যদি এ আমার হৃদয়দুয়ার বন্ধ রহে গো কভু দ্বার ভেঙে তুমি এসো মোর প্রাণে, ফিরিয়া যেয়ো না প্রভু।
নিস্তব্ধ অন্ধকারে বোও বোও শব্দটা কেমন অদ্ভূত একটা কম্পন তৈরী করলো। ঘুমের ভেতর শব্দটা দ্রুত ছড়িয়ে পড়লো রোহানের হৃদয় থেকে মস্তিষ্কে। হুড়মুড় রাতের নিস্তব্ধটা সেঁধিয়ে গেল তার পেটে। রোহান কোনরকমে উঠে ঘাতক টেবিল ঘড়িটাকে থামাতে গিয়ে, সেটা উল্টে পড়লো বিছানায়।
রোহান ঘড়িটাকে পেল বিপরীত অবস্থানে। এখন বাজে ৯২ টা ৯। মানে সংখাগুলোকে পাশাপাশি দাঁড় করালে হয়, 92:9।
সময়টা রোহানের স্মৃতির কোষে আলাদা কোন মাত্রা যোগ হল না। যেন সে এরকম টা দেখেই অভ্যস্ত।
উল্টো সময়টা দেখবার পর থেকেই,ওর মস্তিষ্কের ভেতর কেমন ঘোর লেগে গেল। কেমন আরামদায়ক আলস্য অথচ চনমনে একটা ভাব চাল এলা শরীরে। যেন এই মাত্র ম্যাসাজ শেষ করে চোখ মেলেছে সে। ১৫ দিনে একবার গুলশানের একটা থাই ম্যাসাজ সেন্টারে যায় সে।
শরীরের আলস্য ভাবটাকে কাটিয়ে, ঘরের ভারী কার্টেনগুলো কে সরিয়ে; গ্লাসডোর খুলে, বাইরে এলো।
বাহিরে ততটা আঁধার জমে নেই। বেশ আলা ছড়িয়ে পড়েছে চারিদিকে।
সে অবাক হয়ে দেখল, লোপার লাগানো নাইট কুইনটা এই আবছা অন্ধকারেও নেতিয়ে যায়নি। বরং বেশ তরতাজা। এতদিন ধরে নানান রং এর পটেড ফুলগাছগুলো বারান্দায় আছে, খেয়ালই করেনি সে।
একটু দুঃখ হচ্ছিল তার জন্য।
বাথরুমে গিয়ে, খুশীতে তার দুটো লাফ দিতে ইচ্ছে করলো। তার ব্রাশ, সেভিং কীটস এবং আনুষাঙ্গিক সবকিছু সুন্দর করে গোছানো। যাক, সক্কালবেলাই লোপার ঝাঁঝালো গলাটা শুনতে হবেনা-'আচ্ছা একটা দিনও কি নিজের জিনিস নিজে খুঁজে নিতে পারো না?' রোজ রোজ এসব গুছাতে আর সকালবেলাই তোমাকে খুঁজে দিতে আমার ভালো লাগেনা। '
খুশীতে রোহান একটা গানের সুর ভাঁজতে থাকে।
আজ সব নিয়মের ব্যাতিক্রম। গানটান তার দ্বারা হয় না। অথচ দিব্যি সে একটা রবীন্দ্র সঙ্গীত গুন গুন করে গাচ্ছে। ইস! এটা তো দেখছি লোপার প্রিয় গান।
মুখ ধুয়ে লুকিং গ্লাসটাতে তাকাতেই, লোপাকে দেখতে পেল।
পেছনে দাঁড়িয়ে মিটিমিটি হাসছে। আট বছরের সংসার জীবনের সমস্ত নিয়মকানুন ভুলে সে বউ এর গালে একটা চুমু খেয়ে ফেল্ল। একেকবারে পেশাদার কেজো রোহানুল হক আজকে শুধু রোহান। ছেলেমানুষ রোহান।
রোহান সপ্তাহে দুদিন গুলশানের একটা জিমে যায়।
আজ তারিখ ছিল ভোর বেলাই। সেটা ক্যান্সেল করল।
আজা অফিস যাবার আগে, শুধু কাজের কথা না বলে, টুক টুক করে গল্প করে লোপার সাথে।
তোমার মনে আছে লোপা, বিয়ের প্রথম দিনগুলোর কথা?
তুমি বলছো এ কথা? লোপা অবাক হয়।
কেন?
না, মানে তোমার এসব ভাবার সময় আছে, রনি?
বিয়ের প্রথম দুটো বছর আমাদের কি আনন্দেই না কেটেছে! তারপর রাইয়ান এলো।
তুমি কিছুদিন পাগল থাকলে রাইয়ানকে নিয়ে। তোমার সমস্ত চিন্তা চেতনা শুধু আমাদের ছেলেটাকে নিয়ে। সেখানে এক ফোঁটা জায়গা ছিল না আমার। তারপর রাইয়ান আর আমি বাদ। এখন তোমার সমস্ত সময় জুড়ে শুধু কাজ আর কাজ।
কত অবহেলা করেছ তুমি আমাকে।
আমাদের কথা ভাবার সময় পাও তুমি? লোপার কণ্ঠে তীব্র অভিমান দাঁনা বেঁধে ওঠে।
লক্ষী সোনা আমার, রাগ করেনা। আমাকে একটু সময় দাও বদলে যাবার। আমি এখন থেকে একটু একটু করে চেষ্টা করবো, নিজের ভুল গুলো শুধরে নেবার।
বেরুবার মুখে লোপাকে নিজের বুকের কাছে টেনে নেয়। কপালের চুলগুলো সরিয়ে বলে, আজ তোমাদের জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে। নিজের আচরণে আজ সে নিজেই লজ্জা পায়, বিষ্মিত হয়।
সকালবেলাই টের পায় সে, পকেটে আলাদীনের জিনি এসে আস্তানা গেড়েছে।
অফিসের গাড়িতে বসতেই; জিনি বললো, "বলুন জনাব আপনার জন্য কি করতে পারি?"
আমাকে অমুক জায়গায় একটা ব্রীজ বানিয়ে দাও।
জিনি মাথা চুলকে বল্লো," জনাব এটা আমার জন্য অসম্ভব। এটা আমি বোধ হয় পারবো না। তার চেয়ে অন্য আরেকটা ইচ্ছা প্রকাশ করুন। আমি সাথে সাথে তা তামিল করবো। "
ঠিক আছে এমন কিছু করো যাতে আমার বউ সারাজীবন হ্যাপি থাকে।
জিনি ভয়ে ভয়ে বললো- জনাব আপনার ব্রীজে আপনি ক'টা স্পেল চান?" রোহান অনেক দিন পর হা হা হা করে হেসে উঠলো। হঠাৎই তার মনে হল, ড্রাইভার তার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে আছে।
আজকের সকালটাকে নেহাৎই মন্দ লাগছে না। রোহান উপভোগ করছে।
যখন অফিসে পৌঁছল তখন ঘড়িতে 55:8 বাজে।
অফিসে তার নাভিশ্বাস অবস্থা। দুটো বোর্ড মিটিং সারলো। যারা জনতো রোহানুল হক বিজনেসের ব্যাপারে আপসহীন, অনেকটা কষাই গোত্রের, তাদের মুখে চুন দিয়ে-বুড়ো লতিফ হাওলাদের সাথে অনেকদিনের ব্যবসায়িক ঝামেলাটা মিটিয়ে ফেলল।
তার ব্যাক্তিগত সহকারী সিমলার ব্যাক্তিগত টুকটাক খোঁজ নিল। সিমলার অবাক হওয়াটা তার চোখ এড়ালো না।
বেলা 55:11 টায় নিজেকে একটু ফ্রী করে, লোপাকে ফোন করল। তুমি রাইয়ানকে নিয়ে "ভুতের সামনে অপেক্ষা করো। আমি ঠিক একটায় আসছি। আমরা দুপুরে এক সঙ্গে খাবো। "
পুরোনো বিশ্বস্ত ড্রাইভারেটাকে প্রথমবারের মত সঙ্গে না রেখে উল্টো ৩০০ টাকা দিয়ে বললো, টনির রান্না ঘর থেকে লাঞ্চপ্যাক কিনে খেতে।
সে তার নতুন চকচকে অতি প্রিয় টযোটা সিয়েনটা নিয়ে বেড়িয়ে পড়লো।
গাড়ি কেনার পর থেকে কখনই নিজে ড্রাইভ করেনি। মানে প্রয়োজন পড়েনি।
বেশ খুশীমনে গাড়ি হাঁকাচ্ছে রোহান। সকাল বেলা রাইয়ানকে দেখেনি আজ।
মন জুড়ে ছেলেটার নানান কান্ড ভাসছে। সামনে একটা মল থেকে দুজনের জন্য গিফট কিনবে, ভাবল। রোহান ঘড়ি দেখলো। শীট! নিজেকে গালি দেয়। আবার লেইট।
একটা কথা দিয়েও কি সে ঠিকমত রাখতে পারবে না? কি হত আরেকটু আগে বেরুলে। ও তাড়াহুড়ো করে।
সিগন্যাল বাতিটা সবুজ দেখেই ও টার্ন নেয়।
বিপরীত দিক থেকে আসা ট্রাকটা যেন একটা দানব, কেমন তেড়েফুঁড়ে আসছে। হঠাৎ সে অনুভব করলো কি যেন একটা বিরাট ভুল হয়ে গেছে।
ও শুধু একটা কথাই মনে করতে পারলো- আলোটা সবুজ নয়, শুরু থেকেই লাল ছিল।
ট্রাকটা যখন ওকে তুচ্ছ করে মাড়িয়ে গেল, তখন ওর দামী রোলেক্স ঘড়িটায়, 55:1
রোহান খুব চেষ্টা করলো, সময়টাকে উল্টে দিতে .........পারলো না।
লোপা আর রাইয়ান আরও দুবছর আগে হারিয়ে গেছে ওর জীবন থেকে। লোপা এখন কানাডা প্রবাসী। শুনেছে লোপা আরেকটা বিয়ে করেছে।
সেই ভদ্রলোক নাকি ভীষন ভালোবাসে তার রাইয়ানকে।
হাতের কব্জিতে ভেজা রক্তাক্ত ঘড়িটা বন্ধ হবার আগে, রোহান ঘুমিয়ে পড়ার আগে;শেষবারের রোহান বলতে চেষ্টা করল.........লোপা আমাকে এভাবে ছেড়ে যেও না। পারলো না। দুবছর আগেও এই কথাটা লোপাকে কিছুতেই বলতে পারেনি সে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।