকে গালি দেওয়া ছাড়া আর কিছুই থাকেনা। জামাতি কথা প্রচার করাই তার ওয়াজের মেইন ফোকাস হয়ে গেল।
আর শেখ হাসিনার প্রতি কুইংগিত করা তার ফ্যাশান। তাহলে তার ওয়াজে এত মানুষ আসে কোথ্থেকে। উল্লেখ্য চট্টগ্রামে ছাড়া অন্য কোন এলাকায় তার ওয়াজে এত লোক আসেনা। ঢাকা মিরপুরেই তার ওয়াজ হয়। লোকসংখ্যা বড়জোড় ৩ হাজার।
এই ব্যাপারটা আমার মাথায় ঢুকল। চিন্তা করে দেখলাম চট্টগ্রামে চট্টগ্রাম কলেজ, মহসিন কলেজ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এবং আরো অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শিবিরের দখলে। সাতকানিয়ায় শিবিরের বড় ক্যান্টনমেন্ট। তাছাড়া চট্টগ্রামের লোক কোন বিচিত্র কারনে ওয়াজের ভক্ত। হয়ত অতিমাত্রায় মাদ্রাসা আর মাজারের কারনে তাদের এ বকধর্মিকতা।
ওয়াজ শুনে পরের দিনই ফজরের নামাজে আর পাওয়া যায়না। এ বকধার্মিকতা নিয়ে শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের একটা চুটকি আছে। পরে একসময় বলতে চেষ্টা করব। তবে সাইদীর ওয়াজের মুল আবেদন অন্য জায়গায়। তার কন্ঠ খুব সুন্দর সেটা সন্দেহ নেই।
কিন্তু সবচাইতে আকর্ষনীয় বিষয় হল তার ওয়াজের পর অন্তত পক্ষে দশবারজন হিন্দুর মুসলমান হয়ে যাওয়া। এটা খুবই অবাক করা বিষয়। তাই সাইদীকে চরম ঘৃণা করা শুরু করলেও এই বিষয়টা আমাকে খুব ভাবাতে শুরু করল।
৪.
২০০০-০১ সালের দিকে। তখন এইসএসসিতে পড়ি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে।
চবি স্বভাবতই শিবিরের ঘাঁটি। আমার ক্লাসমেটদের মধ্যে অনেকেই শিবিরের সাথে সরাসরি জড়িত। তাদের হাতে সেসময়ই মোবাইল। তবে এদের সবচাইতে আশ্চর্য্যের বিষয় হচ্ছে তারা ছিল ক্লাসে সবচাইতে লুইচ্চাটাইপ ছেলে। একদিকে ইসলাম আনার জন্য জানপ্রাণ অন্যদিকে মেয়েদের সাথে নোংরামিতে তারা সবার আগে।
সে সময়ই চট্টগ্রামে সাইদীর ওয়াজ মাহফিল। কিন্তু এবার লোকজন বেঁকে বসেছে। তাফসীরুল কোরআনের নামে জামাতি ধ্যানধারণা প্রচার, রাজনৈতিক প্রচারণা চালানোর জন্য মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোকজন তাকে মাহফিল করতে দিতে রাজি নয়। বিরাট আন্দোলন শুরু হয়েছে। শেষ পর্যন্ত সে অন্য একটা জায়গায় সম্মেলন করল।
আমার কাজিনের কথা আগেই বলেছি। তিনি সাইদী'র একনিষ্ঠ ভক্ত। কিন্তু এবার দেখি সাইদীকে ওয়াজ করতে না দিলেও তিনি কোন মিছিল মিটিং করলেননা। এমনকি সাইদী'র ওয়াজেও গেলেননা। ঘটনা কি জানার জন্য আগ্রহ বোধ করলাম।
কাজিনকে জিজ্ঞেস করলাম। কিন্তু তিনি আমাকে বামপন্থি মনে করাতে কোনমতেই বলেননা। অনেক চাপাচাপির পর বলতে রাজি হলেন। তিনি নাকি বিশ্বস্থ সুত্রে খবর পেয়েছেন সাইদীর ওয়াজে হিন্দুদেরকে মুসলমান বানানোর যে নাটক করা হয় তা সম্পূর্ণ বানানো। অন্যান্য জেলার শিবির, জামাত কর্মীদেরকে হিন্দু সাজিয়ে আনা হয় আর মানুষকে ধোঁকা দেওয়ার জন্য তাদেরকে মুসলমান বানানো হয়।
৫.
আমি তার কাছে কথাটা শুনলেও বিশ্বাস করতে পারিনি। এত বড় জোচ্চুরি কিভাবে সম্ভব? তাই আরো অনেক চিন্তা করলাম। চিন্তা করে দেখলাম একজন মানুষের জীবনে ধর্ম একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ জায়গা দখল করে আছে। ইন ফ্যাক্ট, ধর্মের মত এত গুরুত্বপূর্ণ স্থান মনে হয় আর কিছুর নেই। যে কোনদিন নামাজ পড়েনি, পড়েনা, ধর্মীয় অন্য কোন কাজই করেনা সেও নিজেকে মুসলমান পরিচয় দেয়।
একই কথা প্রযোজ্য অন্য ধর্মাবলম্বীদের জন্যও। এমনকি সুনীল গাংগোপাধ্যায়ের বইয়ে পড়েছি নাস্তিকরা যখন কোন বিপদে পড়েন এবং কোন উপায় থাকেনা তখন নাকি আল্লাহকে বলেন "হে আল্লাহ, এবারের মত মাফ করে দাও। কথা দিচ্ছি এবারের পর আর নাস্তিক থাকবনা!" তাছাড়া দেখা যায় তারা জানাজা পড়াতে নিষেধ করেননা, কবর দিতেও না। বিয়ে করার ক্ষেত্রেও ধর্ম মেনেই বিয়ে করেন। একইভাবে চরম বিশ্বাসী লোকের মনেও মাঝে মাঝে নাস্তিকতা দানা বাঁধে।
আসলে এবসলিউট নাস্তিক বা আস্তিক কেউ নেই। তো যা বলছিলাম, আসলে ধর্ম অনেক বড় একটা ফ্যাক্টর। কেউ নিজের ধর্ম পরিবর্তন আগে অনেক ভাববে। ধর্ম পরিবর্তন করার পরে অনেক সামাজিক প্রতিবন্ধকতার মধ্যে থাকতে হয়। তাছাড়া কোন শিক্ষিত মানুষ ধর্ম পরিবর্তন করতে গেলে তাকে এবসলুটলি নিশ্চিত হতে হবে যে তার ধর্ম ভুল এবং যে ধর্ম সে নিচ্ছে সেটাই সঠিক ধর্ম।
অন্য অনেক বিবেচনাও থাকতে পারে। কিন্তু যেটাই হোক, ধর্ম পরিবর্তনের জন্য তাকে অনেক ভাবনা চিন্তার মধ্যে দিয়ে যেতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রে এসে তাবলীগের জামাতে গিয়ে যারা খ্রীষ্টান থেকে মুসলমান হয়েছে এরকম মানুষের সাথে কথাবার্তা বলেও বুঝতে পারলাম তারা অনেকদিন চিন্তাভাবনা করেই মুসলমান হয়েছেন। বাংলাদেশের মত দেশে যেখানে ব্যক্তিস্বাধীনতা নেই সেখানে এটা আরো অনেক জটিল বিষয়। তাই কোন হিন্দু মুসলিম হওয়ার আগে তাকে অনেক ভাবতে হবে।
তার ডিসিশানের পরিণতি কি সেটা চিন্তা করতে হয়। তার পরিবারের কথা ভাবতে হয়। সমাজের কথা ভাবতে হয়। সাইদীর ওয়াজে যেটা থাকে সেখানে কোনমতেই কোন হিন্দু ওয়াজ শুনার জন্য যাবেনা। তার ওয়াজে সাম্প্রদায়িক উস্কানি থাকে।
এম্নি্তেই হিন্দুরা জামাতিদেরকে প্রচন্ড ভয় পাই। একাত্তরে এবং পরবর্তীতে বিভিন্ন সময় হিন্দুদের উপর জামাতিরা যা অত্যাচার করেছে তাতে জামাতিদেরকে তারা চরম ঘৃণা না করে উপায় নেই। তাছাড়া সাইদীর ওয়াজে ইসলাম নিয়ে আলোচনার চেয়ে রাজনৈতিক প্রপাগান্ডাই বেশি। আর কোন হিন্দু মুসলমান হওয়ার নিয়ত করলেও সারা বছর বিশ্বাস করবেনা। এতে কোন সন্দেহ নেই যে সাইদীর ওয়াজে হিন্দুদেরকে মুসলমান বানানোর যে নাটক করা হয় সেটা সম্পূর্ণ মিথ্যা, জোচ্চুরি এবং ধোঁকা ছাড়া কিছুই নয়।
সাধারণ মুসলমানদেরকে বোকা বানিয়ে জামাতিদের ফায়দা নেওয়াই এর একমাত্র উদ্দেশ্য। অবশ্য যারা ৭১-এ মা-বোনকে শত্রুদের হাতে তুলে দিতে পারে, নিজের দেশের মানুষকে মেরে ফেলতে পারে, কোনদিন অধ্যাপক না থেকেও নিজেকে অধ্যাপক হিসেবে পরিচয় দিতে পারে, ইসলামকে নিয়ে ব্যবসা করতে পারে তাদের জন্য এ ছোট্ট প্রতারনা তেমন কিছুই নয়।
নরাধমের ব্লগ থেকে
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।