আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

উত্তরা ফ্ল্যাট প্রকল্প এগোচ্ছে না

উত্তরা অ্যাপার্টমেন্ট প্রকল্পের কাজ ঠিকমতো না করায় রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এনা প্রপার্টিজকে ২৮ দিনের সময় বেঁধে দিয়ে চূড়ান্ত নোটিশ দিয়েছে। প্রাপ্ত কাজের ৪৫ শতাংশ তিন মাসের মধ্যে করার কথা থাকলেও প্রতিষ্ঠানটি ১৫ মাসে করেছে মাত্র ৪ শতাংশ কাজ।
প্রকল্পের ‘এ’ ব্লকে এক হাজার ২৫০ বর্গফুট আয়তনের ছয় হাজার ৬৩৬টি ফ্ল্যাট নির্মাণ করার কথা। এর বড় অংশের কাজের ঠিকাদার নিযুক্ত হয়েছে সরকারি দলের সাংসদ (রাজশাহী-৪) এনামুল হকের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান এনা প্রপার্টিজ। এ কাজের আরেকটি অংশের ঠিকাদারি পেয়েছেন সরকারি দলের আরেক সাংসদ (ঢাকা-৩) ও রিহ্যাবের সভাপতি নসরুল হামিদের প্রতিষ্ঠান হামিদ কনস্ট্রাকশন ও বিল্ডিং ফর ফিউচার (বিএফএল)।

বিএফএলের মালিক তানভীরুল হক রিহ্যাবের সাবেক সভাপতি। তাঁরা তাঁদের মোট কাজের ১৬ শতাংশ শেষ করেছেন। তাই আপাতত তাঁদের নোটিশ দেওয়া হয়নি।
এই প্রকল্পের ছয় হাজার ৬৩৬টি ফ্ল্যাট লটারি করে সাধারণ মানুষকে বরাদ্দ দেওয়া হয়। তাঁদের সবাইকে জামানতের তিন লাখ এবং প্রথম কিস্তির ছয় লাখ ৭১ হাজার মিলিয়ে মোট নয় লাখ ৭১ হাজার টাকা পরিশোধ করতে হচ্ছে।

কিস্তির টাকা পরিশোধের শেষ সময় ৩১ মে। এসব ফ্ল্যাটের নির্মাণকাজ শেষ করার কথা ২০১৪ সালের মধ্যে, আর বরাদ্দপ্রাপ্তদের বুঝিয়ে দেওয়ার কথা ২০১৬ সালের মধ্যে।
ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এনা-ডুঙ্গা এ এইচ কনস্ট্রাকশন ফার্ম উত্তরা অ্যাপার্টমেন্ট প্রকল্পের ‘এ’ ব্লকে রাজউক অংশে ১০টি লটে ২০টি ১৬ তলা ভবন নির্মাণের জন্য রাজউকের সঙ্গে চুক্তি করে ২০১১ সালের ২০ ডিসেম্বর। ২০১২ সালের ৭ মার্চের মধ্যে এ কাজের ৪৫ শতাংশ শেষ করার কথা। কিন্তু এরপর আরও ১৪ মাস পার হয়েছে।

এখন মাঠে কাজ বন্ধ আছে বলে রাজউকের নথিতে উল্লেখ আছে। এ কাজে কাগজে-কলমে এনা প্রপার্টিজের সঙ্গে আছে দক্ষিণ কোরিয়ার প্রতিষ্ঠান ডুঙ্গা এ এইচ কনস্ট্রাকশন ফার্ম।
এনা প্রপার্টিজের সঙ্গে কোরিয়ার অপর একটি প্রতিষ্ঠান ডিডিজে যৌথভাবে ‘এনা-ডিডিজে কনস্ট্রাকশন ফার্ম’ নামের এই প্রকল্পে আরও পাঁচটি লটে ১০টি ভবন তৈরির কাজ নিয়েছে। চুক্তি সম্পাদনের নয় মাস চলে গেলেও প্রায় কোনো কাজই হয়নি। রাজউকের নথিতে দেখা যায়, এখানে দরপত্র অনুযায়ী কাজের হালনাগাদ অগ্রগতি হওয়ার কথা ৩৩ শতাংশ।

অথচ হয়েছে শূন্য দশমিক ৮০ শতাংশ।
রাজউক সূত্র জানায়, চুক্তিবদ্ধ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে কাজের বিষয়ে মৌখিক ও লিখিতভাবে কয়েক দফা তাগিদ দেওয়া হয়। চুক্তি অনুযায়ী তাদের মাঠপর্যায়ে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি, মালামাল ও কারিগরি জনবল নিয়োজিত করার কথাও বলা হয়। কিন্তু এখন পর্যন্ত তা করা হয়নি। এ অবস্থায় রাজউক চুক্তিপত্রের বিষয়ে নির্দেশনা চেয়ে মন্ত্রণালয়ের অনুশাসন চাইলে মন্ত্রণালয় চুক্তি বাতিলের ক্ষমতা সম্পূর্ণ রাজউকের হাতে ছেড়ে দেয়।


প্রকল্পের আরেকটি লটে দুটি ১৬ তলা ভবন নির্মাণের দায়িত্ব পায় এনাম ট্রেডার্স নামের অপর একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। প্রায় এক বছর আগে ওই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে নোটিফিকেশন অব অ্যাওয়ার্ড (নোয়া) দেওয়া হয়। চুক্তিপত্র অনুযায়ী, তাদের কাজের আনুপাতিক অগ্রগতি ৩৩ শতাংশ হওয়ার কথা থাকলেও হয়েছে ৪ দশমিক ৫০ শতাংশ। তারা ছয় মাসেরও বেশি সময় মাঠপর্যায়ে কাজ বন্ধ রেখেছে। রাজউক কাজ চালুর তাগিদপত্র দিলে সম্প্রতি কাজ শুরু করেছে প্রতিষ্ঠানটি।


সূত্র জানায়, প্রকল্পের অগগ্রতির বিষয়ে রাজউকের প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি এ পর্যন্ত চারটি, প্রকল্প স্টিয়ারিং কমিটি চারটি এবং রাজউক চেয়ারম্যানের সভাপতিত্বে ৩৬টি সভা হয়েছে। প্রতি সভাতেই কাজের অগ্রগতি বিষয়ে হতাশা প্রকাশ করা হয়।
ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রতিটি লট কাজের জন্য আলাদা চিঠি দেওয়া হয়েছে। তবে চিঠিগুলোর উপসংহার একই রকম। একটি চিঠিতে বলা হয়, কর্মসূচি অনুযায়ী ২০১২ সালের ৫ নভেম্বর থেকে চলতি বছরের ১৩ মে পর্যন্ত ১৮৯ দিনে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের প্রতিদিন গড়ে তিনটি করে মোট ৪৮৫টি ‘সার্ভিস পাইল কাস্টিং’ করার কথা ছিল।

কিন্তু বাস্তবে মাত্র ২৭টি করেছে। এ ছাড়া ২১ এপ্রিল থেকে কাজ পুরো বন্ধ আছে। এসবই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাজের প্রতি অবহেলা, উদাসীনতা ও অপারগতার বহিঃপ্রকাশ।
রাজউকের চিঠিতে আরও বলা হয়, পত্র জারির দিন থেকে ২৮ দিনের মধ্যে আগের পিছিয়ে পড়া ৪৫৮টি (৪৮৫-২৭) পাইল ছাড়াও আরও ৭০টি পাইল মিলিয়ে মোট ৫২৮টি পাইল কাস্টিং করতে হবে। এতে ব্যর্থ হলে বা অনুমতি ছাড়া কাজ বন্ধ রাখলে চুক্তিপত্রের শর্ত লঙ্ঘিত হবে।

তা এই লটের কাজের চুক্তিপত্র বাতিলের চূড়ান্ত নোটিশ হিসেবে গণ্য হবে।
রাজউকের চেয়ারম্যান মো. নূরুল হুদা প্রথম আলোকে বলেন, অ্যাপার্টমেন্ট প্রকল্পের কাজ দ্রুত শেষ করতে চায় রাজউক। তাই বেঁধে দেওয়া সময়ের বিষয়ে রাজউকের অবস্থান স্থির রাখা হবে। তিনি বলেন, চুক্তি অনুযায়ী কাজের ন্যূনতম অংশও শেষ না করায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন সাধারণ ক্রেতারা। এ ছাড়া নির্মাণ খরচেও এর প্রভাব পড়বে।

তাই রাজউক ঠিকাদার কোম্পানিকে বারবার সতর্ক করেছে। এখন আবার চিঠি দিয়েছে।
এনা-ডিডিজে কনস্ট্রাকশন ফার্ম তাদের ১৭ ও ২০ নম্বর লটের ওপর দিয়ে বিদ্যুতের লাইন থাকায় কাজ করতে অপারগতা জানিয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে গত ২২ এপ্রিল ঠিকাদার তাঁদের জামানতের টাকাও ফেরত চেয়েছেন।
যোগাযোগ করা হলে এনা গ্রুপের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাংসদ এনামুল হক এখনো রাজউকের চিঠি দেখেননি বলে জানান।

চিঠির বিষয়গুলো তাঁর কাছে তুলে ধরলে প্রথম আলোকে তিনি বলেন, নানা সমস্যার কারণে কাজ ধীরগতিতে চললেও এখন কাজ চলছে। জমি বুঝে পেতে দেরি হয়েছে। প্রকল্প এলাকার আটটি ইউনিটে বৈদ্যুতিক খুঁটি এখনো সরানো হয়নি।
বিষয়টির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করলে রাজউকের চেয়ারম্যান বলেন, ‘শুধু দুটি লটে বৈদ্যুতিক খুঁটি রয়েছে। আমরা ঠিকাদারি কোম্পানিকে বলেছি, এই দুটি লট (চারটি ভবন) বাদ রেখে অন্য ভবনগুলোর কাজ চালিয়ে যেতে।

কিন্তু তারা বাকি ভবনগুলোতেও যথাসময়ে কাজ করেনি। ’
গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের (আরপিও) ১২ ধারা অনুযায়ী, সরকারের সঙ্গে কোনো ব্যক্তির ব্যবসায়িক সম্পর্ক থাকলে তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার এবং থাকার যোগ্য হবেন না। তার পরও এনামুল হকের মালিকানাধীন এনা প্রপার্টিজ রাজউকের ৪০টি ভবন তৈরির কাজ নিয়েছে। আর সাংসদ নসরুল হামিদের প্রতিষ্ঠান পায় ১৬টি ভবন নির্মাণের কাজ।
‘আইন ভেঙে সরকারের সাথে বাণিজ্য’ করায় এর আগে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সাংসদ এনামুল হকের বিরুদ্ধে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে নির্বাচন কমিশনকে অনুরোধ করেছিল।

এনা প্রপার্টিজ লিমিটেড ও রাজশাহী সিটি করপোরেশনের মধ্যে বহুতল সিটি সেন্টার নির্মাণের চুক্তিতে এই সাংসদ নিজে স্বাক্ষর করেছিলেন।
পাইল বানানোর কাজও শেষ হয়নি: গতকাল শনিবার সরেজমিনে দেখা যায়, উত্তরা অ্যাপার্টমেন্ট প্রকল্পে কাজ চলছে খুবই ধীরগতিতে। কর্মরত শ্রমিকের সংখ্যাও কম। পাইল বানানোর কাজ এখনো শেষই হয়নি। কিছু শ্রমিক ব্যস্ত ইট ভাঙার কাজে।

অনেক দিন পড়ে থাকা রডে মরচে ধরে গেছে। কোথাও কোথাও ঢালাই মেশিন পড়ে আছে মুখ থুবড়ে। ১০০ একর আয়তনের পুরো প্রকল্পের বেশির ভাগ অংশ এখনো শুধুই ধু ধু মাঠ।
রাজউকের দায়িত্বশীল একজন প্রকৌশলী জানান, এখন দুই থেকে আড়াই হাজার শ্রমিক কাজ করার কথা। অথচ কাজ করছে মাত্র ৩০০-র মতো শ্রমিক।


এলাকা ঘুরে এবং দায়িত্বরত ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রকল্পে রাজউক ও গণপূর্ত অধিদপ্তরের মিলে মোট ৭৯টি ভবনের একটিরও চূড়ান্ত পাইলিং শেষ হয়নি। কোনো কোনো লটে টেস্ট পাইলিং কাজ শেষ হলেও সার্ভিস পাইলিংয়ের কাজ ধরাই হয়নি। আটটি লটে এখন পর্যন্ত কাজ শুরুই করা যায়নি।
গতকাল কাজ চলছিল ২১ ও ২২ নম্বর লটের কাজ। এ দুটি এনা-ডুঙ্গার অধীনে।

এগুলোর টেস্ট পাইলিংয়ের কাজ শুরুর পর বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। ১৬ ও ১৭ নম্বর লটেও এই ঠিকাদারের শ্রমিকেরা কাজ করছেন।
এনা-ডিডিজের ৩৮ নম্বর লটে পাইলিং আর ৩৯ নম্বর লটে পাইল বানানোর কাজ চলছে। এনা-ডুঙ্গার অধীন ব্রাদার্স কনস্ট্রাকশনের প্রকৌশলী খন্দকার ওবায়দুল হক জানান, টেস্ট পাইলিংয়ের পর এখন কিছু কিছু লটে সার্ভিস পাইলিংয়ের কাজ চলছে। শেষ করার চেষ্টা হচ্ছে দ্রুত।


ভবন নির্মাণের প্রাথমিক কাজ শেষ না হলেও ফ্ল্যাট ক্রেতাদের অনেকেই আসছেন প্রকল্প এলাকায়। কালও এসেছিল এক চাকরিজীবী দম্পতি। বললেন, অনেক আশা নিয়ে তাঁরা এসেছেন। কিন্তু প্রকল্পের কাজের অগ্রগতি দেখে তাঁরা থমকে গেছেন। নির্দিষ্ট সময়ে ফ্ল্যাট বুঝে পাবেন কি না, তাঁরা সন্দিহান।

সোর্স: http://www.prothom-alo.com     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.