অতি দক্ষ মিথ্যুক না হলে সত্যবাদিতা উৎকৃষ্ট পন্থা
০১.
সকাল বেলা একটু দেরীতে ঘুম ভেঙেছে গুলজান বিবির।
শিউলি ঘুম থেইক্যা উঠ, আর কত ঘুমাইবি। ঘর-গেরস্তি দেখতি হবি না, আকাইম্যা মাইয়া। ঘুম থেইক্যা জলদি উঠ কইলাম।
সারা রাত তো চোখের পাতা এক করবার পারলাম না।
এই ভোরবেলা একটু দুইচোখ বুজিছি, এখনই কিসের হাঁক দেন আপনি। উঠবো তো।
ঘর থেকে শিউলির বিরক্ত আওয়াজ ভেসে আসলো উঠানে।
কার্তিকের মাঝামাঝি বৃষ্টি আর গুলির আওয়াজে ঠিকমতো ঘুম হয় নি সারারাত, আর বৃষ্টি থামবার পরে ভোর বেলা ঠান্ডা জাঁকিয়ে বসেছিলো গ্রামে, উলিপাড়ায় এমন বৃষ্টিস্নাত কুয়াশা মাখা ভোরের হলদে আলোয় গুলজান বিবি উঠানের ভেজা পাতা সরাচ্ছেন ঝেঁটিয়ে।
রান্না ঘরের বাঁকটা ঘুরলে একটা বাঁশের বেড়া, তার পেছন মজা পুকুরের ধার, পুকুরের পাশে বড় একটা পাকুর গাছ, একটা বড় তেতুল গাছ আর পুকুরের চারপাশেই ঘন হয়ে বেড়ে উঠেছে মানকচুর গাছগুলো।
সেসবের পাশে পৌঁছানোর আগেই আঁতকে উঠলেন গুলজান বিবি, কোথা থেকে একজন ঝাঁপিয়ে পড়লো পায়ের উপরে।
চিৎকারটা মাঝপথেই গিলে ফেললেন তিনি। উজ্জল শ্যামলা ছেলেটার কোণের আর্তি আর ভেজা শরীর দেখে হঠাৎ মনে পড়লো তার রজবের কথা। ছেলেটা ৩ মাস হলো বাসায় আসে না।
তার ছেলেটাও কোথাও এমন জলাজঙ্গলে ভিজছে, আর সারারাত যে বৃষ্টি হয়েছে তার উপরে কার্তিকের শেষ রাতের বৃষ্টি, ঠান্ডায় জ্বর না বাঁধিয়ে বসে ছেলেটা।
অদ্ভুত খসখসে স্বরে ছেলেটা ডাকলো মায়ি কুছ পিনেকে লিয়ে মিলেগা?
আশপাশ দেখে ছেলেটাকে ঘরে নিয়ে আসলেন গুলজান বিবি। সারারাত মনে হয় না ছেলেটার পেটে কিছু পড়েছে, তার উপরে ঘরে একটা মেয়ে, তবুও মায়ার কাছে আশংকা পরাজিত হলো। তিনি পাশের ছোটো ঘরটাতে ছেলেটাকে রেখে বড় ঘরে ঢুকলেন।
শিউলি মায়ের দিকে তাকিয়ে মুখ খুলতে চেয়েছিলো, তাকে ইশারায় চুপ থাকতে বললেন গুনজান বিবি। একদম কোনো আওয়াজ য্যান না শুনি তোর মুখে।
ধামা থেকে একটু মুড়কি নিয়ে সানকিতে ঢেলে ছেলেটাকে খেতে দিলেন। বাবা খাও, চিন্তা কইরো না, তুমি তো আমার ছেলের নাহান।
এলুমুনিয়ামের গ্লাসে কলসি থেকে এক গ্লাস পানি ঢেলে দিলেন।
এক চুমুকেই গ্লাস শেষ করে নামিয়ে রাখলো ছেলেটা।
তোমার নাম কি বাবা?
জামশেদ।
ছেলেটা চুপচাপ শুয়ে পড়বার পরে গুলজান বিবি রান্না ঘরে গিয়ে রান্নার বন্দোবস্ত শুরু করলেন।
শিউলি ফিসফিসিয়ে বললো, কে আসছে মা?
চুপ কইরা থাক হারামজাদী, গলা দিয়া শুধু আওয়াজই বাইরায় তোর।
শিউলি কথা না বাড়িয়ে ছোটো ঘরটাতে উঁকি দিয়েই ছুটে আসলো রান্নাঘরে, ওরে আল্লারে এইটা দেখি পাকিস্তানী সৈন্য। আপনে ওরে ঘরে ঢুকতে দিলেন ক্যান? বটি দিয়া একটা কোবানি দিবার পারলেন না? আপনে না পারলে আমি গিয়া দিয়া আসি এক কোপ......
চুপ কইরা বইয়া থাক তুই। পাকিস্তানী সৈন্য হইছে তো কি হইছে, ওরা কি মানুষ না? খবরদার এই কথা য্যান পাঁচ কান না হয়।
তাইলে তোরে কোবানি দিয়া দুই ঠুম কইরা ফেলাবো।
শিউলি কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ বড় ঘরে গিয়ে বসে থাকে।
বিকেলের একটু আগে ঘুম ভাঙলো জামশেদের। বাইরে বের হয়ে দেখলো শিউলি আর গুলজান বিবি উঠোন বসে গল্প করছে, তাকে দেখেই শিউলি ছুটে পালিয়ে গেলো অন্য ঘরটাতে। জামশেদ নিজেও বিব্রত হয়ে ঢুকে গেলো ঘরে।
বাবা ঘুম ভালো হইছে তোমার। আসো খাইতে আসো।
জামশেদ অল্প কিছু হলো এই দেশে এসেছে, এখনও তেমন ভাষা বুঝতে পারে না, তবে এই মহিলাকে দেখে সে আশস্ত বোধ করে, অন্তত তার কোনো ক্ষতি হবে না এ বাসায়। নিরাপত্তাহীনতার বোধটা কেটে যায় তার। নিরাপত্তাহীনতার বোধটা কেটে যাওয়ার পরে জামশেদ খেতে বসে,
সুরটা পরিচিত মনে হয় শিউলির, চেনে চেনা কোনো একটা সুর,পরিচিত কিন্তু কোথায় শুনেছে মনে করতে পারে না।
রাতে ঘুমানোর আগে মনে পড়লো, এটা রুনা লায়লার গাওয়া চকোরী ছবির গান, তাই এত পরিচিত মনে হচ্ছিলো গানটা।
গুলজান বিবি ঘুম থেকে উঠে দেখলেন জামশেদ বসে আছে রান্না ঘরে, একমনে ছাদটা সারানোর চেষ্টা করছে।
বাবা তুমি কি করো এইটা, করবার দরকার নাই।
মায়ি কুছ নেহী হোগা, ছোড়িয়ে আপ।
জামশেদ নিজের মতো করে ঘরের বেড়া সারিয়ে, রান্না ঘরের চালা সারিয়ে ঘেমে নেয়ে দুপুরে খেতে আসলো।
গুলজান বিবি তাকিয়ে দেখলেন, ছেলেটা রুক্ষ হলেও হাসিলে সে রুক্ষতা কোথায় যেনো উবে যায়। বরং কোমল একটা মানুষ উঁকি দেয় সেই রুক্ষ মানুষের খোলস থেকে। । হাসিটাও রজবের মতো। একটু কালোর ধাঁচ থাকলেও রজবের শরীরটা পোক্ত, আর মুখে সারাক্ষণ একটা হাসি লেপ্টে আছে।
ছেলেটার কথা ভেবে উদ্বিগ্ন হন গুলজান বিবি, কিছুটা আনমনা হয়ে যান।
মায়ি কুছ সোচ রাহিহে আপ? কুছ তাকলিফ হো গেয়া মেরে ওয়াস্তে?
হঠাৎ করেই অন্ধকার হয়ে যায় জামশেদের মুখ, সে অন্ধকার মুখ দেখে মৃদু হেসে গুলজান বিবি বললেন, না কিছু হয় নি বাবা। তুমি খাও।
০২.
সারা রাত ঘুম হয় নি, চোখটা জ্বালা করছে রজবের।
পরশুদিন রাতে ওদের কমান্ডার লতিফ ভাই বললো পাঁচবাড়ীতে রেকিতে যেতে হবে।
বড় রাস্তার পাশেই গ্রামটা, সেখান দিয়েই এরপরের অপারেশনে যাবে মুক্তিযোদ্ধারা। রাস্তাটা রেকি করতে হবে আর সেখানে একদল পাকিস্তানী সৈন্য ছাউনি বানিয়েছে, তাদের কয়েকটাকে ঘায়েল করে আসতে পারলে সেটা বাড়তি পাওনা।
আমাগো গ্রামের জমিরুদ্দিন তরফদার, বুঝলি শালা একটা কুত্তার ছাওয়াল। ওডিরে একটু বানায়া দিয়া আসতি পারলে মনটা শান্তি হতো বুঝলিনে। পাঁচবাড়ীতে তো কিছু দ্যাখলাম না, রাস্তাতো ক্লিয়ার আছে, চ' দেখি তরফদারের ছাওয়ালরে কিছু বুঝায়া দিয়া আসি।
সে তো শান্তি কমিটি করিছে।
তখনই রক্ত চনমনিয়ে উঠেছিলো ৫ জনের দলটার। চলেন ভাই একটা হেস্তনেস্ত কইরা আসপো নে।
লতিফ ভাইয়ের গ্রামটা পাঁচবাড়ী পার হলেই। একটা মোটা দাগের রাস্তা, সামনের টিনের চালের বাসাটাই জমিরুদ্দিন তরফদারের।
জমিরুদ্দিনকে আটক করতে তেমন সমস্যা হয় নি দলটার। পাশের পুকুরের সামনে দাঁড়ি করিয়ে মাথায় গুলি করতে লেগেছে খুব বেশী হলে ১০ মিনিট। গুলির আওয়াজে বাসার সবাই যখন চিৎকার করছিলো তখন ছুটে এসেছিলো আশেপাশের বাসার মানুষ। তাদের দিকে তাকিয়ে লতিফ ভাই বলেছিলো, ভয় পাওয়ার কিস্যু নেই, আমরা মুক্তিবাহিনীর লোক। যান গিয়ে আপনেদের কাজ করেন।
চাচী আমাগোরে দুপুরে খাতি দিতে হবে,
জমিরুদ্দীন তরফদারের বৌকে কথাটা বলে লতিফ ভাই বসে পড়লেন বারান্দার পাশেই।
কান্না আর আতংক মেশানো গলায় তিনি বললেন, বসো বাবা, খাতি দিতাছি।
খাওয়াটা খারাপ হয় নি।
নাজনীন কই চাচী। ওকে তো দেখলাম না।
ওরে পাঠায়া দেন।
বিকেলের আগে আগে লতিফ ভাই যখন নাজনীনকে ঘরে ঢুকিয়ে দরজা লাগিয়ে দিলো তখন বাকি ৪ জনের কিছু করার ছিলো না। প্রচন্ড একটা চড়ের শব্দের পর ঘরের ভেতর থেকে ছিটকে আসা কান্নাটাও একসময় মিলিয়ে গেলো।
দরজা খুলবার আওয়াজ পেয়ে সবাই তাকালো দরজার দিকে, তখনই মোক্ষম কাঁটার মতো শব্দটা গেঁথে গেলো রজবের মাথায়।
আপনে আমারে নষ্ট করলেন ক্যান?
লতিফ ভাই ভেতরে তাকিয়ে বললেন
প্রতিশোধ নিলাম
চাপা কান্নাটা সেই সন্ধ্যা থেকেই মাথায় গুতাচ্ছে, আপনে আমারে নষ্ট করলেন ক্যান, নষ্ট করলেন ক্যান।
নষ্ট করলেন ক্যান। শুধু একটা বাক্যই থেকে থেকে মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে।
লাশের মতো শরীটাকে বয়ে এনেছে ওরা সবাই। কেউ লজ্জায় কারো দিকে তাকতে পারে নি। লতিফ ভাই শীষ বাজিয়ে সুর ধরেছেন চকোরী ছবির গানের সুর।
পরিচিত এই সুরও নিস্তব্ধতা কাটাতে পারে নি।
বাসা থেইক্যা একটু ঘুইরা আসবো লতিফ ভাই।
আইচ্ছা যা।
রজব কোনো উত্তরের অপেক্ষা না করেই বাসার দিকে রওনা হলো।
০৩.
বাসায় পৌঁছাতে পৌঁছাতে বেলা পড়ে এসেছিলো।
সমস্ত পথটাই একটা অসস্তি তাড়া করেছে ওকে। লতিফ ভাইয়ের শেষ শব্দটা মাথা থেকে সরাতে পারছে না। কিসের প্রতিশোধ এটা?
মা, ও মা।
গুলজান বিবি জামশেদকে ঠেলে ঢুকিয়ে দিলেন বড় ঘরে। শিউলিকে বললেন একদম কথা কইবি না চুপ কইরা থাকবি।
কি রে কেমন আছিস তুই?
মা শিউলি কই?
বড় ঘরে।
রজব বড় ঘরের দিকে রওনা দেওয়ার সময় গুলজান বিবি বাধা দিলেন, নাহ তোর যাওনের কাম নাই, শিউলির জামাই আছে ঐ ঘরে।
ওরে বিয়া দিলা একটা খবরও তো দাও নাই।
তুই কোনো খবর দেওয়ার উপায় রাখছিস, গত ৪ মাসে তোর কোনো পাত্তা ছিলো,
রজব অগ্যতা নিজের ঘরে ঢুকেই ধাক্কা খেলো। মোটা কালো চামড়ার বেল্ট এখানে থাকবার কথা না।
০৪.
শিউলির সামনে লাজুক মুখে বসে আছে জামশেদ, ঘামছে অল্প অল্প। চকোরীর সুরটা শিউলির মনের ভেতরে গুণগুণ করে। হঠাৎ করেই জামশেদকে আর ভয়ংকর কিছু মনে হয় না তার। বরং বেশ সাধারণ একজন মনে হয়। এমন ভাবেই লাজুক মুখে অসস্তি নিয়ে বসে থাকা জামশেদের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো শিউলি।
সে হাসিতে আরও বিব্রত হয়ে চুপচাপ বসে থাকে জামশেদ। মাথা নামিয়ে চাদরে আঙ্গুল দিয়ে নক্সা আঁকে ।
নিস্তব্ধ নির্জনতা নিয়ে নেমে আসে সন্ধ্যা।
-----------------------------------------------------------------
গল্পটার খসরা অনেক দিন মাথায় নিয়ে ঘুরছি অথচ কখনই গল্পের শেষটা মনমতো হলো না। এবারও হয় নি।
প্রথমে মনে হয়েছিলো রজব জামশেদকে দেখী তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখাবে, হয়তো বিদ্রোহ করে, কিংবা রাগে বাসা ছেড়ে ছুটে বেরিয়ে যাবে, হয়তো তাদের দলের সবাইকে এনে জামশেদকে ধরে হত্যা করবে। কিন্তু মনে হলো এই হত্যা আসলে কোনো সমাধান বয়ে নিয়ে আসবে না।
এই জয়াগাটাতেই গল্পটা থেমে থাকা ভালো। অনেক অমানবিকতার ভেতরে একটু মানবিকতা বেঁচে থাকুক।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।