যুদ্ধাপরাধীর বিচার ও জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধ করার দাবী করছি
দেলোয়ার হোসেন সাঈদী 2001-এর অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পিরোজপুর-1 (সদর ও নাজিরপুর এলাকা) আসনে চারদলীয় জোটের প্রাথর্ী হিসেবে সাংসদ নির্বাচিত হন জামাতে ইসলামীর নেতা মওলানা দেলোয়ার হোসেন সাঈদী। বিগত সপ্তম সংসদ নির্বাচনেও একই আসন থেকে নগন্য ব্যবধানে জয়ী হলেও সাঈদীর এই জয়ের পিছনে ছিল সামপ্রদায়িক অপপ্রচার, হিন্দুদের ওপর নির্যাতন, ভোট চুরিসহ নানা গুরুতর অভিযোগ। পবিত্র ধর্মের দোহাই দিয়ে একজন 'মওলানা' হিসেবে নিজেকে পরিচয় দিয়ে সাঈদীর অপকর্মের নজির শুধু বিগত নির্বাচনেই নয়, 1971 সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়ও রয়েছে। সে সময় তিনি ধর্মের দোহাই দিয়ে নিজ জেলা পিরোজপুরে হিন্দু সমপ্রদায়ের ঘরবাড়ি, সম্পদ লুট করেছেন। পাকিসত্দানি হানাদার বাহিনীকে গণহত্যা ও নির্যাতনে প্রত্যক্ষভাবে সহায়তা করেছেন সাঈদী।
পিরোজপুরে মুক্তিযুদ্ধের সময় গণহত্যা, নির্যাতন, লুটতরাজসহ নানা যুদ্ধাপরাধের অন্যতম হোতা দেলোয়ার হোসেন সাঈদী। তার এসব অপকর্মের বহু নজির ও সাক্ষী আজো পাওয়া যাবে তার হাতে নির্যাতিত ও তিগ্রসত্দ হয়ে বেঁচে থাকা পিরোজপুরের স্বজনহারা মানুষের ঘরে। কিন্তু স্বাধীনতার 34 বছর পর সাঈদী তার ঘাতক, যুদ্ধাপরাধীর চেহারা গোপন করে ধর্মের নাম ভাঙিয়ে প্রধানত তরুণ প্রজন্মের অজ্ঞতার সুযোগে তাদের কাছ থেকে ভোট পাওয়ার অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। পিরোজপুর ও নাজিরপুরের নতুন ভোটার যারা, যাদের বয়স 30-35 বছরের নিচে তারা সাঈদীর আসল চেহারা চেনেন না বলেই তার মতো ঘাতক পার হয়ে যান নির্বাচনী বৈতরণী। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীনতাবিরোধী ও ঘাতক সাঈদীর দুষ্কর্মের কিছুবিবরণ প্রকাশিত হয়েছে 'একাত্তরের ঘাতক দালাল ও যুদ্ধাপরাধীদের সম্পর্কে জাতীয় গণতদনত্দ কমিশনের রিপোর্ট'-এ।
ওই রিপোর্টে বলা হয়- 1971 সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় এই জামাত নেতা পাকিসত্দান হানাদার বাহিনীকে সহযোগিতা করার জন্য তার নিজ এলাকায় আলবদর, আলশামস এবং রাজাকার বাহিনী গঠন করেন এবং তাদের সরাসরি সহযোগিতা করেন। 1971 সালে তিনি সরাসরি কোনো রাজনৈতিক দলের নেতা ছিলেন না, তবে তথাকথিত মওলানা হিসেবে তিনি তার স্বাধীনতাবিরোধী তৎপরতা পরিচালনা করেছেন। তার এলাকায় হানাদারদের সহযোগী বাহিনী গঠন করে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে লুটতরাজ, নির্য াতন, অগি্নসংযোগ, হত্যা ইত্যাদি তৎপরতা পরিচালনা করেছেন বলে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি তার এলাকায় অপর চারজন সহযোগী নিয়ে 'পাঁচ তহবিল' নামে একটি সংগঠন গড়ে তোলেন, যাদের প্রধান কাজ ছিল মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধে বিশ্বাসী বাঙালি হিন্দুদের বাড়িঘর জোরপূর্বক দখল করা এবং তাদের সম্পত্তি লুণ্ঠন করা। লুণ্ঠনকৃত এ সমস্ত সম্পদকে দেলোয়ার হোসেন সাঈদী 'গনিমতের মাল' আখ্যায়িত করে নিজে ভোগ করতেন এবং পাড়ের হাট বন্দরে এসব বিক্রি করে ব্যবসা পরিচালনা করতেন।
পাড়ের হাট ইউনিয়নের মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ইউনিয়ন কমান্ডের মিজান তালুকদার একাত্তরে সাঈদীর তৎপরতার কথা উলেখ করে জানিয়েছেন- দেলোয়ার হোসেন সাঈদী স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাক হানাদার বাহিনীর প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় লিপ্ত ছিলেন। তিনি ধর্মের দোহাই দিয়ে পাড়ের হাট বন্দরের হিন্দু সমপ্রদায়ের ঘরবাড়ি লুট করেছেন ও নিজে মাথায় বহন করেছেন এবং মদন নামে এক হিন্দু ব্যবসায়ীর বাজারের দোকানঘর ভেঙে তার নিজ বাড়ি নিয়ে গেছেন। দেলোয়ার হোসেন সাঈদী সাহেব বাজারের বিভিন্ন মনোহারি ও মুদি দোকান লুট করে লঞ্চঘাটে দোকান দিয়েছিলেন।
দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর অপকর্ম ও দেশদ্রোহিতার কথা এলাকায় হাজার হাজার হিন্দু-মুসলিম আজো ভুলতে পারেনি। (মাসিক নিপুণ, আগস্ট 1987)।
এছাড়াও মিজান তালুকদার বলেন, একাত্তর সালের জুলাই মাসের শেষ সপ্তাহে দেলোয়ার হোসেন সাঈদী তার বড়ো ভাই আব্দুল মানড়বান তালুকদারকে ধরে পাড়ের হাটে পিস কমিটির অফিসে নিয়ে যায়। সেখানে আব্দুল মানড়বান তালুকদারের ওপর সাঈদী পাশবিক নির্যাতন করে এবং তার ভাই মুক্তিযোদ্ধা মিজান তালুকদার কোথায় আছে জানতে চায় ও তার সন্ধান দিতে বলে।
গণতন্ত্রী পার্টির কেন্দ্রীয় নেতা পিরোজপুরের এডভোকেট আলী হায়দার খানও সাঈদীর বির"দ্ধে অনুরূপ অভিযোগ এনেছেন। তিনি জানিয়েছেন, সাঈদীর সহযোগিতায় তাদের এলাকার হিমাংশু বাবুর ভাই ও আত্মীয়স্বজনকে হত্যা করা হয়েছে। পিরোজপুরের মেধাবী ছাত্র গণপতি হালদারকেও সাঈদী ধরে নিয়ে গিয়ে হত্যা করেছেন বলে তিনি জানিয়েছেন।
তৎকালীন মহকুমা এসডিপিও ফয়জুর রহমান আহমেদ, ভারপ্রাপ্ত এসডিও আবদুর রাজ্জাক এবং সাবেক ছাত্রলীগ নেতা মিজানুর রহমান, স্কুল হেডমাস্টার আব্দুল গাফফার মিয়া, সমাজসেবী শামসুল হক ফরাজী, অতুল কর্মকার প্রমুখ সরকারি কর্মকর্তা ও বুদ্ধিজীবীদের সাঈদীর প্রত্য সহযোগিতায় হত্যা করা হয় বলে তিনি জানিয়েছেন।
মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে তথ্য সরবরাহকারী ভগীরথীকে তার নির্দেশেই মোটরসাইকেলের পিছনে বেঁধে পাঁচ মাইল পথ টেনে নিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। পাড়ের হাট ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান মোঃ আলাউদ্দিন খান জানিয়েছেন, সাঈদীর পরামর্শ পরিকল্পনা এবং প্রণীত তালিকা অুনযায়ী এলাকার বুদ্ধিজীবী ও ছাত্রদের পাইকারি হারে নিধন করা হয়। পাড়ের হাটের আনোয়ার হোসেন, আবু মিয়া, নূর"ল ইসলাম খান, বেনীমাধব সাহা, বিপদ সাহা, মদন সাহা প্রমুখের বসতবাড়ি, গদিঘর, সম্পত্তি এই দেলোয়ার হোসেন সাঈদী লুট করে নেন বলে তিনি গণতদন্ত কমিশনকে জানিয়েছেন। পাড়ের হাট বন্দরের মুক্তিযোদ্ধা রুহুল আমীন নবীন জানিয়েছেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় সাঈদী এবং তার সহযোগীরা পিরোজপুরের নিখিল পালের বাড়ি তুলে এনে পাড়ের হাট জামে মসজিদের গনিমতের মাল হিসেবে ব্যবহার করে।
মদন বাবুর বাড়ি উঠিয়ে নিয়ে সাঈদী তার শ্বশুর বাড়িতে স্থাপন করেন। রুহুল আমীন জানান, 1971 সালের জুন মাসের শেষের দিকে তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য রেশন সংগ্রহ করতে পাড়ের হাটে গেলে দেখেন স্থানীয় শান্তিকমিটি ও রাজাকারদের নেতৃত্বে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর 60-70 জনের একটি দল পাড়ের হাট বন্দরে লুটপাট করছিল। পিরোজপুরের শান্তি কমিটি ও রাজাকার নেতাদের মধ্যে সেদিন পাকিস্তানি সেনা দলটির নেতৃত্বদিয়েছিলেন দেলোয়ার হোসেন সাঈদী, সেকান্দার শিকদার, মওলানা মোসলেহ উদ্দিন, দানেশ মোলা প্রমুখ। এ ছাড়াও সাঈদীকে একটি ঘরের আসবাবপত্র লুট করে নিয়ে যেতে দেখেছিলেন রুহুল আমীন।
রুহুল আমীন নবীন আরো জানান, সাইদী এবং তার সহযোগীরা তদানীন্তন ইপিআর সুবেদার আব্দুল আজিজ, পাড়ের হাট বন্দরের কৃষ্ণকান্ত সাহা, বাণীকান্ত সিকদার, তরুণীকান্ত সিকদার এবং আরো অনেককে ধরে নিয়ে গিয়ে হত্যা করেছেন।
হরি সাধু এবং বিপদ সাহার মেয়ের ওপর নির্যাতন চালিয়েছেন। বিখ্যাত তালুকদার বাড়িতে লুটতরাজ করেছেন। ওই বাড়ি থেকে 20-25 জন মহিলাকে ধরে এনে পাকসেনাদের ক্যাম্পে পাঠিয়ে দিয়েছেন।
জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক নাট্যকার হুমায়ূন আহমেদের পিতা ফয়জুর রহমান আহমেদের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে দেলোয়ার হোসেন সাঈদী জড়িত ছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে। শহীদের পুত্র কথাশিল্পী মুহম্মদ জাফর ইকবাল জানিয়েছেন, দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর সহযোগিতায় ফয়জুর রহমান আহমেদকে পাকিস্তানি সৈন্যরা হত্যা করে এবং হত্যার পরদিন সাঈদীর বাহিনী পিরোজপুরের ফয়জুর রহমান আহমেদের বাড়ি সম্পূর্ণ লুট করে নিয়ে যায়।
(তথ্যসূত্র : মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সংরক্ষণ কেন্দ্র)"
(কৃতজ্ঞতাঃ আড্ডাবাজ)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।